Thursday 30 April 2020

e-কোরাস ৩০//অসময়ের গল্প







অন্তরা ঘোষ এর অনুগল্প 🖋
১.
আঁধার পূর্ণিমা

"আজ বুদ্ধ পুন্নিমে!"―দীপ্তি মাসির ঝোলা চামড়ার ভেতরের চোখে খানিকটা রোদ্দুর।
―"তাতে কি হলো গো মাসি?"ঝাঁঝ সুরভীর গলায়।
―"এই পথ দিয়িই তো পতিবার  শান্তি মিছিল যায়।"
―"সেজে দাঁড়াবে না কিগো মাসি?"ব্যঙ্গ সুরভীর কন্ঠে।

চোখের আলো নিভে গেল দীপ্তির।সুরভী জানলোই না,মাসি নয়,দীপ্তি ওর মা।আর তেত্রিশ বছর আগে এই শান্তি মিছিল থেকেই পথ ভুলে সুরভীর বাবা ঢুকে পড়েছিল কোঠাবাড়িতে।

২.
দহন

মাটির প্রদীপে তেল ঢেলে সলতে উস্কে অপেক্ষা করছে গৌরী।ভোরের আলোর।শ্বশুরের নির্দেশে স্বামী মিথ্যে বলে তার গর্ভের কন্যাভ্রূণ কে গতকাল নষ্ট করিয়ে এনেছে।অল্প আলোর আভা ফুটতেই বাইরে পা রাখলো গৌরী।ঘরের চাপচাপ অন্ধকার দূর করতে জ্বলন্ত সলতেটা খড়ের চালে ছুঁড়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।

৩.
শো পিস

নারীদরদী লেখিকা হিসেবে বসুধার খুব নামডাক।অসহায় নারীদের পক্ষে গর্জে ওঠে তাঁর কলম।ড্রইংরুমে সাজানো থরে থরে পুরস্কার।বিশিষ্ট পত্রিকার তরফ থেকে আয়োজিত'নারী যন্ত্রনার সেকাল একাল' বিষয়ে বক্তৃতা দিতে যাবে সে।আয়নার সামনে গিয়ে থমকে গেল কপালের বামদিকের ক্ষতটাতে চোখ যেতেই।ক্ষতটা দগদগে এখনো।


৪.
চোর

অসুস্থ অকালবিধবা বড়জায়ের ঘরে ঢুকে রাতের অন্ধকারে বেশকিছু গয়না চুরি করে আনে সৌমিলি।নিজের রুমে এসে গয়নাগুলো লুকিয়ে রাখতে গিয়ে দেখে, বিগত কয়েকবছরে  বিবাহবার্ষিকীতে অলকেশের দেওয়া গয়নার জেরক্সকপি যেন এগুলো।
সৌমিলি মুহূর্তে বুঝে নেয়,তার নিজের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বড় জা কবেই চুরি করে নিয়ে গেছে।
                            ......................


সুজাতা জানা এর অনুগল্প 🖋
মায়ের কোল

কিছুদিন আগে নিতারা একটা ভাড়া বাড়িতে এসেছে চাকুরি সূত্রে।নতুন জায়গা নতুন মানুষজন কেমন যেন ভাল না লাগা পরিবেশ। কাজকর্ম সেরে নিতা অনেক সময় ব্যালকনিতে বসে ছোট রানিকে নিয়ে। ওদের ঘরের পাশে ছোট একটা ঝুপড়ি ঘরে পাঁচি আর পুটি তার দিদার সঙ্গে থাকে। সেই ছোট থেকেই দিদা ওদেরকে খুব কষ্ট করে মানুষ করেছে। ব্যালকনি থেকে দেখে কেমন মায়াময় চোখে তাকিয়ে থাকে ওরা। ওদের ওপর কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে! পাড়ায় ওদেরকে কেউ ভালো চোখে দেখে না! ওদের নাকি বাপের ঠিক নেই! রানির সঙ্গে ওদের বেশ ভাব।মাঝেমধ্যেই ওরা আসে রানির সঙ্গে খেলতে। কয়কদিন হল নিতার শরীরটা একটু খারাপ। রনিতও বাড়িতে নেই।
মামি তোমার কি শরীর খারাপ?
হ্যাঁ
আমি তোমার ঘরটা পরিষ্কার করে দেব?
না থাক।

নিতা একদিন পাঁচিকে ডেকে জিজ্ঞেস করল তোদের বাবা মা কি বাইরে থাকে? জলভরা চোখে পাঁচি বলে খুব ছোটবেলাতেই বাবা নাকি ওদের ছেড়ে চলে গেছে! আর মা নাকি ভাতে জোগাড়ে গেছে। দিদার কাছেই শুনেছি। মা আর সেই থেকেই আসে নি। সেদিন রাতে দিদা বলেছে মা নাকি আসবে খুব তাড়াতাড়ি!

ওরা দিন কয়েক আর আসে নি।হঠাৎ একদিন এসে বলল; জানো মামি কাল রাত্তি মা এসেছে। আমাদের জন্য নতুন জামা জুতা আরো কত্তকিছু এনেছে। ওদের চোখে মুখে কি তৃপ্তির খুশি।

সেদিন বিকেল বেলায় জেঠিমা চেঁচিয়ে বলল আবার কত লোকের মাথা খাবে তার ঠিক নেই। ওর চরিত্তি ভালো নয়।খারাপ লাগলেও কিছু না বলে নিতা হজম করে নেয় কথাগুলো। জীবনের গভীরে না ঢুকেই মানুষ কত সহজেই নোংরা ছিটিয়ে দিতে পারে অপরের গায়ে!

এরিই মধ্যে গরমের ছুটিতে নিতা দিনকতেকের জন্য বাবার বাড়িতে যায়। ফিরে এসে বাড়ির কাজকম্ম সেরে রানিকে নিয়ে ব্যালকনিতে বসে। খুব আদর করে রানিকে। মায়ের চুমুতে ভরে ওঠে তার গাল। নীচে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে আছে দুই বোন!!

কিরে কি দেখছিস?
ওপরে আয়।
মা আবার চলে গেছে। আর হয়তো আসবে না কোনোদিন!

আচ্ছা মামি আমরা কি খুব খারাপ! আমাদেরকে ছেড়ে সবাই চলে যায়। কেউ ভালোবাসে না, ভালোবাসতে জানে না! জানো মামি তুমি যেভাবে বোনুকে আদর করো আমাদের মা কখনো ওভাবে...! কথাগুলো বলতে বলতে মেয়েটার চোখে নেমে আসে শ্রাবনের ধারা, কালো মেঘ আরো ঘনিয়ে  আসছে...
                                 ...................

              পৃথিবী আবার সুস্থ হবে   


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - সুকান্ত সিংহ এর পেজ থেকে
ঠিকানা - সুরতপুর, হরিরামপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614



Monday 13 April 2020

e-কোরাস ২৯ // অসময়ের পয়লাবৈশাখ



শুভ হোক, সুস্থ থাকুন, বাড়িতে থাকুন।


গৃহবন্দী পয়লা বৈশাখও  হয়তো তেমনই ভাবছে
আশিস মিশ্র 

"এসো হে বৈশাখ এসো এসো..."। বাংলাদেশের শিল্পীদের গাওয়া সেই গান শুনতে শুনতে মন হয়ে গেলো কিছুটা বিষণ্ণ । এবার আর তোমার দেশের মালিবাগ, যমুনা, পদ্মা ছুঁয়ে আমার ঘরে ফেরা হলো না। চৈত্র সংক্রান্তির সেই আবেগময় বিকেলে মানুষের ভিড়ে যখন ঢাকা শহর প্রাণচঞ্চল, তখন আমার পশ্চিমবঙ্গের কথা মনে পড়লো। তড়িঘড়ি ব্যাগ গুছিয়ে রাত দশটায় বাসে উঠে পড়লাম। রাস্তায় আসতে আসতে সেই মেয়েটির অশ্রুভেজা চোখ, তার করুণ আকুতি, ধানমন্ডীতে ডাক দেওয়া সেই পরমার কথা আমি রাখতে পারিনি। একটি রাস্ট্র যখন পয়লা বৈশাখ উদযাপন উৎসবে প্রাণ সঞ্চার করবে,তখন যেন আমি তাদেরই  একজন হয়ে থাকি, এই তার বাসনা। তার কথা না রাখার বেদনা আমাকে এই অসময়ে বিদ্ধ করছে। সে-সব ২০১০ সালের ঘটনা। ১৫ দিন টুরিস্ট ভিসা নিয়ে প্রথমে টাঙ্গাইল, তারপর ময়মনসিংহ ও ঢাকায় কবিসম্মেলনে যোগ দিয়ে ঘরে ফিরে আসার পালা। এর মধ্যে সেই মেয়েটির সঙ্গে ক্ষণিকের আলাপ। তার বনফুলের মতো চোখ, চাঁদের মতো মুখ, গানের হৃদয় আমাকে বিহ্বল করেছিলো। আলাপের ঢেউ-এ সে-ই প্রথম আমাকে ভাসায়। সেই স্মৃতি আজও অমলিন।  

