Monday 22 June 2020

e-কোরাস ৩৪ // তপনজ্যোতি মাজি এর কবিতা





তপনজ্যোতি মাজি এর কবিতা
১.
ঈশ্বরীকে নিবেদিত

রাত্রি  ন টায় ঈশ্বরী কবিতা পড়ছেন। কৃষ্ণা বসুর 'রাধিকা সংবাদ'।
তরল আলো গাঢ় হয়েছে যেখানে ঘোলা জলের মতো ঈশ্বরীর পা
দুটি ঝুলছে অনাবৃত।

স্বেচ্ছাচারী মেঘে সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়েছে অকস্মাৎ। আবহাওয়ার বৈশাখী
আবেগ। কুড়িয়ে পাওয়া আর্দ্র বাতাসে ঈশ্বরীর সমুদ্র  রঙ ঘুম ফ্রকের
বোতাম দুটি খোলা।

 নির্মাণ রেখার উল্টোদিকে বসে আছেন অক্ষর পুরুষ। তাঁর দৃষ্টি নক্ষত্রে
 নক্ষত্রে খুঁজছে শূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়া জীবনানন্দের অমুদ্ৰিত কবিতার
 ধূসর জীবাশ্ম। ঈশ্বরীর

 ঈশ্বরীর ওষ্ঠে রাধিকার অভিমান কফি রঙের মতো গাঢ়।  ঈশ্বরী নারীবাদী
না হলেও নারীর স্বাভিমানে বিশ্বাস করেন। তাঁর  ট্রিমড চুলে রাত্রির বিষন্ন
নিভৃতি ও অন্ধকার।

অক্ষর পুরুষের কণ্ঠে জর্জ বিশ্বাসের ভঙ্গিতে গাওয়া রবীন্দ্রগান। বাতাসে
সুরের কম্পন। হরিনের জলপানের মতো আওয়াজ হলো কোথাও।  ঈশ্বরী
জানেন এই সময়টি চা পানের।
                      .......................


২.
বিনির্মাণ

বারোটা দু মিনিটে নিভে যাওয়া আলো জ্বলে যায়
শুরু হয় বিনির্মাণ।
কে কার শয্যা ভাগ করে
এক বুক নিথরতা নিয়ে নদী উঠে আসে বালি পায়ে
চুপি চুপ।

শব্দের  রঙ বদল হয়
নীল হয়ে যায় সবুজ, লাল স্থিমিত গোলাপী
রঙিন মাছদের মতো ডুব সাঁতার দেয় দু একটি তৎসম শব্দ।
বোতাম খোলা ঘুমফ্রকে ডুবো পাহাড়ে জলজ সবুজের
ঘ্রান নেয় ভিনদেশি ডুবুরী।

আকস্মিকতার স্পর্শে ঘূর্ণায়মান গোলকের কেন্দ্রবিন্দু বদল
হয় মুহূর্ত সময়।
অযাচিত প্রজ্ঞা না বোঝার স্থূলতা ঘোলা জলে মাছ ধরে শিকারী
বকের মতো।
এই সব জেনেও শব্দরা অন্বেষা সন্ধানী।
দানবিক ক্যানভাসে প্রেম সৌর বিন্দুর মতো
অভিমানী চাদরে মুখ ঢেকে ঘুমায়
সারারাত।

আলো জ্বলে জলযানের দোতালা কেবিনে
কখনো গান কখনো কবিতা শুনতে শুনতে
নির্জন নাবিক গভীরতা মেপে তটবর্তী  করে পালতোলা
জাহাজ।
ঘুমের আগে উদ্ধৃতি  চিহ্ন বসিয়ে চাঁদ চুপি চুপি বলে
পাখির জাগার সময় হলো পর্ণ ছায়ায়।
               .......................


৩.
আকাশ

সীমাহীন বিশালতা। তোমার উদারতা টেবিলের উপরে রাখা প্রিয়
পেপারব্যাক, প্রতিদিন একটু একটু করে পড়ি।  তোমার ঝড় বৃষ্টির
উপাখ্যান , তোমার নীল সরোবর , তোমার নীরবতা , সব।

কাচের খেলনা প্রতিটি জীবন।  ভেঙে খান খান হয়  বিচিত্র অভিঘাতে।
আমরা হয় ব্যর্থ প্রেমিক অথবা ব্যর্থ সংসারী। আমাদের সাফল্য , উচ্চতা
এমনকি অহংকারও  কাচের নির্মাণ। অনিবার্য ভঙ্গুর।

তোমাকে ছুঁতে ইচ্ছা হয় ভোরবেলা কিংবা  মধ্যযামে। আলো হয়ে উঠার
সন্ধিক্ষণটি বড়ো পার্থিব। একটি মানুষের বোধ জেগে উঠছে, ঘুম ভাঙছে
সুপ্ত মনুষ্যত্বের I খুলে যাচ্ছে এ আমির আবরণ।

মধ্যযামে তুমি দার্শনিক কিংবা স্বপ্নসঙ্গী। বিপুল প্রজ্ঞা অথচ নীরব। দূরতম
হয়েও অন্তরতম I এমন প্রেম যা অনুভবে আর্দ্র করে হৃদয়।  এমন সংগীত
যা অনিঃশেষ। একটি অন্তহীন কবিতার অক্ষর প্রকরণ।
                       ............................


৪.
মা

অক্ষর নিরাকার নয় I অথচ অনুভুতিটা আকারহীন।  চেতনালোক জুড়ে
জড়িয়ে আছো, অনশ্বর স্নেহ ও শুশ্রূষা। একবার বাতাস, একবার জল,
একবার আলো কিংবা মৃত্তিকা ভেবেও , মা বললাম স্বগত।

আমার  হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা থেকে  তুলে আনি বিন্দু বিন্দু বুদবুদ।
চাঁদের কপালে টিপ্ দেওয়ার মতো ইস্কুলবেলায় গরম ভাতে আলু। জ্বলন্ত উনুনের পাশে হাতে বোনা আসনে বসে
শ্লেটে লেখা অক্ষর।

 একটা নদী, একজন মা আমাদের মনের শিকড়।  ছড়িয়ে আছে অলক্ষে।
 যত্নে ধরে আছে বলেই শাখা প্রশাখাতে এত পাতা , এত ফুল , এত আলো।
পরিচর্যার নিরুচ্চার প্রকৃতি। মনোময় চিরহরিৎ ভূমি।

 ধ্যানের উপলব্ধি থেকে  মন্ত্র তুলে আনি। পাঠের সুতোতে গাঁথি সমস্ত অক্ষর।
 আকাশ  আলো  জল  মাটি সব মিশে আছে তোমার শরীরে।  প্রথম ধারণভূমি
 তুমি, প্রথম যত্নভূমি তুমি , আমার প্রথম উচ্চারণও তুমি।
                                  .......................


