Tuesday 31 October 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ৮

 


পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা -৮

শারদীয়া – রাজনগর, দাসপুর

শ্রীজিৎ জানা 



রাজার নগর রাজনগর। কোন রাজা? রাজা শোভা সিংহ। কোথাকার রজা? বরদা পরগনার। দিল্লীর মসনদে তখন রাজত্ব করছেন মুঘলরা। ষোড়শ শতকের শেষের দিকে রঘুনাথ সিংহ স্বাধীন চেতুয়া– বরদা রাজ্য স্থাপন করেন। সেই রাজ্যের রাজধানী হল রাজনগর। রাজা রঘুনাথ সিংহের পুত্র কানাই সিংহ এবং পৌত্র হলেন দুর্জয় সিংহ। আর দুর্জয় সিংহের পুত্র হলেন শোভা সিংহ। যিনি দিল্লীর বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। এই শোভা সিংহ যোগাযোগের সুবিধার্থে উত্তরের শিলাবতী আর দক্ষিণের কংসাবতীকে একটি খাল খনন করে যুক্ত করেন। সেই খাল স্থানীয়দের কাছে কাঁকি অথবা কঙ্কাবতী নদী নামে সমাদর পেয়ে চলেছে। কঙ্কাবতী নদী তীরেই ছিল সিংহ রাজাদের গড়– আনন্দগড়। রাজ্যের " কাছারি ছিল ইস্কুলের দক্ষিণ- পশ্চিম কোণের উঁচু ডিবিটি"। বর্তমানে রাজ্য সড়কের উত্তর পার্শ্বে পাল পরিবারের বসতি যেখানে। সেইসাথে  বর্তমানে নাড়াজোল- মেদিনীপুরগামী রাজ্য সড়কের উপর যেই রাজপুকুর বাসস্টপ, সেই পুকুরটি সিংহরাজারাই খনন করেন বলে জানা যায়। কারণ ওই রাজারপুকুরের উত্তর- পশ্চিম কোণে ছিল সিংহ রাজাদের প্রাসাদ ও পরিখা। এমনকি এইরূপ মিথ শোনা যায়, ওই পুকুরপাড়ে আজও নাকি মাটির তলায় চাপা রয়েছে সিংহ রাজবংশের টাকা রাখার কূপ এবং রাজহস্তীর কঙ্কাল। সিংহ রাজবংশের প্রায় দুশো আড়াইশ বছর পর রাজনগর এলাকার স্বত্বাধিকারী হন মলিঘাটীর চৌধুরী জমিদাররা।


একথা নিশ্চিত এতক্ষণে আপনাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। সিনেমাহলের কথা জানাতে গিয়ে রাজকাহিনী শোনাচ্ছি একপ্রকার জোর করেই। আসলে গোড়া না মজবুত করে বাঁধলে ঘর যে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। তাই এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা। ধৈর্য্য রাখুন হে আমার সুবোধ পাঠক,দেখুন কেমন মিলিয়ে দিই রাজপরিবারের সাথে জমিদার পরিবার শেষে বণিক পরিবারের। মানে হল শারদীয়া সিনেমাহলের জন্মস্থল এই মনোরম সুবিশাল রাজারপুকুরের দক্ষিণ পার্শ্বে। এখানে একখানা প্রশ্ন মনে উঁকি দিতেই পারে,রাজারপুকুর মাইতি পরিবারের হাতে এল কিভাবে? আসলে মাইতি পরিবারের আদি নিবাস ডেবরা থানার অন্তর্গত কালিকাগ্যেড়া গ্রাম। অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু পরিবার বলেেই পরিচিত ছিলেন। স্বর্গীয় অশ্বিনী মাইতি এবং তাঁর অন্য ভাইদল মিলে মলিঘাটীর চৌধুরী জমিদারদের কাছ থেকে রাজারপুকুর ও তার পাড় সহ মোট আট একর জায়গা কেনেন। পরবর্তীকালে সেই পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে চব্বিশ শতক জায়গা জুড়ে সিনেমাহল গড়ে ওঠে। নাড়াজোল- মেদিনীপুরগামী পিচ সড়কের উপর রাজারপুকুর বাসস্টপ থেকে কয়েক পা দূরেই শারদীয়া সিনেমাহল স্থাপন করেন অশ্বিনী মাইতির জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রী অজিত মাইতি। শারদীয়ার পথ চলা শুরু ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। কেন সিনেমাহলের দিকে ঝুঁকলেন? - প্রশ্ন করাতে অজিত বাবুর মুখে স্মিত হাসির আভা ফুটে ওঠে। বললেন—" প্রথমে আমার কংক্রিটের ব্যবসা ছিল। সিনেমা দেখতে খুব ভালবাসতাম। তার উপর বকুলতলার ( দাসপুর) মল্লিকা সিনেমাহল তখন প্রায় বন্ধের মুখে। মনের ভিতর সিনেমাহল করার ইচ্ছেটা প্রবলভাবে নাড়া দিল। ব্যস, ১৯৮৮ সাল নাগাদ সিনেমাহল নির্মাণের কাজ শুরু করলাস।" তাহলে 'শারদীয়া' নামকরণের কারণটাও একটু বলুন। " আসলে কি জানেন,আমি প্রথম থেকেই চাইছিলাম সিনেমাহলের শুভ মহরত হবে পুজোর মরশুমে। বাঙালীর বড় পুজো দুর্গাপুজো। সেইমত নির্মাণ কাজ শুরু করি পুজোতে, এমনকি সিনেমা দেখানোও শুরু পুজোর সময়ে,এইসব মিলিয়ে শারদীয়া নাম রেখেছিলাম।"