আজ যখন এই সংকট কালে আমার শিল্পবন্দর হলদিয়া শহরের অদূরে গ্রামের ঘরে বসে তার কথা ভাবছি, তখন মনের সব কাঁটাতার মুক্ত হয়ে গেলো। মন চলে গেলো ওপারে। ওপারের আতিথেয়তা,  প্রকৃতি,বন্ধু, নদী,হাওয়া,নক্ষত্রপুঞ্জ,বৈশাখের তীব্র দাবদাহেও হৃদয় জুড়োনোর একটু অবকাশ ঘটেছিলো। তা আবার কবে হবে জানি না। আর হয়তো দেখতে পাবো না তাকে!

আজ এই পয়লা বৈশাখে ছেলেবেলার কথাও মনে  পড়ে। খুব সকালে উঠে মাঠে খড় নিয়ে আগুন দেওয়া, উঠোনে আগুন জ্বালিয়ে তাতে বঁটি তাতিয়ে  স্পর্শ নেওয়া হাতের নাড়িতে, দুপুরের আগে তুলসি মঞ্চে বসন ঝারার প্রস্তুতি, মুড়ির ছাতু খাওয়া, নতুন পোশাক পরে শিব মন্দিরে যাওয়া, বিকেলে খোলা মাঠে গিয়ে বসা অথবা রান্নাবাটি খেলা দেখা -এ সব আর।
                         ………………. 



হে অকাল বৈশাখ
তৈমুর খান 

১৪২৭এর নববর্ষ বাঙালির জীবনে এক  ক্লান্ত বিষণ্ণ ছায়ার মতো। বাঙালি মানসিকভাবে সামাজিকভাবে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না এই  নিঃস্ব জীর্ণ বৈশাখের জন্য । সারা বিশ্বজুড়ে বাঁচার লড়াই । কী করে বেঁচে থাকা যায় তারই পরিকল্পনা মানুষের। চারিদিকে হাহাকার মৃত্যুর মিছিল হা-অন্ন জীবনের প্রচ্ছায়া ঘনীভূত। করোনাভাইরাস করেছে বিচ্ছিন্ন গৃহবন্দি জীবনের এক মর্মন্তুদ ফরমান জারি।  যে আড্ডা, যে সম্মেলন,যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাঙালি পালিত করে তাদের প্রিয় নববর্ষ ,তা আজ বিষণ্ণ বিধুর করুণ নিস্তব্ধতার আবহাওয়া সংগীতে পূর্ণ । 
     কেন এলে বৈশাখ এই অস্তিত্বহীন অসহায় জীবনে? কী বৈভব আছে আর তোমাকে বরণ করার? কী করে স্বাগত জানাই তোমাকে? এ রুদ্র পৃথিবীর কাছে বাঙালির প্রাণের  অমেয় উচ্ছ্বাস একদিন গেয়েছিল এই গান: 

"এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে   মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
  বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি,   যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
   অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
   মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
   অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি   শুষ্ক করি দাও আসি,
    আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
    মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥"

 আজও কি গাইতে পারবে বাঙালি তার  প্রগাঢ় কন্ঠে? বড় যে অসময় আজ মনে হয় !  কন্ঠে সেই মাধুর্য সেই উদ্গত প্রাণের আকুতি কি আর আছে?  সেই অবিচল পৌরুষের তেজোদীপ্ত বীণা কি আর সেভাবে বাজবে? তবুও বাজুক এ আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে প্রকৃতির দরবারে। এক সংরাগ  সুললিত বেদনার তারে উঠুক ঝংকার তবে । নববর্ষের নব উৎসবে জাগুক নব স্বপ্ন তার। বিমর্ষ কোকিল কণ্ঠে উঠুক হর্ষধ্বনি। রুদ্রের তপস্যায় ফুটুক কমলিনী।  মৃত্যু জর্জর ভূমি যৌবনের বন্যায় ভাসুক।
       এই সেই নববর্ষ পুরাতন জীর্ণকে দূর করে নতুন আহ্বান, নতুন এক পৃথিবীর সন্ধান। যাক ফিরে যাক, মৃত্যুদূত ফিরে যাক তবে। অকাল বৈশাখে মহীয়ান হোক আরও স্বপ্ন সম্ভাবনা ।  কান্নাগুলি অগ্নি বাষ্প মেঘ। বৃষ্টির প্রাদুর্ভাবে ছেয়ে যাক আকাশ। বাঙালি তার বাঙালিত্বে বেঁচে থাক। আবার বলুক বাঙালি : মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারি নিয়ে ঘর করি। মঙ্গলঘট হোক ভরা ।  শুভারম্ভের শঙ্খধ্বনিতে পূর্ণ হোক ধরা। সব ধ্বংস প্রলয় নিশার শেষে আবার অরুণ উঠবে হেসে আবার আমরা গাইতে পারব:
"তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
    তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐনূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়
    তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!"

 অকাল বৈশাখ তবু এই জয়ধ্বনিরই  কোনো শপথ আমাদের দিয়ে গেল যেন।
                   ……………… 


ভালবাসব অথবা মরে যাবো  
লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল 

কোথায় যে হাঁটছি, কোনদিকে। শ্বাস নেওয়া  ফটোগ্রাফিগুলো উলটে-পালটে দেখতে দেখতে রাস্তা পার হচ্ছে একা মানুষের বেঁচে থাকা। শেষরাত বা ভোররাতের রঙিন পাখির দেশ এটা- হতেই পারে। অহঙ্কার নেই কিছু- আমি মরবই আজ না হয় কাল-হয়তো তার সামান্যই কণ্ঠস্বর। এই সেই বাংলা, লালপাড় শাড়ি আর সাদা কোচা লাগানো ধুতির সেই ঐতিহ্যবাহী বাংলা। রাঙামাটির তাপ লেগে আছে গাছপালায় । ঝোপের মাঝে ঝকঝকে ভুতভৌরি। আগে এত উজ্জ্বল দেখা য়ায় নি, কোন ধুলোর প্রলেপ নেই, কোন ভাঙা চোরা ডালপালা নেই, নেই কোন  পায়ের চাপে থ্যাতলানো ব্যথা। এত রঙ কিসের জন্য-ভুলে গেছি সব। শুকনো পাতা ঝরছে অনেক,তবুও আবর্জনা নেই পথের দুধারে।কেবল অভ্যর্থনার আভাস। গান নেই,কেবল সুর ভাসছে বাতাসে। সে সুর চলে যাচ্ছে বুকের নিস্পাপ অন্তর মহলে-এসো, এসো হে--

আমরা অবশ্যই ভালোবাসব,আমরা অবশ্যই বাঁচব,নতু্বা মরে যাব-জীবনের এই সারফেস লেভেলেই  পরিলক্ষিত আনন্দময়ের সংজ্ঞা। বিশাল একটা নদীতে মাত্র মানুষের পারাপার। হয়তো নদী থেকে জল তুলছে একদল আধডোবা কিশোরী; কিংবা খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে কোনো সাদা বক, নিচে তারই পড়ে থাকা ছায়া! দেখি আর ভাবি-জীবন থেকে অনর্গল লিখে চলার মত,পাশ ঘেঁষে কত কি যে পড়ে থাকে জীবনে !