৫.
প্রত্যর্পণ

হাতের তালুতে মুগ্ধ উষ্ণতা।
প্রত্যর্পণে কি দেবো তোমাকে? দৈবসময়ে শ্বাসরুদ্ধ যবনিকা
সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো তীর্থপর্যটক। মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি ধাতব
ইংগিতে বললো , ঈশ্বর নিরুদ্দেশ।

আমি জন্মঅবিমৃষ্যকারী ও প্রান্তিক
আমার পায়ের নিচে পাথরের ক্লীবতা,
মস্তিষ্কে না খেতে পাওয়া মানুষের কান্না ও সংগ্রাম।
আমি কি দৈবগতপ্রাণ হতে পারি ?

জীবনের মুখ্য বিবেচনা নিয়ে তর্ক হলো খুব।
নিশ্ছিদ্র কক্ষ থেকে চুরি যায় প্রাণ
প্রেম আজও দূরতম গ্রহ
অঙ্গের  নামাবলী জানে প্রকৃত প্রতারক কে।

তালুতে মেখেছি উষ্ণতা
শাপভ্রষ্ট দেবতা।
 তোমাকেই মানবী ও দেবী ভাবি ,
পূজা ও প্রেমের গানে  প্রেক্ষাপট হয়ে ওঠে
উৎসব।
তখন বিনত বলি প্রেম হলো
হিরণ্ময় আলো।
অন্ধকারে প্রতিমার রূপ।
                        .............................


৬.
মন্থন

আজ সারাটি মধ্যাহ্ন মন্থন করে অনির্বচনীয় যা পেয়েছি, বিন্দু বিন্দু
করে মিশিয়ে দিই জলের শরীরে। জল ঋতুমতী।
বোধিচিহ্ন বুকের
 প্রান্তরে নিয়ে নিরাবরণ রূপসী।

 সংস্কারশূন্য প্রান্তজন আমি। নিদাঘ ও বর্ষা পার হয়ে একা  দাঁড়িয়েছি
 হরিৎ বেদনার আবহে। আমাকে রিক্ত করো, নিঃস্ব করো, স্থবির এবং
 অপ্রয়োজনীয় করো আনন্দ ইচ্ছায়।

 আমার পূর্বকাল নেই। আমার  উত্তরকাল নেই। অনন্ত করুনা মেখেছি
 হৃদয় অবধি।  বিরল আশ্লেষে অনুভব করেছি তোমার সান্নিধ্যের থেকে
 সমৃদ্ধতর কিছু নেই ধারণ করার মতো৷

 এই উদ্বোধন সন্ধ্যায় জলের চুম্বনে আর্দ্র ওষ্ঠদুটি বৃষ্টিবর্ন পাতার মতো
 কিছু বলতে চাইছে। সময়কে থামিয়ে দিয়ে এক  জন কবি  রচনা করে
 শ্লোক। আমি ধারণ করলাম রক্ত পলাশ।
                         .......................


৭.
রাগ

রাগ বললেই দ্বন্দ্ব।
কোন রাগ ?
মনের অসাম্য থেকে জন্ম নেওয়া রাগ
নাকি শাস্ত্রীয় রাগ।

শাস্ত্রীয় রাগ মানে অবিচল অনুশীলন, শুদ্ধ সুরের বিস্তার।
আলো নিভিয়ে শুনি ,
কখনো ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ  সাহেব
কিংবা পন্ডিত রবিশঙ্কর।
সুরের রূপকথা।

অসাম্যের আবহে যে রাগ সেতো ঘূর্ণি,
ওলট পালট করে দেয় সব কিছু, এমনকি জলের নিরভিমান
 বুক।
ভেঙে চুরমার করে বিশ্বাস
প্রেম
প্রণয়
দাম্পত্যও।

রাগ মেঘমল্লারে বৃষ্টি নামে।
রূপকথা
রাগ পড়ে গেলে জল।
আস্ত একটা নদী
চাঁদনী  রাতের অভিসার।

আমার দ্বন্দ্ব কবে মুছে দেবে
রাগবিরহিনী রাই ?
                    ..............................


৮.
এবং অবশিষ্ট

ছাদের হাওয়ায় তোমাকে তোমার মনের কাছে রেখে যে চলে
গেলো, সত্যিই কি যেতে পারলো সে ? একে কি যাওয়া বলা
 যায় ?
এক একটা মুহূর্ত এক এক রঙের কৌটোতে ভরে সাজিয়ে রাখে
যে উন্মাদ, সে তো ইচ্ছাধীন নয়।  তার সঙ্গে ব্যবধান, অকল্পনীয় ,অসম্ভব।
চিঠি  শেষ করে  পুনশ্চ লিখে  ভুলে যাওয়া জরুরী প্রসঙ্গ লিখতো
কয়েক দশক আগের মানুষ। কি কথা লিখতে পারে নক্ষত্রহীন অন্ধ আকাশ ?
সমস্ত  কথা  উচ্চারিত হয়না এক জীবনে I অনুভব ছুঁতে পারে  রাত
পাখির ডানায় লেগে থাকা ঘুম। তোমার ইচ্ছাকে একবার পাখি হতে দাও।
 নির্বাক আরিকুরিয়ার সবুজ পাতারা  যে ভাবে জলের মূর্ছনা পেতো
 দহন বিকেলে, তোমার অজান্তেই কত মুহূর্ত নদী হয়ে আছে তোমার দশদিকে।
 তুমি এই সব নদীদের একদিন অবসরে  ডাকো। কথা বলে জেনে নাও
 কবে  জলোছ্বাসে  তোমার ঘুমের মধ্যে  অবাধ্য পুরুষ  হয়েছিল মনীশ নক্ষত্রটি।
                           .........................


৯.
নির্জনবর্ণ

নির্জনবর্ণ মন ঋণ করি।

প্রবাসী ও ঋণী
আমার হলোনা গৃহসুখ।
কেবল ফেরি করি
এবেলা ওবেলার রোদ।

তুচ্ছ নয় কেউ
সপ্তপর্ণী হতে পারে চক্ষু পল্লব।
তোমার গ্রন্থনা শুনি
পূর্ণ সভগৃহে।

আমাকে ঋণী রাখো
অপ্রেমে থাক তুচ্ছ ভ্রান্তি গুলি।
দ্যাখো, উন্মোচন কাল
লিপি ও প্রস্তর।

স্পর্শ  দাও একবার
সব ধ্বনি প্রতিধ্বনিময় বলেছিলো কেউ।
ওম খুঁজি নাভিমূলে
পরান্মুখ মনে বাড়ে ঋণ।
             ........................