শারদীয়া সিনেমাহলের প্রথম ছবি ছিল 'মথুরা বিজয়'।  প্রথম পৌরাণিক সিনেমায় সিনেমাহলে ভীড় উপচে পড়ে। ওদিকে গৌরা,দাসপুর নিয়ে এদিকে কেশপুর অব্দি প্রচার চলতে থাকে। ভালো কোন ছবি এলে মাইক প্রচার থাকত। তাছাড়া মোহন দাস ( গোকুলনগর), সুজিত মালাকার ( রাজনগর), বিশ্বনাথ বেরা ( রাজনগর) পোস্টার লাগাতেন বিভিন্ন এলাকায়। শারদীয়ার স্টাফ ছিল ১৬ জন। শুরুর দিকে চিফ অপারেটর ছিলেন রবিদাসপুরের গোপাল বাবু। পরে শক্তি গুছাইত ( রাজনগর) এই দায়িত্ব সামলাতেন।  ফার্স্ট, সেকেন্ড ও থার্ড ক্লাস মিলে মোট ছয়শ দর্শক আসন ছিল শারদীয়ার। সেইসময় থার্ড ক্লাসের টিকিট মূল্য ছিল দ'টাকা,সেকেন্ড ক্লাসের দু'টাকা পঞ্চাশ পয়শা আর ফার্স ক্লাসের টিকিটের মূল্য ছিল তিন টাকা। মাঝে অর্থনৈতিক কারণে সিনেমাহল প্রায় দু'বছর বন্ধ থাকে। পরে সিনেমাহল মালিক এবং তৎকালীন জেলার সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের আলোচনার ভিত্তিতে টিকিটের মূল্য সামান্য বাড়িয়ে ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। 

অজিত বাবু তীব্র উৎনাহ নিয়েই সিনেমাহল চালু করেছিলেন। পলশপাই ( দাসপুর) - এর 'গোপাল টকিজ'  সিনেমাহলের প্রোজেক্টর মেশিন ভাড়ায় এনে প্রথম সিনেমা দেখানোর কাজ শুরু করেন। পরে নিজস্ব মেশিন সহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি কেনেন। কলকাতার লেনিন সরণী ( কমারসিয়াল পয়েন্ট)  থেকে নিজেই ছবি আনতেন। সেখানে ব্রোকার ছিলেন প্রীতিরঞ্জন মজুমদার। পরে এই কাজে নিযুক্ত হন জগন্নাথ আলু ( রাজনগর)। তাঁকে সেইসব দিনের কথা জানতে চাইলে খুব আবেগাপ্লুত হন। বলেন – " মাত্র সত্তর টাকা মজুরির বিনিময়ে সেইসময় কলকাতা থেকে আমি ছবি আনতাম। বৃহস্পতিবার ছবি আসত আর শুক্রবার সেই ছবি দেখানো হত। একটা ছবি দু'তিন সপ্তাহ চলা মানে আমার মজুরি বন্ধ। তবে খুব আনন্দ পেয়েছি ওই কাজে"।  কেমন চলত শারদীয়া সিনেমাহল? কোন কোন ছবি হাউসফুল হয়েছিল? অজিতবাবু জানান, " 'মথুরা বিজয়' ',তুফান'  'শোলে' প্রভূতি ছবি দারুণ লাভের মুখ দেখিয়েছিল"। জগন্নাথ বাবু জানালেন, " অহংকার ছবিটা চলে চার সপ্তাহ,সেইসঙ্গে বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না সিনেমাও চলে একমাস"। তিনটা - ছ'টার শোয়ে যথেষ্ট ভিড় থাকত শারদীয়া সিনেমাহলে। স্থানীয় রাজনগর ইউনিয়ন হাইস্কুলের 'বাণীবীথি' ছাত্রাবাসের অনেক ছাত্রদের স্মৃতির পাতায় এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে শারদীয়া সিনেমাহলে লুকিয়ে ছ'টা– ন'টার শোয়ে লুকিয়ে সিনেমা দেখার স্মৃতি। কত প্রেম জুটি বেঁধেছে আলোআঁধারি প্রক্ষাগৃহের কোণার সিটে। রমরমিয়ে চলেছে গুরুদক্ষিণা,প্রতিবাদ,জোয়ার ভাঁটা,প্রতিদান,অঙ্গার সহ কত বাংলা ও হিন্দি ছায়াছবি। মাঝে মাঝে কঠোরভাবে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য শুক্রবার ন'টা - বারোটার শোয়ে ব্লু ফ্লিম দেখানো হত। কিন্তু গ্রামগঞ্জের ভিতরে 'শারদীয়ার' অবস্থান বলে খুব ঝক্কিঝামেলা সামলে,অনেক চোখকে আড়াল  করে প্রাপ্তবয়স্করা ওইদিন সিনেমাহলে প্রবেষ করত। কিন্তু ক্রমে ভাটা পড়তে থাকে দর্শকের ভিড়ে। অজিত বাবুর গলায় আক্ষেপের সুর শোনা যায়," আসলে প্রথমে সিনেমাহল নিয়ে আবেগটাই বেশি কাজ করেছিল। টেকনিক্যাল বিষয় সম্পর্কে অত জানা ছিল না। বিশেষ করে ছবির উপর ট্যাক্সের পরিমাণ যে যথেষ্ট বসত, সেই বিষয়ে অতটা ধারণা ছিল না। বাংলার চেয়ে হিন্দি সিনেমায় বেশি ট্যাক্স পড়ত। ফলে সিনেমাহল চালানো ক্রমেই চাপের হয়ে যাচ্ছিল। সেইসাথে টেলিভিশনের সংখ্যা বাড়তে থাকে গ্রামে। ফলে হলমুখী দর্শক সংখ্যা কমতে থাকে। বাধ্য হয়ে সিনেমাহল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিই"। সালটা ২০০০, শারদীয়া সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যায়। শেষ ছবি ছিল 'ধন্যি মেয়ে'। 