কয়েকদিন কোন গোলাগুলি নেই-কেন না হত্যা কিংবা আত্মহত্যার ঘটনাগুলি একেবারে শূন্যে এসে পৌঁছেছে । কেউ কারও দিকে আঙুল তুলছে না । মানুষ কান খাঁড়া করে শুনতে চাইছে নিজের আত্মপ্রকাশ, নিজের প্রাণ শক্তি ।    পায়ের পাতায় ভর দিয়ে দেখতে চাইছে প্রচেষ্টাকে। শিখে নিতে চায় সংক্রান্তি-চড়কের বিভৎস পিটফোড় দেখতে পাচ্ছে না কেউ। তারা জীবনধারণ করছেন জীবন দিয়েই। তারপর একটা সান্ত্বনা পাওয়া গেল। 

অনিবার্য  অন্তরের বাজনায় প্রত্যেকটি বছরের শুরুতে রদবদল ঘটে যায় পঞ্জিকার,ক্যালেন্ডারের পাতায়  সংখ্যাগুলো জায়গা বদল করতে থাকে । এবার কী তবে মন্দির মসজিদ গির্জার লাইন গুলো ভেঙে দেওয়া হবে ?  ঘরে ঘরে সন্ধ্যাগুলো নীলকন্ঠের শরীরের নীল রঙকে নিরাময় দেওয়া হবে? হচ্ছেও তাই । নির্জন চিৎ-সত্তায় নির্মল করার জন্য গৃহস্থরাই দুধ দিয়ে চান করাচ্ছেন পাথর ।  আল্পনায় কোন আসক্তি নেই । দিপ্ দিপ্ করে জ্বলে মঙ্গলদীপ-মৃত্যুকে আটকাতে চাই না আর-গৃহ বন্দীর পোশাক উবে গেছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের কাছে-

সত্যি তো কোন নোটিফিকেশন ছাড়াই ভোরের  শঙ্খ বেজে উঠল- এই শঙ্খ ধ্বনির কাছে হার মানে  সামাজিক দুরত্বও। ভাসতে থাকে নতুন পাতার কলরব। এসো, সত্যিকারের নতুন দিন ।
                    …………….. 


দিগন্তফোঁটা
অলক জানা 

ওদিকে যেতে নেই:

এই বারণ-বক্তা জানেন
ওদিকের প্রত্নভয় 

এত ক্ষয় আগলে যে দাঁড়ায় 
তার ওপর বিশ্বাস থাক

সবটুকু হারানোর দীর্ঘশ্বাস
শেষবারের মতো বুক ভাঙতেই পারে 

তবুও প্রতিটি শুরু 
ভোরের মতো নির্ঘাত রোদফেরী। 

ঘুমের আশ্চর্য মহিমা
তালা বন্ধ পরিপাটি

সংসারের নিয়মে চিৎকার 
সেটাই স্বাভাবিক-----

পাওনা মেটানোর প্রসঙ্গেই
সর্বহারা একদা পথে নামে

আর সজাগ ঘুম থেকে উঠে আসে
পোষ্য বুদ্ধিজীবীর স্বেচ্ছাস্ত্র।

আলোর দৈর্ঘ্যে ভাঙে
ছায়ার আলাপ 

প্রিয় মুখের মুগ্ধতা 
অধিকতর মহৌষধ

কে ফিকে করে যায় ?

হাজারো অসাহায়তা থাকবেই তো 
বেঁচে থাকার ইচ্ছেটুকু 
সুন্দরের আর এক নাম।

কাজ হারানো হাত
বড় বেশি অসহিষ্ণু

নিজের সঙ্গেই 
আঘাতের প্রথম মাঠ

বিজয়ী 

নিষ্কর্মা হাতের চেয়ে 
ধর্মের কী এমন দম রাষ্ট্র পোড়াবে ? 

তুলসীতলার বিপন্নতা
পোড়ানোর আয়োজন বাড়ন্ত

মৃত প্রদীপে এখন 
এক অরণ্য ক্ষুধা 

গৃহস্থালিতে তারও বেশি 
বাঁধনছাড়া সমুদ্র… 

অব্যবস্থা

ভাইরাসের চেয়ে
সতেজ সংক্রামক 

দিশাহীন ধুঁকছে
আমাদের প্রজন্ম

আমরা কী নির্মোহ 
স্বেচ্ছাচারী ? 
সই সাবুদ, অস্তিত্ব না রেখে 
মুড়িয়ে খেয়ে বাঁচায় অভ্যস্ত ? 

সৃষ্টির কাছে নত শিরে 
কোন এক সময় 
ফিরে আসতে হয়
নিঃশর্ত… 

এই ঘরেই 
বসত করে একত্র 

কাদাজল, দুঃখ আরোগ্য।

পাতা খসার নিয়মে
মহা বৈশাখের পায়ে বাজে 
রোদের ঘুঙুর

প্রতিটি কোষাগারে মড়ক 
বিপণনের নতুন খাতায় 
উঠে আসে শূন্যতার দহ

কার দোষ কে ভাগে পায়
নিষ্পাপ আসামীর মতো
হেঁটে যায় একক বৈশাখ। 

পৃথিবী এখন
একান্নবর্তী পরিবার

অনিশ্চিত ধাক্কা সামলাতে
ধুয়ে ফেলছে হাতের সঞ্চিত বিষ

এটাই তো মহার্ঘ সময়
একযোগে 
কম খরচে! 
ভেতরে পোষ্য যত কালো
অপসারিত হোক।

১০
ভয় বড় অভিমানী
দুর্বলতার গন্ধে
নিমেষে ভাবজমায়

আলোর পিঠে
ছায়াদের হূল ফোটানোই স্বভাব 

দুর্বলতা চোখা বৈশাখ,
নববর্ষে ভিজলে
আত্মহত্যা বেছে নেয়
ভয়, ভাইরাস
শেষ হাসি, মানবতাই হাসে।
           ………… 


বড় অসময়ে এলে
রাখোহরি পাল

বড় অসময়ে এলে
যদি ও চাঁদ সাবান মেখে উজ্জ্বল
আকাশ ধুলো ঝেড়ে নীল
ভোরের কোরক থেকে বেরিয়ে আসছে নতুন জন্ম
আকাশে মুক্ত ডানার চিল,---তবু
আজ মানুষের বড় দুর্দিন।

শ্রেষ্ঠত্বের গরিমা হারিয়ে মানুষ কেমন বন্দী
এটম,নিউক্লিয়ার,নিউট্রন সব হাতিয়ার ভোঁতা
পরাক্রমে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এশিয়া,ইউরোপ,আমেরিকা
আণুবীক্ষণিক বহুপদী এক ভাইরাস
জীবন মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েছে অন্ধ অহঙ্কার 
তুমি তাকে ক্ষমা করো
আজ মানুষের বড় দুর্দিন।

বড় অসময়ে এলে।
যদি ও চান্দ্রমাস,বছর, দিনক্ষণ পঞ্জিকা ঠিক ছিল
আকাশে মৌসুমীর গন্ধ পেয়েছে অরণ্যানী
শিশুর মতো দোল খাচ্ছে আম, গন্ধ ছড়িয়ে হাস্নুহানা,--- তবু
মানুষের আজ বড় দুর্দিন।

বরণ করার আয়োজন নেই, মালা গাঁথা হয়নি
প্রস্তুত হল না 'ওম্ গণেশায় নমঃ'নিমন্ত্রণ লিপি
শালুর মলাটে হালখাতা,মিষ্টিমুখের প্যাকেট
তুমি তাকে ক্ষমা করো।
মানুষের আজ বড় দুর্দিন।
        …………….. 


মুখোমুখি বসিবার পয়লা বোশেখ
 মলয় পাহাড়ি 

আজও বেরোতে হয়েছিল, পথ বলছে ফিরে যাও, দু-পাশের গাছ, লতা বলছে ফিরে যাও,  যে মুদি দোকানে উঠেছিলাম, সব্জি বা মাছ দোকানদার যেন তারাও বলছে ফিরে যাও ।

একসময় ফিরে এলাম ঘরে, ঘর ও ভেতরে নেওয়ার আগে পরীক্ষা চাইল, তারপর ভেতরে আসছি, প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমি যোগ্য তো ? 

