Sunday 30 July 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২ // শ্রীজিৎ জানা // ই-কোরাস ২

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২

আইভি লতা টকিজ, দুবরাজপুর, নাড়াজোল

শ্রীজিৎ জানা 



ষাট কিম্বা সত্তরের দশকে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে বিনোদের তেমন কোন মাধ্যম ছিল না। ধর্মীয় ও পারিবারিক উৎসব-অনুষ্ঠান, মেলা,যাত্রা,কীর্তন,পালাগান,কবিগান সহ নানাবিধ লোক আঙ্গিকে মানুষজন আনন্দ উদযাপন করত। যদিও সিনেমাহলে সিনেমা দেখার চল ইতিউতি শুরু হয়ে গেছে আগেই। কিন্তু যাওয়ার ঝক্কি সাথে ট্যাঁকে টানাটানি দুভাবেই নিরাশ হতে হত মানুষজনকে। তা বলে এই নিরাশা কাটিয়ে দু'চারজন উৎসাহী যে ছিলেন না, তা জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। হয়তো সংখ্যাটা বেশিই ছিল। এরই মাঝে এক্কেবারে এঁদো গাঁয়ে বাঁশ বেঁধে চট ঘিরে,ত্রিপল ছেয়ে অস্থায়ী সিনেমাহল বানানো হত। তার নাম ছিল চলন্তিকা সিনেমাহল। তাতে সিনেমা দেখানো হত। ঘাটাল নিবাসী সুধীর পাল মহাশয়ের হাত ধরে ঘাটাল এলাকায় চলন্তিকার রমারমা চলে একসময়। নাড়াজোল বাজারেও তিনি এই চলন্তিকা হলে সিনেমা দেখান বেশ কয়েকদিন। বোধহয় ভেতরের ইচ্ছের আগুনটা ওই সময় জোরালো একটা বাতাস পায়। বকুলতলায় তখনো সিনেমাহল চালু হয়নি। ওদিকে ঘাটাল,এদিকে মেদিনীপুর দুরত্ব কম নয়। মন চাইলেও এক আধবার সাধেস্বপ্নে যাওয়া যায়। তার বেশি যাওয়াটা বেশ মুশকিলের। অবশেষে সুরাহা হল। চওড়া হাসি ফুটল এলাকার সিনেেপ্রেমীদের মুখে!


কংসাবতী নদীপারের গ্রাম মগরা। থানা কেশপুর,পশ্চিম মেদিনীপুর। মগরার সিংহ পরিবার এক কালে ছিলেন জমিদার। আজও তাদের পরিবারে দুর্গাপূজা হয়। তা হোক গে। কিন্তু এ তো ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হচ্ছে। সিনেমাহল গেল কই? অত উতলা কেন হে বাপু! জান না, সবুরে মেওয়া ফলে। বাপু হে, ওই মগরার সিংহ পরিবারের হাত ধরেই নাড়াজোল এলাকায় তথা দুবরাজপুর গ্রামে স্থাপিত হল আইভিলতা সিনেমাহল। স্থপতিকার অশোক সিংহ মহাশয়। নাড়াজোল - মেদিনীপুর গামী পিচ সড়ক থেকে খানিব দূরে টিনের ছাউনি আর ঝিটেবেড়ার মাটির দেয়ালের সিনেমাহল।  অশোক বাবু মায়ের নামে সিনেমাহলের নাম রাখলেন "আইভি লতা টকিজ"। বাহারী আইভি লতা অর্কিডের মতোই বেশ মিষ্টি সিনেমাহল। মিষ্টিতে এলার্জি না থাকলে এক্ষণে দু'চারখান রসকদম্ব তথ্য পরিবেশন করতুম। আর এলার্জি থাকলেই বা কি! শাস্ত্র বলে অধিকন্তু ন দোষায়। সিনেমা হলের নাম আইভি লতা, তাই আইভি লতা সম্বন্ধে একটু না জানলে বড্ড অপরাধ হয়ে যায়। তাহলে আসুন মগরার জমিদারের সাথে মিলে যাক তমলুকের রাজ পরিবার। তাস্রলিপ্তের রাজা হরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা ছিলেন আইভি লতা। তাঁকে বিবাহ করেন মগরার জমিদার অভয়পদ সিংহ। এই অভয়পদ সিংহ মশাই আনুমানিক ষাটের দশকে প্রথম একটি সিনেমাহল খোলেন কংসাবতীর দক্ষিনে পাটনা গ্রামে (ভবানীপুর জি. পি, ডেবরা থানা)।  নাম দেন "বাণীশ্রী"। সেই হলে মেঝে ও চেয়ারে বসার ব্যবস্থা ছিল বলে জানান সিংহ পরিবারের এক সদস্য শ্রী অজয় সিংহ।  প্রায় ১০-১২ বছর চলার পর হল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সিনেমাহলের ভূত মাথা থেকে তাঁর নামে না সহজে।  "বাণীশ্রী" র মেশিন, পর্দা প্রথমে ভাড়ায় যায় আনন্দপুর,তারপর কেশপুর। ইতিমধ্যে অভয়পদ প্রয়াত হন। পিতৃদেবের ব্যবসার ঝোঁক চাপল এবার ছেলে অশোক সিংহের মাথায়। দুবরাজপুর মৌজায় জায়গা কিনে তৈরি করলেন 'আইভিলতা টকিজ'।আইভি লতার যাত্রা শুরুর সঠিক  তারিখ অজানা। তবে ১৯৭৬ সালে শুরু বলে জানান প্রয়াত অশোক সিংহের পত্নী শ্যামলী দেবী।




