Saturday 30 April 2022

নিমাই জানার কবিতা // ই-কোরাস ৫৪

 



নিমাই জানার  কবিতা


হলুদ রঙের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ও ৯০° ডিগ্রি পিপুল গাছ

যারা হলুদ রঙের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর পর তাদের দেহে মৃত্যুর ৩০° গজিয়ে ওঠে মৃত মাছের মতো , তারাই পরে বৈষ্ণব ধর্ম পালন করেছে অসহিষ্ণু হয়ে

যে নারী আধ্যাত্মিকতার দুটো তুলসী দানা হাতে ধরিয়ে বলে এ জন্মে আর কিছু নেই , পরজন্মে এসো একবার সাপের মৈথুন খেলি সে আসলে নারী নয় ট্যানজেন্ট ৯০° কোণের পিপুল গাছের ছায়া , তাকে অমর্ত্য বলি সত্যযুগের

আমি মন্বন্তরের পর্যায়গুলো শিখে চলি নরকের খণ্ডিত দেহগুলো পাশাপাশি রাখার পর

নৌকাটি আদিম ভগ্নাংশ ফেলে ঝলসে যাওয়া পাতার নিচে কিছু মায়ের আদ্যশ্রাদ্ধাদি উপকরণ কিনে নিয়ে ফিরি বৃষ্টিভেজা অন্ধকার রাতে

গন্ধেশ্বরী ভান্ডারের এক পুরোহিত ব্রহ্মাস্ত্র ফেলে একদিন আমার বিমুগ্ধ চোখের জলের উপর তাল পাতার নৌকা চালিয়ে দিলেন আমি একটি কালো রঙের মানুষ হয়ে গেলাম 

আমার কর্ণকুহর থেকে বেরিয়ে এল একজোড়া সাদা পায়রা সকলের ভেতরে থাকা অবৈধ বৃশ্চিক রাশি গুলি দোদুল্যমান সেফাড্রক্সিল খাওয়ার পর একটি হিমোফিলিক অন্ধকারে নিয়ে যায় 

আমি তাদের গোপন ওষুধ গুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে বের করে রক্ত বমি করার পর 

এখন খুব চন্দন বৃক্ষের দাম বেড়ে গেল অবৈধ গর্ভাধান রুখতে আসলে ,প্রতিটি পুরুষ মানুষের ও শ্বাসকষ্ট থাকা উচিত

ব্যাসদেব বলে গেছেন কালিয়া দহের নিচে কেন কালিয়নাগ বসবাস করত , সৌরভমুনি খুব ভালো অ্যাবস্ট্রাক্ট ইন্ট্রিগেশন জানতেন

.....................


লিভোসেটিরিজিন নারী ও ডান স্তনের ব্রাকিয়াল

আমার রাত্রি নামক রাজপ্রাসাদের ভেতর থাকা লিভোসেটিরিজিন নারীটি কখনোই রজঃস্রাবের সম্মতি দিত না

কোকিল বৃক্ষের মতোই ছিল তার চোখে অনন্ত দৈর্ঘ্যের ফলাফল , পাশুপত ঘরের ভেতরে থাকা কাঠের আলনা থেকে একটি সাপ প্রতিদিন মুখ বাড়িয়ে দীর্ঘ জিভ দিয়ে এঁটো করে দেয় আমার সৎ রঙের পরিচ্ছদ সকল 

একটি মৃত সুপুরি গাছের নিচে অসংখ্য মূলরোম উবু হয়ে বসে আছে আমার পূর্বজন্মের মতো 

তার গলায় থাকা অশরীরী মৃত্তিকা সকল উল্টে দেখি এরাই আমার একগুচ্ছ শুক্রাণু বহন করে নিয়ে যাচ্ছে চান্দ্রেয়ী নদীর দিকে , হলুদ সেবিকা আমার ব্রাকিয়ালের বদলে ডানস্তনে মাপনি চোঙ রেখে গেছে গলিত হৃদরোগ মাপার জন্য

একটি আগুনরঙা অন্ধকারের নিচে সব পোশাকেরা বৈমাত্রেয় বলে মনে হয় 

আমি আজ সারাদিন মৃত তন্ময়কে নিয়েই একটি শ্মশান গাছের চারা লাগিয়েছি তার মায়ের অবৈধ আতা গাছের নিচে

চারপাশে উবু হয়ে বসে আছি একটি মধ্যকর্ণিকার টকটকে লাল জিভ আলো রেখার নিচে 

আমাদের কালো রঙের ভঙ্গুর হাড়েরা নিজেদের থার্ড জেন্ডার জীবাণুর নাম করে ঘুমের আবছায়ায় চলে আসে

একে নীরব অঙ্কুরোদগম চাদরের মতো দেখায় , কোনদিন ক্রোমোজোমেরা ছোট জলাশয়টির সব জল খেয়ে নেবে আমরা ভুল করে দোষারোপ করব গ্রীষ্মকালকে

শংকর মান্না রঙের কোন রাতের বাউল আখড়া ছেড়ে বেরিয়ে আসছে অজয় নদের হাফ থার্মোমিটার জলের দিকে

......................


একগুচ্ছ সমর্পন ও ডিওডোরেন্ট গন্ধের 

আমার ডান অলিন্দের কুঠুরিটি বানপ্রস্থ নারীর জন্য সংরক্ষিত আছে আজো , আমি আকুন্দ ফুল ভালোবাসতাম শুক্লপক্ষের মতো

শুক্রাণুর গন্ধ কখনো পচন হতে পারে না বরং একটি রজনীগন্ধার ভেতর যে অন্ধকার থাকে তার ফুসফুস এখনো খুঁজে বের করতে পারিনি 

একটি মৃত পুকুরের চারপাশের জমাট অন্ধকার থেকে সিদ্ধার্থ প্রতিদিন উঠে দীর্ঘপথ পাড়ি দেন

দূরের বাগানবাড়িতে হেঁটে বেড়ালেই আমি কিছু ছিল পাতাবাহার নিয়ে দৌড়ে যায় নুপুরের শব্দ ফেলে 

ঈশ্বর প্রতিদিন পায়ে আলতা , নাকে নোলক এবং ১১ জোড়া সন্তানের মৃতদেহ রেখে যায় কাঁঠাল গাছের তলায় 

তারপর একদিন রাক্ষসের মতো এসে ভক্ষণ করে নেবেন ছায়া , কর্ম , দণ্ড , জ্ঞান , অজ্ঞান ,পাপ ও অভিশাপ সকল

আমরা কিছু সমর্পণের মন্ত্র শিখেছি আজকাল , হলুদ রঙ ফেলে কালাচ সাপেরা একটি ফিজিওলজিক্যাল ডিওডোরান্ট গন্ধ শুঁকে ভাসিয়ে চলে অষ্টবসুর নৌকা 

প্রজাপতি ১৫ ° সূক্ষ্মকোণকে ঈশ্বর ভেবে শুক্র গ্রহে লুকিয়ে রাখেন প্রতিটি জীবন চক্র ফেলে

.......................


নোঙরহীন নৌকা  ও দারুচিনির শ্বাসতন্ত্র

আমি নোঙর খুলে দেওয়ার পর সব নৌকাগুলি একদিন ফিরে আসবে মসজিদের পেছনে থাকা ছেঁড়া গোধূলির মতো

রক্তিম মৌমাছিরা নখর বের করে আমাদের তলপেট ছিঁড়ে খাবে আমি তখন বাড়ির দরজা থেকে উলঙ্গ দানার ঔষধ নিয়ে ছুটে যাব প্রাচীন ঘর অথবা জনপদের দিকে 

সকলেই এখানে শৈশবকে রেখে যায় নিজের বাড়ির বারান্দায় 

তারা সব হলুদ রঙের প্রজাপতি অথবা দারুচিনির মত স্থাপত্য জলাশয় অসংখ্য শিলালিপি ডুবিয়ে ছিঁড়ে খাবে আমাদের হৃদপিন্ডের কুঠুরি 

আর আমরা রাতের বেলায় সকলেই নিচু হয়ে একটি বারান্দার কাঁচ ঢাকা গোপন অঙ্গাণু গুলোকে টেনে নিয়ে সব চতুষ্পদের মতো বেঁধে রাখবে নিজের নৈমিত্তিক ছায়া খাটের নিচে 

সকলের হাতের নিচে কি স্বরবর্ণ লুকানো আছে , 

আমি শিশুদের মতোই ফুলের মধু খেয়ে নেওয়ার পর আজকাল আর কোনো মৃত গাছেদের সৎকার করিনা , 

একটি নিশাচর ভুল করে শাসনতন্ত্রের আলো জ্বালে নিশ্ছিদ্র বরফ দানা দিয়ে

আমি ১৮ টি পুরানখণ্ড পড়ে ফেলি মহেন্দ্রযোগ দেখে , সাদা রঙের অশ্বের মতো কৃষ্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে বিধুমুখী বসে আছেন

.......................