আমার পরিবার আমার কাছাকাছি আসছে, ছুঁয়ে  যাচ্ছে এক একটা অস্তিত্ব, চৈত্র মাস চলে যাওয়ার সময় কত কথা বলে যায়, আমি বনসাই আমলকী গাছে জল দিতে দিতে শুনি তার চাপা হুতাশ, শিকড়ে আকটে থাকে সকল ইতিহাস, প্রকট ও প্রচ্ছন্ন থাকার লিপিকার এই চৈত্র, বন্ধুদের নিয়ে আমি বরুনা নদীর তীরে এসে দাঁড়াতাম, নদীর জলে নামিয়ে আনতাম সকল স্বীকারোক্তি, হাতে হাতে ভিজিয়ে নিতাম নদীর জলে আগামীর শপথ। 

এ বছর নদীর কাছে যাওয়া বারণ। সব পথেই নো এন্ট্রি। সব বন্ধুর দরজা বন্ধ। আমি এসে দাঁড়ালাম নিজের প্রতিবিম্বের কাছে। কতকাল নিজের জন্য শুশ্রূষা রাখা হয়নি, আমি যে মাটি  জল থেকে উঠে এসেছি, তার জন্য কোন ‌শুশ্রূষা রাখা হয়নি ,তাই পাহাড় মাটি পাথর ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকে... 

১৪২৭ আসছে। মুখোমুখি বসব ,পানীয়, ধোয়া পোশাক নিয়ে অপেক্ষা করছি সিঁড়ির মুখে, একটা সহজ আলোর ভিতর নিজেকে দেখব এই আশায়।
                 ……………….. 


অসময়ের নববর্ষ
তারাশঙ্কর দাসবৈরাগী

"ওই এলো রে ওই এলো
নতুন বর্ষ ওই এলো।
তরুণ তপন উঠলো রে
ধ্বস্ত তিমির ছুটলো রে
নওরোজের এই উৎসবে -
ওঠ জেগে আজ ওঠ সবে।"

বাংলাদেশের  জনপ্রিয় কবি গোলাম মোস্তফার উপরোক্ত কাব্যময়তার সঙ্গেই মিলে যায় আপামর বাঙালির নববর্ষ
ভাবনা। অন্ততপক্ষে আমি তো শৈশব থেকেই দেখে আসছি অনুভবে উপলব্ধি করে আসছি বাংলা নববর্ষের সূচনা লগ্নটিকে নিয়ে বঙ্গবাসীর চরম উত্তেজনা-সীমাহীন উন্মাদনা।
    আজ ৩০শে চৈত্র, সোমবার ; চৈত্র সংক্রান্তি। এক মহাসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এখন আমরা। রাত পোহালেই পয়লা বৈশাখ ! আরও একটি বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন। বাংলা ক্যালেণ্ডারে ফুটে উঠবে ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। তাকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত কি আমরা ? এবার!

     নববর্ষ মানেই তো নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রত্যাশা, নতুন প্রত্যয়। নববর্ষ মানেই জীর্ণ পুরাতনকে মুছে ফেলে নতুনকে সাদর আহ্বান। নববর্ষ মানেই তো রবীন্দ্রনাথের গান :
     " এসো এসো এসো হে বৈশাখ,
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষেরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক -
           যাক পুরাতন স্মৃতি
          যাক ভুলে যাওয়া গীতি
অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক ।"

কিংবা নজরুলের কবিতা -
     " ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়।
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর। "

বাংলায় পয়লা বৈশাখ মানেই রাঙা প্রভাতে মন্দিরে মন্দিরে পুজোর ডালি হাতে পুণ্যার্থীর দীর্ঘ লাইন। পয়লা বৈশাখ মানেই হালখাতা পুজো, দোকানে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে উৎসবমুখরতা ও চূড়ান্ত ব্যস্ততা। পয়লা বৈশাখ মানেই নতুন পোশাকে পথে নামা, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সমাবেশ, পয়লা বৈশাখ মানেই মিষ্টি মুখের নান্দনিকতা, পয়লা বৈশাখ মানেই ভোজন রসিক বাঙালির রান্নাঘরে একটা অন্যরকম ব্যবস্হাপনা । এগুলো সবই খুব চেনা ছবি বাংলার উঠোন জুড়ে পয়লা বৈশাখের মহা সমারোহে।
             কিন্তু আমার জীবনে এই প্রথম বার , হ্যাঁ, একদম প্রথম বার নিষ্প্রভ নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছে একটা নতুন বছরের সূচনা লগ্নটি। চৈত্রের শেষে রাঢ় বঙ্গের গ্রামে গ্রামে শিবের মন্দিরে এবার বাজেনি ঢাক, শোনা যায়নি গাজন উৎসবকে ঘিরে ভক্তদের কোলাহল । চড়কের মেলার স্মৃতি কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে কিশোর-মন থেকে। অথচ এমন তো হবার কথা ছিল না। গাজনের মেলায় শালপাতার থালায় ঘুগনির স্বাদ, পাঁপড় আর পেঁয়াজির গন্ধ আজও কেমন যেন মনকে উতলা করে তোলে। এই মিলন উৎসবের রেশ ধরেই তো হুড়মুড় করে এসে পড়ত পয়লা বৈশাখ বাঙালির আঙিনায়। ওৎ পেতে থাকতাম সারাটা দিন কখন বাবা বহুবিধ দোকানের হালখাতা সেরে নিয়ে আসবে মিষ্টির ঠোঙা, রকমারি মিঠাই আর লাড্ডুর স্বাদ নেবার জন্য জিভে জল নিয়ে উন্মুখ হয়ে থাকতাম আমরা ভাই-বোনেরা। হয়তো সে বয়স আমার আজ নেই, কিন্তু গ্রামের গৃহস্হের অনেক শিশু কিশোর তো এবছরও আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করতে পারত এই ব্রাহ্ম মুহূর্তটির জন্য।
          না, একটা অজানা অদৃশ্য ঝড় কেমন যেন বদলে দিয়েছে গোটা পৃথিবীটাকেই। একটা অনুজীবের অতর্কিত হানা যে সারা বিশ্বকে টলিয়ে দেবে, একটা চরম অনিশ্চয়তার দিকে টেনে নিয়ে যাবে, একটা ভয়ংকর আশঙ্কা ও আতঙ্কের ঘন কালো মেঘ আমাদের একটা আস্ত সভ্যতার উপর করাল ছায়া ফেলবে - ক'দিন আগেও কেউ বোধহয় দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।
          বিশ্ব জুড়ে মহাসংকট ঘনিয়ে তুলেছে প্রলয়ংকর মহামারী ! হাতছানি দিচ্ছে নিদারুণ দুর্ভিক্ষ তথা আশাতীত আকাল। এখনই লক্ ডাউনে গৃহবন্দি বহু তরুণ তরুণীর মনের মধ্যে চেপে বসতে শুরু করেছে অস্বাভাবিক অবসাদ ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পৃথিবী জুড়ে এমন ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল - ইতিহাস বলছে। আর এখনকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আজকের পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ ও মারাত্মক হতে পারে।  নানা দেশে আজ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় সোয়া এক লাখ মানুষ। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ ! এই জায়গায় দাঁড়িয়ে নববর্ষের সেই চিরায়ত বিনোদন কি প্রত্যাশা করা যায় ? আজ এই শতাব্দীর আরও একটি নতুন বছরের দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে কবি ফররুখ আহমদের কবিতার কয়েকটি লাইন মনে পড়ছে :
    " ধ্বংসের নকীব তুমি, হে দুর্বার, দুর্ধর্ষ বৈশাখ -
সময়ের বালুচরে তোমার কঠোর কণ্ঠে
শুনি আজ অকুণ্ঠিত প্রলয়ের ডাক।"
         জানি না , অদূর ভবিষ্যতে কী পরিনতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য । হয়তো অচিরেই ভালো কিছু    ঘটবে। আশার আলো জ্বলে উঠবে শুধু বাংলার ঘরে ঘরে নয়,বিশ্বের কোণায় কোণায়। সমস্ত খারাপ কিছুর মধ্যেই তো লুকিয়ে থাকে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা। আসুন, এই বিধ্বস্ত সময়ের নিথর দেহের উপর দাঁড়িয়ে "নব বিধানের আশ্বাস" বুকে নিয়েই কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রত্যয়ী কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে অ-সময়ের নববর্ষকে বরণ করি :
     "এসো এসো এসো হে নবীন
                          এসো হে বৈশাখ,
     এসো আলো এসো হে প্রাণ
               ডাকো কালবৈশাখীর ডাক।
        বাতাসে আনো ঝড়ের সুর
       যুক্ত করো নিকট দূর
যুক্ত করো শতাব্দীতে দিনের প্রতিদানে।"
                  ……………… 