আজ যখন রাজ্য সড়ক ধরে রাজারপুকুরের পাশ দিয়ে যাবেন,সহজে চোখে পড়বেনা শারদীয়া সিনেমাহলকে। চিলতে ভাঙা অংশটুকু কোনক্রমে বেঁচেবর্তে আছে মাত্র। বেশিরভাগ অংশ ভেঙে বাড়ি তৈরী হয়েছে। একদিন 'শারদীয়া' এই মফস্বল এলাকাকে সিনেপ্রেমীদের ভিড়ে ভরিয়ে রাখত। নিতাই প্রামাণিক (অভিরামপুর), দুর্গাপদ গুছাইত (রাজনগর),বিশ্বনাথ বেরা (রাজনগর),  শশাঙ্ক বেরা (রাজনগর)- র মতো স্টাফেদের কেউ গেটকিপার,কেউ টিকিট কাউন্টারে, কেউ টর্চ জ্বলে সিট চেনানোর কাজের দায়িত্ব সামলাতেন। সিনেমাহলের সামনে রাস্তার পাশেই ছিল ঝন্টু ছাতিকের পান গুমটি,সন্ন্যাসী ঘাঁটীর চপ দোকান। কোনকিছুরই চিহ্ন নেই আর। সবই এখন স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে অনেকের মনে।


তথ্যসূত্র :–

১. শ্রী অজিত মাইতি ( রাজনগর) 

২. শ্রী জগন্নাথ আলু ( রাজনগর) 

৩. রাজনগর ইউনিয়ন হাইস্কুল পত্রিকা, এপ্রিল সংখ্যা , ১৯৬১,

                     ……………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৪২

 


রবীন্দ্র পরম্পরা 

পর্ব - ৪২

বিজয়া

মহাশ্বেতা দাস 



 আর্জেন্টিনার হোটেল প্লাজার এক চিলতে কক্ষে বসে রবীন্দ্রনাথ এতবছর বাদে যেমন অতর্কিতে দেখা পেলেন তাঁর কল্পলোকে বিরাজমান সিন্ধুপারে থাকা বিদেশিনী কে! ঠিক তেমনই সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যের পাঠক ভিক্টোরিয়া তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনে শান্তির খোঁজ পেয়েছিলেন যে মানুষটির লেখায়… অপেক্ষা করেছিলেন কবে দেখা পাওয়া যাবে!! আজ দশ বছর পরে অভাবনীয় এই সুযোগ তাই তিনিও হাতছাড়া করতে চাইলেন না। হোটেলের ঘরে রবীন্দ্রনাথকে না রেখে তিনি তাঁকে নিয়ে যেতে চাইলেন নিজের ঘরে "ভিলা ওকাম্পো" তে। 


     সান ইসিদ্রো তে ঝকঝকে সম্ভ্রান্ত বাড়ি "ভিলা ওকাম্পো"। কিন্তু ভিক্টোরিয়ার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল তাঁর মা- বাবা কি রাজি হবেন এই প্রস্তাবে? ঘটলও তাই….. অর্থের বিনিময়েও তাঁরা রাজি হলেন না ভিক্টোরিয়ার অন্তরের মানুষ রবীন্দ্রনাথের জন্যে নিজেদের বাড়িটি ছেড়ে দিতে। তখন ভিক্টোরিয়া ছুটে গেলেন তাঁর এই বাড়িটির কিছুটা দূরে খুড়তুতো ভাইয়ের বাড়িতে। ভাইটি অর্থ পিপাসু। ভিক্টোরিয়া ভাইয়ের সেই অর্থলোভকে কাজে লাগালেন….. বিক্রি করে দিলেন নিজের হীরের গয়না আর সেই অর্থ তুলে দিলেন ভাইয়ের হাতে। সান ইসিদ্রো তে বেশ বড়সড় সাদা রঙের ঝকঝকে যে বাড়িটিতে রবীন্দ্রনাথের থাকার ব্যবস্থা হলো সেই বাড়ির নাম "মিরালরিও"। 

 

  “ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন দেশে

   আমি অতিথি তোমারি দ্বারে ওগো বিদেশিনী”

      

     ১৯২৪ সালের ১১ই নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ এলেন "মিরালরিও" নামক বাড়িতে। সার্থক বাড়িটির নাম "মিরালরিও" …. যার অর্থ নদী দেখা। প্লাতা নদীর ধারেই বাড়িটি…. তাই ইচ্ছে হলেই নদী দেখা যায়। বাড়ির সামনের অংশে আছে সুন্দর বাগান। সূর্যোদয় - সূর্যাস্তের সময় হলে হৈমন্তিক কুয়াশার চাদরে ঢেকে অপূর্ব এক মোহজাল রচিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে তাঁর এই বিদেশিনী মানস প্রতিমার নাম দিয়েছিলেন "বিজয়া" । রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রকম সুখ সুবিধের দিকে যত্নসহকারে নজর রেখেছিলেন কবির "বিজয়া"। তাই এই দিনগুলি কবি যেন বিজয়ার অলিন্দেই কাটিয়েছিলেন! 


