Tuesday 28 February 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৯

 



রবীন্দ্র পরম্পরা 

পর্ব - ৯

হিমালয় যাত্রা

মহাশ্বেতা দাস



     " মনেরে আজ কহ যে

     ভালো মন্দ যাহাই আসুক

       সত্যেরে লও সহজে।" 


   সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের জীবন চাকর বাকরদের শাসন- পীড়নে কিভাবে কাটত সে ইতিহাস আমাদের জানা। স্কুল জীবনে সহপাঠীদের নির্যাতন, শিক্ষক মহাশয়ের কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ সব মিলিয়ে স্কুল যাওয়ার অনীহার কথা....  আগের পর্ব গুলিতে আলোচনা করেছি। হিমালয় যাত্রায় পিতার সান্নিধ্য লাভ নিয়েও আগের দুটি পর্বে কিছু কথা লিখেছি। তবে এই পর্বে আলোচনা করব পিতা দেবেন্দ্রনাথ কিভাবে জীবনে সত্য কে গ্রহণ করার শিক্ষা দিয়েছিলেন। 


      পিতা দেবেন্দ্রনাথের চোখে কনিষ্ঠ পুত্রের নক্ষত্রদ্যুতি ধরা পড়েছিল বলেই প্রতিভা সম্পন্ন বালকটিকে তিনি সংসারিক অবজ্ঞা আর চাকর বাকরদের অনাদরের হাত থেকে তুলে এনেছিলেন। ছোট্ট রবির মধ্যে গুটিয়ে থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করে হিমালয় যাত্রায় তাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন.... নিয়ে গিয়েছিলেন প্রকৃতির মাঝে। বিশ্বজোড়া পাঠশালার অকৃপণ দানে শুশ্রূষা করেছিলেন কিশোর মনের। এই সময় তাই পিতার সঙ্গ ও স্নেহ তাঁর আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা উন্মোচনে যেন মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। 


    ছেলেকে পড়াবেন বলে নিজে পছন্দ করে বেশ কিছু বই এনেছিলেন। কিন্তু সেখানেও ফ্রাঙ্কলিনের বইটির প্রতিবাদ না করে থেমে থাকতে পারেন নি। ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হলেই তা মেনে নিতে হবে অথবা বিখ্যাত কেউ লিখলেই তা প্রতিবাদ যোগ্য হবে না .... এই ধরনের সংস্কার থেকে ছেলের মন কে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। 


       বক্রোটায় একটি পাহাড়ের চূড়ায় বাংলোতে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। এখানে ছেলেকে গ্রহ ও নক্ষত্রের রহস্যময় বিশাল জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন। 


     জীবনস্মৃতি গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - " যাহা কর্তব্য তাহা আমরা অন্তরের সহিত করিব, এজন্য তিনি অপেক্ষা করিতেন। সত্য কে এবং শোভন কে আমরা বাহিরের দিক হইতে লইব, ইহাতে তাহার মন তৃপ্তি পাইত না; তিনি জানিতেন সত্য কে ভালোবাসিতে না পারিলে সত্য কে গ্রহণ করাই হয় না।" 


      জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাই ছেলের স্বাতন্ত্র্যে বাধা দিতে চাইতেন না। তাঁর রুচি বা মতের বিরুদ্ধে কোন কাজ করলেও কোনদিন শাসন করে তা নিবারণের চেষ্টা করেন নি। 


      বক্রোটায় এক একদিন দুপুর বেলায় কিশোর রবি একা লাঠি হাতে এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে বেড়াতে যেতেন। মহর্ষি এ বিষয়ে কোনদিন কোন কষ্ট বা বিপদের আশঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন নি। মহর্ষি ছেলের সামনে জীবনের আদর্শ তুলে ধরেছিলেন কিন্তু কখনও শাসনের দন্ড উদ্যত করেন নি। তাই যেমন করে বক্রোটায় পাহাড়ে অথবা শান্তিনিকেতনের মাঠে বাটে একলা ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তেমনি সত্যের পথেও চিরদিন নিজ গম্যস্থান খুঁজে নেওয়ার ও স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। 


       পিতা পুত্রের চিন্তা প্রবাহ যে সব সময় এক পথে হেঁটেছে - এমনটা ও নয়। সেক্ষেত্রেও পিতা দেবেন্দ্রনাথ ছেলেকে নিজস্ব মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। শব্দার্থ নিয়ে ছেলে তর্ক করতে ছাড়তেন না। কলকাতার বাড়ি থেকে চিঠি এলে মহর্ষি ছেলে কে পড়তে দিতেন.... এভাবে যেমন চিঠি লেখার কৌশল রপ্ত করতে শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠিক তেমনই মেজদাদার চিঠির কয়েকটি বাক্য নিয়ে তর্ক শুরু হলে মহর্ষি ছেলে কে একবারের জন্যও ধমক দিয়ে নিরস্ত করেন নি বরং ধৈর্য্যের সঙ্গে সমস্ত প্রতিবাদ সহ্য করে ছেলেকে বিষয় টি বুঝিয়ে দিয়েছেন। মহর্ষি ছেলের সাথে কৌতুকের গল্প ও করতেন যা ছোট রবিকে আনন্দ দান করতো। এই ভাবে প্রথম থেকেই বালকের চিন্তাশক্তির গোড়ায় জল ঢেলেছেন তিনি। পরবর্তী ক্ষেত্রে তাই " বিশ্ব পরিচয়" গ্রন্থে আমরা দেখি মহর্ষি কে তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে স্মরণ করেছিলেন। 


      এইসব স্বাধীনতার পাশাপাশি শৃঙ্খলার দিকটিতে ও অতন্দ্র প্রহরীর মতো মনোযোগ দিতে ছাড়েন নি পিতা দেবেন্দ্রনাথ। রাতের অন্ধকার দূর হতে না হতেই ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে সংস্কৃত পড়ানো, তারপর তাকে পাশে নিয়ে উপনিষদের মন্ত্র পাঠ করা, ছেলেকে সঙ্গে করে পাহাড়ি পথে প্রাতঃভ্রমণ এবং বেড়িয়ে ফিরে ইংরেজি পড়ানো। এখানেই শেষ নয় - বেলা দশটা নাগাদ বরফ ঠান্ডা জলে স্নানের হাত থেকেও রেহাই ছিলো না। 

    

     এভাবে পিতার সান্নিধ্যে বেশ কয়েক মাস কাটানো.... যা পরবর্তী জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তারপর একদিন মহর্ষি তাঁর অনুচর কিশোরী চাটুজ্যের সাথে ছেলেকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন। 

                   ……………… 



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - অভিষেক নন্দী

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614


Saturday 25 February 2023

আমাদের বাংলা ভাষা // ই-কোরাস ৯৮

 



"এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি -খেউড়ের পৌষমাস"

শ্রীজিৎ জানা


---আজ দিনটা চাঁড়ে চলে গেল। মটকা পুরো গরম। মেজাজ খিঁচে আছে। শালা যত্ত ক্যাচাল আমার কিসমতে। ধান্দার লাইনে অল টাইম চোখ কান খোলা রাখা জরুরী। একটু গা হেলান দিয়েছো কি পুরো পোঙা মেরে হাওয়া। 

-----মাল পটানো বাঁ হাতের খেল। ঝারিটারি মারা আমার পোষায় না। ডাইরেক্ট হিট করি। মাল বেশি ঘ্যাম দেখালে আমিও গেম বাজিয়ে দেব। মালের মালাইকারি রেসিপি এক চুটকিতে ভাইরাল করে দেব। তখন কেস পুরো  কিচাইন।

 ----তুমি আবার বেশি সতীপনার জ্ঞান কপচিও না। খালি রং নিচ্ছো? বাওয়ালি?  চাটু তেতে গেলে একদম ঝেড়ে দেবো। তোমার তো মাঝে মাঝেই চেগে ওঠে। ফুল্লি বাইচুং ভুটিয়া কেস। তুমি কে হে সুধীর ভাই? পোঁদ মারাচ্ছো? এমন পাছায় লাথাবো না হাগুমুতু সব সেঁটে যাবে। বসে বসে পেছনে কাঠি করা জন্মের মত চুলকে যাবে। খুব যে দেখি পুলকি! যতই কেরতানি মারো আমার কিছু করতে পারবে না। ছিঁড়ে বোঝা করবে তুমি।

