Tuesday 27 June 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ২৫

 



রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ২৫

সুদূরের পিয়াসী

মহাশ্বেতা দাস



   মুক্ত প্রকৃতির ক্লান্তিহীন পথিক রবীন্দ্রনাথ। তখনও সংসারের জন্য অর্থ উপার্জনের গুরু দায়িত্ব ঠাকুর বাড়ির ছেলেদের কাঁধে সেভাবে ভর করে নি। আপন মনে কবিতা, গান লেখা, বন্ধুদের সাথে সাহিত্যের আড্ডা, মেজ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী দেবী সম্পাদিত "বালক" পত্রিকায় শিশুদের উপযোগী গল্প, কবিতা, নাটক প্রভৃতি রচনায় ভরিয়ে তোলা এভাবেই রবি যাপন করছেন খামখেয়ালী জীবন। এককথায় সৌন্দর্য্য ও শৌখিনতায় কলকাতা শহরের যুবকদের অনুকরণ ও ঈর্ষার পাত্র রবীন্দ্রনাথ।


    পশ্চিম ভারতের রোমান্টিকতা রবির কবিমন কে আকর্ষণ করতো খুব। গাজিপুরের গোলাপ ক্ষেতের সৌন্দর্য্য কবিকে বিশেষ ভাবে টানত। তাই হঠাৎই একদিন একবছরের মেয়ে বেলা আর মৃণালিনী দেবীকে নিয়ে চলে এলেন গাজিপুর। যদিও যে মোহ নিয়ে এসেছিলেন…. "ব্যবসাদারের গোলাপক্ষেত" দেখে ভেঙে গেল সে মোহ! কঠিন বাস্তবতায় প্রকৃতি পিপাসু কবি অনুভব করলেন এখানের গোলাপ বনে "বুলবুলের আমন্ত্রণ নেই, কবির ও নেই।"   তবু কল্পনা প্রবণ স্বভাব কবি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখে ফেললেন শিশু কাব্যগ্রন্থের এবং মানসী কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা। 

    

  ১৮৮৯ সাল….. এখন আর বেলা একা নয়। মৃণালিনী দেবীর কোল আলো করে এসে গেছে রথীন্দ্রনাথ। মহর্ষির ও বয়স হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই জমিদারির দায়ভার গ্রহণের সময় এসে হাজির। জমিদারি দেখাশোনার জন্যই এবার রবিকে কলকাতা ছেড়ে যেতে হলো শিলাইদহ। উত্তর বঙ্গের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আস্বাদন করার বড়ো সুযোগ পেয়ে গেলেন রবি। জমিদারি দেখাশোনার পাশাপশি এখানকার প্রকৃতি, সাধারণ মানুষের সান্নিধ্য রবির সাহিত্য রচনার সহায় হলো। 

 

        "তোরই হাতে বাঁধা খাতা

               তারই শ-খানেক পাতা 

        অক্ষরেতে ফেলিয়াছি ঢেকে।" 

  

     ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ কে উৎসর্গ করলেন সাজাদপুরের নির্জন কুঠিতে বসে লেখা "বিসর্জন" নাটক। এরপর বোলপুরের প্রাকৃতিক পরিবেশে কিছুদিন কাটিয়ে সোলাপুরে মেজদাদার কাছে গিয়ে যেই শুনলেন বন্ধু লোকেন পালিত আর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ বিলেত যাচ্ছেন!.... "সুদূরের পিয়াসী" কবি চঞ্চল হয়ে উঠলেন, তাদের সঙ্গী হলেন। 


    ১৮৯০ সালের ২২শে আগস্ট "শ্যাম" জাহাজে চড়ে তিনজনে পাড়ি দিলেন বিলেতের উদ্দ্যেশ্যে। এডেন বন্দরে যেদিন পৌঁছলেন… জ্যোৎস্না রাতের নিস্তরঙ্গ সমুদ্র শোভা মোহিত করলো কবিকে। আইওনিয়া দ্বীপের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে আর বিচিত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আস্বাদন করতে করতে ১০ই সেপ্টেম্বর লন্ডনে এসে কবির ইচ্ছে হলো কৈশোরের পরিচিত লন্ডন কে ফিরে পেতে।  