    সান ইসিদ্রোতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্যে " মিরালরিও" নামের এই বাড়ীতে প্রায় দুইমাস ছিলেন রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুর। বিশ্বকবিকে ঘিরে আর্জেন্টিনার সাহিত্যিকদের মধ্যে তখন ছড়িয়ে পড়েছে  উৎসাহ-উদ্দীপনা। কবির সাথে ওকাম্পোর আলাপ শুধু সাহিত্য, সংস্কৃতি ও দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল…. এমনটি নয়। দু-জনের মধ্যে রচিত হলো গভীর বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা ও মমত্বের বন্ধন….. যে ভালোবাসা ছিল জাগতিক ভালোবাসার উর্ধ্বে, যাকে ‘platonic love’ বলে অভিহিত করেছেন রবীন্দ্র সমালোচকরা। এই সময়ে ৩০টি কবিতা রচনা করেছিলেন তিনি.…. যেগুলি পরবর্তী সময়ে "পূরবী" কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে "পূরবী" কাব্যগ্রন্থটি কবি  উৎসর্গ করেন ভিক্টোরিয়াকে…. লিখেছিলেন দু'টি কথা - "বিজয়ার করকমলে" ।


    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ বয়সে 'চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ' হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ওকাম্পোর বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করেন রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষজন। কবিতা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের খাতা-কলমের কাটাকাটিতে মূর্ত হয়ে উঠত বিচিত্র ছবি। রবীন্দ্রনাথের আঁকার  ভক্ত ছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। ১৯৩০ সালে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের প্রথম চিত্র প্রদর্শনীর অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রদর্শনীর আয়োজনে প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। প্যারিসে সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়ার দ্বিতীয় এবং শেষ দেখা। রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকে ভারতে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু বিখ্যাত "সুর" পত্রিকার সম্পাদিকা ভিক্টোরিয়ার পক্ষে সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।…..


      “দিনেকের দেখা, তিলেকের সুখ

          ক্ষণেকের তরে শুধু হাসিমুখ

      পলকের পরে থাকে বুক ভ’রে

           চিরজনমের বেদনা।


     তারি মাঝে কেন এত সাধাসাধি

     অবুধ আঁধারে কেন মরি কাঁদি

     দূর হতে এসে ফিরে যাই শেষে

          বহিয়া বিফল বাসনা।”


    সারাজীবনে দেখা মাত্র দু'বার হলেও চিঠির মাধ্যমে উভয়ের যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। রবীন্দ্রনাথ যখন অসুস্থ ….. সেসময়েও তাঁর পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করেছেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন প্রিয় মানুষটির। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের মৃত্যুসংবাদ  ভিক্টোরিয়া পেয়েছিলেন তাঁর গাড়িতে বসে.…. রেডিওর সংবাদে। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর লেখা বই  "Tagore en las barrancas de San Isidro",  বাংলায় যাকে বলা যায় "সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় ঠাকুর"।

            …………………… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


Saturday 28 October 2023

দেবীপক্ষের কবিতা-অনিন্দিতা বসু সান্যাল// ই-কোরাস ১৫২

 



অনিন্দিতা বসু সান্যাল এর কবিতা

১.

শিলাই পাড়ের সেই মেয়েটি 


শালবনী গড়বেতার পথের গভীরে

পার হয়ে শহরের ভিড়, প্রাসাদ, মিছিল  

মাঘী পূর্ণিমায় গাড়ির জানালা দিয়ে  

দেখেছিলাম আনত সেই মুখ, 

ঘোমটায় ঢাকা তন্বী-তনু অনাবিল  

 

শিলাই নদীর নিচু পাড়ে, অস্থায়ী সেতুর কিনারে  

দাঁড়িয়ে আছে চিত্রবৎ

এই বয়সে অমন শুভ্রবেশ 

ও কি পথ হারিয়েছে, গ্রামের বিধবা কোনও, 

অপেক্ষায় আছে কারও, অনাথবৎ?


জঙ্গল পেরিয়ে যাই, গঞ্জ থেকে শহরেই ফিরি

কলাকৈবল্যে ভেসে দেখি যামিনী রায়ের পট, 

বিকাশবাবুর আঁকা দৃপ্ত মুখের মহিমা 

তবু মনে গেঁথে থাকে ওই গ্রীবাদেশ, ক্ষীণ কটি, 

দাঁড়ানোর ঋজু ভঙ্গিমা, যদিও যাবে না জানা  

সেই রাতে শিলাইয়ের ওই ব্রিজ, সে  

একা পেরিয়েছিল কিনা  



২.

