Sunday 30 April 2023

রোহন নাম্বিয়ার এর গল্প // ই-কোরাস ১২৬


 


নিখিল

রোহন নাম্বিয়ার 

 

চা দোকানেই কখন যে সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটে বেজে গেল বুঝতেই পারে নি নিখিল। মায়ের এগারোটা মিসড কল। ইদানিং কারো সাথে কথা বলছে না সে, মেজাজটাও সবসময় এমন চড়া যে কেউ কথা বলতেও আসে না। 

 নিখিলের সাতাশ বছর। গ্র্যাজুয়েশান কোন রকমে কমপ্লিট করে এখন সে একটি ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট। অন্য কেউ ডাকলেও বাজিয়ে দেয়, প্রতি শো হাজার টাকা।

নিখিলের বাবা নেই। মারা গেছেন দুই বছর  আগে। তারপর থেকে সংসারের দায়িত্ব তার ওপর। 

বাবু ঘরের মশলা, চাল সব শেষ হয়ে এসেছে। আর তিন চারদিন চলবে।-নিখিলের মা বলেন।

-হু 

-কিছু হয়েছে ?

মিখিল মুখে না বললেও তার মা বুঝতে পারে ছেলের কিছু হয়েছে। 

অন্য দিনের মত আজও সারাদিন ঘুরল একা একা, রাতে আচমকা উঠে বসল। নিখিলের ভাই কলেজে ভর্তি হয়েছে এবছর। ফোনে কি একটা করছিল তাকে যা না তাই করে উল্টোপাল্টা বলল নিখিল । আজকাল নিখিল ঘুমোলেই ভেসে ওঠে লালনীল আলো, স্টেজ, গিটার কাঁধে সে সাউন্ড চেক করছে, সামনে উচ্ছ্বসিত অডিয়েন্স। সাউণ্ড চেকের সময় সাধারণত হোটেল ক্যালিফোর্নিয়ার লিডটাই বাজায় সে। 

কিছুক্ষণ জানলার দিয়ে তাকিয়ে থেকে বের করল গিটারটা। প্রসেসার থেকে কানে হেড ফোন লাগানো। আগুল স্ট্রিংস ছুঁতেই তার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। A মাইনরে সে অসম্ভব রকমের মায়া বুনে চলেছে। বাজিয়ে চলেছে তো বাজিয়েই চলেছে। ফোনে একটা নোটিফিকেশন এলো। বাজানো থামিয়ে নিখিল কেঁদে উঠলো গিটারটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে । কাঁদছে আর ফ্রেড বোর্ডে হাত বোলাচ্ছে। ডাক্তার যেদিন বাবাকে সময় দিয়ে দেয় মাঝরাতে হসপিটালের বাইরে এমনই কেঁদেছিল নিখিল। 

দেড় বছর কোন শো নেই। বেহিসেবী জীবন যাপন করা নিখিলের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছে কোভিড।পালসারটা বিক্রি করে তার চার মাস চলছিল। গিটার ছাড়া আর কোন কিছুই পারে না সে। 

ক্লান্ত দুপুর। OLX থেকে মেসেজ করা ছেলেটি সোজা রাস্তায় দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। তার পিঠে ঝুলছে গিটারটা…         

               …………………….


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614

Saturday 22 April 2023

রোহন নাম্বিয়ার গল্প // ই-কোরাস ১২৫

 



সুমিতাদি 

রোহন নাম্বিয়ার 


 আগের সপ্তাহে লকডাউন উঠেছে। স্বপ্ন রঙের সন্ধে। রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার পেছনে বিশাল ছাতিম গাছের নীচে পাড়ার চা দোকানে এইমাত্র আলো জ্বলল। মফস্বল। ভীষণ চেনা মুখগুলো গল্পে মত্ত। শুধু পথিকৃৎ’দা আসছে না। 

   সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়েও আজ রেশন পাওয়া গেল না! – তপন বাবু মুখে বিরক্তি নিয়ে বললেন। 

 এ তো জানা কথা! এদের সবকিছুই পরিকল্পনাহীন। - কৌশিক ফোন থেকে মুখ না তুলেই বলে।

    কৌশিক কলেজের ছাত্র নেতা। লকডাউনে কলেজ ফিস দেবে না বলে তারা বাড়ি বসে সোশ্যাল মিডিয়াতে আন্দোলন করছে। তার মাথায় এখন সমাজ পাল্টে দেবার নেশা। একবার অলরেডি ব্যাক এসে গেছে।