     "দূরে বহুদূরে

          স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে

  খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রা নদীপারে

      মোর পূর্বজনমের প্রথম প্রিয়ারে।" 


    প্রায় এক যুগ পরে এসে রবি খোঁজ করলেন সেই বাড়ি… সেই স্কট পরিবারের। কিন্তু তখন আর কে কোথায়! সে বাড়িতে থাকে তখন অন্য ভাড়াটিয়া। 

     

      কৈশরে দেখেছিলেন লন্ডন শহর কে কিশোরের উদ্দীপ্ত চোখ দিয়ে। এবার যুবক রবি যৌবনের উদ্দীপনায় লন্ডন শহর এবং সেখানকার পরিবেশ, রীতিনীতি কে আস্বাদন ও অনুধাবন করলেন নব রূপে। তবে রবীন্দ্রনাথ কখনও নিজস্ব পোশাক ত্যাগ করে বিলিতি পোশাক পরেন নি। এখনকার ঐশ্বর্য্য ও বিলাস বহুল জীবন চর্যায় রবির অভিজাত মন যেমন মুগ্ধ হয়েছিল তেমনই এই বিলাস বহুলতার পিছনে যে গভীর দুঃখ লোক চক্ষুর অন্তরালে আপাত অদৃশ্য ছিলো… সেটিও রবির অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে নি।

  

     দেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার জন্যে যতখানি ব্যস্ততা…. খামখেয়ালী কবিমন ঘরে ফেরার জন্যে ঠিক ততটাই ব্যাকুল। তাই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ঠিক করলেন দেশে ফিরে আসবেন একাই। ৭ই অক্টোবর "টেমস" জাহাজে চড়ে মলাট দ্বীপ, বিখ্যাত catacomb প্রভৃতি দেখতে দেখতে ৩রা নভেম্বর দেশের মাটিতে ফিরে এলেন। আর এই দ্বিতীয়বার বিলেত সফরের দরুণ বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ হলো "য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরি" র মতো মূল্যবান সাহিত্য সম্পদে।  

           ………………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Saturday 24 June 2023

মানসী সাহু র কবিতা // ই-কোরাস ১৩৪

 



মানসী সাহু র কবিতা

১.

তেপান্তরের মাঠ


     সাঁকো পেরিয়ে স্যাঁতস্যাঁতে লাইটপোষ্টে

               ঝুলছে বিশ্বাস

     বিবর্ণ অপেক্ষায় নিরুত্তাপ

     সন্ধ্যাকালীন হাট।

     কুয়াশা ভেজা ঘাসে হেঁটে যাচ্ছে

               বিগত প্রেম ও প্রত্যয়।


     প্রিয়তম নদী-

     অনেক ব্যর্থতা পেরিয়ে

     গভীর গোপন জলজ ইতিহাস

     লিখেছো তুমি

     চারিদিকে ছাই রঙা সকাল

     নেই হলুদ পাতার ঘৃণা

     ডেকে নিয়েছি 

     আমাদের একান্ত আজান।



২.

অবসর


        পোড়ামাটি জানে ধ্বংসের দেশ

        মৃত জনপদ ফসলের লোভে-

        ঘুমন্ত মেয়েটিও রোপন গন্ধ ফেলে

        জীবাশ্ম সরগম।


        দ্রাবিড় দহন-

        ভোজন গানের বিস্তৃতি ক্ষত

        গন্তব্য বিমুখ শ্যাওলার স্বাদ

        পরিত্যক্ত দালানে

        শূন্যতা ফেরে ঘোর।

         

৩.

আদিম গন্ধ গ্রাম


       আগুন ছিটানো চিরহরিৎ প্রেম

       ঘাড় গুটিয়ে নিয়েছে পাহাড়ী খোলা

       তবু রহস্য কুয়াশায় নিরুচ্চার

       শব্দ গুঞ্জন

        সংক্ষিপ্ত স্বীকারোক্তি,

      ক্রমশ পিছতে পিছতে কিনারা ভাঙি দিন-রাত

         

        বিলুপ্ত পাখির ঠোঁটে আদিম গন্ধ

        নি:শর্ত নিশ্বাসে ক্রমশ বেড়ে ওঠে শীতজ্বর



৪.