১০.
অঙ্গবাস

ইস্ত্রি করে নাও অঙ্গবাস
পাহাড়ে  বৃষ্টি  ভোরবেলা
মেঘ পরিযায়ী।

রোদ্দুরে শুকোয় দস্তানা
ঝির ঝির শব্দ কানে আসে
হৃদয়ে  মূর্ছনা।

নির্মম গ্রীষ্মে পুড়ে কৃষ্ণ ত্বক
সন্ধ্যার আগে কথাকলি মেঘ
 দৈব প্রণয়।

 সংকটে  অপরাজেয় প্রেম
 শ্রম ও শ্রমণে তুচ্ছ ব্যবধান
 অক্ষর সংগীত।

 স্নানঘরে  জলের  সমারোহ
 ভেজাচুলে শিবরঞ্জনী রাগ
 ধ্রুপদী আলাপ।

 প্রসারিত শাখায় সবুজ পল্লব
 গৃহ ও বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের গান
 প্রাণের আরাম।

পূর্বাপর মুছে দিলো কণ্ঠস্বর
অন্যমনস্ক মনে তুমি দেবী
কবির প্রেমিকা।

 ইস্ত্রি  করে  নাও  অঙ্গবাস
 কবিতারা  ধাবমান  ট্রেন
 ছায়া চরাচর।
                    .......................




সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
তুলিতে - দেবাশীষ সোঁ
ঠিকানা - সুরতপুর, হরিরামপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614


Friday 5 June 2020

e-কোরাস ৩৩ // মুন্সী প্রেমচন্দ এর গল্প (অনুবাদ-অভিষেক রায় চৌধুরী)




দুই বলদের কথা
মুন্সী প্রেমচন্দ
অনুবাদ-অভিষেক রায় চৌধুরী  
                                                                          
পশুদের মধ্যে গাধাকে সবথেকে বোকা মনে করা হয়। আমরা যখন কাউকে প্রথম সারির বোকা বলতে চাই, তখন তাকে গাধা বলি। গাধা সত্যিই বোকা, নাকি তার সরলতা, ওর নিরাপদ সহিষ্ণুতা তাকে এই নাম দিয়েছে, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। গরু গুঁতোয়, সদ্য প্রসব করা গরু তো কখনো কখনো সিংহীর রূপ ধারণ করে। কুকুরও খুব সরল পশু, কিন্তু কখনো কখনো সেও রেগে যায়; কিন্তু গাধাকে কখনো রাগতে দেখিনি, শুনিওনি। বেচারাকে যত খুশি মারো, যতই খারাপ, পচা ঘাস খেতে দাও, ওর চেহারায় কখনোই অসন্তোষের ছায়া দেখবে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে এক-আধবার খেলে নেয়, কিন্তু আমি তো তাকে কখনো খুশি হতে দেখিনি। ওর চেহারায় বিষণ্ণতার এক স্থায়ী ছায়া থাকে। সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, কোনো অবস্থাতেই তা বদলাতে দেখিনি। মুনি-ঋষিদের সব গুণের চরম সীমা যেন সে ছুঁয়ে ফেলেছে; কিন্তু মানুষ তাকে বোকা বলে। সৎগুণের এত অনাদর কোথাও দেখিনি। মনে হয়, সরলতা সংসারের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। দেখুন না, ভারতীয়দের আফ্রিকায় কিরকম দুর্দশা। কেন আমেরিকায় তাদের ঢুকতে দেওয়া হয় না? বেচারারা মদ খায় না, অসময়ের জন্য দু'পয়সা সঞ্চয় করে রাখে, মন দিয়ে কাজ করে, কারো সঙ্গে লড়াই ঝগড়া করে না, চারটে কথা শুনলে দুঃখ পেয়ে যায়; তবুও তারা বদনামের ভাগিদার। বলা হয় তারা জীবনের আদর্শকে ছোট করছে। যদি তারাও ইটের জবাব পাটকেল দিয়ে দিতে শিখত তো মনে হয় সবাই তাদের সভ্য বলতো। জাপানের আদর্শ আমাদের সামনে রয়েছে। একটি জয় তাকে বিশ্বসংসারের সভ্য জাতির মধ্যে গণ্য করেছে। 
         কিন্তু গাধার একটি ছোট ভাই আছে যে ওর থেকে কম গাধা, সে হলো বলদ। যে অর্থে আমরা গাধা শব্দের প্রয়োগ করি, অনেকটা সেরকম অর্থেই আমরা 'বাছুরের বাপ' শব্দটির প্রয়োগ করি। কিছু লোক বলদকে বোকাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলবেন, কিন্তু আমি সহমত নই। বলদ কখনো কখনো মারে, কখনো কখনো এঁড়ে বলদ দেখা যায়। বিভিন্ন উপায়ে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করে, তাই এদের স্থান গাধার নিচে।