    অনি কৌশিকের সাথেই পড়ত । সেও ছাত্র সংগঠন করে। কিন্তু সে প্রতি বছর ভালো নম্বরে পাস করে এখন ফাইনাল ইয়ারে।

   সুমিতাদি। পথিকৃৎ’দার বউ। শান্ত, মুখে একটা লক্ষ্মীশ্রী লেগে থাকে। অন্যদিন কৌশিকের সাথে দেখা হলে হাসে, কথা বলে। আজ কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে হেঁটে গেল ।

    পথিকৃৎ’দা প্রচুর কথা বলে। কি একটা যেন বিদেশি কোম্পানির রিপ্রেসেনটেটিভ। কৌশিকের সাথে তার প্রতিদিন তর্ক লাগবেই। তার সব ব্যবহার্য জিনিসই বিদেশি। পকেটে আইফোন। দামি বাইক, ঘড়ি। বিশাল ঝকঝকে ফ্ল্যাট।

    অমিত’দা এম.এস.সি করে সরকারি চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছে আর টিউশান পড়ায়। তার সাথে পাড়ার বড়-ছোট সবার খুব ভাব। গুছিয়ে কথা বলে। সবসময় হাসি খুশি। একমাত্র অমিত’দার কাছেই কৌশিক মুখ বুজে বকা খায়। কৌশিক দু একবার দেখেছে অমিত’দার চোখগুলো মাঝে মাঝে কেমন যেন হতাশ …

  টিউশানি শেষ করে চা দোকানে অমিতদা চুপ করে বসে আছে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ।  কৌশিক আর তপনবাবুর জোর কথাবার্তা চলছে লকদাউনে সরকারী ব্যর্থতা প্রসঙ্গে। বাকি সবাই বাড়ি চলে গেছে। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। হরি দোকান গতান শুরু করেছে। অনি হাঁসফাঁস করে দৌড়ে এসেই বলল– পথিকৃ্ৎ…দা … 

  মাস তিনেক আগে না কি পথিকৃৎ’দার চাকরী গেছে। লেটেস্ট আইফোনটা, বাইক, চারচাকা, ফ্ল্যাটের ই.এম.আই বাকি। এই বছরের লক ডাউনে কোন ই.এম.আই স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয় নি সরকার। এখন সবার মনে পড়ল সত্যিই তো পথিকৃৎ  কিছুদিন একদমই বাড়ি থেকে বেরোয় নি।

   এখন মাঝরাত। অনি, কৌশিক, অমিত’দা, তপন বাবু, তাপস বাবু, বিমল কাকা, চা দোকানের হরি সবাই মর্গের বাইরে বসে আছে। হসপিটাল ক্যাম্পাসে ল্যাম্পপোস্টের আলো খুব ক্ষীণ মনে হচ্ছে। নিঃঝুম গাছেদের পাতা নড়ছে না। কালো আকাশে ভেসে আছে নিঃসঙ্গ চাঁদ। সবাই নির্বাক। কারো মুখে কোন কথা নেই। কৌশিকের মনে পড়ছিল বছর পঁচিশের সুমিতাদি কেঁদে কেঁদে বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল …

                 ………………… 

সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614


Tuesday 18 April 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ১৬

 



রবীন্দ্র পরম্পরা 

পর্ব - ১৬

ধ্রুবতারার সান্নিধ্যে

মহাশ্বেতা দাস



       " তারপরে একদিন

        জানাশোনা হল বাধাহীন।

       একদিন নিয়ে তার ডাক নাম

       তারে ডাকিলাম। 

       একদিন ঘুচে গেল ভয়, 

       পরিহাসে পরিহাসে হল দোঁহে

       কথা বিনিময়।" 


    প্রায় দেড় বছর দেশের বাইরে কাটিয়ে অষ্টাদশ রবি ফিরে এলেন - সেই ছাদ, সেই চাঁদ, সেই দখিনা বাতাস, সেই নিজের মনের বিজন স্বপ্ন আর তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা নূতন বৌঠাকুরানীর কাছে। 