----ঝাক্কাস রোদ! ঝিংকু মামনিরা দলবেঁধে বেরিয়েছে বেড়ু বেড়ু করতে। বাঙালি ঘরে বসে ল্যাদ খেতে ভালবাসে।  চলো সোন্টাই,  জানু, সুইটি, হানি বেবিদের সঙ্গে কিছুক্ষণ চ্যাট করি। ফ্লাইং কিস, সেক্সি ইমোজি চালাচালি হোক। হেব্বি লাগছে তোকে। হ্যালো গাইস। কুল ডাউন।বিকেলে পার্টি আছে। ফুল মস্তি হবে।

-----তোর আবার কি হলো? এমন ক্ষেপচুরিয়াস মেজাজ কেন? চিল বেবি! কাজের মাসিরা ওরকম কানের কাছে হাজারটা ভ্যানতারা শোনায়। তুমি আবার বেশি গাঁড়পিঁয়াজি মারতে এসোনা।বেশি ধানাইপানাই করলে কেলানি খেয়ে যাবে। উষ্টুমধুষ্টুম ঝেড়ে দেবো।

----মাইথাই দেখেই তো দিন একটা কাবার। কাজকম্মের গাঁড় মেনে গ্যাছে। শ্লা মাদার-ফাকার সোসাইটি! কেউ কিস্যু করেনা কারুর জন্য। সব বানচোতরা স্বার্থপর। একটাই উশুল ছিনিয়ে নিতে হবে। কুত্তাগিরি না করলে চলবে না।

কথাগুলো শুনে সুশীলবাবুর কানে পোঁ বাজাতে থাকে। হাপরের গরম আঁচ বেরোয়। গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে হাজির হারবার্টদা। নবারুণ ভটচায্যির পাড়ার লোক।নম্র ভদ্র ভাষাপ্রেমী সুশীলবাবু তার  মতামত জানতে চাইলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

---ভায়া, এসব  কথার কি ছিরিছাঁদ  বলো দেখি.?  মাথা তো ঠিক রাখা যায় না। বাংলা ভাষার এমন দৈন্যদশা! শুনে মুডটা খারাপ হয়ে গেল।

 হারবার্টদা তো অভ্যাসবশত ধোঁয়াধার ব্যাটিং করে চলল, -----আমাদের আবার মুড! খানকির ছেলেদের জানবি মুডফুড নিয়ে কোন চুদুরবুদুর নেই। আচে শুধু মজা!

 এসব কি বলছে হারবার্ট! সুশীল বাবুর মুখখানা 'হলদে গোলাপ' হবার জোগাড়। অকুস্থলে স্বপ্নময়  চক্কোতি মশাই হাজির হলেন। প্রসঙ্গ একটু অন্য দিকে মোড় নিল। সুশীল বাবুকে তিনি শোনালেন তাুর  দশম শ্রেণীর এক ছাত্রের গুপ্ত রোগের বর্ণনা ---"এখন আমি আমার এক গোপন সমস্যার কথা বলি। রাত্রে প্রায়ই আমার পেনিসের দ্বার দিয়া শরীরের সারমসলা নির্গত হইয়া যায়। কিছুতেই চেক করিতে পারিনা।... আগে হস্তমোচন করিতাম। ওই কু অভ্যাস ছাড়িয়ে দিয়েছি। এখন রাত্রে শুইবার আগে রাবারের গাডার দিয়া প্যানিস আটকাইয়া রাখি।, তা সত্ত্বেও ঐ পদার্থ নির্গত হইয়া যায়"

 সুশীল বাবুর এবার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। লেধুস মাছের মত মুখ করে চক্কোতি মশাইকে শুধালেন,

----এমন করে খুল্লামখুল্লা আপনি বলে যেতে পারলেন? মুখে বাধলো না? লজ্জা শরম নেই?

 হারবার্টদা  তো ছোডনে বালা বান্দা নয়। সুশীল বাবুর উপর খঁচে ওঠে।

----  বেশ করবে বলবে। যে যুগের যেমন ভাষা সেভাবেই বলবে। মান্যগণ্যদের ঘুষ খেতে লজ্জা নেই, জালজোচ্চুরি করতে লজ্জা নেই, খালি দুটো খিস্তি  দিলেই জগত রসাতলে! কি যুক্তি মাইরি! কেন বঙ্কিম বাবু যখন হরিদাসী বোষ্টমীকে গালিগালাজ করেন, তখন আপনার কানে কি কর্ণমল ঠাসা ছিল মহাশয়? 

-" প্রমদা বলিলে, মাগীর বুকের কাছটা যেন যাত্রার সুখীদের মতো। দেখে ঘৃণা করে। ললিতা বলিল, তা দেখিতে যেমন হউক মাগী গায় ভালো।"

 হারবার্টদা থামছে না কিছুতেই।

---'মাগী' শব্দটাতে কি আপনার আপত্তি আছে? তাহলে দু কলি মধুকবি শোনাই-- "কুলটা যে নারী--বেশ্যা গর্ভে তার কি হে জনমিলা আসি/ হৃষীকেশ?" বেশ্যা শব্দের জন্য মধুকবিকে কী একহাত নিতে চাইবেন?

সামান্য ধাতস্থ হয়ে সুশীলবাবু মুখ খুললেন।

-- তাহলে ভাষার শ্লীল অশ্লীল বলে কোন বালাই নেই?

----ভাষার শ্লীল -অশ্লীল বলে কিস্যু নেই। সুনীল গাঙ্গুলী মশাই কবেই তা বলে গেছেন। প্রকাশ ভঙ্গি ওই দোষে দুষ্ট হতে পারে। বন্ধুকে 'বোকাচোদা'  বল্লে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয় শুনি? ধর্ষকের মুখে কী লেখক আস্থা চ্যানেলের অমৃতবাণী বসাবে।

-----কিন্তু ভাষা তো ভাববাহী। পশুত্বের ভাব, মনুষ্যত্বের ভাব, দেবত্বের ভাব, সকল ভাবের পৃথক পৃথক ভাষা থাকাই তো শ্রেয়। প্রকাশভঙ্গির লালিত্য এবং সম্ভ্রম না থাকলে ভাষার সৌন্দর্য কোথায়? ইচ্ছাকৃত উদোম খিস্তিখেউড় আউড়ে সাহিত্য শিল্প জগত সভায় কোন উচ্চাসন লাভ করে? তা কি শাশ্বত কালের মর্যাদা পায়? ব্যক্তির সাময়িক গায়ের ঝাল মেটে কিন্তু মনের আরাম কিংবা প্রশান্তি আদৌ কি মেলে? যৌনতার শেষে গ্রাস করে চরম বিষাদ। রগরগে যৌনগন্ধী  সংলাপ শুধুমাত্র অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ ঘটায়, মানসিক প্রশান্তির হদিস দেয় না।

----আপনাদের মতো জ্যাঠামার্কা লোকেদের জন্যই বাংলা ভাষার এমন দুর্গতি। সময়ের সাথে ভাষাকে খাপ খাইয়ে নিতে দিন। তাছাড়া যে সমাজে প্রতি সেকেন্ডে নারীর শ্লীলতাহানী ঘটছে,সেখানে ভাষার শ্লীল অশ্লীলতা নিয়ে এত হাইপার কেন বাপু!

একদিকে সুশীল বাবু অন্যদিকে হারবার্টদা। বিতর্ক থামানো যাচ্ছে না।

---জীবনকে যখন প্রকাশ করা হবে তখন জীবনের সমস্ত ভাবকে ভাষার অনুসঙ্গে প্রকাশ করাই একমাত্র লক্ষ্য হবে লেখকের। সেক্ষেত্রে শ্লীল- অশ্লীলতার কোন বাছ-বিচার রাখা মানেই জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে প্রতারণা করা। কোন ব্যক্তিকে যখন অপমানিত করতেই চাইছি তখন 'শুয়োরবাচ্চা' না বলে 'বরাহনন্দন' বল্লে কোন বাহাদুরি দেখানো হয় শুনি?