যৌথ জন্মান্তর


         শব্দ দ্রাঘিমায় যে নাম উল্লেখে

         হতাশ পাখনায় মেলে দাও ব্যার্থ উড়ান

         সেখানে কোনো উদ্বেগ নয়,আগ্রাসণ নয়,

         একাধিপত্য নয়-তুমিই একান্ত বিজয়ী-

         শুধু স্বমহিমায় হতে চাই লোহিত সাগর

         ব্যুহ ভেদ করে চতুরঙ্গ সাথে

         আশায় আমিও ধরি গান্ডীব

         কোনো সংশয় নয়

         অজ্ঞাতবাস কেনই বা শ্রেয়!

         আছে অনন্ত প্রেম

         আছে অখন্ড নিবেদন

         নিশ্চিত রেখেছি তোমারই জন্য

         কৌরব নয়, অর্জুন ভেবে

         প্রতি ভোরে সাজিয়ে রাখি

         কাঙ্খিত আয়ুধ

         তবে আর দ্বিধা নয়, সংযম হোক

         হোমাগ্নি ব্রতে যৌথ আহুতি।



  ৫.         

জ্যোৎস্না - শ্রাবণ


           নির্ঘুম দোরে চাঁদ

              গল্প পালক

          সে উঁকি দিলে-

         শরীর জ্যোৎস্না রাত

           নদীর শ্রাবণ এলে

         পাখির ডানায় মেঘ- আশ্রয়


            সমস্ত উজাড়

          অজস্র দুপুর পড়ে

             স্পন্দহীন

           শিলাই ওপার।

             …………….


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


Tuesday 20 June 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ২৪


 রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব- ২৪

নক্ষত্র পতন

মহাশ্বেতা দাস



      রবির বিয়ের পাঁচমাস যেতে না যেতেই ঠাকুর পরিবারের উপর দিয়ে তো বটেই রবীন্দ্র জীবনেও বয়ে গেল এক বড়সড় ঝড়। যে ঝড় অনেকখানি লণ্ডভণ্ড করলো কবি হৃদয় এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা। সাহিত্য সৃষ্টি, সমালোচনা, সঙ্গীতের জগৎ এসব তো বাইরের জগতে আচ্ছন্ন কিন্তু পারিবারিক সমস্যা, স্নেহ, অন্তরঙ্গতা, সখ্যতা… এসব তো মানুষ রবীন্দ্রনাথের একান্ত মানসলোকের কথা! সেখানে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই দুঃখ আছে, যন্ত্রণা আছে….আছে স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথা। 


    রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘ জীবনে মৃত্যু দেখেছেন অজস্র। স্বজন বিয়োগ বারেবারে ভারাক্রান্ত করেছে কবি হৃদয়। স্বল্পায়ু অনুজ বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু এবং মাতৃবিয়োগ (সারদা দেবীর মৃত্যু) সেভাবে অনুভব করতে পারেননি কারণ তখন কবির বয়স ছিল খুবই অল্প। তবে যে মৃত্যু কবিকে জীবনের প্রথম মৃত্যুর নিষ্ঠুরতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো ..... দীর্ণ বিদীর্ণ করলো কবিহৃদয়কে পরম বিচ্ছেদের বেদনায়!!- তা হলো তাঁর নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর অকাল প্রয়াণ। 

      

        কৈশোরের খেলার সাথী, যৌবনের লীলা সঙ্গিনী.... রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রধান অনুপ্রেরণা ও সমঝদার রবি জীবনের ধ্রুবতারা নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর এই মৃত্যু সম্পর্কে তিনি বলেছেন....


''আমার ২৪ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইয়াছিলো তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদ-শোকের সঙ্গেই মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাথিঁয়া চলিয়াছিল।"


       কবির মনের মণিকোঠায় চিরকালের জন্যে অধিষ্ঠিতা এই নারী  তাঁর হৃদয়কে অত্যন্ত গভীর ভাবে স্পর্শ করেছিল।

   ১২৯১ বঙ্গাব্দের ৮ বৈশাখ, ১৮৮৪ খিস্টাব্দের ১৯শে (মতান্তরে২১ শে) এপ্রিল কী এক গভীর অভিমানে স্নেহের দেবর রবি কে ছেড়ে প্রিয়তম স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কে ছেড়ে না ফেরার দেশে  পাড়ি দিলেন রবির অতি প্রিয় এবং শ্রদ্ধার পাত্রী নতুন বৌঠান কাদম্বরীদেবী। এই মৃত্যু কবি আমৃত্যু ভুলতে পারেন নি...