     ঠাকুর বাড়ির মুখচোরা লাজুক ছেলেটি গিয়েছিলেন বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে আর ফিরলেন প্রগলভ যুবক হয়ে। আঠারো বছরের যুবকের পক্ষে যেরূপ পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক -- রবির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। শীতের দেশের স্বাস্থ্যকর আবহওয়ায় তাঁর সুন্দর কান্তি যেমন সুন্দরতর হয়েছিল তেমনই তাঁর কণ্ঠস্বরে এবং কথা বলার ঢঙে ও দেখাদিল পরিবর্তন। 


      ব্যারিস্টার না হয়ে দেশে ফিরে আসার জন্য কিছু আত্মীয় স্বজনের মনে হতাশার মেঘ ভিড় করেছিল। যদিও এই নিয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং রবি - অগ্রজদের মধ্যে তেমন কোন খেদ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ নিজেও পরিণত বয়সে বোলপুর থেকে তাঁর আদরের বিবি (ইন্দিরা দেবী) কে এক চিঠিতে লিখেছিলেন - 

"ভাগ্যি আমি ব্যারিস্টার হই নি।" 


  আর আমরা রবীন্দ্র প্রেমিকরা তো স্বস্তির শ্বাস ফেলি এই ভেবে যে সেদিনের রবি মন দিয়ে ব্যারিস্টারি পড়লে আমরা কি রবীন্দ্রনাথ কে পেতাম!! তাই মাঝে মাঝে দূর ভবিষ্যতে ভালো কিছু, বড়ো কিছু ঘটার জন্যই বোধহয় বিধাতা এমন অঘটন ঘটিয়ে থাকেন যেটা আপাত দৃষ্টিতে খারাপ মনে হলেও আদপে আমাদের জন্য, সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য ভালো। গতানুগতিক জীবনে সৃষ্টিশীলতা কতটুকু!!!! 


  " আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে 

      তখন কে তুমি তা কে জানত

     ছিল না ভয় ছিল না লাজ মনে

         জীবন বহে যেত অশান্ত।" 


    মাত্র নয় বছর বয়সে ঠাকুরবাড়ির বধূ হয়ে যখন বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে ছিলেন কাদম্বরী দেবী তখন রবির বয়স ছিল সাত বছর। খেলার সাথী, গল্পের সঙ্গী রূপে নিরন্তর চোদ্দটি বছর কেটে গেল দুজনের। বিশেষ করে সারদাদেবীর মৃত্যুর পরে মাতৃহারা ছেলেটিকে নারী হৃদয়ের স্বভাবজাত স্নেহ উজাড় করে রবিকে আরও বেশী আপন করে নিয়েছিলেন নূতন বৌঠান। তাই বিলাতে থাকতেও তাঁর কথাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ত। তাঁর স্নেহময় চোখের চাহনি ধ্রুবতারার মতো সারাক্ষণ মনের আকাশে বিরাজ করত। আজ দেশে ফিরে আসার পর ও সব থেকে বেশি আদর আপ্যায়ন পেলেন নূতন বৌঠানের কাছ থেকেই। 


     রবি বিলেত থেকে ফিরে দেখলেন জ্যোতিদাদা ও অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী দেশী ও বিদেশী সুরের মিশ্রণে বাংলা গানের নূতন সুর সৃষ্টির রূপ সৃষ্টির সাধনায় তন্ময়। যে ঘটনা পরবর্তী ক্ষেত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত রচনার ইতিহাসে বিশেষ প্রভাব বিস্তারের দাবিদার। প্রাচীনপন্থীদের ঘোর আপত্তি কে দূরে সরিয়ে রেখে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে দুঃসাহসিকতার পথ উন্মোচন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সেই পথে বিচিত্র সুর, অনিন্দ্য সুন্দর ভাষা এবং অনির্বচনীয় ভাবের ধারায় যে তটিনীর সৃষ্টি করেছিলেন বাংলা গানের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তা যুগান্তরের সাক্ষ্য বহন করল। 


     জ্যোতিরিন্দ্রনাথের তখন বিভিন্ন সুরের ঘাত প্রতিঘাতে "মানময়ী" নাটক (গীতিনাট্য) লেখা প্রায় শেষ পর্যায়ে। রবীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে ফিরে এই নাটকে একটি গান সংযোজন করলেন..... 

"আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি।" 

নাটকটি যখন মঞ্চস্থ হল.... জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ইন্দ্রের ভূমিকায় অভিনয় করলেন, রবীন্দ্রনাথ হলেন মদন আর কাদম্বরী দেবী সাজলেন দেবী উর্বশী। 

               …………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614

Saturday 15 April 2023

রোহন নাম্বিয়ার এর গল্প // ই-কোরাস ১২৪

 




এস এম এস

রোহন নাম্বিয়ার 


সুহাস, তপন, রাজ, মনোজ সবাই ক্লাস ইলেভেনে উঠেছে। তাদের এক পাড়া, এক সাথে হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্ট, একই সাথে সিগারেটও। 

কি যে হল সুহাসের! এমন তো কখনো হয় নি খেলা কামাই করে টিউশান যাচ্ছে!- ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে তপন বলল। 

রাজ তপনের দিকে তাকিয়ে বলল- সুহাস ইদানিং খুব বাংলা পড়ছে, সকালের বদলে বিকেলে ব্যাচ,সময়ের আগেই হাজির। একা একা ঘুরছে ,নিরিবিলিতে বসছে, সবসময় মোবাইলে মন। সারারাত হোয়াটস অ্যাপে অন। বাত কুছ আলাগ হি হ্যায় ভাই…

টাউন হলের পাশের এই রাস্তাটা বেশ মায়ামাখানো। রাস্তার দুই পাশে মাঝে মাঝে ছাতিম-অশথ্ব-বত-কদম আরও কত কি গাছ। অনন্যা আজকেও মুচকি হাসল, বলল বাই। পাহাড়ি নদীর মত অনন্যার স্বর। সুহাস মনে মনে হাসতে হাসতে বাড়ির পথে। বাড়ি এসে বই খুললেই সাদা স্কুল চুড়িদার আকাশি ওড়না,শরতের মেঘ পাহাড়ি নদী সব কেমন এলোমেলো করে দেয় ওকে। অয়নদা এমন ভাবে ব্যাখ্যা করে যেন বৈষ্ণব পদাবলীর রাধার মুখটা অনন্যার মত মনে হয়।  

সুহাসকে একদমই দেখা যাচ্ছে না যে ভাই! কি হল বল তো? – তপন বলে।

এক হপ্তা হল বাংলা পড়তেও যাচ্ছে না – রাজ গম্ভীরভাবে বলে।

সবাই একে ওপরের মুখ দেখে। চোখে বিস্ময়। মাঠে অন্ধকার নেমে এসেছে। সবাই বাড়ি চলে গেছে, শুধু তপন রাজ আর মনোজ বসে সিগারেট টানচ্ছিল। ডান দিকে চোখ যেতেই রাজ বলে- ওটা কি রে? সবাই ওদিকে তাকায়। মাঠে দূরে একটা লাল আলো নিঃশ্বাসের মত বাড়ছে কমছে। ব্যাট বল উইকেট নিয়ে ওরা ওদিকে যায়। তপন মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালালো। সুহাস হাঁপাচ্ছে , চোখ রক্তের মত লাল। কেমন একটা করছে যেন এখনই কেঁদে ফেলবে। হাতে গাঁজার কল্কে। রাজ কল্কেটা জোরে ছুঁড়ে দেয় দূরে। 

          মনোজ সুহাসকে জড়িয়ে ধরে বলে – কি হয়েছে ভাই ?

  • এক চড়ে জামিন চাটিয়ে দেব…কি হয়েছে তোর!- বলেই রাজ সুহাসকে এই মারে সেই মারে অবস্থা ।    

      তপন রাজকে বলল – আরে থামবি ? 