সুশীলবাবু মেনে নিতে পারেন না। তার কাছে বাংলা ভাষা ক্রমশ অশ্লীলতায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। ইচ্ছাকৃত এবং অপ্রয়োজনীয় ভাবে। যৌনগন্ধী,  সন্ত্রাসমূলক,  ঊস্কানি ও শাসানিমূলক  শব্দ প্রয়োগ করা হচ্ছে দৈনন্দিন কথাবার্তার মধ্যে। বাংলা ভাষা তার লালিত্য হারাচ্ছে ক্রমশ। সমাজের একাংশের মুখে ভাষা ক্রমশ দূষিত হচ্ছে। রাজনীতি নেতাদের ঔদ্ধত্য ভাষাকে সংক্রমিত করছে প্রতিনিয়ত। তাদের নিজস্ব আসুরিক প্রবৃত্তির ছাঁচে ভাষাকে বসিয়ে সমাজের উপর প্রভুত্ব কায়েম করতে চাইছে।  ভাষা হয়ে উঠছে নেতাদের ক্ষমতা প্রকাশের বাহন। অহংকারের ও পেশী প্রদর্শনের হাতিয়ার। সেক্ষেত্রে বর্তমান বহুল প্রচলিত 'খেলা হবে' শব্দবন্ধ নিছক আনন্দ বিনোদন ভরা ক্রীড়ামূলক অর্থকে তুলে ধরছে না।  উচ্চারণেরর স্বরক্ষেপে এবং প্রয়োগের বিচারে বিশেষত বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে 'খেলা' শব্দটি যেন বিভীষিকাময় রূপ নিয়ে প্রতিভাত হচ্ছে সমাজে। তখন খেলা অর্থ  জীবন নিয়ে খেলা, রক্ত নিয়ে খেলা, ধ্বংসের খেলা, লুটতরাজের খেলার  দ্যোতক হয়ে উঠছে। ঢাকের বাদ্দি 'চড়ামচড়াম'  উৎসবমুখর পরিবেশের কথা বলে না। পরিবর্তে হুকুম না মানায় শাসকের উত্তম মাধ্যমের শাসানকে স্মরণ করিয়ে দেয়। একইভাবে 'নকুলদানা', 'গুড়বাতাসা', 'শিককাবাব' প্রভৃতি বহু ব্যবহৃত শব্দগুলো বর্তমানে সমাজের এক ধরনের শাশনের কোড ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। 

ঝাড়গ্রাম - পুরুল্যা-বাুঁকুড়ার জঙ্গলমহল এলাকা থেকে লোকগান রূপে যে গান আমাদানি করা হচ্ছে আসলে তা কোনভাবেই  উক্ত অঞ্চলের শিকড়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়।থ সিনেমা, সিরিয়ালে বিশেষত ওয়েব সিরিজের ডায়লগে  প্রতিনিয়ত এমন ধরনের শব্দ ঢুকিয়ে দেওয়া  হচ্ছে যা কোনোভাবেই  শ্রুতিসুখকর নয়।  অশ্রাব্য বললেও অত্যুক্তি হবে না। শব্দ অথবা ভাষা যা কানের ভেতর দিয়ে মর্মে আঘাত হানে আর প্রাণকে আকুল করে তোলে। বাংলা ভাষার ভেতর থেকে সেই প্রাণ আকুল করা সুরতরঙ্গ, ব্যঞ্জনা, পদলালিত্য   ক্রমশ অপসৃয়মান।

আবরণ ভাষার অর্থসৌন্দর্যকে, অর্থগৌরবকে সর্বক্ষেত্রে ঢেকে দেয় না। অনেক ক্ষেত্রেই আড়াল ভাষার নান্দনিক গুণকে দ্বিগুণ করে দেয়। ভাষার প্রসাদগুণ বৃদ্ধি করে। শ্রুতি মধুর করে তোলে। ভাষার ভিতর দিয়ে ভাবের অতলে পৌঁছে দুদন্ড শান্তি খোঁজে পাঠক। সাময়িক গা গরম করতে চাওয়া এবং করাতে চাওয়া এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা। বাংলা ভাষা সেই অসুস্থতায় আক্রান্ত হচ্ছে। তবে বাংলা ভাষার ব্যাধি প্রতিরোধ ক্ষমতা তার জন্মলগ্ন থেকেই বিদ্যমান।  সেই আশা সেই দৃঢ়তা থেকেই বাংলা ভাষার দীর্ঘ সুস্থতা কামনা করা যেতেই পারে।

হারবার্টদা অদৃশ্য হয়ে যায়। সুশীল বাবু সোজা হয়ে দাঁড়ান। চোখে মুখে তার প্রত্যয়ের চিহ্ন স্পষ্ট। ভাষা ভাবের আধার। শব্দ ব্রহ্ম। যে ভাব,যে শব্দ সমাজের জন্য,প্রজন্মের জন্য হিতকারী নয় তার আয়ু স্বল্প। মধুক্ষরা বাংলা ভাষা তার অতুল সৌন্দর্য নিয়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল। দু'চারটে কটু শব্দ তার বিশাল শব্দভাণ্ডারে জোর করে ঢুকবে ঠিকই কিন্তু কালের বিচারে তারা যেমন সম্মানের  যোগ্য তার বেশি কখনোই পাবে না। সুশীল বাবুর মুখে উচ্চারিত হয় কবিতার পঙক্তি --" হে আমার আঁখিতারা তুমি উন্মীলিত সর্বক্ষণ জাগরণে/ তোমাকে উপড়ে নিলে বলো আর কী থাকে আমার?/......বর্ণমালা আমার দুখিনী বর্ণমালা।"


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - অভিষেক নন্দী

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614

Tuesday 21 February 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৮

 



রবীন্দ্র পরম্পরা 

পর্ব - ৮

হিমালয় যাত্রা

মহাশ্বেতা দাস



   " খোকা যে ছিল বাঁধন -বাধা -হারা

         যেখানে জাগে নূতন চাঁদ,

             ঘুমায় শুকতারা।" 


মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের চোখে কনিষ্ঠ পুত্রের নক্ষত্রদ্যুতি ধরা পড়েছিল অক্লেশেই। রবীন্দ্রনাথ বহুবার বলেছিলেন উপনিষদ তাঁর আজন্ম সখা। তাঁর সমগ্র জীবন এবং বিপুল সৃষ্টির ধারায় উপনিষদেরই আলোকছটা। ব্রাহ্মোপাসনা এবং উপনিষদের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন কবি বাবার কাছেই। এমনকি জীবনভর কবির অগণিত মৃত্যুশোক সহনের অতুলনীয় শক্তিও পিতা দেবেন্দ্রনাথেরই তেজের অংশ। 


শান্তিনিকেতনের সেই দিনগুলিতে খোয়াই থেকে জামার আঁচলে করে পাথর বয়ে এনে যে পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন সেদিনের কিশোরটি - পিতা দেবেন্দ্রনাথ সেখানে চৌকি নিয়ে উপাসনায় বসতেন। পুবদিকের প্রান্তরে তখন সূর্যোদয় হত। খোয়াইয়ের মাটি ক্ষয় হয়ে যেখানে গভীর গর্ত সৃষ্টি হয়েছিল... সেখানে মাটি চুঁইয়ে জল জমা হত। এই জলে ছোট ছোট মাছেদের খেলা, কখনও বা গর্ত ছাপিয়ে ঝিরঝির জলস্রোত কিশোর রবিকে এক অনিন্দ্য আনন্দের জগতে পৌঁছে দিত। একদিন বাবাকে গিয়ে বললেন.... 