সেদিনের জলসায় 

 

শীতের সকালে 

মেঘ আর ঝুরো বৃষ্টিতে 

কুয়াশার লেগে রং 

হুগলির গ্রামীন রিসর্টটিতে  

নেমে এল কালিম্পং, একটু পরেই 

শুরু হবে গানের আসর, খোলা মঞ্চ 

আয়োজকরা সাবধানে বিছিয়েছে শতরঞ্চ

অতিথি সমাগত, ছড়িয়ে ছিটিয়ে সমঝদার 

খানিকটা দূরে শুকনো ডালে আগুন জ্বেলে 

বসে আছে জবুথবু মালিদের পরিবার 


অবশেষে শুরু হল গিটার বাজিয়ে গান 

গরিব মানুষের দুঃখ, প্রতি বাক্যে ছুরিকার শান

মগ্ন শ্রোতারা নির্বাক, উদ্বেলিত মন 

শুধু দূরে বসা গরিব মানুষেরা বুঝতে পারছিল 

গানের কথাগুলি দুঃখী মানুষের 

গায়ক যদিও দুঃখী নন              


৩.

দৃশ্য

 

ছাদে উঠলে দেখতে পাই চাঁদ, সূর্য, মেঘ, তারা, ব্রহ্মাণ্ড

মাটিতে পা রাখলে ফিরিওয়ালা, হকার, জোচ্চর, পথচারী, নপুংশক

অসম্ভব দুটি বিপরীত দৃশ্য-কিন্তু পাশাপাশি বহমান

দৃশ্যের দোটানায় কালি কলম ল্যাপটপ মাউজ

জীবনীসূত্রে চতুর্ভাবনার সুলক্ষণ, সুসময়

এই দুয়ের ব্যাবধানে বিমূর্ত প্রতীক চিহ্নে তুমি দাঁড়িয়ে একা

একটা সাদাকালোর সহাবস্থান

বিস্মিত বিয়োগ চিহ্নের মতন রূপান্তর…

            …………………….


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Tuesday 24 October 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৪১

 


রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ৪১

সিন্ধু পারে

মহাশ্বেতা দাস 


সুদূরের পিয়াসী মনকে অধরা রূপলোকে মিশিয়ে দেওয়ার  আকুলতা বার বার ফুটে উঠেছে রবীন্দ্র কবিতায়, গানে। ১৮৯৫ সালে শিলাইদহে বসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন - 


         "তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে,    

          তোমায়  দেখেছি মাধবী রাতে,

তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী।" 


রবীন্দ্র অনুরাগীদের মনে প্রশ্ন জাগে-কে এই বিদেশিনী? কাকে শারদ প্রাতে, মাধবী রাতে কবি হৃদয়ের মাঝে দেখতে পেতেন? সেই রমণী কি শুধুই কবির কল্পলোকের মানস প্রতিমা! নাকি বাস্তবের কোন প্রিয়া!!  


আগের পর্বেই বলেছি নোবেল প্রাপ্তির পর থেকে দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কবি আমন্ত্রণের পর আমন্ত্রণ পাচ্ছেন। বিশ্ববরেণ্য কবির সুদূর পিয়াসী মন তাই এখন বিশ্বপথিক। তাঁর মতে - 


  "যে জাতির চলার পাথেয় ফুরোল, চলার সাধনায় যার জড়ত্ব এল, সে জাতি তার গতির শেষে দুর্গতিতে এসে ঠেকল।" 


জাপানে থাকাকালীন কবি দক্ষিণ আমেরিকার পেরু রাজ্য থেকে সেখানকার স্বাধীনতা- শতবার্ষিকী উৎসবে যোগদানের আমন্ত্রণ পেলেন। তাই ভ্রমণ পিপাসু কবির উৎফুল্ল মন এবার চায় পেরু রাজ্যে পাড়ি দিতে। ৩রা সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা আসার সময় সেদিন সকালে মন্দিরে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বললেন- " মানুষ ঘরছাড়া জীব, মানুষ পথিক। …. সে যে চির পথিক। " 

    

১৯শে সেপ্টেম্বর কবি রওনা দিলেন। কবির এবারের বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গী পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী এবং তাদের তিন বছরের পালিতা কন্যা নন্দিনী। আর সঙ্গে চললেন সুরেন্দ্রনাথ। কলকাতা থেকে মাদ্রাজ হয়ে সিংহল কলম্বো পৌঁছবেন এবং সেখান থেকে জাহাজে চড়ে পাড়ি দেবেন দূর দেশে। 

    

এবারে বিদেশ ভ্রমণের আগে কবি ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় বিভিন্ন স্টেশনে গুরুদেব কে অভ্যর্থনার উপদ্রব অসহ্য করে তুলেছিল। তবু এই অবসন্ন শরীরেই দেখা মিলেছে কাব্যলক্ষীর….. বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে অমর সৃষ্টি "পূরবী" কাব্যগ্রন্থ ও "পশ্চিম যাত্রীর ডায়রি" নামক গদ্যগ্রন্থ।  