        ঝুরী কাছীর দুই বলদের নাম হীরা আর মোতি। দুজনেই এক বিশেষ জাতির, দেখতে সুন্দর, কাজে চৌকস, তাগড়াই চেহারা। অনেকদিন সঙ্গে থাকতে থাকতে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। দুজনে মুখোমুখি বা পাশাপাশি বসে একে অন্যের সঙ্গে মূক ভাষায় মনের ভাব বিনিময় করত। একজন অন্যের মনের কথা কি করে বুঝতো তা আমি বলতে পারি না। অবশ্যই তাদের মধ্যে এমন কোন গুপ্ত শক্তি ছিল যা পেতে জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার মানুষ-ও বঞ্চিত ছিল। দুজনে একে অন্যকে চেটে ও শুঁকে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করত। কখনো কখনো দুজনে শিঙে শিঙ মিলিয়ে নিতো--যুদ্ধের জন্য নয়, কেবল মজার জন্য, আত্মীয়তার জন্য, যেমন বন্ধুদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়লে লুকোচুরি খেলা হয়। এসব ছাড়া বন্ধুত্ব কিছুটা জোলো, কিছুটা হালকা-ই লাগে, যার ওপর বেশি বিশ্বাস করা যায় না। যখন এই দুই বলদকে লাঙ্গল বা গাড়ির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হতো আর ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে চলত তখন প্রত্যেকের এই চেষ্টা হতো যে বেশি থেকে বেশি বোঝা আমার ঘাড়ে থাকুক। সারাদিনের পর দুপুরে বা সন্ধ্যায় যখন দুজনকে খোলা হত তখন একে অপরকে চেটে নিজের শ্রান্তি অপনোদন করত। পাত্রে খোল ভুসি দিলে দুজনে একসাথে উঠে একসাথে পাত্রে মুখ দেয় আর একসাথে বসে, একজন মুখ সরিয়ে নিলে অন্যজনও মুখ সরিয়ে নেয়। 
       আশ্চর্যের কথা, ঝুরী একবার দুজনকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিল। বলদরা কিছুই জানেনা যে তাদের কোথায় পাঠানো হচ্ছে, ভাবল মালিক আমাদের বিক্রি করে দিয়েছে। নিজেদের এরকম বিক্রি করে দেওয়া তাদের ভালো লাগলো,না খারাপ, কে জানে কিন্তু ঝুরীর শালা গয়ার ঘর পর্যন্ত দুজনকে নিয়ে যেতে মাথার ঘাম পায়ে পড়ে গেল। পেছন থেকে হাঁকলে দুজনে বামে-ডানে পালায়, গলার দড়ি ধরে সামনে থেকে টানলে দুজনে পেছনের দিকে জোর লাগায়, মারলে দুজনে শিঙ দিয়ে গুঁতাতে আসে। যদি ঈশ্বর ওদের ভাষা দিতেন তাহলে ঝুরীকে জিজ্ঞেস করত-তুমি আমাদের গরিবদের কেন বের করে দিচ্ছো?আমরা তো তোমার সেবা করতে কোনো ত্রুটি করিনি। যদি এই অল্প পরিশ্রমে তোমার কাজ না হয় তাহলে আরো কাজ করিয়ে নিতে। আমরা তো তোমার চাকরি করতে করতে মরে যেতেও রাজি। আমরা কখনোই খাওয়ার নিয়ে অভিযোগ করিনি, তুমি যা খাইয়েছো তাই মাথা নিচু করে খেয়েছি। তাহলে তুমি এই পাপীর হাতে আমাদের কেন বিক্রি করে দিলে? 
        সন্ধ্যার সময় দুই বলদ নতুন জায়গায় পৌঁছাল। সারাদিন না খেয়ে ছিল, কিন্তু যখন খাবার দেওয়া হল একজনও তাতে মুখ দিলো না। মন ভারাক্রান্ত হচ্ছিল। যাকে ওরা নিজের ঘর ভেবেছিল, তা আজ ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নতুন ঘর, নতুন গ্রাম, নতুন লোক, সবকিছুই যেন পর মনে হচ্ছিল। 
       দুজনে নিজেদের মূক ভাষায় পরামর্শ করল, একে অন্যকে আড়চোখে দেখল আর শুয়ে পড়ল। যখন গ্রামে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ল তখন দুজনে জোর লাগিয়ে বাঁধার দড়ি ছিঁড়ে ঘরের দিকে চলল। দড়িগুলো যথেষ্ট মজবুত ছিল। ভাবাই যায় না যে কোন বলদ তাদের ছিঁড়তে পারে, কিন্তু এই সময় দুজনের মধ্যে দ্বিগুণ শক্তি এসে গেছিল।এক এক ঝটকায় দড়ি গুলো ছিঁড়ে গেল।
       ঝুরী ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠলো, দেখল দুই বলদ গোয়ালে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের গলা থেকে অর্ধেক অর্ধেক দড়ি ঝুলে আছে। হাঁটু পর্যন্ত পা কাদায় ভরা আর দুজনের চোখে বিদ্রোহময় স্নেহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। 
       ঝুরী বলদদের দেখে স্নেহে গদগদ হয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে তাদের আলিঙ্গন করল। প্রেমালিঙ্গন ও চুম্বনের সেই দৃশ্য বড়ই মনোহর ছিল।
       ঘর আর গ্রামের বাচ্চারা জড়ো হয়ে গেল আর তালি বাজিয়ে বাজিয়ে তাদের স্বাগত জানাল। গ্রামের ইতিহাসে এই ঘটনা অভূতপূর্ব না হলেও মহত্ত্বপূর্ণ ছিল। বালকদের সভায় সিদ্ধান্ত হল দুজন পশুবীরকে অভিনন্দনপত্র দেওয়া উচিত। কেউ ঘর থেকে রুটি, কেউ গুড়, কেউ কেউ ভুসি আনল।
এক বালক বলল-এরকম বলদ কারোর কাছে নেই। দ্বিতীয়জন তাকে সমর্থন করল-এতদুর থেকে দুজনে একলাই চলে এলো।
তৃতীয়জন বলল-এরা বলদ নয়, পূর্বজন্মে মানুষ ছিল।
এসবের প্রতিবাদ করার সাহস কারোরই হলো না। ঝুরীর স্ত্রী বলদদের দরজায় দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। বলল-কেমন নেমকহারাম বলদ।একদিনও ওখানে কাজ করলো না; পালিয়ে এল। ঝুরী নিজের বলদদের ওপর এই অভিযোগ সহ্য করতে পারলো না- নেমকহারাম কেন হবে? ওখানে খেতে কিছু দেয়নি তো কি করবে? স্ত্রী জোর দেখিয়ে বলল-ব্যাস, তুমিই একমাত্র বলদদের খাওয়াতে জানো আর বাকিরা জল খাইয়ে রাখে। ঝুরী ক্ষ্যাপাল-খাবার পেলে কি পালাতো? স্ত্রী রেগে বলল-পালিয়েছে এই কারণে যে ঐসব লোকেরা তোমার মত বোকাদের মত বলদদের আদর করে না। যেমন খাওয়ায় সেরকম কাজ করিয়ে নেয়। এরা দুজন কামচোর, তাই পালিয়ে এসেছে। এখন দেখি কোথা থেকে খোল আর পাতা পায়! শুকনো ভুসি ছাড়া কিছুই দেব না, খাক নয়তো মরুক।
তাই হল। মজুরকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হল যে বলদদের খালি শুকনো ভুসি দেওয়া হোক। বলদরা পাত্রে মুখ দিল তো ফিকে ফিকে মনে হল। না কোনো স্বাদ না কোনো রস। কি খাবে?  আশাভরা চোখ নিয়ে দরজার দিকে তাকাতে লাগলো। ঝুরী মজুরকে বলল-একটু খোল দিস না কেন?
"মালকিন আমাকে মেরে ফেলবে।"
"চুরি করে দিয়ে দে।"
"না দাদা পেছন থেকে তুমিও মালকিনের হয়েই কথা বলবে।"