একটি জগডুমুর গাছ ও সাইক্রিয়াটিক পুরুষের ছায়া

নরম ভূষণ্ডির মাঠ থেকে ফিরে আসা দুটো শ্বাসযন্ত্র বুকে নিয়ে আমি রোপন করে চলি একটা মৃতপ্রায় বাগানের বক্ররেখা ,

প্রতিটি গাছের মূলগোড়ায় দাঁড়ালেই ছায়া ও ঈশ্বর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে , আর গাছের কুঠুরির ভেতর কালো রঙের পিপীলিকা একগুচ্ছ অন্ধকার নিয়ে বিষাক্ত যন্ত্রনা ঢেলে দেয় আমার বুকের ভেতর

আমি তবে নদীতে এত অশৌচ বলি কেন ,কারন আমার প্রতিটা দিন একেকটা আয়ু খেয়ে নেয় মৃত্যুর মতো এতো কাজল রাঙা চোখ দেখে নেওয়ার পর 

আমি কোন মাংসল অজুহাত রেখে যায়নি জগডুম্বর গাছের গোড়ায় , সর্পগন্ধার মতো অসংখ্য শহর ঝুলে আছে সবুজ ফলের নিচে

মৃত্যুর আগে নারীটি অহেতুক গোপনীয়তা লুকিয়ে রাখে নিজের ভেতর 

সাইক্রিয়াটিক পুরুষ মানুষটি একা একা বেদনার বসন্ত বাজাচ্ছে 

যে নৌকাটি ঘরের উঠোনে স্বচ্ছন্দভাবে যাতায়াত করতে পারে না সেই কেবল অ্যাটোরলিপ ১০ খায় কোলেস্টেরল কমাতে

হৃষিকেশ প্রদত্ত অসুখের কথাই যুদ্ধক্ষেত্রেও বলে গেছেন বৃষ্টিভেজা গতিশক্তি নিয়ে

..............…....


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - অরণ্য মণ্ডল

ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614










Saturday 23 April 2022

বসন্ত এনেছি রাই // শ্রীতনু চৌধুরী // ই-কোরাস-৫৩

 


শ্রীতনু চৌধুরী এর "বসন্ত এনেছি রাই" সিরিজের কবিতা

দ্রাক্ষাক্ষেতের দেবী


তোমার বিদিশার নক্ষত্রগুলি

এখনো ছুঁতে পারিনি রাধে

ওপারে যেতে চাইলেও

এক অলীক অসুবিধায়

স্তব্ধ রেখেছ সেতুবন্ধন

অথচ, তুমি নিজেই জানো না

কেন সেই লক্ষ্মণরেখা ?

কতবার বলেছি 

সামান্য এই পথ জুড়ে গেলে

সামনেই শর্করা ক্ষেত

ঘিরে আছে সবুজ বৃত্তায়ন

পরিধি প্রান্তরে ক্রমশ খসন্ত আয়ু

লক্ষ পরিক্রমার পর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে

অন্তর ভদ্রাসনে আবছা হয়ে যেতে পারে

সমূহ কৃষক মহিমা


শরীরের নালায় নালায় প্রবাহিত

তোমার অতুল ঐশ্বর্য

সিঞ্চন সুমিষ্ট হবে

অন্বয় অমরাবতী

তাই,হে দেবী

খুলে দাও দ্রাক্ষা দ্রাঘিমা

তোমার অমৃত পান করে

চিরহরিৎ হোক

আমাদের অবশিষ্ট ক্ষেত্রাবলী।


ইতিহাস


হাঁ আর না'র মাঝে 

ক্ষয়ে যাচ্ছে হীরক মুহূর্ত

বোধিবৃক্ষ নিকট বন্ধ চোখ

এভাবেই যাচঞা করি প্রেম

এভাবেই পেরিয়ে যায়

সকাব্দ শব্দমালা

কুড়ানো সময়গুলো

আঁচলে বেঁধে রাখো রাই

ওতে

শতাব্দীর ইতিহাস লেখা আছে।



সঠিক চুম্বন


সঠিক জায়গায় স্বরচিহ্ন না দিলে

অক্ষর যেমন অলংকার হয় না

সঠিক জায়গায় ধনুকচিহ্ন না দিলে

পুরুষ কখনো প্রেমিক হয় না


কোথায় চুম্বন রাখলে

কখনো একজন ব্যাধ

আবার কখনো নক্ষত্রপুরুষ

সে চকমকি বিদ্যা আছে

সরস্বতীর কাছে

সেখান থেকে চেয়ে নিয়ে

গড়ে নাও রাই 

ওষ্ঠ অভ্যেস

কেবল মনে রেখো

একটি প্রকৃত চুম্বনেই

একটি পথ

ঘর হয়ে যেতে পারে।



এখনো হরিৎ


দিকশূন্যে দাঁড়াই

মায়া ও মরীচিকা মুক্ত -একা

হরিৎহীন কৃষ্ণগহ্বর

অনন্ত প্রতীক্ষা নভোমন্ডলে ভাসায়

দৃষ্টি নৌকো

তার শুভ্রবস্ত্র হয়ে

উড়ে যাচ্ছে মেঘ

যুগল শ্বেতপদ্ম

কুলুঙ্গি থেকে বেরিয়ে

ওষ্ঠ উদগ্রীব

মাথা নত করে আমি

পৃথিবীর দিকে তাকাই

দেখি

গাছ পাখি প্রতিটি ধূলিকণায়

স্বহস্তে কেউ

সাজিয়ে রেখেছে প্রেম।



রাই-গ্রহ


আপেল সঙ্গতে চলে গেছে

তুলোর পাহাড়

নির্জন রোদে কেঁপে কেঁপে ওঠে

অসংযত অলিন্দ বিহার


কিছু নেই

সব নিয়ে চলে গেছ

একটি অদৃশ্য হাত কেবল

দিয়ে যায় নিঃশব্দ নিরাময়

শূন্য প্রহরে জানি,

এ ভূমি পৃথিবী নয়

একদিন ডাকা হবে ঠিক তাকে

রাই-গ্রহ নামে।

.................


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - সুব্রত ঘোষ

ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614








Sunday 17 April 2022

বসন্ত এনেছি রাই // শ্রীতনু চৌধুরী // ই-কোরাস-৫২

 


শ্রীতনু চৌধুরী এর "বসন্ত এনেছি রাই" সিরিজের কবিতা


অমরত্ব


তুমুল প্লাবন শেষে

ওই দেখো-

পলি হয়ে শুয়ে আছে

শুদ্ধ শতক

চলো

রোপন করে দিয়ে আসি

অমরত্ব বীজ

নদীগুলি যদি ভেসে যায় তারপর

শিলাবতী জলে-

ক্ষতি নেই

এ জন্মে অন্তত একবার

তোমাকে ছুঁয়ে

পবিত্র হয়ে গেছি,রাই।

............


ওষ্ঠ উপাখ্যান


কোথায় ছোঁয়াবে ঠোঁট?

কপালে?

মা রোজ ওখানে দিয়ে যান আশীর্বাদ

গালে?

এমন হৃদয়হীন আদিখ্যেতায়

আমি লোভ করি না

তবে ওষ্ঠে?

কত মুদ্রায় প্রেয়সী পিপাসা

পান করে উষ্ণ প্রস্রবণ


তার চেয়ে 

ছুঁয়ে দাও বুক-এখনো নিদাগ

বিলিয়েছ মঞ্জুরি অন্য অভিধায়

চেখেও দেখোনি স্বাদ

এসো, যেখানে বসে আছো দেবী হয়ে

সেখানে নিজেই নিজের ঠোঁটে রাখো ঠোঁট

পরখ করে নিজস্ব অমৃত আস্বাদ

বুঝে নাও

আমাকে দেবার আগে 

আর কত ঢালতে হবে প্রেম

ওষ্ঠ উপাখ্যানে !