যেদিন কলম্বো পৌঁছলেন ওখানে তখন খুব বর্ষা। …" আকাশে ঘন মেঘ, দিগন্ত বৃষ্টিতে ঝাপসা, বাদলার হাওয়া।"   কলম্বো থেকে "হারুনা- মারু" জাহাজে চড়লেন সবাই ২৪শে সেপ্টেম্বর।  ক্রমে "আন্ডেশ্" জাহাজ আর্জেন্টিনার রাজধানী বন্দর বুয়েনোস এয়ারিশ এ এসে পৌঁছাল। অভ্যর্থনার অতিচার পেরিয়ে আগের থেকেই অসুস্থ কবি বেশ কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। এই পরস্থিতিতে যাত্রা করা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলো আর্জেন্টিনায় কিছুদিন থাকার। সদল- বলে কবি আশ্রয় নিলেন হোটেল প্লাজা তে। তখন কে জানতো যে এই অসুস্থতা, এই যাত্রাবিরতি রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে দেবে তাঁর কল্পলোকের আরাধ্যা বিদেশিনীকে! আর্জেন্টিনার  হোটেল প্লাজাতে সহযাত্রী ও সেক্রেটারি লেনার্ড এলমহার্স্টের সাথে আছেন রবীন্দ্রনাথ…… ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কোনোভাবেই এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননা। তাই সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠে একদিন রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করা জন্য হোটেল প্লাজাতে চলে এলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো৷ ভিক্টোরিয়ার সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর এলমহার্স্ট তাকে রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেন। দেখা হলো  চৌত্রিশ বছরের  ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে তেষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথের। 


    ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো….. ১৮৯৯ সালের ৭ই এপ্রিল বুয়েনস আইরিশ এর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। ১৯১২ সালে নিজের পছন্দের পুরুষ বার্নাডো এস্ত্রাদার কে বিয়ে করলেও বৈবাহিক সম্পর্ক মধুর হলো না। ১৯২১ সালে স্বামীর ঘর ছেড়ে প্রেমিক মার্তিনেথের সাথে বসবাস শুরু করেন। এর মাঝেই ভিক্টোরিয়ার মননশীল সাহিত্যপ্রেমী মন ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতে শুরু করে দেয়। সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যের সাথে নিগূঢ় পরিচয় এই বিদুষী রমণীর। তবু মনের খিদে মিটছে না…. খুঁজে পাচ্ছেন না কোন লেখকদের লেখায় তাঁর কাঙ্খিত প্রত্যয়ের মাটি। তবু চালিয়ে যাচ্ছেন সাহিত্যচর্চা। আর এই সাহিত্যচর্চার পথ ধরেই ১৯১৪ সালে ভিক্টোরিয়ার হাতে এসে পড়ে আন্দ্রে জিদের অনুবাদে "গীতাঞ্জলি" কাব্যগ্রন্থ। ব্যাস্ গীতাঞ্জলি'র সুরের আগুন জ্বলে উঠলো এই স্প্যানিশ রমণীর মনেপ্রাণে। ক্ষত বিক্ষত বিবাহিত জীবনের অপমান যন্ত্রণার আঁধারে ডুবে থাকা এই রমণীর মনের বাগানের মরা গাছের ডালে ডালে সুরের আগুন নেচে উঠল…. সে আগুন ছড়িয়ে পড়লো সবখানে। ভিক্টোরিয়া আকাশে হাত তুলে যেন কার অপেক্ষায় থাকলেন! রবীন্দ্রসাহিত্যে আপ্লুত নূতন পথের দিশা খুঁজে পাওয়া ভিক্টোরিয়া লিখলেন….. 

 "Reading Tagore, Thinking of Tagore, waiting for Tagore". 


 সেই অপেক্ষার অবসান হলো দীর্ঘ দশ বছর পরে এমনই অপ্রত্যাশিত ভাবে। মুগ্ধ বিস্ময়ে সাহিত্যের আঙিনায় দেখা মানুষটিকে এবার ভিক্টোরিয়া দেখলেন পার্থিব জগতের আলোয়। স্প্যানিশ রমণীটি দেখলেন ঊনত্রিশ বছরের বড়ো পুরুষটির নির্ভাজ কপাল, সৌম্য, শরীরে হিরন্ময় দ্যুতি। মুহূর্তে মুছে গেল সমস্ত বিভেদ রেখা। প্রেম দেখাদিল সমারোহে। 


     " জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,

       বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে ॥" 

                  ………………….. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Saturday 21 October 2023

দেবীপক্ষের কবিতা-তাহমিনা শিল্পী // ই-কোরাস ১৫১

 



তাহমিনা শিল্পী এর কবিতা 

১.

কৃষ্ণঠাকুর


ওই চোখের দিকে তাকাতেই

আমার ভেতর আকস্মিক বৃষ্টিপতন শুরু হল 


এই যে এখন 

তুমি গান শোনাচ্ছ আর আমি ভিজছি... 

আমরা উভয়েই কি কেঁপে উঠছি কখনও 


ফুলের গন্ধে ম ম করছে

আমার ঘর বারান্দা উঠোন 


ওই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে 

কাল-গড়িয়ে যাক... 


বৃষ্টির ছাঁট মাখতে মাখতে 

দ্যাখো দু-হাতে কেমন শক্ত করে 

তোমাকে আঁকড়ে রেখেছি কৃষ্ণঠাকুর


২.