প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের বসবার জন্য  আসন ছিল সাড়ে চারশ। সব কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার। থ্রি টায়ার আসন ফ্রন্ট,মিডিল আর ফার্স্ট ক্লাসে সাজানো। কোন ব্যালকনি ছিল না। শুরুর দিকে ফ্রন্ট আসনের টিকিট মূল্য ছিল সত্তর পয়সা,মিডিল আসনে এক টাকা আর ফার্স্ট ক্লাসে দেড় টাকা। শো হত দুটো টাইমে, তিনটা আর ছ'টা। সেই সময় আইভি লতার প্রত্যেকটা শো হত হাউস ফুল। দূরদূরান্তের সিনেমাপ্রেমী দর্শক ভীড় করত হলে। ভালো ছবি মানেই শোয়ের পর শো টিকিট ব্ল্যাক হবেই হবে। সাইকেল মাইকে প্রচার চলত সকাল বিকাল। সাইকেলের পেছনে বাঁশের চাঁচে সাঁটা থাকত পোস্টার। এদিকে নাড়াজোল বাসস্ট্যান্ডের যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে,ওদিকে সিঙ্গাঘাই বাজারে লাগানো থাকত ছবির পোস্টার।


আইভি লতা সিনেমাহলের প্রথম ছবি ছিল ' সাধক বামাক্ষ্যাপা'। পৌরাণিক এই সিনেমা দিয়ে হলের শুভ মহরতের পেছনে একটা কারণ ছিল। দুবরাজপুর গ্রামে যেখানে সিনেমাহল গড়ে ওঠে আগে সেইস্থানে ছিল শ্মশান।  আর তার পাশেই ছিল কালীমন্দির। আজও কালীমন্দিরে তিথি মেনে পূজা হয়। শ্মশান এবং কালীমন্দিরের কারণে সিনেমাহলের শুভাশুভের কথা ভেবে ওই সিনেমা প্রথম দেখানে হয় । তারপর একের পর এক হিন্দি ও বাংলা মুভির টানে আইভিলতা টকিজ ভিড়ে ভিড়াক্কা হতে থাকে। হলের অনতিদূরেই নাড়াজোল রাজ কলেজ। টকিজের অনেক সিট থাকতে কলেজ পড়ুয়াদের দখলে। কত যুগলের হৃদয় বাঁধা পড়েছে,কত অভিমানের মেঘ কেটে গেছে,অথবা প্রথম প্রেম ছুঁয়ে দেখার শিহরণ, প্রেম নিবেদন – সবটুকুই ঘটেছে  আইভিলতা টকিজের আলোছায়ায় ভিতর। এক সময় রমরমিয়ে কয়েক সপ্তাহ চলেছে 'বাবা তারকনাথ', 'অনুসন্ধান', 'অন্যায় আবিচার', 'প্রতিকার','শোলে','কুলি' প্রভৃতি সিনেমা। 'বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না' সিনেমা হাউসফুল চলেছে বেশ কয়েক সপ্তাহ।