                                  
দ্বিতীয় দিন ঝুরীর শালা আবার এসে বলদদের নিয়ে চলল। এখন দুজনকে গাড়িতে বেঁধে দিল। দুচারবার মোতি গাড়িকে রাস্তার ধারে খাদে ফেলার চেষ্টা করল কিন্তু হীরা সামলে নিল। ও অনেক সহনশীল। সন্ধ্যার সময় ঘরে পৌঁছে দুজনকে মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধল আর গতকালের বদমাসির সমুচিত জবাব দিল। আবার সেই শুকনো ভুসি দিল। নিজের দুই বলদকে খোল সবকিছু দিল। 
দুই বলদের এমন অপমান এর আগে কখনো হয়নি। ঝুরী এদের ফুলের ছড়ি দিয়েও ছোঁয়নি। ওর টিটকিরি শুনে দুজনে হাসত। এখানে মার পড়ল। সম্মানহানির ব্যথা তো ছিলই, তার ওপর মিলল শুকনো ভুসি। পাত্রের দিকে চোখ তুলেও দেখল না। দ্বিতীয় দিন গয়া বলদদের হালে জুড়ল কিন্তু এই দুজন যেন পা না তোলার দিব্যি খেয়েছিল। ও মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেল; কিন্তু দুজনে পা তুলল না।একবার ওই নির্দয় যখন হীরার নাকে জোরে লাঠি মারলো তো তখন মোতির রাগের বাঁধ ভেঙে গেল। হাল নিয়ে দৌড়ালো। হাল, দড়ি সব ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেল। গলায় বড় বড় দড়ি না থাকলে দুজনকে ধরাই যেত না। 
হীরা মূক ভাষায় বলল-পালানোর চেষ্টা ব্যর্থ। 
মোতি বলল-আরেকটু হলে তো তোমার প্রাণটাই নিয়ে নিত।
'এবারে আরো মার পড়বে।' 
'পড়তে দাও, বলদের জন্ম নিয়েছি, মার থেকে কতদূর পালাবো?'
'গয়া দুটো লোকের সঙ্গে দৌড়ে দৌড়ে আসছে। দুজনের হাতেই লাঠি আছে।' 
মোতি বলল-বল তো আমিও কিছু মজা দেখাই। লাঠি নিয়ে আসছে।
হীরা বোঝাল-না ভাই! দাঁড়িয়ে যাও।
'আমাকে মারবে তো আমিও এক-দুজনকে ফেলে দেবো।'
'না, আমাদের জাতির এটা ধর্ম নয়।' 
মোতি মনমরা হয়ে গেল। গয়া এসে পৌঁছালো এবং দুজনকে ধরে নিয়ে চলল। ভালো হলো যে সে তখন মারপিট করলো না, নাহলে মোতিও পাল্টা লড়াই করতো। ওর তেজ দেখে গয়া ও তার সহকারীরা বুঝে গেল যে এই সময় এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
আজ দুজনের সামনে আবার সেই শুকনো ভূষি দেওয়া হল। দুজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ঘরের লোক খাওয়া-দাওয়া করতে লাগলো। সেই সময় ছোট একটি মেয়ে দুটো রুটি নিয়ে বেরোলো আর দুজনের মুখে দিয়ে চলে গেল। ওই একটি রুটিতে এদের খিদে কি শান্ত হবে; কিন্তু দুজনের হৃদয় যেন খাওয়ার পেল। এখানেও কোনো সজ্জনের বাস রয়েছে! মেয়েটি ভৈরোর মেয়ে। তার মা মারা গেছে। সৎ-মা তাকে সবসময় মারতো। এইজন্য বলদদের সঙ্গে তার এক প্রকার আত্মীয়তা হয়ে গেছিল।
       দিনভর দুজনে হাল চালায়, মার খায়, এঁড়েমি করে। সন্ধ্যাবেলায় গোয়ালে বেঁধে দেওয়া হয় আর রাত্রে ওই বালিকা তাদের দুটো রুটি খাইয়ে যায়। প্রেমের এই প্রসাদের এমন গুণ ছিল যে দুই গাল ভুসি খেয়েও দুজনের কেউই দুর্বল হয়নি, কিন্তু দুজনের চোখে, রোমকূপে-রোমকূপে বিদ্রোহ ভরা ছিল।
একদিন মোতি মূক ভাষায় বলল-আর তো সহ্য করা যায় না হীরা!
'কি করতে চাও?'
'এক-আধজনকে শিঙে উঠিয়ে ফেলে দেব।'
'কিন্তু জানো ওই ছোট্ট মেয়েটি যে আমাদের রুটি খাওয়ায় তারই মেয়ে, যে এই ঘরের মালিক।এই বেচারী অনাথ হয়ে যাবে না?'
'তো মালকিনকে ফেলে দিই। ওই তো এই মেয়েটাকে মারে।'
'কিন্তু মেয়েদের ওপর শিঙ চালানো নিষেধ, এটা ভুলে যাচ্ছ।'
'তুমি তো কোনভাবেই প্রতিবাদ করতে দাও না। বলো তো, সবকিছু ছিঁড়ে পালিয়ে যাই?'
'হ্যাঁ এটা অস্বীকার করছি না, কিন্তু এত মোটা দড়ি ছিঁড়বে কি করে?'
'এর এক উপায় রয়েছে। প্রথমে দড়িগুলোকে চিবিয়ে নাও। তারপর এক ঝটকায় ছিঁড়ে যাবে।'
 রাত্রে যখন ওই বালিকা রুটি খাইয়ে চলে গেল দুজনে দড়ি চেবাতে লাগলো, কিন্তু মোটা দড়ি  মুখে ধরছিল না। বেচারারা বারবার জোর লাগিয়েও বিফল হচ্ছিল।
হঠাৎ ঘরের দরজা খুললো আর ওই মেয়েটি বেরিয়ে এল‌। দুজনে মাথা ঝুঁকিয়ে তার হাত চাটতে লাগলো। দুজনের লেজ খাড়া হয়ে গেল। মেয়েটি তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আর বলল-খুলে দিচ্ছি। চুপিচুপি পালিয়ে যাও, না হলে এখানকার লোক মেরে ফেলবে। আজ ঘরে আলোচনা হচ্ছিল যে, এদের নাকে দড়ি পরিয়ে দেওয়া হোক। মেয়েটি দড়ি খুলে দিল, কিন্তু দুজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
মোতি নিজের ভাষায় জিজ্ঞাসা করল-এখন পালাচ্ছ না কেন?
হীরা বলল-পালিয়ে গেলে কাল এই অনাথ মেয়েটির ওপর বিপদ নেমে আসবে। সবাই এর ওপর সন্দেহ করবে। হঠাৎ মেয়েটি চিৎকার করল- দুটো বলদ পালিয়ে যাচ্ছে! ও দাদা! দাদা! দুটো বলদ পালিয়ে যাচ্ছে, জলদি দৌড়াও।
             গয়া তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো এবং বলদদের ধরতে চললো। দুই বলদ দৌড় লাগালো। গয়া পিছু ধাওয়া করলো। তাদের গতি আরও তীব্র হলো। গয়া চেঁচামেচি শুরু করলো। আবার গ্রামের কিছু লোককে সঙ্গে নেওয়ার জন্য ফিরল। দুই বন্ধু পালানোর সুযোগ পেয়ে গেল। সোজা দৌড়াতে লাগলো। পথের হদিস জ্ঞান রইল না। যে পরিচিত পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ দেখতে পেল না। নতুন নতুন গ্রাম দেখতে পেল। তখন দুজনে একটি ক্ষেতের ধারে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো, এখন কি করা যায়।
হীরা বললো-মনে হয় রাস্তা ভুলে গেছি।
'তুমিতো দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে দৌড়ালে। ওখানেই ওকে মেরে ফেলা উচিত ছিল।'
'ওকে মারলে দুনিয়া কি বলবে? ও নিজের ধর্ম ছেড়ে দিয়েছে বলে কি আমরা আমাদের ধর্ম ছেড়ে দেব?'
দুজনে খিদেয় আকুল হচ্ছিল। ক্ষেতে মটর ছিল। চরতে লাগল। মাঝে মাঝে কান পেতে শুনছিল কেউ আসছে কিনা।
যখন পেট ভরে গেল, দুজনে স্বাধীনতার অনুভব করল, তখন আনন্দে নাচানাচি শুরু করল। প্রথমে দুজনে ঢেঁকুর তুললো তারপর শিঙ মিলিয়ে একে অন্যকে ঠেলতে লাগলো। মোতি হীরাকে কয়েক পা পিছিয়ে দিল, এমনকি খাদে ফেলে দিল।তখন সেও রেগে গেল, নিজেকে সামলে নিল আর মোতির সঙ্গে মিলে গেল। মোতি দেখলো খেলতে খেলতে ঝগড়ার উপক্রম হতে পারে, তখন একপাশে সরে গেল।
                                     