অসময়ের খেলা
পল্লবী ঘোষ

'এসো হে বৈশাখ এসো এসো..'
তাপসনিস্বাসবায়ে,সব আবর্জনা,জীর্ণতা,গ্লানি,তিক্ততাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে পয়লা বৈশাখ আসে।এভাবেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশাখ কে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। চৈত্রের প্রবল দাবদাহ কাটিয়ে বৈশাখী বিকেলের স্নিগ্ধ আবাহনে মানুষের জীর্ণ স্মৃতি কে পুনরায় স্মৃতিমেদুর করে তোলে। পয়লা বৈশাখ বাঙালি জীবনের এক শ্রেষ্ঠ দিন। সারা বছরের তিক্ততা ভুলে একে অপরের উদ্দেশ্যে বিদ্বেষ ভরা বন্ধুত্বের ডালি ঝেড়ে ফেলে,নতুন করে ভালোবাসায় ডালি ভরিয়ে তোলে। প্রকৃতিও তার সাথে সঙ্গ দান করে।কিন্তু হায়! এ কোন রূপে এসেছে আজ পয়লা বৈশাখ। বৈশাখ সে তো অন্ধকারের মায়াজাল কাটিয়ে আলোয় ভুবন ভরিয়ে তোলে।কিন্তু আজ তার মায়ারূপ কোথায়!!
পৃথিবী বিশ্ব ঢেকে গেছে মোহাচ্ছন্ন কুজ্ঝটিকার গ্রাসে। মানুষ অসহায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে, এ বৈশাখ তো আমাদের কাম্য ছিলনা। এ বৈশাখ আমার নয়,তোমার নয় এ বৈশাখ আমাদের কারোর নয়৷ আমাদের মৃত্যুমুখী পাপের স্বরূপ ফল ভোগ করছে এই বিশ্বপ্রকৃতি। আমরা কী দায়ী নই এই অসুস্থতার জন্য!..
তবু শেষে বলতে হয় মানুষ আশা ছাড়ে না, আশা ছাড়া বেঁচে থাকা যায়না। একদিন এই মৃত্যুরূপী খেলা  শেষ হবে। প্রাণে আবার পরশ লাগবে।সেদিন শান্ত স্নিগ্ধ পৃথিবীর মায়ারূপের প্রেমে আবার মগ্ন হবে মানুষ। আশার পথ বেয়ে নবরূপে আসবে  পয়লা বৈশাখ, এই অসময় একদিন ঠিক ফুরিয়ে যাবেই। ততদিন না হয় আমরা এই অসময় কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করি,মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে শক্ত হয়ে হাত ধরে এই অসময় কে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এক নতুন পৃথিবী গড়ে তুলি।
                       …………….. 


অসময়ের পয়লা বৈশাখ
আভা সরকার মন্ডল

সময় থেমে থাকে না। চারপাশের যাই ঘটুক না কেন বয়ে চলে নির্বিকার। এই মুহূর্তে বিশ্বের 17 লক্ষ মানুষ করোনায় আক্রান্ত । 17 লক্ষ!! ... একজন দুজন নয়। দেশে দেশে হাহাকার। ওষুধ নেই, যন্ত্রপাতি নেই হিমশিম খাওয়া দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে আমাদের রক্ত হিম হয়ে আছে। কিভাবে লড়বো আমরা,বিপুল পরিমাণ অসচেতন এবং অসতর্ক মানুষ কে সাথে নিয়ে? যেখানে  প্রত্যেকের সতর্কতা এবং প্রত্যেকের ভালো থাকাই এই অদৃশ্য ভাইরাস যুদ্ধে আমাদের একমাত্র হাতিয়ার। ক্রন্দনরত পৃথিবীতে এখন চলছে অসময়। আর এই অসময়ের হাত ধরেই এসেছে বাঙালির বড় উৎসব… পয়লা বৈশাখ।একেবারে নিঃশব্দে।
চৈত্র মাস পড়তে না পড়তেই যে উৎসবের সূচনা হয়। চৈত্র সেল এর ভিড়ে জেগে ওঠে প্রাণ। সে উৎসব আজ বড়  ম্রিয়মাণ! না বিক্রেতারা পসরা সাজাতে পেরেছেন, না ক্রেতারা একবারও ভেবেছেন কেনাকাটার কথা। শিশুদের মুখ গুলো  বড় করুণ, বড় শুকনো। নীলের উৎসব নেই, গাজনের মেলা নেই, চৈত্র সেল নেই, চৈত্র সংক্রান্তির ভাইছাতু উৎসবও বন্ধ ।নতুন জামাকাপড় নেই, পড়াশোনার চাপ নেই .... থমকে যাওয়া এক অদ্ভুত সময় তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের।আমরা কি কখনো এমন একটা অসময়ে, পহেলা বৈশাখ কাটানোর কথা কল্পনা করেছিলাম? ...করিনি।
কোথায় মঙ্গল শোভাযাত্রা,বর্ষবরণ, মিষ্টি হাতে ছুটোছুটি, ফুলে ফুলে সজ্জিত ফুলেদের ঢল? টিকটিক শব্দে ঘড়ি জানিয়ে দিচ্ছে সময় বয়ে চলার বার্তা। বাইরে কোকিল আর কবুতরের ডাক। দুটো একটা অটো টোটোর শব্দ! কাল কি খাব ...চিন্তায় দিন আনি দিন খাওয়া পরিবারগুলোর চোখ থেকে উড়ে গেছে ঘুম। পথের কুকুর গুলোর কুঁইকুঁই কান্না। কিসের পয়লা বৈশাখ? কিসের বর্ষবরণ?
 ভাইরাস মুক্ত একটি পৃথিবী দেখার আশায় দিন গুনছে মানুষ, দুটো খাবারের সন্ধানে বাইরে বেরোনোর তাগিদে ছটফট করছে মানুষ।হে  ঈশ্বর! এই অসময়ের পয়লা বৈশাখের মতো আর একটি উৎসবও যেন আমাদের দেখতে না হয়। পৃথিবী তাড়াতাড়ি সুস্থ হোক,শুভ নববর্ষ বয়ে আনুক ভালো থাকার বার্তা। সেই বার্তা যেন আমাদের সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আমরা সবাই যেন ভালো থাকি, সুস্থ থাকি, যেন প্রাণখুলে বরণ করতে পারি পয়লা বৈশাখ। বলতে পারি হাসিমুখে ... শুভ নববর্ষ।
                 …………………… 


সার কথা
লিপি সেনগুপ্ত 

সার কথাটি বুঝি এই...কথা সার হয়ে যায়! কখনো কখনো সেই কথা কোনো গাছের নীচে,মাটির সাথে মিশে যায়! তারপর? সেই সার কথা শিকড় বেয়ে চলে যায়...শাখায় শাখায়‚ পৌঁছে যায় পাতায় পাতায়‚ শিরায় শিরায়‚ রন্ধ্রে
 রন্ধ্রে ! কথা ছুঁয়ে থাকে সবুজ পাতা‚ কিছু ঝরে যায় হলুদ হয়ে‚ কিছু থেকে যায় শাখার গায়ে ! শরীর আগলে ! আর বাকি সব কথাকলি! সে কলি দিনের আলোতে পাপড়ি মেলে লাজুক মায়ায় ! গোধুলির ম্লান আলোকে ঝরে পড়ে বিরহ গাঁথায়!  প্রখর তাপে কথা হয়ে যায় পাতার ছায়া‚ শ্রান্ত পথিক থমকে দাঁড়ায়! কথায় কথায় বেলা গড়ায়, দিনান্তের কোমল তাপে বক্ষ জুড়ায়—  
সেই কথাতেই হয়তো সিক্ত‚ নিভৃত কোন পালক অবকাশ! সন্ধ্যার প্রতীক্ষায়! কথা শেষ করে নেয় পাখিরা,গাছের কোটরে‚ আধোঘুমে। তখনও কি কথা চেয়ে থাকে চাঁদের পানে? জোছনার সাথে হয়ত বাকি কথা! আনমনে! 
সব কথা সার কথা হয়ে বুনে দেয় মায়া জাল ! যা শিকড় বেয়ে পাতায় ছেয়ে ‚ বলে যায়...কথা আছে, কথা আছে...কিছু কথা তখনও  বাকি রয়ে যায়, সময়ে অসময়ে শুকনো পাতার মত ঝরে পড়ে, অবহেলা ভরে।বুকের ভিতরে না বলা কথার বেদীমূলে ! সেইখানে, সায়াহ্নে কোন দীপ জ্বেলে রাখে কেউ!দিন থেকে মাস!দিনান্তে জমে হয়ত বা কারো দীর্ঘশ্বাস!আরও আরও.... আরও কিছু  না বলা কথা,না বলাই থাকে!