সিনেমাহলের কথা উঠতেই লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষক দেবাশিস ভট্টাচার্য জানালেন তার ছোটবেলাকার স্মৃতি–" বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ছুটির দিনে বাবার হাত ধরে আমার প্রথম ওই হলে সিনেমা দেখতে যাওয়া। আবার বয়স তখন আট। সেটা ছিল দারুণ অনুভূতি। পরে যখন ক্লাস টেনে পড়ি(১৯৮২) তখন হলে দেখানো হচ্ছিল সত্যজিৎ রায়ের  'অশনি সংকেত' ছবি। স্কুল থেকে দেখানো হবে। বলা হল, যে বেশি টিকিট বিক্রি করতে পারবে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। সর্বোচ্চ একশটা টিকিট বেচে পুরস্কৃত হয়েছিলাম সেবার। এর পর স্কুল থেকেই দেখতে গিয়েছি,'পথের পাঁচালি','বাঞ্ছারামের বাগান','ছুট','চিরন্তন' এর মতো সিনেমা"। বিরতির মাঝে হলের ভিতর ফেরি হত লজেন্স,ছোলা-বাদাম। ছোটবেলায় খুব বায়না করতাম হলের ভিতর ওগুলো কিনে খাওয়ার জন্য।"


প্রায় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে গ্রামগঞ্জে বিনোদনের নতুন এক ধারার প্রচলন হয়। টিভি ও মিনি পর্দার ভিডিওহল গড়ে ওঠে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর ভিতরে। ভিডিও হলের টিকিটের মূল্য ছিল বেশ হাতের নাগালের মধ্যে।তার উপর ওইসব হলে বিভিন্ন ভৌতিক ও 'এ' মার্কা ছবি দেখিয়ে এক শ্রেনীর দর্শকদের ভিডিওহলমুখী করা হত। স্বভাবিক কারণে সিনেমাহলের ভিড় ক্রমশ কমতে থাকে। আইভিলতা টকিজের পাশেই এবং কয়েক মাইল দূরে ঝলকা মৌজায় গড়ে ওঠে এরকম ভিডিওহল। ক্রমশ আইভিলতার ভিড়ে ভাটা পড়তে থাকে। ছবির খরচ,সাত- আট জন স্টাফের বেতন,প্রচার,হলের মেইন্টেনেন্স খরচ প্রভৃতি আয়ের চেয়ে বেশি হতে থাকে। ফলে লসে রান করতে থাকে সিনেমাহল। অবশেষে ২০০০ সাল নাগাদ আইভি লতা টকিজ  বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ সিনেমা হলের কাঠামো দীর্ঘদিন টিকে থাকলেও বিগত ২০১১-১২ সাল নাগাদ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। আজ শুধুমাত্র এলাকার মানুষের স্মৃতিতে বেঁচে আছে 'আইভি লতা টকিজ'।


কৃতজ্ঞতা :–

অজিত সিংহ ( মগরা)

দেবাশিস ভট্টাচার্য ( নাড়াজোল)

শ্যামলী সিংহ  ( মেদিনীপুর) 

সৌভিক সিংহ ( মেদিনীপুর)

           ……………………… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Saturday 29 July 2023

সুবীর সরকার এর কবিতা // ই-কোরাস ১৩৯


 


সুবীর সরকার এর কবিতা

জলদস্যুদের গ্রাম



যে হাত ছেড়ে দেই আর ছুঁই না সেই হাত।

সব গাছেরই নিজস্ব এক ছায়া আছে

জলদস্যুদের গ্রামে ঢুকে পড়ছে প্রতারক

এক দিনের ম্যাচ খেলে কি হবে!