    "ভারি সুন্দর জলের ধারা দেখিয়া আসিয়াছি, সেখান হইতে আমাদের স্নানের জল অনিলে বেশ হয়।" 


মহর্ষি উৎসাহ সহকারে সেখান থেকে জল আনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। 


    "সে বিচারে আমার কী বা হয়

      খোকা বলেই ভালোবাসি

          ভালো বলেই নয়।" 


রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি তন্ময়তার পাশাপাশি যে বৈষয়িক বুদ্ধির পরিচয় আমরা পাই সেই জমিদারি তদারকি শিক্ষার হাতে খড়ি ও গড়ে উঠেছিল পিতা দেবেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে। শান্তিনিকেতনের এই দিনগুলিতে দুই-চার আনা পয়সা দিয়ে ছেলেকে বলতেন হিসাব রাখতে হবে। তাঁর দামি সোনার ঘড়িটা দম দেওয়ার ভার দিয়ে দায়িত্ব বোধের শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। যদিও কিশোর রবির প্রবলবেগে যত্নের দরুণ কিছুদিনের মধ্যেই ঘড়িটা মেরামতের জন্য কলকাতা পাঠাতে হয়েছিল! পয়সা জমা খরচের হিসেব মেলানোর সময় কিছুই মিলত না। কিন্তু সেজন্য  কোনদিন তিরস্কার করা বা নিরুৎসাহিত করেন নি। একদিন হিসেব দিতে গিয়ে তো তহবিল বেড়ে গেল! উৎসাহ দিয়ে বললেন -- 

  "তোমাকেই দেখিতেছি আমার ক্যাশিয়ার রাখিতে হইবে, তোমার হাতে আমার টাকা বাড়িয়া উঠে।" 


বোলপুরে কয়েকদিন থাকার পরে যথাক্রমে সাহেবগঞ্জ, দানাপুর, এলাহাবাদ, কানপুর প্রভৃতি স্থানে মাঝে মধ্যে কয়েকদিন বিশ্রামের জন্য... এরপর অমৃতসরের উদ্যেশ্যে যাত্রা। 

রেলগাড়ি ছুটে চলেছে.... মাঝে মধ্যে নির্দিষ্ট স্টেশনে গাড়ি থামলে যাত্রী ওঠা নামা ইত্যাদি রোজকার চেনা ছবি... এমনই একটি স্টেশনে গাড়ি থামলো। রবির বয়স তখন বারো বছর হয়নি বলে তার জন্য হাফ টিকিট কাটা হয়েছিল। টিকিট পরীক্ষক এসে টিকিট দেখলেন। রবির মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন সন্দেহ হল! কিছুক্ষণ পরে স্টেশন মাস্টার এসে রবিকে দেখিয়ে মহর্ষি কে বললেন - "ইহার জন্য পুরা ভাড়া দিতে হইবে।" আত্মসম্মান সচেতন মহর্ষির কোনখানে বাজলো তা সেদিনের এগারো বছরের কিশোর রবির চোখ এড়িয়ে যেতে পারেনি। তাই জীবনস্মৃতি গ্রন্থে তিনি এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন -- 

 "আমার পিতার দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। তিনি বাক্স হইতে তখনই নোট বাহির করিয়া দিলেন। ভাড়ার টাকা বাদ দিয়া অবশিষ্ট টাকা যখন তাহারা ফিরাইয়া দিতে আসিল তিনি সে টাকা লইয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন, তাহা প্ল্যাটফর্মের পাথরের মেঝের উপর ছড়াইয়া পড়িয়া ঝনঝন করিয়া বাজিয়া উঠিল।" 


স্টেশন মাস্টার অপ্রস্তুত এবং সংকুচিত হয়ে চলে গেলেন। আসলে টাকা বাঁচানোর জন্য মিথ্যা কথা বলা... এই সন্দেহের ক্ষুদ্রতায় মহর্ষির মত মানুষের মাথা হেঁট হয়েছিল। 


অমৃতসরের শিখ মন্দিরে পিতৃদেবের সাথে গিয়ে শিখ উপাসকদের সাথে সাধন- ভজনে স্বল্প বিস্তর যোগদান... মিছরির খন্ড ও হালুয়ার প্রসাদ - সব মিলিয়ে কিশোরের মনে এক স্বপ্নের দেশ রচিত হয়েছিল... যার স্মৃতি থেকে গিয়েছিল বহুদিন।


অমৃতসরে যেখানে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল.... সন্ধ্যাবেলায় গাছের ছায়ার ভিতর দিয়ে চাঁদের জোৎস্নার আলো বারান্দার উপর এসে পড়ত। মহর্ষি সেই বারান্দায় বসে ব্রহ্মসঙ্গীত শোনাবার জন্য ছেলেকে ডেকে পাঠাতেন। এমনই এক সন্ধ্যায় যখন বাড়ির সামনের বাগান, বারান্দা চাঁদের জোৎস্নার স্রোতে ভেসে যাচ্ছে, মহর্ষি কোলের উপর দুহাত জোড় করে একান্ত ধ্যান মগ্নের মত বসে আছেন.... রবি কিশোর কণ্ঠে বেহাগের সুরে গাইছেন... 


   " তুমি বিনা কে প্রভু সংকট নিবারে, 

         কে সহায় ভব অন্ধকারে।"

             ………………………… 



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - অভিষেক নন্দী

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614

Monday 20 February 2023

আমাদের বাংলা ভাষা // ই-কোরাস ৯৭

 



ভাষার জন্য দেশ

তাহমিনা শিল্পী

ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা সাধারণত ১৯৫২ সালের ৮ ফাল্গুন বা ২১ ফেব্রুয়ারিকেই বুঝি। এই সময়ে ভাষার জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল তার ইতিহাস সকলেরই জানা। কিন্তু এই ভাষা আন্দোলন থেকেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের মোহনায়। এটি অনেকেরই জানা বা বোঝার বাইরে। তাই আমি আজ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে বিশদভাবে আলোচনায় না রেখে,বরং ভাষা আন্দোলনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কের সূত্রে আলোকপাত করবো।

ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। আমাদের দেশ স্বাধীন হবার নেপথ্যে যার রয়েছে বিশাল ভূমিকা ও প্রভাব। সেইসূত্রে বলা যায়,ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার প্রথম পর্ব।

তৎকালীন পাকিস্তানের মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬% বাংলাভাষী।তাই স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের রাষ্টভাষা হবার কথা ছিল বাংলা। তথাপি অন্যায়ভাবে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষনা করে, পাকিস্তানি শাসকবর্গের চাপিয়ে দেয়া অন্যায়ের প্রতিবাদে যদি ভাষা আন্দোলন না হত,যদি না বাংলা ভাষায় কথা বলার জোড় দাবী উঠতো। তাহলে আপামর জনতার মনে বাংলা ভাষার প্রতি গভীর মমতা তৈরি হত না। তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হত না এবং ভাষা আন্দোলনও মারাত্মক আকার ধারণ করত না।

প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্টভাষা একমাত্র উর্দু হলে,বাঙালা ভাষাভাষীরা যে কত পিছিয়ে যেত,বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালনা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ থেকে বাদ পড়ে যেত,সেই ষড়যন্ত্র বুঝতে ভুল করেনি বাংলার দামাল ছেলেরাও সাধারণ জনগন। তাই ভাষা শহীদদের আত্মবলিদানের বিনিময়ে ভাষার দাবী পূরণ হবার পরও বাঙালি থেমে থাকেনি। বরং ভাষা আন্দোলনের সুত্র ধরেই,স্বায়ত্তশাসনের দাবি ক্রমাগত প্রখরতর হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সুকৌশলে ভাষা আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করে প্রায়ই পার্লামেন্টে সংসদের কার্যপ্রণালী বাংলায় বলতে দাবী জানান।এক সময় ধীরেন দত্ত-ও পার্লামেন্টে এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ছিলেন। এইসবের প্রেক্ষিতে একে একে হয় ৬দফা,১১ দফা ও অসহযোগ আন্দোলন। সবশেষে হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। 

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে নিজ বাসভবন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষাণ দেন। সেই থেকে আমরা স্বাধীন। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু বললেন বাংলার মাটি থেকে চির তরে পাকিস্তানের শেষ সৈন্যকে খতম করা না পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে। ৯ মাস যুদ্ধ চলল। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে ও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই দিন আমাদের মহান বিজয় দিবস। বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি লাভ করে। 

৫২-র ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনের এক অবিস্মরনীয় ঘটনা।এক গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস।যার একপ্রান্তে ভাষা আন্দোলন আর অন্যপ্রান্তে মুক্তিযুদ্ধ।তাই ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বাংলাদেশের মানুষের জীবনে অপরিসীম। একুশের শহীদেরা বুকের রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যেটি সেটি হলো-ভাষা শহীদদের রক্ত এ দেশের উর্বর মাটিতে বপন করেছিল স্বাধীনতার বীজ। যে কারণে বায়ান্ন ও একাত্তর একসূত্রে গাঁথা। 

উল্লেখ্য, একুশে ফেব্রুয়ারি এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক দিবসে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। ফলে এখন পৃথিবীজুড়ে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। পৃথিবী জুড়েই বাংলাদেশের পরিচিতি।