 তবুও কিছু কথা সবুজে আবিরে মাখামাখি করে তাকায়! তারা নতুন দিনের হাতছানি, চেনে! নতুন ভোরের ডাকে পাখির মত, শিশুর মত, ফুলের মত নির্মল চোখে ...চেয়ে থাকে! চোখই কেবল পড়তে জানে সেই কথা!
সারকথা...সাঁঝকথা...কথকতা...নিভৃত নির্জনে...
              …………………. 


এ কোন পয়লা বৈশাখ ! 
মানসী সাহু

  পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষ  বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন।বাঙালীর সার্বজনীন লোক উৎসব।মানুষের কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত নববর্ষ। এ সময় বাঙালীর ঘরে ঘরে উৎসবের মহড়ায় ভরে ওঠে অঙ্গন— বাংলাদেশে ও এর ব্যতিক্রম নয়। বৈশাখী মেলা,হালখাতা আর মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে চলে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান। মঙ্গল খাতায় আঁকা হয় স্বস্তিক। এ বছর সবকিছু ফিকে,বেগুনীরঙের ঝুল-বারান্দা থেকে কেউ তাকিয়ে নেই ভক্তাদের দিকে,নেই পাটভক্তা ও। চড়কের মেলা এবছর আর বসবে না বুড়ো বটতলার মাঠে। দেবী লক্ষ্মী ও গনেশ  হাত ধরাধরি করে কৈলাশে মায়ের কাছে বোধ হয়। দোকান, শিল্প প্রতিষ্ঠান তালা বন্ধ। পুরোনো খাতায় ফ্যাকাসে স্বস্তিক। লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হীন,একমুঠো খাদ্যের জন্য দিশেহারা। শুরু হয়েছে অনুজীবের সঙ্গে অদৃশ্য লড়াই। তবে প্রকৃতি কিছুটা শান্ত,বায়ুতে দূষণের মাত্রা ও কম,ন্যাড়া গাছে সবুজ কিশলয়। পাখিদের কলকাকলি তে ভরে গেছে চারদিক। ঘেঁটু ফুল ফুটেছে খুব। নীল আকাশে রাঙা রাঙা মেঘেরা নৌকা বেয়ে চলেছে দূরদেশে। মাঝে মাঝে কালবৈশাখী উঁকি দিয়ে যাচ্ছে,প্রকৃতি নারী তার আপন খেয়ালে প্রিয়মুখ দর্শনে প্রতীক্ষারত—দূরতম গ্রহ থেকে কখন নামবে আগামী আলো। সকালের সূর্য কিছুটা ম্লান। দুপুরে তার নগ্ন রুপ ঠিকরে পড়ে পাথরের গায়।পৃথিবীর প্রান্তভাগ থেকে চুঁইয়ে পড়া বিষণ্ণতা দুমড়ে দেয় মানুষের মন। রাতের আকাশে নোঙর করা নক্ষত্ররা প্রহরীর মতো অপেক্ষমান—
পৃথিবীর আজ বড়ো অসুখ। মেরামত চলছে দিকে দিকে।মন ভালো নেই,বড্ড অসহায় আমরা।এ বৈশাখ উদযাপনের নয়,বিষণ্ণতার। এ নববর্ষ নিছকই মন খারাপের, রিক্ততার, নিরন্নতার,নিঃস্বতার।
                     …..…………..



বৈশাখী অপেক্ষায়
মৃণাল কান্তি দত্ত  

সময়টা বদলে গেছিল সেদিন যেদিন আমাদের ঢাকের ঘরে ঢুকে গেছিল ডিজে। সময়টা বদলে গেছিল সেদিন যেদিন আমাদের নববর্ষের ঘরে ঢুকে গেছিল হ‍্যাপি নিউ ইয়ার।
সময়টা বদলে গেছিল সেদিন যেদিন আমাদের মননের ঘর থেকে হারিয়ে যেতে থাকল বসনঝরা তুলসী মঞ্চ নিমপাতা বাটা মুড়ির ছাতু...দৃশ‍্যগুলো বদলাল ক্রমশ হালখাতার নাড়ু নতুন ক‍্যালেন্ডার  নিয়ে উন্মদনা সেরে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে পৌঁছে যাওয়া মন্দির প্রাঙ্গনে,আজ থেকে শুরু পঁচিশে বৈশাখের মহড়া! এখন শৈশব বেলা আছে শৈশবতা নেই। এখন বৈশাখ আছে এসো হে বৈশাখের মন কেমনিয়া সুর নেই। অসময়ের সময় শুরু সেই থেকে…   
আমরা ভুলে গেছি শেষ কবে আমাদের চোখ পার্থক্য খুঁজেছে মাঘী আর চৈতালি চাঁদনি রাতের! আমরা ভুলে গেছি চৈত্র সংক্রান্তি দিনের পিতৃতর্পন গাজনের গান আগুন পাঠ। আমরা ভুলে গেছি সেই পথ যে পথে যেতে যেতে কোনোদিন চাঁদ উঠেছিল গগনে! সরলতাগুলোকে খুব সহজে মেরে ফেলা ঐই আমরা কি চাই? আমরা জটিল হবো আর প্রকৃতি সরল! আমাদের ভোগ বিলাসিতা চরিতার্থ করতে নির্মম নিষ্ঠুর হবো আর প্রকৃতি থেকে যাবে নাটক চরিত্রের দয়াময়ি। 

দেওয়ালেরও পিঠ ঠেকে দেওয়ালে। সময় এসেছে নিজের মুখোমুখি হওয়ার ভাবুন এতোদিন প্রকৃতি আপনার ভুল ধরাতে বকাঝকা করেছিল মাত্র। সময়ে বৃষ্টি না দিয়ে অসময়ে বন‍্যা দিয়েছে। অভিমানে শরতের আকাশ পরেনি তোমার পছন্দের নীল শাড়ি। আপনার পছন্দের রিতু ধরা দেয়নি সহজ সাবলীলে।এবার ভুল ধরাতে নয় আপনাকে মেনে নিতে না পেরে ঘোষনা করেছে যুদ্ধের এ আপনার কাছে ভাইরাস হলেও তাঁর কাছে অস্ত্র  শুধু ঝনঝনানির শব্দে পুরো পৃথিবী আজ আতঙ্কগ্রস্ত যুদ্ধ শুরু হলে কিন্তু… 

একটা পাহাড়ের নীচে দাঁড়িয়ে আমরা কতটা ছোট্ট একটা সমুদ্রের কাছে দাঁড়িয়ে আমরা কতটা অসহায় অনুভব করি। বৈশাখ আবার আসবে এবং ভীষন ভাবে আসবে প্রখর দারুন দগ্ধ দিনের শেষে দখিনা বাতাসের গন্ধ মেখে আপনার পছন্দ সই শাড়ি কখনো কালোটিপ পরে  সমস্ত গ্লানি মুছে দিতে সে শুধু আসবে না ধরা দেবে আপনার বৈশাখী হয়ে। আপনি শুধু প্রেমটা জাগিয়ে রাখুন….
              ………………… 