অভিমানটা বইছে গভীরে 


পাহাড়ের কোন মন থাকেনা

তবু মানবিকতায় মানুষ যতোটা ধনী 

পাহাড় তারচেয়ে কিছুটা বেশি।

পাহাড়ের কোন রাগ-ক্ষোভ অভিমান থাকে না

থাকে না শোক-তাপ, প্রেম-ভালোবাসা

তবু অনন্তকাল নিশ্চুপ পরে থাকে একা।

রোদ বৃষ্টি খরা তাকে ছোঁয় না

তবু তার ভিতরেও ঝরে রক্ত ফোঁটাফোঁটা।


৩.

আত্মজ 


কেউ যা দেখে না,

আমি তা দেখে ফেলি অবাক বিস্ময়ে।

কেউ যা জানে না, বোঝে না

আমি তা জেনে ফেলি,

বুঝে ফেলি এক নিমিষেই।

তার সবকিছু ভেবে ফেলতে পারি

বিপুল অধিকারে।

সে অবাক হয়,

জানতে চায় কি করে সম্ভব? 

ভালোবাসার জলোচ্ছ্বাস উঠে মনে

চোখে গড়িয়ে পড়ে জল।

দেবতুল্য সরল মন

অতোশত জটিল কথা বুঝবেনা জানি

শুধু বলি, আমারই জরায়ুর ভূমিতে বেড়ে ওঠা 

আত্মজ তুই।

তোর মত এক দেব শিশুর 

মা হওয়ার গৌরবই যে অনেক।


৪.

বৃষ্টিগন্ধা রুমাল


বৃষ্টিদিনে মন ভিজলেও 

ঠোঁটের উষ্ণতা ক্রমশ বেড়ে চলে।

প্রচন্ড জ্বরঘোরে তোকেই খোঁজে মন।

ওগো,আমার বৃষ্টিগন্ধা রুমাল! 

রোজ দু'বেলা দিলাম ধূপ-চন্দন।

তবু তুই হারালি কই?।



৫.

উঁনূন পোড়া  কঙ্কাল


সূর্য ছুঁয়ে বুকের ভাঁজে রচনা করেছি সবুজ বন, 

কনকনে শীত সন্ধ্যা সাজিয়েছি চোখের ভিতর। 

সারাগায়ে মেখেছি ধূঁপের সুগন্ধি , 

বিনুনির চক্রে গেঁথেছি মেঘভাঙা রোদ্দুর। 

আর তুমি পাহাড়ি ঢলের মত হঠাৎ নেমে এসে, 

খুঁজেছো নরম শরীরের শহর। 


বলো,কতটা হৃদয় খুঁড়লে দেখতে পাবে 

উঁনূন পোড়া কয়লার কঙ্কাল?

           ............................ 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Saturday 14 October 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা// ই-কোরাস ৭

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ৭

রূপছায়া, কলাইকুন্ডু, দাসপুর

শ্রীজিৎ জানা 


মাথার উপর হুসহুসিয়ে এরোপ্লেন ছোটানের কৃতিত্ব রাইট ভাতৃদ্বয়ের নামে লেখা আছে। আহারে, মানুষের পাখি হয়ে উড়বার সাধকে খানিকটা হলেও পূরণ করেছে ওই ভাইদল। একইভাবে আরো একটি ভাইজোড়া মানুষকে মাতিয়ে রেখেছে আজঅব্দি। অবাক হওয়ার কিচ্ছু নেই, তা হল একমেবাদ্বিতীয়ম সিনেমা। অগাষ্ট এবং লুই ভাইদের দৌলতে ওদেশে শুরু হল সিনেমা তৈরি এবং প্রদর্শন। সালটা ১৮৯৫। তার ছ'মাস পরেই শুরু হয়ে গেল মুম্বাইয়ে ছবি দেখানো। ভারতের রাজধানী তখন কলকাতা। এক ডিসেম্বরে ফ্রান্সে যেমন সিনেমার জয়যাত্রা শুরু,আরেক ডিসেম্বরে কোলকাতায় তেমন সূচনা হল নির্বাক চলচিত্র প্রদর্শনের। বাংলায় প্রথম  নির্বাক চলচিত্র বিল্বমঙ্গল প্রদর্শিত হল ১৯১৯ সালে ম্যাডোনা কোম্পানির প্রযোজনায়।

এইখানে একটা মজার বিষয় নিয়ে একটু নাড়াচাড়া না করলে জমবে না। মানে একটু রসালাপ। বাঙলায় একখান প্রবাদ আছে, ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবার একথাও তো আছে– ভরত ছিল রামের ভাই / তুলনা তার কোথাও নাই। আচ্ছা প্রবাদ, ছড়া ইত্যাদি নিয়ে কেন বাড়া বিস্তর কচ্ছি বলুন তো!  কারণ আছে মশাই। ওদেশে এরোপ্লেন করল ভাইজোড়া, সিনেমা শুরু করল ভাইজোড়া আর এদেশে মানে আমাদের দেশে কি ভাইজোড়া মানে জুডো - ক্যারাটে। মোটেই না। এদেশেও মানে বঙ্গে প্রথম বায়োস্কোপ কোম্পানি তৈরী করলেন বাঙালি ভাইজুটি— হীরালাল সেন আর মতিলাল সেন। আরো কেমন মজার কান্ড দেখুন, সেই তো ফ্রান্সে ডিসেম্বরে শুরু,কোলকাতায় শুরু আরেক ডিসেম্বরে আবার সেই ডিসেম্বর মাসেই শুভ মহরত সবাক চলচ্চিত্রের। ভারতে প্রথম সবাক চলচিত্র দেখানো হয় ডিসেম্বর মাসে। ভারতের প্রথম সবাক সিনেমা হল 'আলম আরা'। কিন্তু ১৯৩১ -এর এপ্রিলে বাংলা সবাক চলচিত্র জামাইষষ্ঠী দেখানো হয়।