      ''তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।

         যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায়   

                 নব প্রেম জালে।

            যদি থাকি কাছাকাছি,

   দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি--

                   তবু মনে রেখো।" 


     কাদম্বরীদেবীর মৃত্যু রবীন্দ্র জীবন জিজ্ঞাসায় এক অনিবার্য কৌতূহল। রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষ থেকে রবীন্দ্র গবেষকদের মধ্যে এই মৃত্যুর কারণ নিয়ে একাধিক মত বিনিময় করতে দেখা যায়। ঠাকুর বাড়ির তরফ থেকে পারিবারিক সম্মানের কথা চিন্তা করে এই মৃত্যু রহস্যকে অনেকখানি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল চিঠিপত্র থেকে কাদম্বরীদেবীর লেখা সুইসাইড নোট পর্যন্ত। তাই সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয় নি আজও।তবু…. সুনয়না দেবী এবং ইন্দিরা দেবীর মতে আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। কাদম্বরীদেবী ছিলেন মানসিক অবসাদের রুগী। নিঃসন্তান জীবনে এই মানসিক অবসাদ মাথা চাড়া দেওয়ার সুযোগ পেত খুব। স্বর্ণময়ী দেবীর ছোট মেয়ে ঊর্মিলার দেখাশোনার ভার নিজেই নিয়েছিলেন কাদম্বরীদেবী। ঊর্মিলার সঙ্গ তাঁর নিঃসন্তান জীবনে কিছুটা হলেও প্রলেপ লাগাতে শুরু করেছিল। কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস!!! এক বছর যেতে না যেতেই তেতলার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়ে মারা যায় ঊর্মিলা। নিঃসন্তান বলে মহিলা মহলে নানা কটুকথা শুনতে তো হতই…. ঊর্মিলার মৃত্যু এই অবসাদে আরও ইন্ধন যোগালো…. নিজেকে অপরাধী মনে করতে লাগলেন তিনি। তাঁদের নিঃসন্তান পরিবারে রবির উপস্থিতিও অনেকখানি ভরিয়ে রাখতো। রবিও মাতৃ বিয়োগের পর থেকে আঁকড়ে ধরেছিলেন বয়সে কয়েক বছরের বড়ো নতুন বৌঠানকে। রবি পড়াশোনার জন্য দ্বিতীয়বার বিলেত যাওয়া মনস্থির করে রওনা দিলে কাদম্বরীদেবী সেই সময়ে একবার আত্মহননের চেষ্টা করে বিফল হয়েছিলেন…. রবি ফিরে এসেছিলেন….. বিলেত যাওয়া হয়ে ওঠেনি সে যাত্রায়। এছাড়া শোনা যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোব্বার পকেটে পাওয়া গেছিলো তখনকার এক বিখ্যাত অভিনেত্রীর চিঠি। অনেকে মনে করেন স্বামীর এই অবৈধ সম্পর্কই ছিল কাদম্বরীদেবীর মৃত্যুর আসল কারণ। ঠাকুর বাড়িতে প্রায়ই কাপড় বেচতে আসতো বিশু নামে এক কাপড়ওয়ালি। তাকে গোপনে টাকা দিয়ে আফিম আনিয়ে রেখেছিলেন তিনি। পরে ঐ আফিম খেয়েই আত্মহননের নেশায় মেতে ওঠেন। দুদিন ধরে ঠাকুর বাড়িতে দুজন ডাক্তার রেখে চিকিৎসা করানো হয় কাদম্বরীদেবীর। কিন্তু ডাক্তারদের অক্লান্ত পরিশ্রম, পারিবারিক বন্ধন, স্নেহশীল স্বামীর ভালবাসা , স্নেহের রবির আন্তরিক সখ্যতা.…. সবকিছুর মায়া কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত না ফেরার দেশে চলে গেলেন রবির নূতন বৌঠান। 