..............



খেলাপাতি


ছাদ কতটা লম্বা হলে

তোমাকে ঘরে নেওয়া যায়

ভাবতে ভাবতেই

আকাশের নিচে টাঙানো দেখি

অজস্র শামিয়ানা

দিগন্ত ছুঁয়ে

চৈ-চৈ শব্দে ভাসিয়ে দিই ডাক


কোথাও লেখা নেই ঘরের ঠিকানা

শূন্যে ঝাড় লন্ঠন 

বিস্তীর্ণ এই সরোবরে

এসো রাই

এবার একটি 

খেলাপাতি সংসার গড়ি ।

...............


যুদ্ধ


দূর নয় মধ্যরাতের দামামা

নিপুন সেনা প্রস্তুত করেছে ব্যূহ

আপ্রাণ চেষ্টা

নিশ্ছিদ্র বর্মে ঢেকে নিতে শরীর

খুলে খুলে পড়ে যাচ্ছে তবু

সন্ধি বোতাম


ফিরতে হবে

ভেরি আর যুদ্ধর মাঝে দাঁড়িয়ে

বিরাট একটা শূন্য

কয়েকটি ধবলি প্রস্তুত রেখো রাই

গোচারণেই

পেরোনো যায় অতৃপ্ত বৈতরণী ।

..................



সঞ্চিত সাধন


আকাশমনি অন্ধকারে

সোনাঝুরি শিঞ্জিনি-পূর্ব জন্ম স্মৃতি

তোমার বুকের চন্দন গন্ধ

বৌদ্ধস্তুপের পান্থ পাদপ

ক্রোধ,হতাশা,যাবতীয় অভিমান

আঁচলের প্রতিটি ভাঁজে গুঁজে দিতে দিতে

কখন যেন তোমার বুকের উপরেই

ঘুমিয়ে পড়ি

শতাব্দীর পর শতাব্দী

এমনই প্রগাঢ় ঘুমে

আরো ঘুমোতে চাই

হাজার বছর


মাথায় বোলানো তোমার প্রেমার্ত অলপদ্ম

যদি কখনো ক্লান্তকুসুম

হয়ে যায় স্থির

ছিন্ন ঘুমের সাক্ষাতে

বিলোল বাহুতে আমার মাথা রেখো

বড় যত্নে মজুত রেখেছি রাই

শুধু তোমারই জন্য

প্রজন্ম সঞ্চিত 

সাধন বৈভব।

..............


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614










Thursday 14 April 2022

একটা পয়লা বৈশাখ // ই-কোরাস ৫১

 



মধু ও মাধবের মুখ

সঞ্চিতা দাস

নদী শুকিয়ে ক্রমশ রোগা হয়ে যাচ্ছে, পুকুরের জলে কচিকাঁচারা মাছ ধরতে ব্যস্ত। খাদানের জল তলানিতে পৌঁছালেও নীল রং এখনও যায়নি। বাংলার মাঠ সবুজ ধানের ফুল নিয়ে সত্যের মতো ঝলমল করে দুলে উঠছে। খেলার মাঠগুলোয় ফাটল দেখা দিলেও যারা খেলার তারা আপন মনে খেলছে। দু-এক দিন আকাশ কালো করে এসে হাওয়া দিলেও বৃষ্টি আমাদের ছুঁয়ে যায়নি। চৈত্র মাস পেরিয়ে বৈশাখের দিকে এগোচ্ছে গরমের দুপুর! উনুনের আঁচে বস্তিবাসী মা-মেয়ের চোখের জল ঝলসে যায়। দূরে কোথাও কোকিল কোথাও ঘুঘু ডাকছে। মন পলকা বাতাসে গাছের পাতার মতো কেঁপে ওঠে। এক নিস্তব্ধ আবেগে কেউ গোরুকে খেতে দেয়, স্নান করায়, পাখিদের জন্য কটা মুড়ি ছড়িয়ে রাখে উঠোনে।   


পুরোনো বাংলার পটে আবার নতুন করে ফুটে উঠছে মধু ও মাধবের মুখ।

                      ……………… 



পয়লা বৈশাখের ওপার এপার 

আশিস মিশ্র 

বাংলাদেশের কয়েকজন শিল্পী। একসঙ্গে। একটি গান গাইছেন-- "এসো হে বৈশাখ এসো এসো.. "। তাঁদের অপূর্ব গায়কী মুগ্ধ করে। বয়সে তাঁরা নবীন-নবীনা। সেই গান শুনতে শুনতে আমার বাংলাদেশ যাওয়ার কিছু স্মৃতি মনে পড়ে। চৈত্রসংক্রান্তির দুপুর। আমরা একদল ভারতীয় কবি ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা শহরে প্রবেশ করলাম। ঢাকার মালিবাগ। ক্লান্তি থাকলেও, সেই শহরের চারপাশ দেখে চলেছি। সবকিছু গ্রহণ করে ফিরতে হবে যে। দেখতে দেখতে মালিবাগে বিকেল। গোধূলি। সন্ধ্যা। এতো মানুষের সমারোহ? কেন?  

কাল যে পয়লা বৈশাখ। সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ নতুনকে বরণ করবে। নতুনের স্বাদ গ্রহণ করবে। তাই সংক্রান্তির দিনে কেনাকেটার ভিড় উপচে পড়েছে শহরের রাস্তায়। একটা গোটা রাষ্ট্র নববর্ষের আনন্দে অবগাহন করবে। এমনটা যদি এপারেও হতো! এপারের বাঙালি কি আস্তে আস্তে বিরিয়ানি-বন্দী হয়ে গেলো? ওপারের বাঙালির সঙ্গে এপারের বাঙালির মেলবন্ধন অটুট থাকলেও, ওপারের মতো নববর্ষকে আমরা গ্রহণ করতে পারিনি। যতটা গ্রহণ করেছি হ্যাপি নিউ ইয়ার বা ২৫ ডিসেম্বর, ততটা যদি পয়লা বৈশাখকে গ্রহণ করতাম, তাহলে বাঙালির মনন জগত আরও অন্যরকম হতো। সেই চৈত্র সংক্রান্তির রাত। এপারে ফিরছি। বাসের মধ্যে। একটি টেলিফোন। ব্যথাময় তার কথা। সে এক নারী। ধানমণ্ডি থেকে আসা সেদিনের মালিবাগে দাঁড়িয়ে আমাকে বিদায় জানালো। তার দুচোখে তখন অশ্রুর প্রবাহ। কিন্তু কেন?  তার সঙ্গে তেমন কিছু তো হয়নি! চৈত্র সংক্রান্তির রাত। কখন যে বাসের মধ্যে চোখ বুজে এলো। কখন যে পয়লা বৈশাখ এসে আমার পাশে বসেছে। মনে হলো এ তো বৈশাখ নয়, এ সেই ধানমণ্ডির নারী। যে আমার কাছে আজও নতুন প্রেমের মতো। আবার যদি তার সঙ্গে পয়লা বৈশাখে দেখা হয় কোথাও!