গুছিয়ে টেস্ট খেলুন,ওক কাঠের টেবিলে লাঞ্চ

                                                  সারুণ

কুয়ো থেকে বেরিয়ে সরাসরি চোখে চোখ রাখুন




২.

হাসপাতাল থেকে লেখা



আপনাদের গমরঙের আঙুল

আপনাদের খয়েরি চোখ

আপনাদের ব্যাক্তিগত হাসপাতাল

সব আমি সযত্নে গুছিয়ে রাখবো

দু দশটা খাল বিল আমি একাই টপকে যেতে 

                                                   পারি

জনপদে হাঁস ও ফড়িং।

হাততালি উড়ে আসে ছোটবোনের জন্মদিনে।




৩.

উৎসব



দু'দুটি আপেলের মাঝে মুখ গুঁজে পড়ে থাকছি

                                                         আমি

এদিকে সার্কাসতাঁবুর মাঠে বসন্তউৎসব

তোমার উড়ে যাওয়া

                                                           টুপি

পাখির বাঁকানো নখের মত রোদ ছড়িয়ে পড়ে

                                   ধানক্ষেত ও গমবনে

নাম ও প্রতীকসহ মুখস্থ করি হিমবাহের নাম

পতাকায় পারদ ঢুকলে

নদীর উপর আছড়ে পড়ে 

                                  ঝড়



৪.

অপেক্ষা


বনিকবাড়ির ব্যালকনিতে সেলফি তুলি।

শিকারের আগে জলের নীচে জ্বলে ওঠে গজার

                                           মাছের চোখ

এখন সরু চালের ভাত।

এখন কপালের ভাঁজে উড়ে আসা প্রজাপতিদের

                                               দূরে সরিয়ে দেই

তিরতির নদীজলে অপেক্ষা ভেসে

                                                 যায়।


৫.

সম্পর্ক



'দূরে সরে যাওয়া নদী হয়ে যাবে হয়তো 

                                       একদিন'

গাছের ছায়া মেখে দৌড়তে থাকা হরিণ

                            মনে হয় তোমাকে

শপিং মলে সেজে ওঠা এই শহরে খুব

মনখারাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকি

টাইট জিনসের মেয়েরা

                                  

বাদাম ভাঙছে

পিঁপড়েদের পদযাত্রায় আমি অংশ নিই

                                               না

বজ্রপাত ও বৃষ্টির ভেতর আমি কেবল

তোমার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে

                                   থাকি

      …………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Thursday 27 July 2023

বৃষ্টি কথা - বনশ্রী রায়দাস // ই-কোরাস ৪

 


প্রহর গোনে বীজ বাসনা

 বনশ্রী রায়দাস 

 যে ঋতু নিয়ে কবির ভাবনার শেষ নেই যে ঋতুর অপেক্ষায় প্রহর গোনে বীজ বাসনা । উচাটন মন ঘিরে নৃত্য করে সহস্র ময়ূর, আকাশের আলেখ্যপাঠ করে সাতরঙা রামধনু।মৃদুমন্দ স্বর খোঁজে মেঘ মল্লার, যে ঋতুর জন্য অনন্তকাল অপেক্ষারত বিরহকাতর যক্ষ ও যক্ষপ্রিয়া। কুটজকুসুমের মালা গেঁথে মেঘদূতের মাধ্যমে ব্যাথাতুর হৃদয়ের সংবাদ পাঠায় । তার প্রিয়ার কাছে । সেই ভাব বিহ্বল গুরু গুরু গম্ভীরা আজও বিপুল ঝড় তোলে নম্র জানালায়। ভেসে ওঠে  মেঘের চঞ্চল দেহপুষ্প , ঈশান কোণে দানা বেঁধে চকিতে হয়ে উঠে উন্মত্ত প্রেমিক,  আদরে সোহাগে ভরিয়ে দেবে নম্র ধরাতল। ফ্রক-বালিকার আঁচলই আশ্রয় কি ক্ষতি করতে পারে তার ঘন ঘন বিজুরী ছটা তীব্র আলোর রোশনাই। কবির কথায়  ----