ফোনের ফ্ল্যাশ জলছে, অল্প আলো। সুহাসের মাথা নিচু, মনোজ পাশে বসে সুহাসকে ধরে আছে । 

-কি হয়েছে বল সুহাস ? – শান্ত গলায় তপন জিজ্ঞেস করে । 

মিনিট পনেরো হয়ে গেছে সুহাস মুখ নিচু করে বসে আছে। রাজ, তপন,মনোজ একে ওপরের মুখ দেখছিল । 

  • সুহাস বল ভাই ? – চিন্তিত গলায় মনোজ বলে।

  • অনন্যার ফোন আমার হাতে ছিল।

  • তাতে কি হয়েছে ? রাজ বলল। 

সুহাস  আবার চুপ করে যায়। চোখের কোন ভেজা।


  • সিনেমা শেয়ার করছিলাম ওকে । 

  • সিনেমা দিয়েছিস তো কি হয়েছে ? – তপন বলল।

  • একটা Msg এলো…  – বলেই কেঁদে ফেলে সুহাস । 

  • কে পাঠিয়েছে? নাম বল শালা শুয়োরের বাচ্চার পা ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে দেব- রাজ চিৎকার করে বলে।

  • কার msg ? কি লিখেছে ?  – মনোজ জিজ্ঞেস করে।

  • অয়নদার…আই লাভ ইউ টু লিখেছে… 

কেউ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। অয়নদা তাদের টিউশান টিচার …   

                ………………… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614

আমার ১ লা বৈশাখ : দুঃখানন্দ মণ্ডল // ই-কোরাস ১২৩



আমার পয়লা বৈশাখ

দুঃখানন্দ মণ্ডল  

খন বোধহয় ক্লাস ফাইভ কিংবা সিক্স। মাথা ফাটানো রোদ। সকালে স্কুল সেরে বাড়ি ফেরা। এর মাঝেই এক মাসের ছুটি কাটিয়ে স্কুলের নতুন ক্লাসে পা দেওয়া। বেশ নতুন নতুন আমেজ। তখনো বই আসেনি। তার পড়ার চাপও কম। বাড়ি ফিরে কোনো রকমভাবে মুখে দুটো খাবার দিয়ে নদীতে ঝাঁপ। নদী মানে শীলাবতী। আমাদের আর এক মা। কখনোই আমাদের প্রতি রাগ করেনি। তার বুকের উপর সারা দুপুর জলে ঝাঁপাই ঝুড়তাম। বহমান জলকে একটি সময়ের জন্য শান্ত হতে দিতাম না। আমরা অশান্ত থাকতাম কিন্তু জলের ধারা বরাবর এগিয়ে যেতো কাঁকড়ার বাচ্চাদের লাইন। একটা সময় আমাদের পেট জানান দিতো; খিদে পেয়েছে। মাঝ আকাশ থেকে সরে গেছে সূর্যটা। যে পাশে জল শুকিয়ে গেছে নদীর, সেইপাশ দিয়ে আমাদের বাড়ি ফেরার পথ। বালির উপর আগুন ছুটছে। আমরা রোদে পুড়তে পুড়তে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছি।        


দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ। পয়লা বৈশাখ বলে কতরকমের তরিতরকারি ভাতের সাথে। কলাপাতায় কলমি শাকের সাথে আরো চাররকমের শাক একসাথে ভাজা, গয়না বড়ি ভাজা, বেগুন ভাজা, গোল গোল করে আলু ভাজা, পটল ভাজা, ভাত, টক ডাল, শুক্তো,

বাটা মাছের তেলঝাল, পুঁটি মাছ ভাজা আরো কি কি মা রান্না করতো। বাবা মায়ের সাথে আমরা ভাত খেতাম। আমাদের টোকা আম গাছের ডালে বসে কোকিলটা ডেকে চলেছে। দক্ষিণের দুয়ারে মা মাদুর পেতেছে। সামনের বড় পুকুরে হাঁসগুলো জল চৈ চৈ খেলছে। তখনও সব বই আসেনি বাড়িতে। যে কয়েকটি এসেছে মা স্বযত্নে পুরাতন ক্যালেন্ডারে পাতা দিয়ে বই মলাট করছে। নতুন খাতার আমন্ত্রণ পত্রগুলি বাবার হাতে। মনের পড়ে যায় বাবা কী করবেন মোটা কাগজের আমন্ত্রণ পত্রগুলি দিয়ে। পাখা তৈরী হবে। হ্যাঁ কাগজের পাখা। শীতের উচ্ছে মাঁচার অবশিষ্ট টুকরো তারে পাখাটি স্থাপন করতেন। তারপর আমাদের হাতে দিতেন। আমরা ছুট মারতাম পাকা ধানের ক্ষেতের দিকে। পাকা ধানের গন্ধে মকমক করতো আমাদের নাক। পাখাটা পৎ পৎ করে ঘুরতো। আমরা আমাদের  গল্পে মেতে থাকতাম। ঐদিকে দেখতে পেতাম বাবা তার পুরাতন সাইকেল করে নতুনখাতা সারতে বেরিয়ে যাচ্ছেন। 


বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। বড়মার সাথে মা আর কাকিমা কৃষ্ণ মন্দিরে প্রদীপ জ্বালাতে ব্যস্ত। জেঠুর গলায় শুনতে পেতাম গীতা পাঠ-

                  ধৃতরাষ্ট্র উবাচ

ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।

মামকাঃ পান্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয়।।১।।

                     সঞ্জয় উবাচ

দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্যোধনস্তদা। 

আচার্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ।।২।।


আমরা একে একে পুকুর ঘাট থেকে পা হাত মুখে ধুঁয়ে ঘরে ফিরতাম। খিদেতে পেট মোচড় দিতো। তবু অপেক্ষা করতাম নতুনখাতার লাড্ডু খাবো বলে। সেই সময় যার দোকানে নতুনখাতা তাঁর বাড়িতেই মোতিচুরের লাড্ডু হতো। বাড়ির বৌয়েরা সেই মিষ্টি যত্নসহকারে তৈরী করতেন। বেশ সুস্বাদু, সুন্দর গন্ধ, কাগজের ঠোঁঙাটি খোলা মাত্রই ছড়িয়ে পড়ত মিষ্টির গন্ধ। আমরা একটি দুটি করে মিষ্টি সাথে সাথে খেয়ে নিতাম। বাবা কোন দোকানে কি টিফিন খেয়েছে মাকে বলতে থাকতেন। বেশ কয়েকদিন ধরে সকালে এক জাম মুড়ির সাথে একটি  মিষ্টি খেয়ে পাঠশালায় যেতাম। আর নতুন বইয়ের নতুন পড়া বোঝাতেন মাষ্টারমহাশয়। একটা সময় অপেক্ষার সময় গুনা শেষ হতো। বাবার সাইকেলের কিড়িং শব্দ কানে আসতো। কেমন ভাবে কেটে যেতো একটি ১ লা বৈশাখের প্রথম দিন তার টের পেতাম না সেই বয়সে। 

           ………………….. 



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - সৌতি বসাক

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614




রেখেছো বাঙালি করে… : শ্রীজিৎ জানা // ই-কোরাস ১২২

 



রেখেছো বাঙালি করে…

শ্রীজিৎ জানা


বিদায় চৈত্র। নিদাঘের গনগনে আঁচে 'এসো হে বৈশাখ'। দেয়ালে লটকানো হল নববর্ষের ক্যালেন্ডার। অম্নি একদল বাঙালির ধেই ধেই শুরু। এদিকে  ঠা ঠা রোদে কাজীর হাটে বসে আছে পুনি মাসী। কোলের কাছে দু'চার আঁটি করে গিমা, কুলেখাড়া আর মাঠ কলমি শাক। দু টাকা পাঁচ টাকা আঁটি বেচবে। আজকাল ছেলে বৌমার বোঝা সে। জেলে পাড়ার টগরী বালিবিল থেকে গেঁড়ি তুলে এনে বিকোচ্ছে বাবুর হাটে। লখি মেছুনি দাসপুর আড়ত থেকে ময়নার মাছ এনে বাজারে বসেছে।দোলুই পাড়ার বউ বাসন্তী সাইকেলে শাড়ি শায়া ব্লাউজ নিয়ে ফেরি করতে বেরিয়েছে পাড়ায় পাড়ায়। মুর্শিদাবাদের মইনুল মেয়েলি সাজের পসরা নিয়ে গাঁয়ে ডুগডুগি বাজিয়ে ফিরছে। নন্দ আইসক্রিম আর জীবন ঠান্ডার বাক্স সাইকেলে বেঁধে রোদে পুড়ে ঘুরছে। বিহার থেকে আসা প্রমোদ মটকা- কুলপির টলি নিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে ডাকছে পুঁচকেদের। চিতন তালগাছে তালরসের জন্য হাঁড়ি বাঁধতে ব্যস্ত।নমিতা বৌদি সারা দুপুর ফুচকা ভেজে রেডি। বিকেলে বসবে বাজারে। সান্ত্বনা দি কী যেন কোম্পানির প্রোডাক্ট নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরছে। মিতালী বৌমা সেই রাত অব্দি সেলাই মেশিনে বসে আছে। এবছর চন্দ্রকোনার আলু চাষিরা ভাল দাম পায় নি। রাখাল মাড়র গাজন মেলায় যাবে না বাঁশরী। ছেলেমেয়েদের নতুন জামা কিনে দিতে পারে নি বলে মন খারাপ।