                      ………………… 



ইন্সপিরেশন ও নিরন্তর চলা 

অলক জানা 

চুল্লিতে গনগনে নেগেটিভ আগুনের দাপুটে ফুলকি। ইঁটভাটার চিমনি কি অদ্ভুৎ না? উগ্রে দিচ্ছে বিবিধ দেশীয় আকৃতির কালো কুণ্ডলী  ধোঁয়ার রাজপাট। উগ্রমতি তাপীয় বৈশাখের সুর ও চিমনি প্রস্তাবের যৌথ খরমিথুন উৎসবে ইন্ধন জোগায় দগ্ধদিনের কৃষ্ণচূড়া। দু-পাড় বরাবর দাউ দাউ অগ্নিশিরার বিন্যাস, তো সেখানে নম্র-ঢেউ জলের অভিবাদন থাকবে এটাই সাচ্চা স্বাভাবিক। হাতবাড়ালে প্রতিদিনের কেলেঘাই। শান্ত স্মিত জলজ হৃৎপিণ্ডের সহমর্মীতা। 


বৈদ্যুতিনবাসা হোয়াটস অ্যাপে 'সুপ্রভাত' বিনিময়েয় পর ফোনটা বেজে উঠলে কতকিছুই গৌণ। সীমান্তের যুদ্ধ, মূল্যবৃদ্ধি, দলবদল কেচ্ছা অথবা প্রশ্রয়ের বউপলায়নের মতো ছিন্নপত্রের পদাবলি। তবে সংলাপের অস্থিমজ্জায় বিনীত মন্ত্রোচ্চারণের ১৮০ ডিগ্রি সমান্তরাল বৃষ্টিরেখা হেরফের সময়ের পরও ধ্রুবক। প্রেম মচকায়, ভাঙে না। আহত হয় কিন্তু নিহত না হয়ে বিনির্মাণে ফুটে ওঠে একটি নির্বাচিত ফুল। 


রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রায়ত্ত সবকিছু এখন মালিকানাধীন। আমার মেধা, আমার শ্রম বিকৃত পোস্টারে ছয়লাপ করে একদল আততায়ী বুনো ভয়। অসিত, দেবাশিসবাবু, সঞ্জয়রা একটা উজ্জ্বল স্বপ্নের মাছকে বশ মানাতে পেরিয়ে যাচ্ছে চৌরাস্তার কোলাহল, সহযাত্রী আমিও।কাঁটাখালি স্টপেজ ছেড়ে যাচ্ছে যাত্রীবাহী বাস,এক যন্ত্রপুট শকট সবপেয়েছির মহানগরের পথে, আমি তাকে অনুসরণ করি। 


বাঁশপাতা গ্রামের অনুৎপাত মৌনমেঘ গঙ্গানদী পেরিয়ে গেলে বৃষ্টিহীনের মতো হৃদয়হীন হয়ে পড়ে। এ অনর্থক অশান্তি কার ভালোলাগে ? সমর্পিত হোক যাবতীয় যত্নের আড়াল অক্ষর। পৃথিবীর প্রতিটি সুচারু শিল্প সেটাই দাবি করে। কিছু খুটখাট বিপন্ন মনখারাপ চিরদিনের জন্য মুক্তি চায়। আকার পেতে চায় সংরক্ষিত  মনোভাব। নতুন সূর্যোদয়ে হে নিস্তারিণী আমার এ নিবেদন মঞ্জুর হোক।

                           …………………



শিক্ষিত বাঙালি ও বাংলা নববর্ষ

সন্দীপ দত্ত

বাঙালির ঐতিহ‍্য, বাঙালির সংস্কৃতি, বাঙালির আবেগ মিলেমিশে যখন বাঙালিয়ানা হয় এবং সেই শাশ্বত বাঙালিয়ানা অভিমুখ যদি যন্ত্রের দ্বারা চালিত হয়, তাহলে যুগের ওপর তার প্রভাব পড়তে বাধ‍্য। তাই বলতেই হয়,বর্তমান সময়টাতে আমরা যারা বাঙালি, প্রত‍্যেকেই এক মেকি বাঙালিয়িনার যুগে বাস করছি। বাঙালির গায়ে শিক্ষিত'র তকমাটা আজকের নয়,বহুদিনের। শতকের আগেই বাঙালির ইতিহাসে অনেক বিদ্বান বিদুষীর সন্ধান আমরা পেয়েছি।


আসলে শিক্ষার ধারাটাই অন‍্য খাতে বইছে এখন। যে কারনে তাদের স্বশিক্ষায় কোথাও যেন একটা ভাঁটা দেখতে পাই। অতিরিক্ত ইংরেজি অনুকরণ অনেকটাই এর জন‍্য দায়ী। সাধারণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে আজকের বাঙালি, অথচ অসাধারণ মেধা। ভাবলে অবাক লাগে।


আধুনিক শিক্ষার এই জাঁতাকলেই আজ হাঁসফাঁস করছে বাংলার অনেককিছু। হারিয়ে যাচ্ছে আঞ্চলিক নানা উৎসবগুলো। হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির পরম্পরা। বাংলা নববর্ষই বাদ যায় কেন? তাই জৌলুস হারাচ্ছে ১ লা বৈশাখ। স্বকীয়তার জৌলুস। আজকের এই কৃত্রিম আলোময় পৃথিবীতে জোনাকির দাম কোথায়? হ‍্যাঁ,জোনাকিকে দেখবার ইচ্ছে হয় কেবলমাত্র উপভোগের জন‍্য। বাংলা নববর্ষও আজ তাই জাস্ট সেলিব্রেশন। বারো মাসের নাম জানব না, কোন বঙ্গাব্দ জানব না, শুধু নতুন জামাটি পরব আর বিকেল নামলে প্রেমিক প্রেমিকার হাত ধরে কোনও রেস্তরাঁয় চলে যাব চাউমিন খেতে। আর একটু সাহসী হলে যুগলে মিলে হুইস্কির পেগে চুমুক। এই তো আজকের বাঙালির বর্ষবরণ।


এমন অনেক শিক্ষিত বাঙালি চাকুরিজীবীকে দেখেছি, দেখেছি শিক্ষক অধ‍্যাপকদের, বাংলা মাসের নামগুলোও যাঁরা ঠিকঠাক বলতে পারেন না। তারিখ তো অনেক দূরের ব‍্যাপার। যেটা লজ্জার!


বাংলা নতুন বছর তাই আসে প্রতিবারই। প্রতিবারই ফিরে যায় মনমরা হয়ে। পরম্পরা হারাতে থাকে।

                        …………………. 


বর্ষসঙ্গীত

তপনজ্যোতি মাজি

বর্ষ যায়। বর্ষ আসে। জেগে থাকে দ্বীপের মতো,

টিলার মতো ঘটনা নির্ভর, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া স্মৃতি।


স্পর্শ করে যাওয়া স্মৃতিগুলোকে কবিতা মনে হয়। মনে হয় ক্রমাগত লিখে যাওয়া অনিঃশেষ পংক্তিসমগ্র। স্মৃতিমনস্কতার আবহে ভোরের নির্জন দিগন্তে চিরতরুণ সূর্যের অনির্বচনীয় প্রাত্যহিক উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সূচনা হয় আর একটি নতুন দিনের। বৈশাখের প্রথম প্রভাত। নববর্ষের মাঙ্গলিক পদার্পণ। উৎসবপ্রিয় বাঙালী জীবনে নববর্ষ তাই-

যতখানি মাঙ্গলিক, ঠিক ততখানি উৎসবময়।লক্ষ্য করার বিষয় হলো, ব্যবসাবাণিজ্য সম্মন্ধে বাঙালির উদাসীনতা বিষয়ে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গুলিতে ক্রেতাদের বিশেষভাবে অ্যাপায়ান করার জন্যে পূজাপাঠ এবং নতুন খাতার শুভসূচনা হয়। নববর্ষ হয়তোবা

বাঙালিকে স্বাবলম্বী হয়ে উঠার স্বপ্ন দেখায়।


রুদ্র বৈশাখের সঙ্গে বাঙালি মননের নিবিড় যোগসূত্র রচনা করে গেছেন আমাদের সাংস্কৃতিক ঈশ্বর রবীন্দ্রনাথ। বৈশাখ এলেই মনে জেগে ওঠে কবিপক্ষ,কবির কবিতা ও গান। এমন বিপরীত আবহে কবিতা ও সংগীতের সর্বজনীন দোলা বোধ করি নববর্ষের উজ্জ্বল অর্জন। প্রত্যয় ও হৃদয় কে একই সূত্রে গ্রন্থিত করার বিরল পরম্পরার সৃষ্টিপুরুষ তিনি। তাঁর জন্ম এই দীপ্ত বৈশাখেই। দাবদাহকে পরাজিত করে দক্ষিণসমীরের স্পর্শে মনে আসে কবিতা ও গান। যেন বর্ষব্যাপী যে সঙ্গীত আমাদের মননে গুনগুন করে নিরবচ্ছিন্ন আবহমানতায়, তার শুরু হয় নববর্ষের আলোকিত সকালে।

                        ………………….. 