   "শ্রাবণ গগনে ঘোর ঘনঘটা 

           ঘনঘন দামিনী রে"

                এসে গেল দ্রিম দ্রিম ঝমঝম।  হুটোপাটি গৃহস্থের উঠোনে । ত্রস্ত মা জেঠিমা শুকোতে দেওয়া শীতল পাটির ধান গম মশলাপাতি বাঁচাতে অস্থির।

ঠাকুরমা রাখালকে বলেন শিগগির গরু গুলোর বাঁধন খুলে দিতে। বারান্দা-দোলনায় ফ্রক-বালিকা কামিনী সংকেতে হৃদি-ফুল ফুটে উঠল নয়ন তারায়। মাঠঘাট কাণায় কাণায় পূর্ণ মনের হরষে সে ছড়া কাটে --

         "টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে নদে এলো বান

        শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যে দান '।

বর্ষার নতুন জল মেখে খেলায় মত্ত হয় দামাল ছেলেরা। নদী বাঁক বদল করে , কেতকী কদমের স্বরগ্রামে আসন পাতে লজ্জাবতী স্পর্শ । আকাশ কোণে কম্পিত চাঁদ ধোয়া জলে যৌবনের আঘ্রাণ।

    কবি লিখলেন ----

           "ওগো নির্জনে বকুল শাখায় 

            দোলায় কে আজি দুলিছে

                     দোদুল দুলিছে "

   নীড়ে না ফিরে ডালে বসে বৃষ্টি মাখে কপোত কপোতি, বেশ কিছু সময় অঝোর ঝরে যেন সমাহিত শান্ত। ধুয়ে মুছে সাফ করে সবুজ প্রকৃতি। উৎফুল্ল কবি গেয়ে উঠলেন "বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল", আবার কখনও বিষাদ মথিত কবি ছুটে যান হারানো প্রিয়ার সন্ধানে বিগ্রহ শূন্য হৃদয় ----

              "এ ভরা বাদর মোহ ভাদর 

                    শূন্য মন্দির মোর "।

       বর্ষা আমার কাছে ধরা দেয় সমস্ত অপ্রাপ্তির অবসান হিসেবে । মেঘের বজ্রবিশান যেমন ধুইয়ে দেয় বর্ষাপাঠ তেমনি হৃদয়ের গুমোট যন্ত্রণা ধুয়ে মুছে সাফ করে । শীতল প্রাণ জুড়িয়ে গান বাজে বেতারে --- 'বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি এ কোন অপরূপ সৃষ্টি'। বর্ষার সেই মাতাল করা রিমঝিম ভরিয়ে দেয় পিয়াসী অঙ্গন। আমার কলমে তখন সম্পূর্ণ এক শ্রাবণ দিনের কাব্য----


        "মেঘের টুকরো থেকে দু পঙক্তি 

          বেজে উঠল পাহাড়ের দ্রিম দ্রিম,

          নদীর হাঁসলি বাঁকে অঝোর, 

          বাউল উড়ে গেল ধৈবতে।


          বীজ বোনা অসম্পূর্ণ রেখে

          কৃষক ফিরেছে নাকছাবি ঘরে,

          নৌকো ঘাটে বেঁধে নুলিয়া ফিরল 

          আগুন পোহাবে বলে"।

          এইভাবেই প্রতিটি তৃষীত হৃদয়কে যেমন পূর্ণ করে বর্ষা তেমনই তার অবারিত বারি, শস্য শ্যামল করে দাহজর্জর প্রকৃতিকে। হাসি ফোটে কৃষকের ঘরে বর্ষণসিক্ত নরম মাটি কর্ষণ, বীজ বপন তারপর সারা বছরের খাদ্যের সংস্থান। কেয়া ফুলের মাতাল সুগন্ধ খাজুরাহো ছুঁয়ে গেলে ----