                                  
আরে! একি? একটা ষাঁড় হুংকার দিতে দিতে আসছে। হ্যাঁ, ষাঁড় বটে। ওটা সামনে চলে এলো। দুই বন্ধু আশেপাশে তাকাতে লাগলো। ষাঁড় পুরো হাতির মতো। ওর সঙ্গে লড়াই করা ঝুঁকির ব্যাপার। কিন্তু লড়াই না করলেও প্রাণে বাঁচা যাবে এমন মনে হচ্ছে না। এদের দিকেই এগিয়ে আসছে। কীরকম ভয়ঙ্কর দেখতে! মোতি মূক ভাষায় বলল-ফেঁসে গেলাম। প্রাণে বাঁচবো? কোন উপায় ভাবো।
হীরা চিন্তিত স্বরে বলল-নিজের অহংকারে ডুবে রয়েছে। অনুনয়-বিনয় শুনবে না।
'পালাচ্ছ না কেন?'
'পালানো কাপুরুষের লক্ষণ।'
'তাহলে এখানেই মরো। আমি পালালাম।' 
'আর যদি দৌড়ায়?'
'তাহলে কোনো উপায় ভাবো তাড়াতাড়ি।'
'উপায় এটাই যে ওর উপর দুজনে একসঙ্গে আক্রমণ করি। আমি সামনে থেকে ওকে সামলাই, তুমি পেছন থেকে আঘাত করো। দুদিক থেকে মার পড়লে পালিয়ে যাবে। আমাকে আক্রমণ করলে তুমি পাশ থেকে ওর পেটে শিং ঢুকিয়ে দেবে। প্রাণের ভয় রয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় উপায় নেই।'
          দুই বন্ধু প্রাণ হাতে নিয়ে আক্রমণ করলো। ওই ষাঁড়েরও সংগঠিত শত্রুর সঙ্গে লড়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। সে তো একজন শত্রুর সঙ্গেই লড়াই করতে অভ্যস্ত ছিল। যখনই হীরার ওপর হামলা করল মোতি পেছন থেকে তাড়া করল। ষাঁড় ওর দিকে ঘুরতেই হীরা হামলা করল। ষাঁড় চেয়েছিল এক এক করে দুজনকে কাবু করতে; কিন্তু এই দুজন-ও ওস্তাদ ছিল। ওকে সেই সুযোগ দিল না। একবার ষাঁড় প্রচন্ড লাফিয়ে হীরাকে শেষ করে দিতে উঠলে মোতি পাশ থেকে তার পেটে শিঙ ঢুকিয়ে দিল। ষাঁড় রেগে গিয়ে পেছনে ফিরতেই হীরা অন্য দিক দিয়ে শিঙ ঢুকিয়ে দিল। শেষে বেচারা জখম হয়ে পালালো আর দুই বন্ধু দূর পর্যন্ত তার পিছু ধাওয়া করল। শেষে ষাঁড় ক্লান্ত হয়ে পড়ে গেল। তখন দুজনে তাকে ছেড়ে দিল।
দুই বন্ধু জয়ের আনন্দে নাচতে নাচতে চললো। 
মোতি সাংকেতিক ভাষায় বলল-আমিতো চেয়েছিলাম ওকে মেরে ফেলি।
 হীরা বলল-পড়ে যাওয়া শত্রুর ওপর শিঙ চালানো উচিত নয়।
'এসব ঢঙের কথা। শত্রুকে এমন মারা উচিত যাতে আর উঠতে না পারে।'
'এখন ঘর কি করে পৌঁছাব সেটা ভাবো।' 
'আগে কিছু খেয়ে নিই তারপর ভাববো।'
       সামনে মটর ক্ষেত ছিল।  মতি তাতে ঢুকে গেল। হীরা বারণ করল, কিন্তু সে শুনলো না। দু-চার গ্রাস খাওয়া মাত্রই দুটো লোক লাঠি নিয়ে দৌড়ে এল আর দুই বন্ধুকে ঘিরে নিলো। হীরা আলপথে ছিল, বেরিয়ে গেল। মোতি ভেজা মাটিতে ছিল, ওর খুর কাদায় বসে যেতে লাগল। পালাতে পারলো না। ধরা পড়ল। হীরা দেখল, সঙ্গী সংকটে রয়েছে, তাই ফিরে এল। ফাঁসলে দুজনে একসঙ্গে ফাঁসবে। গ্রামরক্ষীরা তাকেও ধরে নিল। সকালবেলায় দুজনকে খোঁয়াড়ে পুরে দেওয়া হল।
               