অধিকার আদায়ের আন্দোলন বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই হয়েছে।কিন্তু ভাষার জন্য এইরকম আন্দোলন। ভাষার জন্য দলমত নির্বিশেষে জাতিগত চেতনা জাগ্রত হওয়া। নিজের ভাষার জন্য বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি,পরিচিতি এবং সর্বোপরি মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হওয়ার ইতিহাস বিরল। তাই এক কথায় বলা যায়,ভাষার জন্যই আমাদের প্রানপ্রিয় এই বাংলাদেশ।

                      ............................. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

ছবি - তাহমিনা শিল্পী

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614


Saturday 18 February 2023

আমাদের বাংলা ভাষা // ই-কোরাস ৯৬

 




ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

সুবল বিশ্বাস


পটভূমি: ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত নামে দু‘টি রাষ্ট্র ব্রিটিশের শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এ দু‘টি দেশের মধ্যে পাকিস্তান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এবং ভারত বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন দ্বি-জাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে পাকিস্তান নামের একটি দেশ দু‘টি ভূ-খন্ড নিয়ে গঠিত হয়। ভারতের পূর্বের ভু-খন্ড পূর্ব পাকিস্তান এবং ভারতের পশ্চিমে পশ্চিম পাকিস্তান। একই দেশের দুই অংশের মধ্যে দূরত্ব ছিলো ১২‘শ মাইল বা ১৮‘শ কিমি। তখন সারা পাকিস্তানের লোক সংখ্যা ৬ কোটি ৯০ লাখ। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের লোক সংখ্যা ছিলো ৪ কোটি ৪০ লাখ। ব্রিটিশ আমল থেকেই পূর্ব বাংলার বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা। আর পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দূ ও ফার্সি। পশ্চিম পাকিস্তানে ৬০ ভাগ লোকের মধ্যে উর্দূ ভাষা প্রচলন ছিলো। এ কারণে উর্দূকে প্রাধান্য দিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হয়। তখন থেকেই গোটা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দূ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় শাসকগোষ্ঠী। যেখানে ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাঙালি এবং তাদের ভাষা বাংলা; সেখানে ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে খুশি করতে পাকিস্তানের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালির ঘাড়ে উর্দূভাষা চাপিয়ে দেওয়ার নীলনক্সা তৈরি করতে থাকে পাকিস্তান সরকার। উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাস্তবায়ন করার ষড়যন্ত্রই হলো বাঙালি জাতির ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। 


বাঙালি জাতি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট হলেও শাসকগোষ্ঠী বিমাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর জুলুম, নিপীড়ন-নির্যাতনের পথে এগুতে থাকে। কথায় আছে কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে আগে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত করতে হয়। তাই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সেই পথ অনুসরণ করে প্রথম আঘাত করে ভাষার উপর। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি বাঙালি জাতি ব্রিটিশ আমল থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম করে শাণিত হয়ে উঠেছে। শাসকগোষ্ঠীর এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে গোটা বাঙালি জাতি রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদে ফেঁটে পড়ে। একদিকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়ায় গোটা বাঙালি জাতি; অন্যদিকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সংঘাতের পথ বেছে নেয় শাসকগোষ্ঠী ও পাকিস্তান ভিত্তিক উর্দু ভাষাভাষীর বুদ্ধিজীবীরা। এর ফলে ভাষা আন্দোলন আরো বেগবান হতে থাকে। ফুঁসে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের কবি-সাহিত্যিক, ছাত্র সমাজ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ভাষাবিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদসহ সর্বস্তরের মানুষ। 


প্রায় দু‘শ বছর ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে দ্বি-জাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে যখন ভারত-পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে; তখনই শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক। এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন পূর্ব বাংলার রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, কবি সাহিত্যিকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। ১৯৪৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের আগেই মুসলিম লীগ নেতা খালিকুজ্জামান, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও উর্দুভাষার পন্ডিতরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে অবস্থান দেন। তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে যুক্তি তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শহীদুল¬াহ, লেখক আবদুল হক, মাহাবুব জামান জাহেদী, কবি ফররুক আহমদ, এম. ওয়াজেদ আলীসহ বেশ কিছু বাংলাভাষার পন্ডিত। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তাঁদের অবস্থান ছিলো বাঙালি জনগোষ্ঠীর পক্ষে। কিন্তু উর্দুভাষার পন্ডিতরা তা মেনে নিতে পারেননি। জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে নানা বৈষম্য সৃষ্টি করে পূর্ব বাংলার জনগণের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়।  বাঙালি সংস্কুতি ধ্বংসের পায়তারা, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী দুষ্টিভঙ্গির কারণে ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে পূর্ব বাংলায়। বাঙালিদের অধিকার আদায়ে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস’ নামের একটি সংগঠন। তমদ্দুন মজলিস বাঙালিদের নানা দাবী ও অধিকার আদায়ে ভাষা আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।  


ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায় (১৯৪৮-৫১): ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি করাচীতে পাকিস্তান গণ-পরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে ভাষার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের কোনো কোনো গণ-পরিষদ সদস্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ও বিপক্ষে অংশগ্রহণ করে। ওই অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের কুমিলা থেকে নির্বাচি কংগ্রেস দলীয় গণ-পরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সর্বপ্রথম উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ২৫ ফেব্র“য়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত সংশোধনী প্রস্তাবের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। একই কায়দায় পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, ‘উর্দুই একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে পারে বলে পূর্ব পকিস্তানের অধিকাংশ লোকের অভিমত। বাংলাকে সরকারী ভাষা করার কোনোই যুক্তি নেই। তবে পূর্ব পকিস্তানের শিক্ষা ও শাসনকার্যের ক্ষেত্রে যথাসময়ে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হবে।’ (সূত্রঃ ভাষা আন্দোনের ইতিহাস; বশির আল হেলাল, পৃষ্ঠা ২৪৩)।         



ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধিতা করেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয়মন্ত্রী, গণ-পরিষদের সহসভাপতি মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য ফরিদপুরের তমিজুদ্দিন খান। তিনি সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করে খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যকে সমর্থন করেন। তবে কংগ্রেস দলীয় গণ-পরিষদ সদস্য প্রেমহরি বর্মা ও ভুপেন্দ্র কুমার দ্ত্ত তাদের বক্তৃতায় যুক্তিতর্ক তুলে ধরে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত প্রস্তাব সমর্থন করেন। করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণ-পরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ও গণ-পরিষদের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত প্রস্তাব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষাকে অন্তর্ভূক্তির জন্য সংশোধনী প্রস্তাব ভোটের মাধ্যমে নিয়ে আসেন। তখন গণ-পরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী প্রস্তাবটি কণ্ঠভোটে বাতিল হয়ে যায়। (সূত্রঃ ভাষার  লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন; গোলাম কুদ্দুছ, পৃষ্ঠা ১৯২)।


১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব ২৫ ফেব্র“য়ারি পাকিস্তান গণ-পরিষদে সংশোধনী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হয়। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। এ সংবাদ যখন পূর্ব পাকিস্তানে আসে তখন পূর্ব বাংলার সর্বত্র বিক্ষোভ দেখা দেয়। ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্র“য়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভ মিছিল করতে করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জমায়েত হয়। সেখানে তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহবায়ক নঈমুদ্দিন আহমদ ও ফজলুল হক হল ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ তোয়াহা। বক্তারা মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও গণ-পরিষদে বাংলা ভাষা বিরোধী ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন। সমাবেশ থেকে সারা পূর্ববঙ্গে বিক্ষোভ মিছিল, সভা-সমাবেশ ও ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ২৮ ফেব্র“য়ারি তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় ১১ মার্চ সর্বাত্বক সাধারণ ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ধর্মঘট সফল করার জন্য তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাসেম, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিল সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান (বর্তমানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান), মুসলিম ছাত্রলীগের আহবায়ক নঈমুদ্দিন আহমদ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলের নেতা আবদুর রহমান চৌধুরী ১ মার্চ যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তারা বাংলা ভাষার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুব সমাজকে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানান। ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা কলকাতায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে পাকিস্তান গণ-পরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব নাকচ করার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তারা বাংলা ভাষার বিরোধিতাকারী মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের নিন্দা জানিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অভিনন্দন জানান। (সূত্র ঃ ভাষার  লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনÑগোলাম কুদ্দুছ, পৃষ্ঠা ১৯৩, ১৯৪)।