          "মন মোরো মেঘের সঙ্গী 

          উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে"।

             …………………  


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ ভাবনা - রাজকুমার মুখার্জী

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪



Tuesday 25 July 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ২৯

 


রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ২৯

মর্ত্যপ্রেমে

মহাশ্বেতা দাস


     "পুণ্য সঞ্চয় করলেই স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে এই কথাই চলতি কথা; কিন্তু আমি বলছি যে, আমি স্বর্গ থেকেই পুণ্যের জোরে মর্তে নেমে এসেছি। আমি যখন গন্ডীবদ্ধ প্রকাশের মধ্যে পরিস্ফুট হলাম তখনই আমার সকল অপূর্ণতা সত্ত্বেও মর্তের মধ্যে স্বর্গ ধন্য হল।"       


      রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন আন্তরিকতার সাথে মানুষের কাছে, মাটির কাছে, প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে সুখ দুঃখে ভরা মানব জীবনের রস আস্বাদন করতে চেয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই গণ্ডিবদ্ধ জীবন সাধারণ মানুষের কাছে না যেতে পারার কষ্ট তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল। তাই পরিণত বয়সে যেদিন থেকে জমিদারি দেখাশোনার জন্য মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার অনুমতি মিলল…. সেদিন থেকে কবির মননে, লেখনীতে যেন নব দিগন্ত উন্মোচিত হলো। জমিদারি দেখাশোনার কাজে নিয়মিত বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়…. পল্লী গ্রামের সুখ দুঃখ, হাসি কান্না বিজড়িত অনেক সমস্যার সাথেই পরিচয় ঘটে, বিভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়। ঠাকুর বাড়ির ছোট ছেলেটির এসব ভালোই লাগে। উচ্চবিত্তের ঘেরাটোপে মোড়া দমবন্ধ করা বদ্ধ জীবনের চেয়ে এই জীবন বেশ ভালো। মাঝে মাঝেই নদীতে নৌকা বিহারে বেরিয়ে পড়া.… এমনি করেই বেশ দিন কাটছিল। নৌকায় ঘুরতে ঘুরতেই একদিন চলে এলেন রাজশাহী তে। এখানে এসে দেখা পেলেন সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার মৈত্র'র সাথে। আর পেলেন রবীন্দ্র সাহিত্যের একান্ত সমঝদার, সৌন্দর্যের উপাসক অন্তরঙ্গ বাল্যবন্ধু লোকেন পালিত কে। লোকেন পালিত তখন রাজশাহীতে জেলা-জজ।


         ব্রিটিশ সরকারের প্রভাবে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার তখন একপ্রকার ভগ্ন দশা। ঔপনিবেশিক সরকার তাদের ব্যবসায়িক বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলছে একের পর এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। লক্ষ্য একটাই বছর বছর আগত ভারতীয় শিশুদের তোতাপাখির মতো কিছু বুলি শিখিয়ে মাছি মারা কেরানী গড়ে তোলা আর সমস্ত উচ্চ পদ গুলিতে থাকবে ব্রিটিশরা। স্কুল গুলির বাইরের চাকচিক্যে মোহিত হয়ে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ মাতৃভাষা শিক্ষা ছেড়ে চাকরি পাওয়ার আশায় সেদিকেই তখন মনোনিবেশ করছে, যেটা আমাদের দেশ ও সমাজ কোন কিছুর জন্যেই স্বাস্থ্যকর নয়। বিষয়টি কবিকে ভাবিয়ে তুলেছে। বাল্যবন্ধু এবং অক্ষয় কুমারের অনুরোধে তাই লিখে ফেললেন "শিক্ষার হেরফের" প্রবন্ধ। রাজশাহী এসোসিয়েশনে (১৮৯২) প্রবন্ধটি পাঠও করলেন। 

    