পয়লা বৈশাখ; একলা বৈশাখ নয়

বিকাশ চন্দ 

আবার একটা পয়লা বৈশাখ ছুঁয়ে ১৪২৯ শুরু।  নতুন বছরের সময়ে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি এ বিশ্লেষণ চলতেই থাকবে, আর ভেতরে ভেতরে একটা তাগাদা জন্ম নেয় নতুন প্রাপ্তি বিষয়ক অবচেতন আগ্রহ। মনে পড়ে খুব ছোট বেলা মাটির তুলসীমঞ্চতে কাঠি বেঁধে ঝোলানো নতুন ছোট মাটির হাঁড়ি / ঠেকি, তলাতে একটা ছোট ফুটো, ফুটোতে একটা ছোট খড় ঢোকানো, যেখান থেকে চুইয়ে পড়বে ফোঁটা ফোঁটা জল তুলসী গাছের গোড়ায়, বসুন্ধরা তৃপ্ত হবে। একদম সকালে কাজটা করতেন স্নানের পরে ঠাকুমা বা মা, জানিনা এপ্রথা অক্ষুণ্ণ আছে কিনা প্রতি ঘরের উঠোনে। আর বাকি দোকানে দোকানে নতুন খেরোখাতায় লিখে হালখাতা, শুভমহরৎ, গণেশ পুজো সব কিছু চলে আসছে প্রথা মাফিক সে প্রথম প্রথাগত ইতিহাসের যুগ থেকে। মনে হয় বাংলা নববর্ষের কৌলিন্য অনেকটা ম্রিয়মাণ ইংরেজি নববর্ষের উদ্দাম দাপটে। তবু্ও বারো মাসের তেরো পার্বণের প্রথম পর্ব বাঙলার নববর্ষের পয়লা বৈশাখ ভুলি কি করে। এখন বেশ মজা, চৈত্র শুরু হলেই খুড়োর কলের মতোই কী নগর শহর মফস্বল গঞ্জ সর্বত্র ঝুলতে থাকে চৈত্র সেল, সেল, সেল- জানান দেয়া আবার নতুন বছর 'এসো হে বৈশাখ...। ভাষা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কি পুরুষ কি নারী আবাল বৃদ্ধ বণিতা বেশির ভাগই ভিড় জমায় কেনা কাটায় ফুটপাত  থেকে মেগাশপে সারা বছরের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে রিবেটে। একাজে যে কতটা বাঙালীয়ানা গর্বিত হয় সে প্রশ্ন অবান্তর। সারাটা ১৪২৮ সাল দেখেছে ভাষা জাতি ধর্মের নামে বীভৎসতা, অকাল যুদ্ধের দামামায় মৃত্যুর বিভীষিকা, শিশু ঘাতী নারী ঘাতী নারকীয় পরিণাম, কর্মহীনতা, অসহনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অসহ্য অসামাজিক কার্যকলাপ, এই অশুভ বিষয়গুলির

সাথে করোনার মতো বিশ্বজোড়া ভয়াবহতার সর্বনাশা যা শরীর থেকে শরীরে মরণ যোগ বয়ে আনলো, ১৪২৯ তে যেন এসবের আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। হ্যাঁ, আমরা ভারতবাসী, বিশ্বাস করি ভারতীয়ত্ব আমাদের মর্যাদার ধারক বাহক, তেমনই  'বাঙালীর ঘরে যত ভাই বোন এক হোক এক হোক' এই আকুল আত্মকথন কেন ভুলে যেতে হবে ! কার দোষ, কিসের দোষ, এসব না ভেবে বাঙলার কৃষ্টি সংস্কৃতির সঠিক দর্শনকে উপলব্ধি করার সময় এসেছে। বকেয়া খেরোখাতায় ধার দেনা শোধ, ক্যালেণ্ডার, মিষ্টি ঠোঙ্গা,  ভুরিভোজ নিয়ে ১লা বৈশাখ প্রতিবার আসে কিন্তু বাঙালির প্রিয় ভাষার মর্যাদা,  বাঙালিত্বের আত্ম-সমীক্ষার মধ্য দিয়ে বাঙালির জাত্যাভিমান টুকু ভুলে গেলে হয়তো ১৪২৮ বছরের আগে দাসত্বের হালখাতায় পৌঁছে যাব। প্রার্থনা,  আসুন ১লা বৈশাখ কৃষ্ণ চূড়ায় আমের শাখায় শিক ডাবে পূর্ণ ঘটে প্রতি উঠোনে সূর্য সকালের সাগ্নিম স্নিগ্ধতায় সকল গাছের কচি পাতায় ফুলে ফলে মানুষের সংসারের অনিন্দ্য উৎসব যেখানে যেমন, তা যেন অবক্ষয়ের রক্তক্ষরণে অন্তরাত্মা না ভিজে যায়। ১লা বৈশাখের মঙ্গলদ্বীপের আলো প্রতি বাঙালির ঘরে বিশ্বময় শাস্বত হোক, সংস্কারমুক্ত মর্ম বোধের এই ধারাবাহিকতা বিমুক্ত মনে আজকের দিনে মুক্ত আলোয় বাঙালির নববর্ষের এই মঙ্গলবার্তা ধ্বনিত হোক। সার্বজনিক নববর্ষের পয়লা বৈশাখ যেন কখনো একলা বৈশাখ না হয়ে যায়।

                    ……………………


আমার চেতনায় বাংলা নববর্ষ

তারাশংকর দাসবৈরাগী

বসন্ত শেষে রুদ্রের বেশে বৈশাখ এসে দ্বারে

নবীন কেতন উড়িয়ে যতনে আমোদে কামোদী গায়,

দীপকের রাগে জাগিয়ে মনন বরণ করো গো তারে -

আশাবরী আলো উঠবেই জ্বলে জীবনের আঙিনায়।


সময় এগিয়ে চলে। দিনের পরে দিন যায়। ঋতুর পরে ঋতু। জীর্ণ পুরাতনকে মুছে ফেলে একটা বছর শেষে আসে আবার একটা নতুন বছর। আসে নতুন আশা ও স্বপ্ন জাগিয়ে। সারা বছরের যাবতীয় ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে নব নব সাফল্যের বার্তা বয়ে আনবে নতুন বছরটি-এমনই প্রত্যাশা জাগে প্রায় সবার মনে। প্রতীক্ষার দীপ জ্বেলে বরণ করি নতুন বছরটিকে। বাঙালি হিসেবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ পয়লা বৈশাখ।


কিন্তু সত্যিই কি আগের বছরের সমস্ত গ্লানি, ব্যর্থতার কালো দীর্ঘশ্বাস মুছে যায় নববর্ষের বন্দিত বাতাসে ? বোধহয় না। সম্ভবও নয়। সময় এগিয়ে চলে প্রকৃতির নিজের খেয়ালে। মানুষও নিয়ম মেনে ছুটে চলেছে তার পিছু পিছু। সেই অনাদি কাল হতে। যখন সময়ের হিসেব নিকেশ ছিল না, বৎসরের গণন ছিল না, সঙ্গত কারণে নববর্ষকে ঘিরে উৎসব-আহ্লাদ ছিল না। সভ্যতা এগিয়েছে। কালের যাত্রাপথে এসেছে খ্রিস্টাব্দ, হিজরি, বঙ্গাব্দ প্রভৃতি সময় গণনার বিশেষীকরণ। বঙ্গাব্দের প্রচলন গৌড়রাজ শশাঙ্ক করেছেন কিনা, 'পয়লা বৈশাখ' বাংলা বছরের প্রথম দিন-এই ঘোষণা মুঘল সম্রাট আকবর করেছিলেন কিনা, এসব ঐতিহাসিক বিতর্কে না গিয়েও আমরা বলতে পারি, এই দিনটি বাঙালির আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সেই কবে থেকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। আমরা ছোটো- বড়ো, ধনী-গরীব, জাত-ধর্ম নির্বিশেষে আপামর বাঙালি কোনো না কোনো ভাবে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ দ্বারা প্রভাবিত হই। হ্যাঁ, আগেও হতাম। এখনও হই। হয়তো প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই ধারাবাহিক পরম্পরা এগিয়ে নিয়ে যাবে।