১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বিভিন্ন ছাত্র, যুব, রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে সর্বদলীয় এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কমরুদ্দিন আহমেদ। এই যৌথসভায় উপস্থিত ছিলেন আবুল কাসেম, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল আলম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল আওয়াল, শহীদুলাহ কায়সার, রণেশ দাস গুপ্ত, আজিজ আহমদ, অজিত গুহ, শামসুদ্দীন আহমদ, আবদুল অদুদ, তোফাজ্জল আলী, সরদার ফজলুল করিম, আলী আহমেদ, মহিউদ্দিন আহমদ,শওকত আলী, আনোয়ারা খাতুন, অলি আহাদ, লিলি খান, নূরুল আলমসহ ছাত্র নেতারা। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে পূর্বে গঠিত ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ বিলুপ্তি করে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। এই ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’র আহবায়ক করা হয় শামসুল আলমকে।


আন্দোলনের রূপরেখা ঠিক করতে এবং ধর্মঘট সফল করতে ৪, ৫ ও ১০ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’র ৩টি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই কমিটির ব্যানারে শাসকগোষ্ঠীর নানা ভয়ভীতি ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১১ মার্চ সর্বাত্বক পালিত হয়। এদিন ধর্মঘট চলাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে মুসলিম ছাত্রলীগের নেতারা ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, অলি আহাদসহ বেশকিছু নেতা সচিবালয়ের ১নং ও ২য় গেটে পিকেটিং করেন। এ সময় পুলিশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পিকেটিংয়ের এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা রাস্তায় শুয়ে অফিসারদের সচিবালয়ে প্রবেশে বাঁধা প্রদান করেন। পুলিশের লাঠিচার্জে মোহাম্মদ তোয়াহা ও শওকত আলী আহত হন। পুলিশ সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, আহত শওকত আলী, শামসুল হক, অলি আহাদকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। 


ভাষা আন্দোলনের এ সময় তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর দূরদৃষ্টি, সাহসিকতা, বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ও সাংগঠনিক দক্ষতা ভাষা আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে ওঠে। ক্ষমতাশীন শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভাষা আন্দোলনের গতিসঞ্চার করা ছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ়প্রত্যয়ী মনের বহি:প্রকাশ। ১১ মার্চ ছিলো ভাষা আন্দোলনের মাইল ফলক। তাই ১১ মার্চ প্রথম ‘ভাষা দিবস’ পালিত হয় এবং বায়ান্ন সালের আগ পর্যন্ত ১১ মার্চকে ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। (সূত্রঃ ভাষার  লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন; গোলাম কুদ্দুছ, পৃষ্ঠা ১৯৫, ১৯৬, ১৯৯)। ভাষা সৈনিক গাজিউল হকের বক্তব্যে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ভাষা সৈনিক গাজিউল হকের বক্তব্য সমর্থন করে অলি আহাদ বলেছেন, ‘সেদিন সন্ধায় যদি মুজিব ভাই ঢাকায় না পৌঁছাতেন তা‘হলে ১১ মার্চের হরতাল, পিকেটিং কিছুই হতো না।’  (সূত্রঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-জীবন ও রাজনীতি, প্রথম খন্ড সম্পাদক-মোনায়েম সরকার, পৃষ্ঠা ১৬৭)। এ থেকে সহজেই উপলব্ধী করা যায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত ১১ মার্চ ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ শুধু ঢাকা নয় পূর্ব বাংলার সকল জেলা ও মহকুমায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কর্মসুচি পালিত হয়। সুতরাং ১১ মার্চ ছিলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাইল ফলক।


ভাষা আন্দোলনের এক পর্যায়ে শুরু হয় শাসকগোষ্ঠীর কুট-কৌশল, বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি। এরই মধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নার পূর্ব পাকিস্তান সফরের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে ঠিক তখনই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ও পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ সরকারী সফরে প্রথম ঢাকায় আসেন। তার এ সফরকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার পাশাপাশি কৌতুহল ছিলো ব্যাপক। ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা সভায় বক্তৃতাকালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করেন। তার এ ঘোষণার প্রতিবাদে উপস্থিত ছাত্র সমাজ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ‘নো নো’ বলে প্রতিবাদ জানিয়ে সভাস্থল ত্যাগ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আবার উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করেন। এতে সাথে সাথে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং ছাত্ররা হল ত্যাগ করে রাস্তায় নেমে পড়ে। আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে সারা পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। জেলায় জেলায় গঠিত হয় ভাষা আন্দোলন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দাবী উপেক্ষা করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই হটকারী ঘোষণা অখন্ড পাকিস্তান বিভক্তির বীজ রোপিত হয় তখন থেকে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ও পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও পূর্ব বাংলার গভর্নর খাজা নাজিমউদ্দিনের পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, যৌক্তিক দাবী-দাওয়ার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন, জুলুম-নির্যাতন ও বাংলা সংস্কৃতির উপর আঘাত অখন্ড পাকিস্তান বিভক্তির পথ সুপ্রসারিত হয়। ভাষা আন্দোলনের মুখে ১৯৪৮ সালের ৮ এপ্রিল পূর্ব বাংলার আইন সভায় বাংলা ভাষাকে শুধু পূর্ব বাংলার সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার কারণে খাজা নাজিমউদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে তিনি তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। এতে ভাষা আন্দোলনের পথ আরো প্রসারিত হয়ে দীর্ঘায়িত হয়ে পড়ে।  ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইন্তেকাল করেন। এ সময় রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনের কর্মকান্ড কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে ১৯৪৯ সালের প্রথম থেকে ভাষা আন্দোলন আবার জোরদার হয়ে ওঠে।


১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারী পূর্ব বাংলায় জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা ধর্মঘট পালন করে। ধর্মঘট শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যামাগারের উন্মুক্ত স্থানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন তুখোর ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দবিরুল ইসলাম ও অলি আহাদ। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগের আহবায়ক নঈমুদ্দিন আহমেদ। বক্তারা সকল জুলুম নির্যাতন বন্ধ করে পূর্ব বাংলার সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের ন্যায্য দাবী মেনে নেওয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠীর প্রতি আহবান জানান। এতে স্তিমিত ভাষা আন্দোলন আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ২৪ ফেব্র“য়ারি গঠিত হয় বর্ণমালা সাব-কমিটি। এ সময় বাংলা হরফ পরিবর্তনের ষড়যন্ত্র করে কেন্দ্রীয় সরকার। এর প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ৪ মার্চ তমদ্দুন মজলিসের সভায় প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রহমান খানসহ ছাত্র নেতারা। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ড. মুহাম্মদ শহীদুলাহ। এর পর থেকে প্রদেশের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ সংগঠিত হতে থাকে। ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য ২৯ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ ছাত্র-ছাত্রীকে জরিমানা ও দন্ড দিয়ে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ আচরণের প্রতিবাদে ১৭ এপ্রিল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-কর্মচারী পরিষদ লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দেন। ১৮ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র লাগাতার ধর্মঘট, সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। এ সময় সাধারণ মানুষ ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। অনেক ছাত্র নেতাকে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালানো হয়। ফলে ভাষা আন্দোলনের সাথে কারামুক্তির আন্দোলন যোগ হয়ে ভাষা আন্দোলন যুগপৎ আন্দোলনের রূপ নেয়। আন্দোলনের মুখে জুন মাসে কারাগার থেকে মুক্তি পান ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কারামুক্তির পর আন্দোলন আরো বেগবান হতে থাকে।

১৯৫০ সালের ১১ মার্চ (সম্ভাব্য) ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটির আহবায়ক করা হয় ছাত্র নেতা আবদুল মতিনকে। ১৯৫১ সালের প্রথম থেকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ ব্যাপক কর্মসুচি গ্রহণ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে জোরদার করে তোলে। ঐ বছর ১১ মার্চ সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে দিক নির্দেশনামূলক ইশতেহার প্রকাশ করা হয়। পূর্ব বাংলার শহরে শহরে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আগুনের লেলিহান শিখার মতো ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে বড় বড় শহরে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন নতুন জাগরণের সৃষ্টি হয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। (সূত্রঃ ভাষার  লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন; গোলাম কুদ্দুছ)। 

ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫২): বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে সুদীর্ঘ ও লাগাতার আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৫২ সালের দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ড পর্যায়ের সংগ্রাম এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের জন্ম দেয়। দ্বি-জাতির ভিত্তিতে স্বাধীন পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বিপুল জনপ্রিয়তাকে উপেক্ষা করে পূর্ব বাংলার যে সকল ছাত্র-যুবক ১৯৪৮ সালে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তাঁরা অবশ্যই নমস্য। তাঁরা শুধু চিন্তা-চেতনা ও মননে দুঃসাহসিক ছিলেন না; মনে প্রাণে ছিলেন খাঁটি বাঙালি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারী রক্তাক্ত অধ্যায় সম্পর্কে পর্যালোচনার আগে একটু পেছনে ফিরে তাকালে জানা যায়, ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের প্রথম দিকে নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শাহ আজিজুর রহমান কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। এ সময় মূলত; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে এবং অলি আহাদসহ অন্যদের সহযোগিতায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করা হয়। নঈমুদ্দিন আহমেদকে এই সংগঠনের আহবায়ক নির্বাচিত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালের ৪ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’এর কাউন্সিলে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে নতুন নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ)। তখন থেকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ধর্মীয় গন্ডি অতিক্রম করে একটি অসা¤প্রদায়িক ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করে। এই রাজনৈতিক সংগঠনের আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালের ২৭-২৮ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত যুব-সম্মেলনের মাধ্যমে ‘পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ’ গঠিত হয়। এই সংগঠনের মাহমুদ আলী সভাপতি, অলি আহাদ সাধারণ সম্পাদক এবং আবদুল মতিন ও রুহুল আমিন কায়সার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।  (সূত্রঃ ভাষার  লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন; গোলাম কুদ্দুছ পৃষ্ঠা ২৫৫,২৫৬)। 

১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হলে খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে চতুর্থ শ্রেণির সরকারী কর্মচারীদের নানা দাবী-দাওয়া নিয়ে চলমান আন্দোলন আরো গতি লাভ করে। একদিকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন; অন্যদিকে সরকারী কর্মচারীদের ন্যায্য দাবীর আন্দোলন, এই দু‘টি আন্দোলন একত্রিত হয়ে অশান্ত হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলা। এ পরিস্থিতিতে এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিল উপলক্ষে ১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারী পাকিস্তানের নয়া প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন সস্ত্রীক ঢাকায় আসেন। ২৭ জানুয়ারী ঢাকার পল্টন ময়দানে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন। কাউন্সিল অধিবেশন শেষে খাজা নাজিমউদ্দিন প্রধান অতিথির দীর্ঘ বক্তৃতা প্রদান করেন। তার এই ভাষণ সেদিন রেডিও পাকিস্তান সরাসরি স¤প্রচার করে। তার ভাষণে তিনি ১৯৪৮ সালে দেওয়া মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্য পূনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। প্রদেশের ভাষা কি হবে তা প্রদেশবাসী ঠিক করবে। একাধিক ভাষা থাকলে কোন রাষ্ট্র শক্তিশালী হতে পারে না।’ তিনি তার ভাষণের এক পর্যায়ে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘প্রাদেশিকতাকে যে বা যারা প্রশ্রয় দেয় তারা পাকিস্তানের দুশমন।’ (সূত্র দৈনিক আজাদ, ২৮ জানুয়ারী, ১৯৫২)। খাজা নাজিমউদ্দিনের এ বক্তব্য অখন্ড পাকিস্তান বিভক্তির অন্যতম কারণ। 


খাজা নাজিমউদ্দিনের এই ভাষণ পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকারীদের মনে দারুণভাবে রেখাপাত করে। তিনি তার ভাষণে রাষ্ট্রভাষার দাবী বাংলাকে পুরোপুরি অস্বীকার করেন। শুধু তাই-ই নয় বাঙালির সকল আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার হরণের অশুভ ইঙ্গিত বহণ করে তার এ ভাষণে। ফলশ্র“তিতে ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে গড়ে ওঠা আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। তখন থেকে শুরু প্রতিবাদ, ধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও যুব সমাজসহ সামাজিক সংগঠনের যৌথসভায় সর্বসম্মতিক্রমে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’। সভায় সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বক্তব্য রাখেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, পূর্ব বাংলার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সম্পাদক অলি আহাদ, তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবদুল গফুর, ইসলামিক ব্রাদারহুডের সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক আহম্মদ, খেলাফত রাব্বানী পার্টির সম্পাদক আবুল হাশিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আবদুল মতিন, মোহাজের এসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ আবুল ফজল, অধ্যাপক আবুল বাশার, নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈফুদ্দিন আহমদ এবং ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন। 


‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’এর সদস্য ছিলেন-মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাশিম. শামসুল হক, আবদুল গফুর, আবুল কাসেম,আতাউর রহমান খান, কমরুদ্দিন আহমদ, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন, আলমাস আলী, আবদুল আওয়াল, সৈয়দ আবদুর রহিম, মোহাম্মাদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শামসুল হক চৌধূরী, খালেক নেওয়াজ খান, মীর্জা গোলাম হাফিজ, মজিবুল হক, হেদায়েত হোসেন চৌধুরী, শামসুল আলম, আনোয়ারুল হক খান, ডা. গোলাম মাওলা, সৈয়দ নূরুল আলম, নূরুল হুদা, শওকত আলী, আবদুল মতিন এবং আখতার উদ্দিন আহমদ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষে চলমান আন্দোলন আরো জোরদার হতে থাকে। ৪ ফেব্র“য়ারি ঢাকাসহ প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটকালে ছাত্র-ছাত্রীরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না চলবে না’ স্লোগান দিয়ে ক্লাস বর্জন করে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জমায়েত হয়। সেখানে বিশাল সমাবেশে সভাপতিত্ব করার জন্য গাজীউল হকের নাম প্রস্তাব করেন এম.আর আখতার মুকুল ও ছাত্রনেতা কমর উদ্দিন। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক এবং তিনি প্রধান বক্তা হিসেবে পরবর্তী কর্মসুচি ঘোষণা করেন। সভায় ২১ ফেব্র“য়ারি সারা পূর্ব বাংলা ব্যাপী হরতাল, সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল সাফল্য মন্ডিত করার ডাক দিয়ে শপথ করা হয়।


২১ ফেব্র“য়ারির কর্মসূচি সফল করতে ১১ ফেব্র“য়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। ভাষা আন্দোলনের তৎপরতা সারা পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে দিতে ১২ এবং ১৩ ফেব্র“য়ারিকে পতাকা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজন্দির মুক্তির দাবীতে বৃহৎ কর্মসূচি পালিত হয়। ২১ ফেব্র“য়ারি যতোই ঘনিয়ে আসতে থাকলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও রাজবন্দিদের মুক্তির আন্দোলন আরো জোরদার হতে লাগলো। তখন থেকে ঢাকা সারা পূর্ব বাংলায় ফুঁসে উঠলো আন্দোলনের অগ্নিশিখা। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ ‘উদৃু হরফে বাংলা লেখা চলবে না চলবে না’ স্লোগানে স্লোগানে উত্তপ্ত হয়ে উঠলো গোটা প্রদেশ। আন্দোলন থামাতে সরকার নতুন কৌশল অবলম্বন করলো। কারাগারে অনশনরত ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদকে ১৫ ফেব্র“য়ারি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হলো। এতে আন্দোলন আরো তীব্র আকার ধারণ করে জেলায় জেলায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ ফেব্র“য়ারি শেখ মুজিবুর রহমান, মহিউদ্দিন আহমেদসহ সকল রাজবন্দির উপর নির্যাতন বন্ধ করে তাদের মুক্তির দাবীতে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়। স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষানী, আতাউর রহমান খান, মাওলানা রাগীব আহসান, নূরুল হুদা, আবুল হাশিম, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, মির্জা আবদুল কাদের, ডা: গোলাম মাওলা, শামসুল হক, কমরুদ্দিন আহমাদ, আবদুস সালাম, তফাজ্জল হোসেন, জহীরুদ্দিন আহমেদ, হাসান ইকবাল, সিরাজউদ্দিন আহমেদ, কাজী গোলাম মাহবুবসহ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি, সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, যুবলীগের সম্পাদক, তমদ্দুন মজলিমের সম্পাদক, বিভিন্ন ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচিত প্রতিনিধি, মিউনিসিপ্যাল কমিশনারগণ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। 