অনেক গৌরচন্দ্রিকা হল। এবার আসল কথায় এসো তো বাপু। আসল বলতে আপনারা যা বোঝেন,তা হল সিনেমাহলের ইতিবৃত্ত। সপ্তম পর্বে যেই সিনেমাহল নিয়ে কথা হবে তার সঙ্গে এই লম্বা গৌরচন্দ্রিকার একটা যোগ আছে। কেনকি 'রূপছায়া' সিনেমাহলের জন্ম স্বাধীনতার পূর্বে অথবা অনেকের মতে স্বাধীনতা লাভের সমসাময়িক। ফলত তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নিরাশ হতে হয়েছে অনেকখানি। যেটুকু মিলেছে সেটুকুই যত্নে রাখার প্রয়াস রইল।

  ঘাটাল নিবাসী সুধীর পাল প্রথম একটি চলন্তিকা সিনেমাহল তৈরী করেন সয়লা গ্রামে [সোনাখালি, দাসপুর, পঃ মেদিনীপুর]। অস্থায়ী সেই সিনেমাঘরের কোন মাটির অথবা পাকার দেওয়াল ছিল না। চট - ত্রিপল ঘেরা খড়ের ছাউনি দেওয়া 'রূপছায়া' সিনেমাঘর। তা প্রায় দুশো দর্শক বসে ছবি দেখতে পারত। বেশিরভাগ দর্শকের জন্য মাটিতে চট বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা ছিল। পেছনের দিকে গুটিকতক  কাঠের তক্তা বিছানো বসার আসন করা ছিল। খাড় রাধাকৃষ্ণপুরের বাসিন্দা স্বদেশ মাইতি, যিনি টালিভাটা বাজারহাট এলাকার মানুষের কাছে পুনা মাইতি নামে বেশি পরিচিত (পুনা মাইতির চা দোকান) তাঁর স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল সয়লা গ্রামের 'রূপছায়া' সিনেমাহলের কথা। তিনি জানান,"সোনাখালি– সয়লার ওই হলে আমি ছোটবেলায় বাবার সাথে একবার কথা না বলা সিনেমা দেখতে গেছি"। অর্থাৎ কিনা নির্বাক সিনেমা রূপছায়া -তে চলেছে সেইসময়। কলাইকুন্ডু গ্রামের রঞ্জিত পাঁজা মহাশয়,যিনি রাজনগর ইউনিয়ন হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন,তিনি জানালেন," স্মৃতি খুব কাজ করছে না ঠিকই। তবে বাবার নাথে এক'দুবার রূপছায়াতে ছবি দেখতে গেছি। তখন টিকিট মূল্য ছিল দু'আনা"। তবে একথা বলতে খুশিই বোধ করছি যে সয়লার এই সিনেমাহলের নাম যে রূপছায়া ছিল, তার প্রথম হদিশ দেন এই রঞ্জিত বাবু।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সয়লাতে রূপছায়া মাত্র দু'বছরের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়।  কলাইকুন্ডু গ্রামে রাবণতলা বলে একটি জায়গা রয়েছে।  সেইখানে পাঁজা ব্রাদার্স মানে গোপাল পাঁজা,বটু পাঁজা,মুকুন্দ পাঁজা মিলে ওই রূপছায়া সিনেমাহলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।তবে এবার মাটির দেয়াল ও খড়ের ছাউনি দিয়ে রীতিমতো স্থায়ী ভাবে রূপছায়ার জয়যাত্রা ষুরু হল। এবারো মাটিতে চটা- ত্রিপল আর পেছন দিকে তক্তার পেতে উঁচু করে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা হল। এক্ষেত্রেও সিনেমার টেকনিক্যাল  বিষয়ে সহযোগিতা করলেন ঘাটালের সুধীর পাল,ফণী পাল এবং জলধর পাল। এমনকি চোঙা ফুঁকে ছবির প্রচার করতেন ঘাটালের মদন পাল। আরো মজার বিষয় রূপছায়ার ছবির প্রচারে শুধু চোঙা নয়,ড্রাম বাজিয়ে পাড়ায় পাড়ায় তিনি প্রচার সারতেন। 

কলাইকুন্ডু গ্রামের রূপছায়া সিনেমাঘরের আসন সংখ্যা প্রায় তিনশোর মতো ছিল। সেইসময় টিকিট মূল্য দশ, কুড়ি ও পঁচিশ পয়সা ছিল বলে জানালেন রঞ্জিত পাঁজা মহাশয়। রূপছায়াতে তিনটা এবং ছ'টার শো হত। পৌরাণিক সিনেমায় ভীড় যথেষ্ট হত সিনেরমাহলে। আর একটি বিশেষ ঘটনা হল,দোলযাত্রা উৎসবের সময়ে সারারাত ছবি দেখানো হত 'রূপছায়া' তে।


তথ্যঋণ :–

শ্রী রঞ্জিত পাঁজা - কলাইকুন্ডু

............................


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...