গৃহস্থ বৈশাখ
অঞ্জন দাস    

দিন পেরোতেই প্রথম বৈশাখ। প্রতিবছর প্রস্তুতি হতো গতকাল থেকে।মানে চৈত্র শেষ সকাল।ভোর ভোর উঠে গ্রামের পূর্বপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালে বড়রা সূর্য প্রণামে যেতো, সঙ্গে থাকতো চুনামারা,দো-ফাসলা  জাল ও জালগুড়ি (বাঁশের ফ্যারেটির গোল বাঁট থেকে নেমে যাওয়া ছুঁচলো জাল)।গ্রামে সবার পুকুর নেই তারা ও যাদের আছে সবাই এক হিড়িকে সংগ্রহ করতে যেতো বিশেষত শোল মাছ।সূর্য প্রণাম সেরে বেলা ১১টা অবধি জাল পেটাতো। পয়লা বৈশাখ শোল মাছ আম অন্য এক মজা। এদিকে গৃহস্থ মায়েরা ঘরের চারদিকের পরিত্যক্ত ময়লা জ্বালানি স্তুপিকৃত করতেন। সারাদিন অরন্ধন,মুড়ির ছাতু, গুড়, কলা,বাতাসা, ফলমূল ইত্যাদি এদিনের খাওয়ার। বিকেলে চড়ক দেখা সঙ্গে চড়কের ব্রত সন্ন্যাসীর  ছোঁয়া খড় আনা হতো।সে এক অদ্ভুত আবেগের দিন।
সারারাত ঘুম নেই, রাত যেন বড় হয়ে গেছে।সকালের আগে গুনগুন গল্পে মায়ের মিষ্টি রাগ মনে পড়ে।কখনো ভোরের দিকে ঘুমিয়ে গেলে মা ঠিক ডেকে দিতো। না ডাকার যন্ত্রণা মায়ের অভিজ্ঞতায় ছিল ও খুব । 
খুব ভোরে আগের দিনের জড়ো পরিত্যক্ত স্তুপে সন্ন্যাসীর ছোঁয়া খড় দিয়ে  আগুন জ্বলিয়ে তার চারপাশে ধোঁয়া নেওয়া হতো। হুল্লোড়ে বড়দের মস্করা শুধু আনন্দ কোন ভয় সঙ্কোচ নেই ।সেই প্রথম দিনের এত খোলামন আমাদের সারা বছরের প্রত্যাশায় থাকে। সকলের নতুন পোশাক।দূর্গা পুজোর না পাওয়ার কোন যন্ত্রণা কাজে আসতো না। এটাই আমাদের প্রিয় উৎসব। সকলেই বাড়িতে থাকতেন। প্রসঙ্গে বলি মা ঠাকুমারা সেই  ধুনির ভেতর দা পুড়িয়ে ঠাণ্ডা হওয়ার আগের গরম আমাদের পেটে ছেঁকা দিতো। হুমকি দিতো গতদিন গুঁড়ি খেয়েছো ভুড়িতে ছেঁকা নিতে হবে তা না হলে শোল মাছের টক দেওয়া হবেনা। অগত্যা ছেঁকা নিতে হতো। রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তা করা হতো।
পবিত্র সংগ্রহ খড়ের সঙ্গে খড় মিশিয়ে ভেজানো খড় বিভিন্ন বীজের চাটিতে(মাটি কোপানো জায়গা) ছড়ানো বীজের ভেজা জায়গায় চাপাতো বেশির ভাগ বাড়ির পুরুষেরা।  মায়েরা তুলসি লাগাতো। তুলসী মঞ্চে কিছুটা ভাড়ি তৈরি ভারিতে ঝোলানো হতো নতুন মাটির হাঁড়ি। যার একদম তলায় ছোট ফুটো, দূর্বাঘাস গোঁজা থাকতো। তাতে সারা বৈশাখ জলদেওয়া হতো। যাকে বলাহয় "বসনঝরা" আমাদের পবিত্র একটি শব্দ। 
ঠিক ১০টার পরে পুকুর ঘোলানো মাছ ধরবার ধুম পাঁক নিয়ে খেলা ক্ষুদ্র বড়ো সব গাছের গোড়ায় মাটি দেওয়া চিরকালের প্রথা। এর সাথে সপ্ত ব্যঞ্জন। সাথে  থাকতো নানা ধরনের সংগ্রহ শাক ছোট বড়ো মাছের বিভিন্ন পদ নাম সপ্ত হলপও কিন্তু চোদ্দ ব্যঞ্জনই হতো সঙ্গে মিষ্টি দই পায়েস। প্রথা সারাবছর ভালো চলবে। 
আমাদের সব প্রথা সব আনন্দ সব ইচ্ছে ইচ্ছেই থেকে যাক। আমাদের মুক্তির সময়ে আমরা সবার হয়ে থাকলাম একা একা। সকালে বাড়িতে ফেরত  আসতে পারেনি। কেরলে অনেকে আছে আছে যে যার মতো বিভিন্ন জায়গায়। ওরা ভালো আমরা ভালোভাবে থাকলে আমাদের বৈশাখ আবার নতুন হবো সবাই সকলের।        
                 ………………..      



                                অসময়ের পয়লাবৈশাখ
মঞ্জীর বাগ

একটি ফুলকে ভয় পাওয়ার কথা জানা ছিলনা। দিন ফুরলেই নতুন বছর আমাদের ফুলের প্রয়োজন অনেক। কয়েক মাসে একটি ফুলের দাপটে পৃথিবী সভ্যতা নিজের মুখ দেখতেই ভয় পাচ্ছে। এই ফুলেরসৃষ্টি করেছে তো মানুষই। মানুষের লোভ। ফুলই সভ্যতাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী জমে থাকা ক্লেদকে নিজের আয়নায় দেখতে বলছে, সভ্যতাতুমি দেখ নখচুল সমেত তোমার চেহারা কি রকম। আকাশের রঙ দেখ গাছের পাতায়  দূষণের রঙ দেখো।

সংক্রান্তির আগের দিন আমাদের বাড়ি পরিষ্কার করে সব ঝাঁটিয়ে ঝুঁটিয়ে এককোনে সব পুড়িয়ে ফেলা হতো। পয়লাবৈশাখের সকাল বেলা থেকে একটু নতুনের স্বাদ পাওয়া যেত। মিষ্টিমুখ গানবাজনা একটা নতুন জামা তাবড় গুরুজনদের প্রনাম। একটু আলাদা দিন। নতুন বছরের আশা আকাক্ষা। ভালো যেন কাটে এই আশায় দু-একটি পদ বেশী।

বাঙালি রবিবারের ভাত ঘুমের পর একটু ডিও মেরে একটু ঘুরে আসতে যেমন ছকেবাঁধা নিশ্চিন্ত জীবনের অভ্যাসে বাঁচতে ভালো বাসে।পয়লা বৈশাখ তেমন হলেই বাঁচা যেত।এখনকার ছেলেমেয়েরা বলে একলা বৈশাখ।

একলা বৈশাখ দেখে নিতে হবে, প্রকৃতি যেন তাই আমাদের  দেখানোর জন্য একটা মৃত্যু নামক স্লাইড শো র টাইম শিডিল ঠিক করে দিয়েছে। আমেরিকা নামের একটা দৈত্য এই ফুলের দাপটে ধরাশায়ী। চিকিৎসা নামের অহংকার  চুরচুর হয়ে যাচ্ছে। এমন এর দাপট মানূষ মানূষকে ছুঁতে হয় করছে। অসুস্থ হলে তোমায় অবিশ্বাসী চোখে পৃথিবী দেখবে। কারন এই মরণের মারণ নেই।

মহাভারতের আঠের দিনের যুদ্ধ শেষ। চিতা জ্বলার শেষ নেই। এযুদ্ধের কারণ কি অনৈতিকতা মানুষের লোভ। মানূষ যত সমৃদ্ধির পথে হাঁটে ততই  তার লোভ বাড়ে, পাপ বাড়ে।এযুদ্ধ নিয়ন্ত্রনের ইচ্ছা কি যদূপতি কৃষ্ণ করেন নি। মুষল পর্বে দেখি কূশ ও মূষল হয়ে মানব সভ্যতা ধ্বংস করছে।

একটি ক্ষমতালোভী দেশ জৈব মারণাস্ত্র  পৃথিবীকে স্তব্ধতার নতুন রূপ দেখাচ্ছে।ঘরের ভেতর মানুষ থাকছে ভাঙছে অর্থনৈতিক রেখাচিত্র।প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানবসভ্যতার চরিত্র মানবচরিত্র  বদলেছে। মানব সম্পর্কের ধরণ বদলেছে। সম্পর্কের বিশুদ্ধতা বদলেছে বানিজ্যে।