                               
দুই বন্ধুর জীবনে প্রথমবার এমন হল যে সারাদিন কেটে গেল অথচ খাওয়ার জন্য একটুকরো খড়-ও জুটল না। বুঝতেই পারল না যে এই মালিক কিরকম। এর থেকে তো গয়া অনেক ভালো ছিল। এখানে কিছু মোষ, কিছু ছাগল, কিছু ঘোড়া, কিছু গাধা ছিল; কিন্তু কারো সামনেই খাবার ছিল না। সবাই মাটিতে মড়ার মতো পড়ে ছিল। কয়েকটা এত কমজোর হয়ে গেছিল যে দাঁড়াতেও পারছিল না। সারাদিন দুই বন্ধু দরজার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল; কিন্তু কেউই খাবার নিয়ে এল না। তখন দুজনে দেওয়ালের নোনামাটি চাটতে লাগলো, কিন্তু এতে কি তৃপ্তি হয়?
রাতেও যখন কিছু খাবার পাওয়া গেল না তখন হীরার মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল। মোতিকে বলল-আর তো সহ্য করা যায় না মোতি!
মোতি মাথা ঝুঁকিয়ে জবাব দিল-আমার তো মনে হয় প্রাণ বেরিয়ে যাবে।
'এত তাড়াতাড়ি হার মেনো না। এখান থেকে পালানোর কোনো উপায় ভাবো।'
'এস দেওয়াল ভেঙে ফেলি।'
'আমার দ্বারা আর কিছু হবে না।'
'এই যে খুব তড়পাচ্ছিলে।'
'সব তড়পানি বেরিয়ে গেছে।'
দেওয়ালগুলো মাটির। হীরা শক্তিশালী ছিল, ছুঁচলো শিঙ দেওয়ালে ঢুকিয়ে জোরে মারতেই মাটির এক চাঙড় খসে পড়ল। ওর সাহস বেড়ে গেল।
সেই সময় খোঁয়াড়ের চৌকিদার লন্ঠন নিয়ে পশুদের সংখ্যা হিসেব করতে এল। হীরার উচ্ছৃঙ্খলতা দেখে তাকে কয়েক ঘা লাঠির বাড়ি মারলো এবং মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে দিল। 
মোতি বলল-শেষে মার খেতে হল। কি পেলে?
'নিজের জোর লাগিয়ে মেরেছি তো।'
'এমন জোর লাগিয়ে কি লাভ যে বাঁধা পড়ে গেলে।'
'জোর লাগিয়ে মারতেই থাকবো, যতই বাঁধুক না কেন।'
'প্রাণে মারা পড়বে যে।'
'পরোয়া করি না। এটাও তো একরকম মরা। ভাবো, দেওয়ালটা ভাঙলে কত প্রাণ বাঁচত। এত ভাই এখানে বন্দি আছে। কারুর দেহেই জোর নেই। দু-চারদিন এরকম হলে সবাই মারা যাবে।'
'হ্যাঁ। এটা ঠিক। আচ্ছা, তাহলে আমিও জোর লাগাই।'
মোতিও দেওয়ালে ঐ জায়গায় শিঙ মারলো। একটু মাটি খসে পড়ল, ওর সাহস বেড়ে গেল। তারপর দেওয়ালে শিঙ দিয়ে এমনভাবে জোর লাগালো, মনে হল যেন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে লড়াই করছে। প্রায় দু-ঘন্টা এরকম করার পর দেওয়ালের উপরের একহাত অংশ পড়ে গেল। ও দ্বিগুণ শক্তি দিয়ে দ্বিতীয় ধাক্কা মারতেই দেওয়াল অর্ধেক পড়ে গেল।
দেওয়াল পড়ে যেতেই অর্ধমৃত পশুগুলির মধ্যে চেতনা ফিরে এল। তিনটি ঘোড়া তড়বড়িয়ে পালালো।এরপর ছাগলগুলো পালিয়ে গেল। মোষগুলোও পালাল। কিন্তু গাধারা আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল। 
হীরা জিজ্ঞেস করল-তোমরা দুজন পালাচ্ছনা কেন? এক গাধা বলল-যদি আবার ধরা পড়ে যাই? 
'তাতে অসুবিধা কি? এখন তো পালানোর সুযোগ পাচ্ছ।'
'আমাদের ভয় লাগে। আমরা এখানেই পড়ে থাকব।'
রাত্রি অর্ধেক পেরিয়ে গেছিল। দুজন গাধা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল পালাবে কি না আর মোতি নিজের বন্ধুর দড়ি ছিঁড়তে ব্যস্ত ছিল। যখন সে আর পারল না তখন হীরা বলল-তুমি যাও, আমাকে এখানেই পড়ে থাকতে দাও। অন্য কোথাও তোমার সঙ্গে দেখা হবে।
মোতির চোখে জল এল-তুমি আমাকে এতটা স্বার্থপর ভাবো হীরা? আমরা এতদিন একসঙ্গে থাকলাম। আজ তুমি বিপদে পড়লে, আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব?
হীরা বলল-অনেক মার খেতে হবে। লোক বুঝে যাবে যে এটা তোমার বদমাসি।
মোতি গর্বিত হয়ে বলল-যে অপরাধের জন্য তোমাকে বাঁধা হলো, তার জন্য যদি মার খেতে হয়, তো কিসের চিন্তা। এটাও হল যে ন-দশটা প্রাণীর প্রাণ বেঁচে গেল। 
তারা তো সবাই আশীর্বাদ করবে।
এই বলে মোতি দুই গাধাকে শিঙ দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে খোঁয়াড়ের বাইরে বের করে দিল, তারপর নিজের বন্ধুর পাশে এসে শুল।
ভোর হতেই মুন্সী আর চৌকিদার তথা অন্য কর্মচারীদের মধ্যে কেমন হৈচৈ আরম্ভ হল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মোতিকে খুব মারা হল আর মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা হল। 
              

