Tuesday 31 October 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৪২

 


রবীন্দ্র পরম্পরা 

পর্ব - ৪২

বিজয়া

মহাশ্বেতা দাস 



 আর্জেন্টিনার হোটেল প্লাজার এক চিলতে কক্ষে বসে রবীন্দ্রনাথ এতবছর বাদে যেমন অতর্কিতে দেখা পেলেন তাঁর কল্পলোকে বিরাজমান সিন্ধুপারে থাকা বিদেশিনী কে! ঠিক তেমনই সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যের পাঠক ভিক্টোরিয়া তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনে শান্তির খোঁজ পেয়েছিলেন যে মানুষটির লেখায়… অপেক্ষা করেছিলেন কবে দেখা পাওয়া যাবে!! আজ দশ বছর পরে অভাবনীয় এই সুযোগ তাই তিনিও হাতছাড়া করতে চাইলেন না। হোটেলের ঘরে রবীন্দ্রনাথকে না রেখে তিনি তাঁকে নিয়ে যেতে চাইলেন নিজের ঘরে "ভিলা ওকাম্পো" তে। 


     সান ইসিদ্রো তে ঝকঝকে সম্ভ্রান্ত বাড়ি "ভিলা ওকাম্পো"। কিন্তু ভিক্টোরিয়ার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল তাঁর মা- বাবা কি রাজি হবেন এই প্রস্তাবে? ঘটলও তাই….. অর্থের বিনিময়েও তাঁরা রাজি হলেন না ভিক্টোরিয়ার অন্তরের মানুষ রবীন্দ্রনাথের জন্যে নিজেদের বাড়িটি ছেড়ে দিতে। তখন ভিক্টোরিয়া ছুটে গেলেন তাঁর এই বাড়িটির কিছুটা দূরে খুড়তুতো ভাইয়ের বাড়িতে। ভাইটি অর্থ পিপাসু। ভিক্টোরিয়া ভাইয়ের সেই অর্থলোভকে কাজে লাগালেন….. বিক্রি করে দিলেন নিজের হীরের গয়না আর সেই অর্থ তুলে দিলেন ভাইয়ের হাতে। সান ইসিদ্রো তে বেশ বড়সড় সাদা রঙের ঝকঝকে যে বাড়িটিতে রবীন্দ্রনাথের থাকার ব্যবস্থা হলো সেই বাড়ির নাম "মিরালরিও"। 

 

  “ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন দেশে

   আমি অতিথি তোমারি দ্বারে ওগো বিদেশিনী”

      

     ১৯২৪ সালের ১১ই নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ এলেন "মিরালরিও" নামক বাড়িতে। সার্থক বাড়িটির নাম "মিরালরিও" …. যার অর্থ নদী দেখা। প্লাতা নদীর ধারেই বাড়িটি…. তাই ইচ্ছে হলেই নদী দেখা যায়। বাড়ির সামনের অংশে আছে সুন্দর বাগান। সূর্যোদয় - সূর্যাস্তের সময় হলে হৈমন্তিক কুয়াশার চাদরে ঢেকে অপূর্ব এক মোহজাল রচিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে তাঁর এই বিদেশিনী মানস প্রতিমার নাম দিয়েছিলেন "বিজয়া" । রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রকম সুখ সুবিধের দিকে যত্নসহকারে নজর রেখেছিলেন কবির "বিজয়া"। তাই এই দিনগুলি কবি যেন বিজয়ার অলিন্দেই কাটিয়েছিলেন! 


    সান ইসিদ্রোতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্যে " মিরালরিও" নামের এই বাড়ীতে প্রায় দুইমাস ছিলেন রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুর। বিশ্বকবিকে ঘিরে আর্জেন্টিনার সাহিত্যিকদের মধ্যে তখন ছড়িয়ে পড়েছে  উৎসাহ-উদ্দীপনা। কবির সাথে ওকাম্পোর আলাপ শুধু সাহিত্য, সংস্কৃতি ও দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল…. এমনটি নয়। দু-জনের মধ্যে রচিত হলো গভীর বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা ও মমত্বের বন্ধন….. যে ভালোবাসা ছিল জাগতিক ভালোবাসার উর্ধ্বে, যাকে ‘platonic love’ বলে অভিহিত করেছেন রবীন্দ্র সমালোচকরা। এই সময়ে ৩০টি কবিতা রচনা করেছিলেন তিনি.…. যেগুলি পরবর্তী সময়ে "পূরবী" কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে "পূরবী" কাব্যগ্রন্থটি কবি  উৎসর্গ করেন ভিক্টোরিয়াকে…. লিখেছিলেন দু'টি কথা - "বিজয়ার করকমলে" ।


    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ বয়সে 'চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ' হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ওকাম্পোর বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করেন রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষজন। কবিতা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের খাতা-কলমের কাটাকাটিতে মূর্ত হয়ে উঠত বিচিত্র ছবি। রবীন্দ্রনাথের আঁকার  ভক্ত ছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। ১৯৩০ সালে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের প্রথম চিত্র প্রদর্শনীর অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রদর্শনীর আয়োজনে প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। প্যারিসে সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়ার দ্বিতীয় এবং শেষ দেখা। রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকে ভারতে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু বিখ্যাত "সুর" পত্রিকার সম্পাদিকা ভিক্টোরিয়ার পক্ষে সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।…..


      “দিনেকের দেখা, তিলেকের সুখ

          ক্ষণেকের তরে শুধু হাসিমুখ

      পলকের পরে থাকে বুক ভ’রে

           চিরজনমের বেদনা।


     তারি মাঝে কেন এত সাধাসাধি

     অবুধ আঁধারে কেন মরি কাঁদি

     দূর হতে এসে ফিরে যাই শেষে

          বহিয়া বিফল বাসনা।”


    সারাজীবনে দেখা মাত্র দু'বার হলেও চিঠির মাধ্যমে উভয়ের যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। রবীন্দ্রনাথ যখন অসুস্থ ….. সেসময়েও তাঁর পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করেছেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন প্রিয় মানুষটির। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের মৃত্যুসংবাদ  ভিক্টোরিয়া পেয়েছিলেন তাঁর গাড়িতে বসে.…. রেডিওর সংবাদে। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর লেখা বই  "Tagore en las barrancas de San Isidro",  বাংলায় যাকে বলা যায় "সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় ঠাকুর"।

            …………………… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...