       "সে  চলে গেল, বলে গেল না-- 

      সে  কোথায় গেল ফিরে এল না।"


     তবে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখায় পাই রবীন্দ্রনাথের মন একজায়গায় ছিল অদ্ভুতভাবে নিরাসক্ত; কবির মতে - "ভুলিবার শক্তি প্রাণশক্তির একটা প্রধান অঙ্গ।" পুরাতন কে বিদায় দিয়ে কবি বারে বারে নূতন কে আহ্বান জানিয়েছেন। বিস্মৃতি ও অনাসক্তি কবিদের মহৎ গুণ; নইলে যে স্মৃতিভারে জর্জরিত হতে হয়…. নূতনের অভ্যুদয় হয় না! 

    

     "হেথা হতে যাও পুরাতন 

          হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে।" 

  

  কবির মতে আমরা আমাদের হারানো প্রিয়জনকে ফিরে পেতে পারি স্মৃতিভারে জর্জরিত হয়ে নয় বরং স্মৃতির আলো কে বিস্মৃতি তে রূপান্তরিত করে। আমাদের প্রিয়জন বেঁচে থাকে আমাদের প্রতিদিনের সৃষ্টিশীলতায়, নিত্য ভালোলাগায়…. ভালোবাসায়।

     

           "স্মরণের গ্রন্থি টুটে

                সে যে যায় ছুটে

            বিশ্বপথে বন্ধনবিহীন।" 

            ……………………… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


Sunday 18 June 2023

মানসী সাহু র কবিতা // ই-কোরাস ১৩৩

 



মানসী সাহু র কবিতা

১.

মা-গন্ধ


     তোমার সাম্রাজ্য বহু দূরতর গ্রাম

     একপাতা চাঁদ নেমে আসে প্রতি রাতে

     আমাকে ফিরিয়ে নেয় শ্রাবণের ধারা

     খরস্রোতা নদী চোরা স্রোতের সম্মুখে।


     সেখানে অয়ন বাঁচে ধানফুল ঘ্রাণ

     ডাহুক দুপুর ডানা স্বপ্ন অবিরল

     বিন্যস্ত বিকেল এসে পড়ে আলোয়ান

     দোহারা ললিত দেহ ফুলের সোপান।  

  

     কেবল জ্যোৎস্না টুকু অনন্ত পাওয়া

     আকাশের হাতে হাত ঠোঁট রামধনু

     একান্ত আগলে রাখি ঘুমহীন ভোর

     ফিরে পাই মা'র গন্ধ তোমার শরীর।


২.

সাত তারা উঠোন


      ধরেছো অশক্ত আঙুল

      কন্যাকুমারী সন্তাপ

      অপ্রাপ্ত অসীমে

      আক্ষেপ আকাশ

      ঘুটঘুটে আঁধার।

      দু'হাতে মুছবে কত?

      ক'দিন রাখবে ধরে

      হলুদ অঙ্গীকার?


      এখনো একটি উঠোন আছে

      স্পর্শহীন-সাত তারা

      পরের স্টেশনের নাম হতে পারে

      সুখ সন্ধি

      একটু এগোলেই

      সুদীর্ঘ অবকাশ

      কুহক কুজ্ঝটি

      তবু পেরোতে চাই

      অজানা পথ।


৩.        

তখনও বৃষ্টিকাল


      অন্তর অনুচক্রিকায় এখনও

      মন খারাপের অবশিষ্ট ভগ্নাংশ

      শীতার্ত বাতাসে ভেসে আসা

      তীব্র স্ফটিক

      পাঁজরের অবাধ্য স্বচ্ছতায়,

      নৈশব্দ নীড়ে উৎসুক

      ডানা ঝাপটানো অলক্ষ্য দুপুর

      তখনও বৃষ্টিকাল

      ঘন মেঘ জল ছল্ ছল্

      নিরুচ্চার দু'টি হৃদয় সন্তাপ।


৪.   