      সমাজ সচেতন যে মানুষটির সহজাত প্রবৃত্তি শিক্ষাদান, তিনি যে এ বিষয়ে লেখনী ধারণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। তিনি অনুভব করেছিলেন যে আমাদের দেশে শিক্ষার সঙ্গে ভাষা ও জীবনের সামঞ্জস্য সাধিত হয় নি, রচিত হয়নি তাই যোগাযোগের রাস্তাও। তিনি মনে করেছিলেন এই হেরফেরটি মুছে যাওয়া দরকার। এ যেন জলের মধ্যে থেকেও মাছেদের তেষ্টা মিটছে না! জল আছে মাছেদের তেষ্টাও আছে তবু পান করার উপায় নেই! অর্থ রোজগারের চিন্তা এতটাই বেড়ে উঠেছে যে তারা নিজেদেরকে উচ্চতর ভাবের আদর্শে অধিষ্ঠিত রাখে না। স্বাভাবিক ভাবেই পার্থক্য রয়ে যায় বিদ্যা ও ব্যবহারের মধ্যে অথচ প্রয়োজনটাই হলো শিক্ষার সঙ্গে জীবনের সামঞ্জস্য বিধান। রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন এই গুরু দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষা। এর আগে শিক্ষা বিষয়ে এমন সুচিন্তিত লেখনী ধারণ আর কেউ করেন নি। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ মোহন বসু কবিকে এই প্রবন্ধে তাঁর সুচিন্তিত, বলিষ্ঠ ও যুক্তিপূর্ণ কথনের জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লেখেন। 


    এরপর নাটোরের রাজা জগদিন্দ্রনাথের আতিথ্য গ্রহণ ইত্যাদিতে বেশ কিছুদিন  সমারোহে কাটলেও পার্থিব রোগ জ্বালা থেকে তো রেহাই নেই! দাঁতের ব্যথায় কাবু হলেন!!  ফিরে এলেন শিলাইদহে। এ তো গেল শারীরিক কষ্ট। কিন্তু কবির মন!! বহু দিন হলো কাব্যলক্ষীর দেখা মেলেনি। কবি-মন কি সুখে থাকতে পারেন? একটি পত্রে তিনিই তো একবার লিখেছিলেন- "বাস্তবিক এ জীবনে কবিতাই আমার সর্বপ্রথম প্রেয়সী - তার সঙ্গে বেশীদিন বিচ্ছেদ আমার সয় না।"  সত্যিই তো আশৈশব যিনি স্বভাব কবি তিনি কতদিন আর কবিতা থেকে দূরে থাকবেন!! লিখলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা "মানস সুন্দরী"। প্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কে কেবলমাত্র হৃদয়াবেগের মুগ্ধতা নয় বরং তার থেকেও বেশী প্রকৃতি ও মানুষকে পূর্ণসত্ত্বায় প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি এই কবিতায়। সত্য ও সুন্দরের পূজারী তিনি। কবির এই সৌন্দর্য্য চেতনার সাথে যুক্ত হয়েছে মানব মনন। আর তাই কবিতার পরতে পরতে ব্যক্ত হয়েছে মানুষের মনোজগতের কথা। 


     "মানস সুন্দরী" কবিতায় কবির বিশ্বপ্রেমের আলোকে ধ্বনিত হয়েছে মর্ত-প্রীতির সুর। ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো অনুভূতি গুলিকে এক জায়গায় জড়ো করে মানস লোকে একটি নারীমূর্তি প্রত্যক্ষ করলেন তিনি। তাই "মানস সুন্দরী" হলো বিশ্বের সমস্ত প্রিয়ার প্রতীক। প্রকৃতি ও মানুষ এখানে এক সূত্রে গ্রথিত হয়েছে। পদ্মাতীরের গ্রামের ছবি, সূর্যাস্তের ছবি, বালিকা বধূর ঘরে ফেরার ছবি, জীর্ণ কুটিরে সাঁঝবাতির আলো জ্বালার ছবি ফুটে উঠেছে কবিতায়। সুখ দুঃখ, বিরহ প্রেম, আনন্দ বেদনায় বিশ্ব এখানে পরিপূর্ণ রূপে প্রকাশিত। কবির মর্তপ্রেম এবং মানুষের প্রতি গভীর সমবেদনা ও ভালোবাসা কবিতাটিকে চরম উৎকর্ষতা দান করেছে। 


    " মানসী রূপিণী ওগো বাসনাবাসিনী,

      আলোকবসনা ওগো নীরবভাষিনী, 

     পরজন্মে তুমি কি গো মূর্তিমতী হয়ে

      জন্মিবে মানবগৃহে নারীরূপ লয়ে

      অনিন্দ্যসুন্দরী?"  