তবে সময়ের সাথে সাথে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের রীতি বা পদ্ধতি পাল্টেছে। মনে পড়ে, আমার ছোটো বেলায় পয়লা বৈশাখ কবে আসবে তা নিয়ে অধীর হয়ে থাকতাম। আর শুধু নববর্ষ বলে নয়, তার আগে চৈত্র সংক্রান্তি, চড়ক পূজা, শিবের গাজন উপলক্ষ্যে গ্রামীণ মেলা, যাত্রা গান, মেলায় কাঁঠাল পাতার মোড়কে তালপাতার চামচ দিয়ে দশ পয়সার ঘুগনি কিংবা দু পয়সার লাল-নীল-হলুদ রঙের আইসক্রিম কিনে খাওয়ার স্বাদ নেওয়ার সুযোগ হাতছানি দিয়ে ডাকত। অনাবিল আনন্দের স্রোতে ভাসতাম আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের আন্তরিক সাহচর্য পেয়ে। আর পয়লা বৈশাখ হালখাতা সেরে সন্ধ্যা বেলায় বাবা কখন মিষ্টির ঠোঙাগুলো (প্যাকেট নয়) নিয়ে আসবে তা ভেবে সময় যেন কাটতেই চাইত  না। হ্যাঁ, তখন দেখেছি, ছাপার অক্ষরে ঝাঁ চকচকে কার্ড নয়, মুদিখানা থেকে ডাক্তারখানা, কাপড় দোকান থেকে সোনার দোকান - সবাই হাতে লেখা আমন্ত্রণ পত্র পাঠাতো। তাতে কিন্তু আন্তরিকতার কোনো অভাব থাকতো না। আর আপ্যায়ন করা হতো একটা কাগজের ঠোঙায় মোড়া গোটা চারেক হাতে বানানো বোঁদের মিঠাই দিয়ে! কারো কারো ক্ষেত্রে কখনো কখনো ঠোঙায় থাকত এক আধটা নিমকি। কিন্তু সেই মিঠাইগুলোর যে স্বাদ তখন হৃদয় ভরে উপভোগ করেছি এখন এই হাইটেক যুগে হালখাতা পূজা উপলক্ষ্যে বিভিন্ন দোকান থেকে প্যাকেট ভর্তি নামি দামি কোম্পানির অভিজাত যেসব মিষ্টান্ন আসে, কই আজকালকার ছেলেমেয়েরা সেগুলোও আনন্দ ও তৃপ্তির সঙ্গে গ্রহণ করে কিনা আমার সন্দেহ আছে।


নববর্ষ পালনের মধ্যে এখন জৌলুস বেড়েছে অনেক, আড়ম্বর-উৎসাহের সীমা নেই। কিন্তু সব বিষয়গুলোই কেমন যেন আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে, আনন্দ ও আন্তরিকতা কতখানি আছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবুও নববর্ষ স্বাগত। নববর্ষ এসেছে। আসবে। নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়েই নতুন বছর ফিরে ফিরে আসুক পয়লা বৈশাখের পুণ্য প্রভাতে। বাঙালি-জীবন এর চেনা সঙ্গী হয়ে। আর অতিমারী ও যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আতঙ্কিত পৃথিবীর এককোণে বসে ১৪২৯ বঙ্গাব্দের ভোরে আমাদের সবার প্রার্থনা হোক -

হিংসার বিষ নির্মূল করো, ঘৃণা দাও দূরে ঠেলে,

বিশ্বাসেরই বৃন্তে ফুটুক সত্যের সাদা ফুল।

জ্ঞানের আলো চেতনার দীপে ভালোবাসা দিক জ্বেলে

বিবেকের বাণী ছড়িয়ে পড়ুক মুছে যাক সব ভুল!

                   ………………… 



যে জন্য একটা ১লা বৈশাখ সাজাই

মলয় পাহাড়ি

'বাবাই টি সেন্টার' হালখাতা পুজোর অনুষ্ঠানে ডেকেছে, আন্তরিক উষ্ণতা ছিল তার গলায়। গেলে কিছু কাজ হয়, সঙ্গে একখান মিষ্টির প্যাকেট ফোকটে, আর একটা ক্যালেণ্ডার,১৪২৯এর। মেয়ে খুশি হবে। 


কাজের ছুটি। খাওয়া দাওয়ার কিছু বিশেষ আয়োজন করলে হয়, মানে করতেই পারি ভেটকির পেটি সঙ্গে ঘাড়ি শোল, একসাথে বসে খাওয়া। বউ এর ভালো লাগবে।


সুজিতদা ফোন করেছিলেন, বললেন চলে এসো শিলিগুড়ি, আমার 'একটা অ্যানিভার্সারি' আছে,পরের দিন সাহিত্য উৎসব, দু'পঙক্তি লিখে সুজিতদাদের ভালোবাসা পাওয়া একটা অন্য রকমের ব্যাপার।


সংক্রান্তির দুপুর গড়ালে, যখন লিখছি এসব হাইটেনশন লাইনের উপর একটা ঘুঘু বসে আছে ঠায়। রসুলপুর নদীর পলি জলের মতো মেঘলা আকাশ, ইউক্যালিপটাসের মগডাল থেকে গাজনের মতো বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ওই মুরগি ঘরের চালা। বিবেকানন্দ জবা ফুটে আছে আঙিনায়।


আমার রান্নাঘর আরশোলাতে পোরা, সকাল থেকে অপারেশন ক্লিনিং শুরু হবে। তারপর ছাদবাগানের গাছগুলোর টব বদলানো আছে, একটু টাকা পয়সার জোগাড় করতে হবে, দু'জন লেবার লাগাতে হবে, টুকটাক রিপেয়ারও আছে। ছুটির দিন তো এভাবেই কাটে আমাদের। 


সময় নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। যুদ্ধের দেশের মা সন্তানের পিঠে উল্কি করে লিখে দিচ্ছে নাম, ঘরবাড়ির হদিস, একটু পরে কী হবে কে জানে!


 মাকে জড়িয়ে শিশু ঘুমাচ্ছিল, ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল রাজনীতি এই বাংলায়, চোদ্দ বছরের মেয়ে, রেপ করে ঘরে ফেলে গেল। একটু একটু করে বাবা মা'র চোখের উপর মরে গেল মেয়ে, কিছু মুখ চেনা অচেনা দৈত্যের মতো রাতারাতি পুড়িয়ে দিল রাতের অন্ধকারে...


আলু পেঁয়াজ কেনার মতো মৃত্যুর খবর আসে, এসব সত্যি? ঠিক সত্যি? যার যায় শুধু তারই যায়।

বসে চা খেতে খেতে ফ্লিপকার্ট করি, খোঁজখবর করি আত্মীয়দের, সেভিংস ও ট্যাক্স মেটাই। আঠারো শতাংশ ছাড়ে ওষুধ ও কন্ডোম কিনি। আর কবিতা লিখি...

 

সিবিআই আসে, সিট তদন্ত, উডবার্ন ও আই.পি.এল একসঙ্গে দেখি। কতো দেখি বলতো...


কাল তো দোশরা হয়ে যাবে। তারপর তেশরা। দু-এক বার মনে করবো আজ পয়লা, পয়লা বোশেখ, চোদ্দশো ঊনত্রিশ। আমাদের নতুন বাংলা সন এলো। আমাদের ?


 আমাদের হাতে কিছু কি আছে? কে আর শোনে আমাদের কথা? 


আমাদের কিছু ছিল একদিন। শিক্ষা, ভাষা, সুর, মূল্যবোধ, সমাজবোধ, দেশাত্মবোধ -- এসব ছিল একদিন। সম্মান সম্ভ্রম ছিল একদিন। একদিন বাঙালি ছিলাম। 


 আজ একটা পয়লা এল, একটু স্বস্ত্বি, নিরাময় এ সব আশা করছি না আর, আসবে না জানি। সব মেনে নিয়েছি, সব! শুধু আজ পয়লা তে নিজের মনে একবার ভাববো, কিছুটা ভালো ছিলাম, ধনী ছিলাম মননে, বোধে কখনও, কোনো একদিন…

                 ………………….. 