আমরা এখন এক নিঃশব্দ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখছি। পৃথিবীর মহাকায় দেশ গুলি মৃত্যু মিছিলে অসহায়।কাজ নেই খাদ্য নেই চিকিৎসা নেই। লকডাউন শেষ হবে কবে জানা নেই। আমার পাশের বাড়ির লোকটা খেতে পাচ্ছে কিনা জানা নেই। আমাদের কি জানা আছে? কত মানুষ মরে গেল? পৃথিবী ধ্বংসে প্রান্ত গ্রামে বসে  নিজেকে দেখছে সে কি এ কথা ভাবছে সভ্যতার লকলকে জিভ জীবনকে নষ্ট করেছে।
এখন জীবন ও মৃত্যু হাত ধরাধরি করে হাঁটছে।মৃত্যুর নিশ্বাস জীবনের ঘাড়েই পড়ছে।
তবু কি আশ্চর্য  দেখো, মানুষ ঘরের ভেতরই বলে দূষণ কমছে। বাতাস নির্মল হচ্ছে। পাখিদের দেখা যাচ্ছে। ক্যাঙ্গার হরিণ রাস্তায় চরছে। তবে কি আমরাই  দূষণ?
আজ পয়লা বৈশাখে যে প্রদীপটি জ্বালবো সেটি পৃথিবীর সুস্থতার জন্য। সবুজ গ্রহ তোমায় সুস্থ দেখতে চাই। প্রতিটি প্রাণের জন্য তোমার সুস্থ থাকা জরুরী। বসনঝরা দিলাম প্রতিটি ঘাস ফুলপ্রতিটি গাছের জন্য। বড় তৃষ্ণা তোমার জল দিই শূদ্ধতার জল, প্রাণময়তার জল, নির্মলতার জল
আজ উৎসব থাক। দুরত্বই আমাদের সুস্থতা হোক। প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে আজ প্রাণের জন্য প্রার্থনা করি।
এভাবেই  এবার এসো অসময়ের একলা বৈশাখ।
                 ……………… 



অসময়ের বৈশাখ
 সুজাতা চক্রবর্তী

বাঙালি জাতিসত্তার এক গুরুত্বপূর্ণ দিন পহেলা বৈশাখ । সম্রাট আকবরের সময় থেকে খাজনা আদায়ের মাস বৈশাখ থেকে শুরু হয়েও বর্তমানে তা পরিবর্তিত হয়ে প্রাণের মেলার উৎসবে পরিণত হয়েছে। কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বলেছেন "বৈশাখে অনলসম বসন্তের খরা।
তরুতল নাহি মোর করিকে পসরা
পায় পোড়ে খরতর রবির কিরণ।"
এই দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি  ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত। বৈশাখের প্রথম দিনে মন্দিরে মন্দিরে মানুষের ঢল, শোভাযাত্রা, হালখাতা খোলা বিভিন্ন কর্মকান্ডের ফলে জনসমাগম দেখা যায় রাস্তার অলিগলিতে। মহামারীর বিভীষিকায় রাস্তাঘাট নীরব,নিস্তব্ধ,জনকল্লোলহীন হাট-মাঠ। মন্দিরে সম্মিলিত হওয়ার কল্পনা ও নতুন বস্ত্র পরিধান করার ভাবনাকে যেন 'উষর মরু ধূসর গগন যেমন হেরে মেঘের স্বপন' এর মতো অলীক মনে হয়। হালখাতা বোধ হয় নির্বাসিত ই থাকবে! যেখানে সাধারণ মানুষ পরের দিনের অন্নসংস্থান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে, যেখানে দুমুঠো খাদ্য জোগাড় করা ও উপযুক্ত খাদ্য খেয়ে, সঠিক নিরাপত্তা নিয়ে মারণ ব্যাধির বিরুদ্ধে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া অনেক মানুষের কাছে দূরপরাহত । সেই অবস্থানে দাঁড়িয়ে হালখাতা , মিষ্টি বিতরণকে কল্পনাবিলাস ও ক্রুর ভাবনার সম্মিলিত এক বোধ বলেই মনে হয় ।
       
গ্ৰীষ্মের পদচারণায় বৈশাখের আগমনে বৈশাখের প্রথম দিনে কাকভোরে উঠে আত্মীয় পরিজনকে মেসেজে 'শুভ পয়লা বৈশাখ' লেখার থেকেও পরস্পরের কুশল সংবাদ বিনিময় করে বিশ্বে ত্রাস সৃষ্টিকারী মহামারী সম্বন্ধে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে আরো বেশী ওয়াকিবহাল হওয়াই হবে এই দুর্দিনের ঘনঘটাময় পরিস্থিতিতে। পহেলা বৈশাখ দিনটি যতটা ধর্মীয় অনুভূতিসিক্ত,তার চেয়ে বেশী গুরুত্ব বাঙালির সর্বজনীন সংস্কৃতির দিন হিসাবে। ঋতুরাজ বসন্তের ছোঁয়া লেগে থাকে গ্ৰীষ্মের গায়ে।কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, স্বর্ণচাঁপা,কুরচি,নাগকেশর, হিজল,জ্যাকারান্ডা ইত্যাদি ফুল রঙে রঙে প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে, বৈশাখের পুষ্পবীথির রঙ এতটাই আবেদনময়ী হয়ে ওঠে যে চোখ ফেরানো যায় না। কিন্তু মারীর পাশাখেলায় আজ মৃত্যুর কত রকমের রং হয় প্রত্যেক মানুষ অবহিত সে সম্পর্কে , মৃত্যুর বীভৎসতা কী ধরনের হতে পারে তার চরমতম নিদর্শন বোধ হয় এই ভয়াল মারী দেখিয়ে দিচ্ছে।শীতে , বসন্তে প্রকৃতিতে যে রুক্ষতা দেখা দেয়, বৈশাখে সেই রুক্ষতায় দেখা দেয় সবুজ সতেজ প্রাণ ।
    "আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
     আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে।" 
বিপন্ন বিস্ময় আমাদের প্রাণের হিল্লোলে থাবা বসিয়েছে ‌।এ যেন বৈশাখ নয় , বৈশাখ আসার এ যেন উপযুক্ত সময় নয় । বৈশাখের ধ্বংস রূপ নতুন বছরের আগমন সৃষ্টিকে নতুন রূপে উৎসাহিত করে, নতুন সম্ভাবনার প্রত্যাশায় নতুনকে বরণ করার রীতি বাঙালি বর্ষবরণ উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন করে ।আজ যেন তাপস গ্ৰীষ্মকে সাথে নিয়ে বৈশাখ নয় ... মৃত্যুর রূঢ় বাস্তবতা অনাহুতের মতো দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছে । তবু আশার সুর বলে যায়--"ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর /প্রলয় নূতন সৃজন বেদন " ।কত শ্রমিক,মজুর কাজ হারিয়ে নিরুপায় ।ওই শিশুশ্রমিক যে পেটচুক্তি হারিয়েছে তার করুণ দিনগুজরান ,মন্দার কলরোল ,মানব অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা অসময়ের এই বৈশাখে অদৃশ্য কালবৈশাখী ঝড়ের মতোই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সহাস্য বদনে ।বিপন্ন মানবসমাজ কে জাগিয়ে রাখার , বাঁচিয়ে রাখার অনন্ত প্রয়াস চলছে বিশ্বে । এই জীবনযুদ্ধে মনোবল অটুট রাখা অনিবার্য। তাই নতুন বঙ্গাব্দ কে স্বাগত জানানো এখন আর উৎসব নয় , জীবনযুদ্ধ জয়ের শপথ । জনসমাবেশ ঘটিয়ে নয় গৃহে অবস্থান করেই এই শপথে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়েই ঘটুক বর্ষবরণ। আগত বৈশাখের এই অসময়ে লেখনী তথা সৃষ্টিকর্ম দ্বারা বৈশাখের জয়গান নয়, এই চরম সময়ে মানুষকে শিল্পকলার দ্বারা ভয়ংকর ,মারণ ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করার প্রয়াসের মাধ্যমে যথার্থ বরণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে । এ বরণ মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনকে বরণ, বেঁচে থাকার প্রেরণাকে বরণ ।কবি বলেছেন-
"মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি
বাঁচিয়া গিয়েছি বিধির আশীষে অমৃতের টীকা পরি।"
গ্ৰীষ্মের তাপপ্রবাহে মানুষ যেমন তটস্থ থাকে। দীর্ঘ খরায় অনেক সময় হাহাকার অবস্থা চলে।এক ফোঁটা--স্বস্তির বৃষ্টির জন্য প্রহর গোনে তেমনি মানব ও প্রকৃতির অবস্থার শাশ্বত ঘূর্ণনে সেই মহামারী মুক্ত ভোরের অপেক্ষায় আমরা অর্থাৎ বিশ্বের প্রতেকটি মানুষ অপেক্ষা করব সেই ভোরের জন্য । নতুন ভোর আসবেই ....কারণ গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গিয়েছেন ....
"মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে।"
                      ………………. 



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - সুকান্ত সিংহ
চিত্ররূপ - ফেসবুক
ঠিকানা - সুরতপুর, হরিরামপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614

ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...