                    ……………………


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


Saturday 22 July 2023

সুবীর সরকার এর কবিতা // ই-কোরাস ১৩৮

 



সুবীর সরকার এর কবিতা

 বাহান্ন হাতির মিছিল

 

 হাঁসেদের নিজস্ব জলাশয় থাকে

 সার্কাস তাঁবুর পাশে সাতসকালের 

                                              রোদ

 জঙ্গলে প্রবেশ করলেই টুপি উড়ে যায়

 উড়ে যাওয়া টুপি কি কান্না আড়াল করে!

 আমরা বিমানবন্দরে পাখি ঢুকতে দেই না

 দেওয়ালে পেরেক,গাদাবন্দুক

 কফির মগ হাতে নেমে আসছেন প্রবীণ জোতদার

 ডাংগুলি খেলার মাঠে জড়ো হচ্ছে 

 সমস্ত উড়তে শেখা পাখিরা

 আমি কামানের মুখে দাঁড় করিয়ে দেব ক্রোধ

 ফিরে আসবে মৎসন্যায়।

 ফিরে আসবে বাহান্ন হাতির মিছিল।

 টুক করে একটু শিস রেখে আসবো

 কুড়িয়ে পাওয়া বেলুন রেখে আসবো


কাকতাড়ুয়া


যে শীতে কুয়াশা নেই আমি তার থেকে দূরে 

                                                            থাকি

আঙুল ভালোবাসলে আঙুলের আংটিকেও

                                       ভালোবাসতে হয়

কাঠের আগুনে পোড়ানো হচ্ছে আলু

আলুতে লবণ মাখানো হচ্ছে

এই সব দৃশ্য জড়িয়ে আমরা একটা নির্মীয়মান 

সেতুর পাশে গিয়ে তো দাঁড়িয়ে পড়তেই পারি!

মূলত সবকিছুতেই ম্যাজিক

মূলত সবকিছুতেই গোপনতা

আর রেডিওবার্তা শুনে হেঁসে ওঠে শীতদেশের 

                                                        কাকতাড়ুয়া



গিটার


পাহাড়ে বেড়াতে গেলে অবধারিত নীল টুপি

রাস্তার বাঁক জেনে যায় কিভাবে কখন উড়ে আসে

                                                         পাখি

শরীর দুলে ওঠে।

সমতলের নদীর গল্পে যে বিষাদ তা কি জানে

                                           পাহাড়ি রঙ্গীত!

প্রপাতের পাশে দেখি মঠ,মাঠ ও শিশুপার্ক

তিস্তায় চাঁদের মায়া।

খাদের ওপর দিয়ে ভেসে আসে লামাদের

                                                মন্ত্রপাঠ

পেলিং থেকে রাণীপুল

তিমি চা বাগান থেকে 

পাহাড়ে বেড়াতে গেলে বৃষ্টি ও গিটার কিন্তু 

                                              একসাথেই বাজে



মায়া


রেডিওতে নদী ভাঙনের গল্প শুনি।

জিপ ভরতি কবিরা বেড়াতে আসেন 

                                           চিড়িয়া খানায়

আমরা দেখতে পাই জার্সি উড়ে যাচ্ছে

                                      শয়তানদের ডেরায় 

ছবি আঁকতে আঁকতে একসময়

পরকীয়া সিরিজ নিয়ে ফাঁকা শহরের রাস্তায়

                                              চিত্রশিল্পী

আমি একজন সম্পাদককে চিনি

যার দুই চোখে লোভের আগুন।

চারপাশে কুলগাছ।ওয়াচ টাওয়ার।

আর আধখাওয়া আপেলের পাশে

চিরদিনের সব জঙ্গলমায়া রেখে আসি।

               ……………………….. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...