পরশু পয়লা বৈশাখ সুমনা

মৃণালকান্তি দত্ত

দহন আর দাহের ভেতর যে ভেদ তার ভেতর হেঁটে আসছে উষ্ণতা পুড়তে পুড়তে ভিজতে ভিজতে

পোড়া আর ভেজার উৎস কিংবা উত্তরণ স্থলে এই যে আমি বসে দহন আর দাহ তাপ আর উষ্ণতা নিয়ে ভিজে যাচ্ছি সে ও কি পোড়া নয়! ঘাম মস্তিষ্ক থেকে হৃদয়ে পৌঁছোতে চেয়ে  ঢুকে পড়ছে চোখে …। দৃশ্য গুলো ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমশ, তবু দূর গাজনতলার মাঠ থেকে ভেসে আসছে ঢাকের শব্দ। আজ নীল বার ব্রত উপোস কাঁসার গামলা পূজোর ফল মূল  তার ভেতর লুকানো চিঠি আর সুমনা…। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মায়ের দৃষ্টি এড়িয়ে আমাকে ইঙ্গিত করছে একজোড়া চোখ তারপর প্রসাদ দেওয়ার ছলনায় চিঠি হাতে গুঁজে চলে যাচ্ছে মায়ের কাছে সময়ের কাছে

এই দৃশ্য কি ভুল? আমি এই তো শ্মশান পুকুর বট গাছের তলে পড়ছি “এই শোনো কাল বাদে পরশু শুক্রবার পয়লা বৈশাখ মনে আছে তো! সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানস দা্ রা গান গাইতে যাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিল বাবা হ্যা বলেছে তুমি কিন্তু ওই হলুদ পাঞ্জাবীটা পরবে, বলে রাখলাম ! তা না হলে গান তো গাইবোই না আরও যে কি কি করবো তা আমি ও জানি না। বছরের প্রথম দিন নতুন কিছু পরতে হয় যার যত অভাব থাকুক না কেন! মনে রেখো আর হ্যা আমি হলুদ চুড়িদারটা পরবো”।


শ্মশান পুকুর থেকে জলহাঁস নিজেকে ভিজিয়ে নিয়ে আবার উড়ে গেলো অদূরের পলাশ ডাঙ্গা পেরিয়ে… দৃশ্যের বাইরে…! ঝাপসা হয়ে আসা চোখে যে জল গুলো হৃদয় ছুঁতে চাইছে সে কি ঘাম নাকি অশ্রু!

দহন নাকি দাহ তাপ নাকি উষ্ণতা

স্নান নাকি ভেজা  দৃশ্য নাকি অদৃশ্য

কেমন যেনো এক হয়ে যাচ্ছে মস্তিস্ক থেকে

চোখ থেকে হৃদয় সরলীকরণ সমীকরণে…


তবু পরশু পয়লা বৈশাখ সুমনা

তোমার চুড়িদার আমার পাঞ্জাবি

রঙ কিন্তু হলুদ মনে আছে তো….

                …………………. 



'হে নূতন...'

শ্রীজিৎ জানা

নূতন কতোদিন নূতন?  নূতন শব্দটা কী তবে ইলাস্টিক। টেনেটুনে ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে নেওয়া যায় যদ্দুর মন চায়। তাহলে কী তা মনের অবস্থার উপর নির্ভরশীল। নূতন আর পুরাতনের মাঝখানে কী খেলে বেড়ায় মনের তরঙ্গভঙ্গ!  পাওয়া না পাওয়ার হিসেবনিকেশ। যা ভালো,যা আলোময় তাকে ফিরে পেতে চাই বারবার! আর যা বিষাদময় তাকে  মুছে দিতে চাই যাপনের ক্যানভাস থেকে! একেই কী বলে নূতন-পুরাতনের রহস্যময় খেলা! 'নূতন' কথাটার গায়ে কী লেগে থাকে আপেক্ষিকতার গন্ধ! 'কতটা পথ হাঁটলে তবে পথিক বলা যায়'-এর মতো স্থির না করতে পারা ভাবনা। শেষমেশ শিবরাম চক্কোতি মশাই এই জটের একখানা রসালো সমাধান বাতলেছেন,-"বহু বছরের কঠিন পরিশ্রমের পর আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে,'নতুন বছর','নতুন বছর' বলে  খুব হইচই করার কিস্যু নেই। যখনই কোন নতুন বছর এসেছে এক বছরের বেশি টেকেনি..."।  টেকেনা বলেই ফিবছর বাড়ির দেয়াল থেকে, অফিসের টেবিল থেকে ক্যালেন্ডার মুখভার কোরে বিদায় নেয়। ঠাকুর-পটের চল্ কমেছে। হালফিলে ক্যালেন্ডার-গার্লসদের স্বল্পবাস পরিহিত দন্তবিকশিত নয়নভোলানো রূপের ছবি শোভা পায় দেয়ালে। নীচে দিনপঞ্জি। কারো কারো  বাড়িতে বেণীমাধব শীলের নবপঞ্জিকার শুভাগমন হয়। অম্নি বর্ষগত রাশিফলের পাতায় চোখ দৌড় দ্যায়। মনোমত ফললাভ হোলে 'ইয়া-আ-আ হু' নইলে বিরস বদনে বিরক্তিসূচক স্বরক্ষেপন--ওয়াক্ থু! হালার কপালে লবডঙ্কা! বচ্ছরটাই পুরো চাঁড়ে চলে গেলো। ইত্যাদি।


বাঙালী বচ্ছরকার দিনে নতুন কিছু পেতে চায়। গেলো বছরের না পাওয়ার শূন্য ঝোলায় প্রাপ্তিযোগের বন্যা আশা করে। এর জন্য নিদেনপক্ষে শুরুর দিনে একটা ঝাঁকুনিমার্কা উদযাপন চায়। যাকে বলে ঝাকানাকা ককটেল পার্টি। আসলে দুশো বছর গোরাদের সাথে ঘর করে সবেতেই একটা গরমাগরম উল্লাস পেতে চাই আমরা। ফলত কালক্রমে বাঙালীর নববর্ষ যাপনের আয়োজনে আনতে চাইছে নিউইয়ার সেলিব্রেশানের আমেজ। একটু নাচাগানা,একটু গেলাসে ঢুকুঢুকু, ফোনে ফোনে শুভেচ্ছা বিনিময়, চারটে সেল্ফি,ছটা পোস্ট, মারকাটার বাঙালিয়ানা মেজাজের পোস্ট ইত্যাদি নানান কায়দাবাজিতে একটা দিন কাটানো। পান্তা-ইলিশ, ডাল-সুক্তুনি-ছ্যাঁচড়া-পাঁচশাক ভাজা দিয়ে নতুন বছরে অতিথি ভোজন, হালখাতার বোঁদের লাড্ডু, লক্ষ্মী-গনেশের পট, গুড়ছোলা, তুলসীমঞ্চে বসুধারা টাঙানো, পঞ্জিকাপাঠ, কুলদেবতার পুজো অর্চনা ক্রমে অপসৃত হোচ্ছে বাঙালী জীবন থেকে। বাঙলা নববর্ষ বল্লেই মনের মধ্যে ক্যামন একটা ধূপধুনোফুলচন্দন ভরা ঠাকুর ঠাকুর ভাব আসে। আর সেইটাই  বোধকরি বাঙালিয়ানা। জাতিগত রিচুয়্যালস্ যদি হারাতে থাকে তবে সেই জাতির বেঁচে থাকার ধরণটা অনেকখানি জীবন্ত জীবাশ্মের মতো। তবুও পিছুটানের মতো কোরে এখনো সকালে প্রণাম পর্ব, পুজোপাট, বই প্রকাশ, কবিসম্মেলন, পান্তা উৎসব, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নান্দনিক আয়োজন প্রভৃতির ভিতর নববর্ষের চিলতে আবেগ ও আনন্দ অনুভূত হয়। বাংলা পদ্য লেখা হলুদ কুর্তা আর গীতবিতান লেখা পলাশরঙা শাড়ীর সলাজ চাহুনিতে, মাঠের গর্ভবতী ধানশীষের খুশিতে,গলায় আঁচল জড়ানো তুলসীতলায় মায়ের মঙ্গলকামনায়, গোপালপুরের বিশু গোঁসাইয়ের খমকের বোলে, নাড়াজোলের খান রাজাদের নাটমঞ্চের পান্তা উৎসবে বেঁচে থাক নববর্ষের উন্মাদনা। নতুনকে পেতে চেয়ে পুরাতনকে এক্কেবারে ভুলে গ্যালে চলে না। আজ আর কালের মাঝে, নতুন আর পুরাতনের মাঝে কোথাও একটা পিছুটান থেকে যায়। হয়তোবা মায়াভাষ। ওই মায়াটুকুই লেগে থাক চোখের পাতায়।

                       …………………. 