                               
এক সপ্তাহ দুই বন্ধু বাঁধা পড়ে রইলো। কেউ একটুকরো খড়-ও দিল না। একবার জল দেওয়া হত। এটাই ওদের ভাগ্যে ছিল। দুই বন্ধু এত দুর্বল হয়ে গেল যে উঠতেও পারছিল না, পাঁজর বেরিয়ে এসেছিল।
একদিন খোঁয়াড়ের বাইরে ডুগডুগি বাজতে লাগলো আর দুপুর হতেই ওখানে পঞ্চাশ-ষাটজন লোক জমা হয়ে গেল। দুই বন্ধুকে বের করা হল আর সবাই তাদের দেখতে লাগলো। সবাই এসে এসে তাদের দেখল আর মন খারাপ করে চলে গেল। এমন আধমরা বলদদের কে কিনবে?
হঠাৎ এক দাড়িওয়ালা লোক, যার চোখ লাল আর ভঙ্গি অত্যন্ত কঠোর, এল আর দুই বন্ধুর কোমরে আঙুল ঢুকিয়ে টিপে টিপে মুন্সীর সঙ্গে কথা বলল।
তার চেহারা দেখে দুই বন্ধুর অন্তর কেঁপে উঠলো।ও কে আর কি বিষয়ে আলোচনা করছে, এই বিষয়ে দুজনের কোনো সন্দেহ রইল না। দুজন একে অন্যকে ভীত চোখে দেখল আর মুখ নীচু করল।
হীরা বলল-গয়ার ঘর থেকে তো পালালাম, এবার আর প্রাণে বাঁচব না।
মোতি অশ্রদ্ধার ভাব এনে ‌উত্তর দিল-ভগবান‌ নাকি সবার ওপর দয়া করেন। আমাদের ওপর তাঁর দয়া হয় না কেন?
'ভগবানের কাছে আমাদের বাঁচা মরা সমান। ভালোই হল, কিছুদিন তো ওনার কাছে থাকব। একবার ভগবান ঐ মেয়েটার রূপ ধরে আমাদের বাঁচিয়েছিলেন। এবার কি বাঁচাবেন না?'
'এই লোকটা আমাদের মেরে ফেলবে, দেখে নিও।'
'তো কিসের চিন্তা? মাংস, চামড়া, শিঙ, হাড়-সব কিছু না কিছু কাজে লাগবে।'
নিলাম হওয়ার পর দুই বন্ধু ঐ দাড়িওয়ালার সঙ্গে চলল। দুজনের শিরা-উপশিরা কাঁপছিল। কেউই পা তুলতে পারছিল না, কিন্তু ভয়ে ভয়ে যাচ্ছিল, কারণ একটু ধীর হলেই জোরে লাঠির মার পড়ছিল।
         রাস্তায় সবুজ মাঠের মধ্যে একদল গাই-বলদ চরছিল, সবাই খুশি ছিল, উচ্ছল, লাবণ্যময়। কেউ লাফাচ্ছিল, কেউ আনন্দে জাবর কাটছিল। এদের জীবন কত সুখের; কিন্তু সবাই স্বার্থপর। কেউই ভাবছিল না যে তাদের দুই ভাই কসাইয়ের হাতে পড়ে কতটাই দুঃখিত।
      হঠাৎ দুজনের মনে হলো যে এই রাস্তা তাদের পরিচিত। হ্যাঁ, এই রাস্তা দিয়েই গয়া তাদের নিয়ে গেছিল। সেই ক্ষেত, সেই বাগান, সেই গ্রাম আসতে লাগলো। প্রতি মুহূর্তে তাদের গতি বাড়তে লাগলো। সমস্ত ক্লান্তি, সমস্ত দুর্বলতা উধাও হয়ে গেল। এ তো নিজের গ্রামে চলে এলাম। এই কুয়োয় তো আমরা আসতাম। 
মোতি বলল-আমাদের ঘর কাছাকাছি চলে এসেছে। হীরা বলল-ভগবানের দয়া।
'আমি এখন ঘর পালাই'
'এ যেতে দেবে?'
'একে আমি মেরে ফেলবো।' 
'না না, দৌড়ে গোয়ালে চলো। ওখান থেকে আমরা কোথাও যাবো না।'
'দুজন পাগল হয়ে বাছুরের মত দৌড়াতে দৌড়াতে ঘরের দিকে চলল। ওই তো আমাদের গোয়াল। দুজনে দৌড়ে এসে গোয়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাড়িওয়ালাও পেছনে পেছনে দৌড়ে এল। 
        ঝুরী দরজায় বসে রোদ পোয়াচ্ছিল। বলদদের দেখেই ছুটল আর বার বার আদর করতে লাগল। দুই বন্ধুর চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু ঝরতে লাগলো। একজন ঝুরীর হাত চাটতে লাগল। 
দাড়িওয়ালা গিয়ে বলদদের দড়ি ধরল।
ঝুরী বলল-আমার বলদ।
'তোমার বলদ কি করে হল? আমি খোঁয়াড় থেকে নিলাম করে কিনেছি।'
'আমি তো ভাবছিলাম চুরি করে এনেছো। চুপচাপ চলে যাও। আমি বিক্রি করলে বিক্রি হবে। অন্য কারোর আমার বলদ নিলাম করার অধিকার নেই।'
'আমি থানায় খবর দেবো।'
'বলদ আমার। এর প্রমাণ এই যে এরা আমার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।'
দাড়িওয়ালা লাফিয়ে দুই বলদকে জবরদস্তি নিয়ে যাওয়ার জন্য এগোলো। সেই সময় মোতি শিঙ চালাল। দাড়িওয়ালা পিছু হটল। মোতি তার পিছু ধাওয়া করলো। দাড়িওয়ালা পালালো। মোতি তার পিছন পিছন ছুটলো। গ্রামের বাইরে বেরিয়ে যেতে সে থামল, কিন্তু দাঁড়িয়ে দাড়িওয়ালাকে দেখতে লাগলো। দাড়িওয়ালা দূরে দাঁড়িয়ে ধমকাচ্ছিল, গালি দিচ্ছিল, পাথর ছুঁড়ছিল আর মোতি বিজয়ী বীরের মতো রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছিল। গ্রামের লোক তামাশা দেখছিল আর হাসছিল।
যখন দাড়িওয়ালা হেরে চলে গেল তখন মোতি ফিরল। হীরা বলল-আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম যে রাগের মাথায় তুমি তাকে মেরে না ফেল। 
'যদি ও আমায় ধরত তাহলে আমিও ছাড়তাম না।'
'আর আসবে না।'
'এলে দূর থেকেই হামলা করবে। দেখি কেমন করে নিয়ে যায়।' 
'যদি গুলি করে মারে?'
'মরে যাব, তবু ওর কাজে লাগব না।'
'আমাদের প্রাণকে কেউ প্রাণ বলেই মনে করে না।' 'কারণ আমরা অত্যন্ত সরল।'
একটু পরে পাত্রে খোল ভুসি দানা ভরে দেওয়া হল আর দুই বন্ধু খেতে লাগল। ঝুরী দাঁড়িয়ে দুজনকে আদর করছিল আর একপাল বাচ্চা তামাশা দেখছিল। সারা গাঁয়ে উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছিল।
সেই সময় মালকিন এসে তাদের মাথায় চুমু খেল।
.........................


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
ঠিকানা - সুরতপুর, হরিরামপুর, দাসপুর,

পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614




ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...