মহুয়া ফুল


       তবুও আয়নার গায়ে

       গলে যায় পুরানো সফর।

      

       দূরত্ব বাড়ুক-

       ওই মহুয়া নাকছাবি দেখা যায়


       জ্যোৎস্না ঝংকারে মিলিয়ে যায় শিশির

       ডাঙায় উঠে স্নিগ্ধ সাঁতার।


        জানালার ঘামে

                 শালুক পাতার ঘ্রান

         মস্ত নদীর পাড় দূরত্ব মাপক।



৫.

সিন্ধুর মেয়ে


      অবসন্ন পাঁজরে কৃষ্ণচূড়া ঠোঁট

      অন্ধকার  জ্বেলে 

      অক্ষর স্নানে আমার

      বসন্ত ইাস্তাহার।


      তবু ধানসিঁড়ি মেঘ 

      বক্ষ সংবাদ বাহক

      জলপানা পিনাক প্রকোষ্ঠ

      একতারা তার।


       হরিদ্রাভ বাদল দেশ

       বৈশাখী কন্ঠস্বর   

       সঙ্গমরত পাখি- কেবল নদী প্রবন।

               …………………… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - 9434453614

Tuesday 13 June 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ২৩

 



রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ২৩

রবি-পরিণয়

মহাশ্বেতা দাস


   "ধরাতলে দীনতম ঘরে 

 যদি জন্মে প্রেয়সী আমার, নদীতীরে

কোন এক গ্রামপ্রান্তে প্রচ্ছন্ন কুটিরে

  অশ্বত্থ ছায়ায়, সে বালিকাবক্ষে তার

  রাখিবে সঞ্চয় করি সুধার ভান্ডার

    আমারি লাগিয়া সযতনে।" 


   ছোট দেবর টি দেখতে দেখতে বাইশ বছরের হয়ে গেছে… এবার তো তাঁকে সংসারী করে দেওয়া বৌঠানদের একরকম দায়িত্ব ও কর্তব্য! জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, কাদম্বিনী দেবীর চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো এমনই সব ভাবনা। তাছাড়া জ্যোতিদাদা আর নূতন বৌঠানের ছত্রছায়ায় থাকলে রবি কোন দিনই দায়িত্ববান হবেন না, জমিদারির দায়ভার ও দেওয়া যাবে না! তাই তাঁকে সংসারী করে দেওয়া কর্তব্য…. এমন ভাবনা মহর্ষির মনেও উঁকি দিয়েছিল। আর তাই, রবির জন্যে শুরু হয়ে গেল পাত্রীর খোঁজ।  

   

    এ বিশ্ব-সংসারে রবির মতো প্রতিভাবান পাত্রের জন্য সুযোগ্য পাত্রীর অভাব অলভ্য না হলেও পিরালি ব্রাহ্মণ সমাজে এমন সুশিক্ষিত গুণসম্পন্না পাত্রী যথেষ্টই দুর্লভ ছিলো। শেষ পর্যন্ত জ্ঞানদানন্দিনী দেবী জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তার কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর মেয়ে ফুলি ওরফে ভবতারিণী কে রবির জন্য পছন্দ করে শ্বশুরমশায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কে একথা জানান। মহর্ষির সম্মতি এবং রবীন্দ্রনাথের মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী দেবীর ঘটকালিতে বিয়ের জন্য ওখানেই মনস্থির করা গেল।  

    

     দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মের প্রাণপুরুষ হলেও এক্ষেত্রে খুলনা জেলার হিন্দু বিবাহ রীতি অনুযায়ীই বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বললেন। সেসব ঠিকই ছিল..… কিন্তু রবির ইচ্ছে কন্যাহ্বানে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। অর্থাৎ পাত্র শ্বশুরালয়ে যাবে না বিয়ের জন্যে…. উল্টে পাত্রীকে আহ্বান করে নিয়ে আসা হবে এখানে। ঠাকুর পরিবারের ছোট ছেলের বিয়ে বলে কথা…. তার উপর লেখালেখিতে সে এখন  যথেষ্ট যশস্বী। দেবেন্দ্রনাথ তাই পাত্রীর বাড়ীর আত্মীয় স্বজনদের সবাইকে কলকাতায় এনে রাখলেন একটি ভাড়া বাড়িতে। গায়ে হলুদ, আইবুড়োভাত এসব অনুষ্ঠানের সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরোয়া এবং ইন্দিরাদেবীর লেখনীতে। আইবুড়োভাতের দিন রবীন্দ্রনাথ এমন জমকালো রঙের শাল জড়িয়েছিলেন ইন্দিরা দেবীর কথায়- "একে রবিকা তায় এই সাজ! সে শুধু আমরাই দেখে নিয়েছি।" অবনীন্দ্রনাথের কথা অনুযায়ী সেদিন তাঁর রবিকা কে লাগছিল 'দিল্লির বাদশা'! 