ওদিকে বৈশাখী প্রেমে শোভনসুন্দর সাজে মাতোয়ারা মহানগর। কবির কবিতার বই বেরুবে। টিভিতে বাঙালিয়ানা নিয়ে আড্ডা বসবে। রেস্তোরাঁয় বাঙালি পদ চেখে দেখার সাদর আমন্ত্রণ জানানো হবে। বই দোকান থেকে হু হু বিকোবে বেণীমাধব শীলের হাফ কিংবা ফুল পঞ্জিকা। চ্যানেলে,কাগজে জ্যোতিষ সম্রাটগণ আগত বাঙলা বর্ষের ভবিষ্যৎ শোনাবেন। নন্দনে বাঙলা পদ্দ লেখা শাড়ি- পাঞ্জাবির সাজে সেজে বাঙালিয়ানা জাহিরের চেষ্টা চলবে। দু'কলি মাটির গান গাইবেন শহুরে বাউল। এক কলি রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনাবেন খোয়াই। মলে,ফুটপাতে,বাজারে ক্রেতাবন্দনা গীত শোনা যাবে। সাথে সামান্য ডিসকাউন্ট তৎসহ মিষ্টিমুখ। 


একইসাথে বঙ্গ কোন ফুল ঢলে ঢলে বর্ষ কাটাবে তার মহড়া চলবে ব্রিগেডে ও ধর্মতলায়। কোন রঙে মতি রাখলে উন্নতি নিশ্চিত তারও একটা হিসেবনিকেশ চলবে গোপনে। শুধু একদিন পান্তাভাত খবাব আদিখ্যেতায় চোখতোলা করে থাকবে সারাবছর দুমুঠো পান্তার জন্য লড়াইকে। পয়লা নাকি একলা বৈশাখ, এনিয়ে তাই একটুও আগ্রহ নেই পুনি মাসীর,চিতনের,বাসন্তীর, মইনুলের। ফিবছর বচ্ছরকার দিনের সুড়সুড়ি দিয়ে মাথা চিবোবে মর্ডান মার্কেটিং। 

যে বাঙালি ভোটযন্ত্রের সামনে মেরুদন্ড সোজা রাখতে পারে না, যে বাঙালির মেধা দাসত্ব করে,যে বাঙালির মনন অর্থের কাছে হাঁটুমুড়ে বসে,সেই বাঙালির পয়লা বৈশাখ উদযাপনের কায়দাবাজিকে ধিক্।

তারচে পয়লা বৈশাখ বেঁচে থাক গাঁয়ের তুলসীতলার বসুধারায়,বটতলার জলসত্র আর গুড়ছোলা বিতরনে,আচায্যি ঠাকুরের পঞ্জিকা পাঠে,জমির কোনায় একনা ধোঁয়ায়,নিমপাতা মুসুর চিবানোর নিয়মে,বড়দের প্রণাম আর  সপরিবারে পঙক্তিভোজনে। 


আশ্চর্য শোনালেও, এসব অতীত হয়ে যায় নি। এখনো টিকে আছে। বাঙালির এইসব শুদ্ধ ও আন্তরিক,হৃদয়স্পর্শী আচারকে যদি বাঁচিয়ে না রাখি তবে বাঙালি জীবিত লাশ হয়ে বেঁচে থাকবে।

 বঙ্গের হালখাতায় গুচ্ছের দেনা। বাঙালির হালখাতায় গুচ্ছের অপরাধ। হে বাঙালি,বছরের শুরুতে একটু ভাবিও, পান্তাভাতে মজে থাকব নাকি মুষ্টিবদ্ধ হাতে সোচ্চার হব?

            …………….


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - প্রসেনজিৎ মূলা

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614


ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...