আজি এ পয়লা বৈশাখের তরে 

সুজাতা চক্রবর্তী



"হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,

ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল

তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল

কারে দাও ডাক-

হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ?"


চৈত্র ক্ষয়াটে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে ... পয়লা বৈশাখের প্রতি ভাঁজে বাঙালির স্মৃতিমেদুরতা। নানা ভালোলাগার প্রকাশ হালখাতা, কোথাও বা নতুন পোশাকে পুজো দেওয়া, বা কোথাও আদ্যন্ত বাঙালি খাওয়ার মধ্যে দিয়ে। নববর্ষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে বাংলার নিজস্ব শস্যচক্রের। এই উৎসব এ-পার বাংলা ও ও-পার বাংলা, দুই দেশেই জনপ্রিয়। লীলা মজুমদারের খেরোর খাতায় পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে এক অন্য দিক উঠৈ আসে ... সে যুগে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় হালখাতা ছিল প্রায় সর্বজনীন উৎসব। এমনকি পরিস্থিতি অশান্ত থাকলেও বইপাড়ার হালখাতায় তার খুব প্রভাব দেখা যেত না। পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে  মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়, যেখানে বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে তুলে ধরা হয়। ২০১৬ সালে এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো ‘ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রায় সব দেশে, সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে, সব সংস্কৃতিতেই নববর্ষ উদযাপনের প্রথা প্রচলিত আছে। অবশ্য উদযাপনের রীতি-প্রকৃতি ও পদ্ধতি-প্রকরণের মধ্যে তারতম্য আছে, তবু সর্বক্ষেত্রেই একটি মৌলিক ঐক্য আমাদের চোখে পড়ে। তা হলো, নবজন্ম বা পুনর্জন্ম বা পুনরুজ্জীবনের ধারণা। পুরানো জীর্ণ এক অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে সতেজ সজীব নবীন এক জীবনের মধ্যে প্রবেশ করার আনন্দানুভূতি। নতুনভাবে জেগে ওঠার , জীবনকে নব আলোকে বরণ করার শিখা যেন নতুন বর্ষের হাত ধরে নেমে আসে ..তাই  Tennyson বলেন ..

"Ring out the old, ring in the new,

Ring, happy bells, across the snow:

The year is going, let him go;

Ring out the false, ring in the true."


সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি আগে বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে বাংলা নববর্ষকে এদেশের জনগণের নওরোজ বলে উল্লেখ করেছেন।ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজত্বের দিনগুলোর এক পর্যায়ে বাংলা নববর্ষ পালনের মধ্যে এদেশের শোষিত ও পরশাসিত জনগণের চিত্তে স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল। এ এক অন্য দিক চেতনার ডিসকোর্স।


পয়লা বৈশাখে  নানা ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, প্রদর্শনী ও মেলার আসর, সঙ্গীতানুষ্ঠান, কবিতা আবৃত্তি, আলোচনা সভা, বক্তৃতা-ভাষণ ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়‌।  অর্থনৈতিক কারণে শহরে পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ করে এখন যে চাঞ্চল্য ও আনন্দ-উৎসব দেখা যায় তা নিতান্তই মেকি  না কিন্তু তার মধ্যে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নাগরিকের বুর্জোয়া বিলাস ও ফ্যাশনের একটি বড় অংশ এই পয়লা বৈশাখ উদযাপন তা অস্বীকার করা যাবে না ! মনে জমা কয়েকটা কথাই বলি  কলেজ স্ট্রিটের চারদিকে লক্ষী গণেশের মূর্তি একেবারে গমগম করছে পয়লা বৈশাখের একদিন আগের বাজার আবার কলকাতার সেই মেদুরতাভরা 'কফি হাউস' থেকে বেরিয়ে আসছি এক মা তার বাচ্চাকে নিয়ে বসে আছেন সিঁড়িতে পয়লা বৈশাখে... কিন্তু এঁদের মুখেও কি সেই হাসির কণা লেগে থাকবে ? এসব দৃশ্য কিছু প্রশ্ন ফেলে যায় ! বৃহত্তর জনজীবনের সঙ্গে এই পয়লা বৈশাখকে রাখিবন্ধনের মতো করে বাঁধতে হবে, নতুন মাত্রিকতা যোগ করতে হবে একটু একটু করে। নববর্ষের উৎসব যে বিশেষভাবে ঐতিহ্যমণ্ডিত, শ্রেণিগত অবস্থান নির্বিশেষে, সাধারণ মানুষের উৎসব, এর ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ও তার মহিমাকে যথার্থভাবে আত্তীকরণ করা কর্তব্য হোক। ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতার চেতনায় পূর্ণ হোক পয়লা বৈশাখ। ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধার প্রদীপ জ্বালা থাক মানুষের হৃদয়ে ...যে ঐতিহ্য ঐক্যের সুর বাজিয়ে যায়... তাই পয়লা বৈশাখে এই প্রার্থনা ...


"মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,

 অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা"।

                   ……………………



ভিন্ন স্বাদের পয়লা বৈশাখ 

ভবেশ মাহাত

ছোটোবেলার যে কথাগুলো আজও খুব মনে পড়ে তার মধ্যে 'পয়লা বৈশাখ' অন্যতম। এই দিনটির গুরুত্ব আমার কাছে বরাবরই ভিন্ন স্বাদের, আমাদের বাড়িতে মুদিখানার দোকান বহু পুরনো, অন্তত আমার ঠিকঠাক জ্ঞান হওয়ার দিন থেকে দেখে আসছি। যদিও দোকানে হালখাতা  সাধারণত হয়ে থাকে 'পয়লা বৈশাখ' অথবা 'অক্ষয় তৃতীয়া'তে। আমাদের দোকানে হালখাতা হতো পয়লা বৈশাখ এর দিনে। ঠাকুমা এই দিনটিকে বলতেন 'একলা বৈশাখ'। অবশ্য তার পিছনে যে যুক্তি তিনি দেখাতেন, তা খণ্ডন করার মতো পাল্টা যুক্তি আমি আজও প্রতিস্থাপন করতে পারিনি। ঠাকুমা বলতেন- 'বৈশাখ মাস ধর্মের মাস' সেকারণেই পুরো মাস জুড়ে নিরামিষ খেতেন। প্রতিদিন স্নানের পর নিয়ম করে অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় জল ঢালতেন, যা বছরের অন্য কোনো মাসে করা হয় না। প্রতি সন্ধ্যায় গ্রামের মূল রাস্তায় কীর্তন গান পরিবেষণ করা হয়, গ্রামের মানুষ ঐ সময় ঘর থেকে বেরিয়ে শঙ্খধ্বনি দেন। আমরাও অনেকে পা মেলাতাম। বৈশাখ মাসে বাড়িতে কোনো দিন প্রাণী হত্যা হতো না। ঠাকুমার যুক্তিতে এসব কারনের জন্যই তো বৈশাখ মাসকে একলা বলা চলে। বছরের আর কোনো মাসে এসব পালন হয় না, তাই তো একলা। 


একটু বড়ো হয়ে মজা করার জন্য ঠাকুমাকে বললাম- তুমি কি জানো গাছেরও প্রাণ আছে? ঠাকুমা ঠিক কী বুঝলেন জানিনা, তবে সেদিন থেকে অনেক রকম সব্জি তাঁর তরকারির তালিকা থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিল।


আর আমার কাছে যে কারণে দিনটার স্বাদ ভিন্ন তা হলো-আমাদের বাড়ির আশেপাশের দোকান যেমন- লোহার দোকান, রাসায়নিক সার ও ঔষধের দোকান প্রভৃতি দোকান গুলো থেকে ঐ দিন যে মিষ্টির প্যাকেট আসতো,তার মধ্যে থাকতো গজা, মিহিদানা, দানাদার, লাড্ডু, নিমকি ইত্যাদি মিষ্টি। যার প্রত্যেকটার স্বাদ ছিল আলাদা। যার প্রত্যেকটার স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে।

                         ……………….



তোমার জন্য নতুন করে...



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - সুকান্ত সিংহ

ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614







ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...