   এসবের পর একদিন অর্থাৎ ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১২৯০ ( ৯ই ডিসেম্বর, ১৮৮৩) জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে রবীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালেন অন্দরমহলে বিয়ের পিঁড়িতে। ঠাকুর বাড়ির রীতি অনুযায়ী একখানা বেনারসি শাল বংশ পরম্পরায় যেটা বর সজ্জার অন্যতম উপকরণ হতো ….  রবীন্দ্রনাথ ও সেদিন সেই শাল গায়ে জড়িয়ে বর সজ্জা সম্পন্ন করেছিলেন। 

    

     যদিও এই বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ থেকে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর মতো ঠাকুর পরিবারের অনেক সদস্য এবং রবির প্রিয়জনেরা। টুকরো টুকরো অনেক কারণের মধ্যে যে ঘটনাটি ভীষন ভাবে উল্লেখ্য… ঐ দিন শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়ো বোন সৌদামিনী দেবীর স্বামী সারদা প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় মারা যান। মহর্ষি যাকে পুত্রতুল্য স্নেহ করতেন… এই ঘটনা মহর্ষির মনে দারুণ রেখাপাত করে। 

     

      কেবলমাত্র পিরালিত্ব ছাড়া দুই পরিবারের মধ্যে কোন মিল তো ছিলই না আর রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভাবান, সুদর্শন, সুপুরুষের কাছে পাত্রী হিসেবে অতি সাধারণ ভবতারিণী তো বলার  অপেক্ষা রাখেই না! যাইহোক…. এভাবেই অত্যন্ত সাদামাটা ভবতারিণী একদিন ঠাকুর পরিবারের বধূ হয়ে এলেন। কিন্তু "ভবতারিণী" নামটি তো এখানে, ঠাকুর পরিবারে অচল! যেমন করে কাদম্বিনী দেবী হয়েছিলেন কাদম্বরী দেবী…. ভবতারিণীর ও নাম পাল্টে রাখা হলো মৃণালিনী। রবি ই তাঁর প্রিয় নাম নলিনী'র প্রতিশব্দ রূপে নাম রাখলেন মৃণালিনী। 

     

    কিন্তু শুধু নাম পরিবর্তন করলেই তো হলো না…. শিক্ষা, সংস্কৃতি সব দিক থেকেই তাঁকে ঠাকুরবাড়ির উপযুক্ত করে তুলতে হবে। রবি অগ্রজ হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী নীপময়ী দেবী দায়িত্ব নিলেন রবিপত্নীর স্বাস্থ্য ও শিক্ষার। এভাবে ঠাকুর বাড়ির তত্ত্বাবধানে এবং রবি-স্নেহে ধীরে ধীরে 'ভবতারিণী' হয়ে উঠলেন 'মৃণালিনী'। 

     

    যদিও স্বল্পায়ু ছিলেন মৃণালিনী দেবী। জগৎ খ্যাত প্রতিভাবান, ধনবান, রূপবান স্বামীর স্নেহডোর বেশীদিন তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি এই মর্ত্যলোকে! রবির স্নেহের আদরের  "ভাই ছুটি" র ছুটি হয়ে গেছিলো বড্ড তাড়াতাড়ি! …. তবু রবীন্দ্রনাথের নানান কর্মপ্রচেষ্টায় তিনি ছিলেন সহচরী, সহযোগী। রবীন্দ্রনাথের প্রাণাধিক প্রিয় শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠায় কবি সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবীর অবদান ছিল অপরিসীম।

                  …………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...