২১ ফেব্র“য়ারির কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতির পূর্বে ২০ ফেব্র“য়ারি ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. কোরেশী এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেন। ২০ ফেব্র“য়ারি জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সন্ধায় নবাবপুর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে জরুরী সভা করে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।’ সভায় উপস্থিত ২৪ নেতার মধ্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়।সভায় সভাপতিত্ব করেন আবুল হাশিম। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে-বিপক্ষে নেতাদের অবস্থান নেওয়ায় দেখা দেয় মতবিরোধ। এক পর্যায়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে অনড় থাকে একটি অংশের নেতারা। তারা ২১ ফেব্র“য়ারির কর্মসূচি সফল করতে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ২০ ফেব্র“য়ারি রাতে ফজলুল হক হলের পুকুরপাড়ে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ’, বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ ও ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির’ সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত হয়। ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির’ সভায় ২১ ফেব্র“য়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রসভার সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভাষা আন্দোলনকে সঠিক ধারায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর সদস্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ডাঃ গোলাম মাওলাকে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’এর অন্তর্বর্তীকালীন আহবায়ক নিযুক্ত করা হয়। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া বেশ কয়েকজন নেতা ২১ ফেব্র“য়ারির আগে গা ঢাকা দিলেও আন্দোলন থেমে থাকেনি। ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ-এর আহবায়ক ডাঃ গোলাম মাওলা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে অনড় থাকেন এবং পরবর্তী করণীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। 

২১ ফেব্র“য়ারি বৃহস্পতিবার ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার আগে সকালে ডা: গোলাম মাওলার সিদ্ধান্তে ঢাকা মেডিকেলে প্রথমে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়। সকাল থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়, ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়, নবাবপুর, আবদুল গণি রোডসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে জমায়েত হতে থাকে।  বেলা ৩টা থেকে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে আন্দোলনকারীরা। এ সময় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘উর্দু হরফে বাংলা লেখা চলবে না চলবে না’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই মুক্তি চাই’ স্লোগান দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের তীব্রতা দেখে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশের এ্যাকশন শুরু হয়। প্রথমে টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ায় চেষ্টা চালায় পুলিশ বাহিনী। অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশ ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিতে রাজপথে লুটিয়ে পড়ে শহীদ হন রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার। এ সময় কমপক্ষে ৩০ জন ছাত্র-যুবক আহত হলে তাদের মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। আহত ১৭ জনের নাম পাওয়া গেছে তারা হলো-আনোয়ারুল ইসলাম, এ.আর. ফৈয়াজ, সিরাজউদ্দিন খান, আবদুস সালাম, এম.এ মোতালেব, এলাহী বকশ্, মনসুর আলী, বসিরউদ্দিন আহমদ, তাজুল ইসলাম, মাসুদুর রহমান, আবদুস সালাম-২, আখতারুজ্জামান, আবদুর রেজ্জাক, মোজাম্মেল হক, সুলতান আহমেদ, আবদুর রশিদ, মোহাম্মদ আলী। এর মধ্যে আহত সরকারী শুল্ক বিভাগের পিয়ন (বাড়ি ফেনী) আবদুস সালাম ৭ এপ্রিল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। একটি অসমর্থিত সূত্রমতে এদিন ওহিউল­াহ ও আবদুর রহিম নামে ৮/৯ বছরের দুই শ্রমিক শহীদ হয়। পনবর্তীতে ঐ দুই শহীদ শিশুর পরিচয় জানা যায়নি। পুলিশের গুলিতে ছাত্র হতাহতের ঘটনায় চলমান গণপরিষদের অধিবেশন ত্যাগ করে রাস্তায় নেমে আসেন মাওলানা আবদুর রহিম তর্কবাগীশ ও বিরোধী দলের গণপরিষদ সদস্যরা। তাঁরা রাস্তায় এসে আন্দোলনরত ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সমর্থন দেন। এদিন অধিবেশনের শুরুতেই পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে বক্তব্য দিলে অধিবেশনের মধ্যে হট্টগোল শুরু হয়ে উত্তপ্ত হয়ে পড়ে গণপরিষদ ভবন। ২১ ফেব্র“য়ারি পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনায় যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা মোকাবেলা করে আন্দোলন সঠিক পথে পরিচালনার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ডা: গোলাম মাওলাকে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’এর আহবায়ক মনোনীত করা হয়। তাঁকে সহায়তা করেন অলি আহাদসহ আন্দোলনরত ছাত্রনেতারা। 


২১ ফেব্র“য়ারির পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করে আন্দোলন সঠিক পথে পারিচালনায় ডা: গোলাম মাওলার ভুমিকা অনস্বীকার্য। ২১ ফেব্র“য়ারির রক্তাক্ত ঘটনার পর ২২ ফেব্র“য়ারি গণবিক্ষোভ, সর্বস্তরের জনতার অংশগ্রহণে শহীদদের গায়েবানা জানাজা শেষে শোক মিছিল বের করা হয়। মিছিলে পুলিশ ও মিলিটারী পূনরায় লাঠিচার্জ ও গুলি চালায়। গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র। অনেক মৃতদেহ পুলিশ সরিয়ে ফেলে। যার ফলে ভাষা আন্দোলনে হতাহতের সঠিত ইতিহাস আজো অন্ধকারে রয়ে গেছে। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদ ২১ ফেব্র“য়ারি সম্পর্কে তাঁর ডায়েরিতে উলে­খ করেছেন, ‘বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে সাধারণ ধর্মঘট চলছে। গতকাল থেকে এক মাসের জন্য সিআর, পিসি, ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আজ বিকেলে অ্যাসেমব্লি বসেছে। ধর্মঘট পালনকারী ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে অ্যাসেমব্লি হাউসের কাছে জড়ো হয়; যাতে তাদের কণ্ঠ অধিবেশনে উপস্থিত এমএলএ-রা শুনতে পান। প্রথমে শুরু হলো গ্রেফতার করা। এরপর কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হলো। তারপর গুলি চালানো হলো মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে। গুলিতে চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হলো। আহত হলো ৩০ জন। জানা যায় ৬২ জনকে জেলে পোরা হয়েছে। আরো শোনা যায়, পুলিশ কয়েকটি মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। বেসরকারী সুত্রের দাবী, মৃতের সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জন।’ (সুত্র তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৫২, চতুর্থ খন্ড)। 


২১ ফেব্র“য়ারি পুলিশের গুলিতে ঢাকা মেডিকেলের যেখানে ছাত্ররা শহীদ হয়েছিলো সাঈদ হায়দারের নক্সায় ২৩ ফেব্র“য়ারি সেখানে কংক্রিটের একটি অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ২৪ ফেব্র“য়ারি প্রথম শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। শহীদ মিনার নির্মাণে ইট, বালু, রড সিমেন্ট দিয়ে সহায়তা করেন পুরান ঢাকার পিয়ারু সর্দার নামের এক ব্যবসায়ী। যার নাম অনেক ইতিহাসবিদ উপেক্ষ করে গেছেন। এই শহীদ মিনার নির্মাণে মূল ভূমিকা পালন করেন ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’এর আহবায়ক, মাদারীপুরের সন্তান ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ডা: গোলাম মাওলা। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন অব্যাহত ছিলো। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে বিল পাস করে প্রেসনোট জারি করলে অর্জিত হয় বাংলা ভাষার দাবী। ১৯৬৩ সালে অস্থায়ী শহীদ মিনারের জায়গায় একটি পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। এটাই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। এই হলো ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ঘটনা এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।    



তথ্যসূত্রঃ

অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান-সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি

ড. তপন বাগচী, কবি, লোকসংস্কৃতিবিদ ও ইতিহাস গবেষক, উপ-পরিচালক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

সহায়ক গ্রন্থ:-একুশের দলিল গ্রন্থ- ভাষা সৈনিক এম. আর. আক্তার মুকুল

ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন-গোলাম কুদ্দুছ. প্রথম প্রকাশ ফেব্র“য়ারি ২০১৫

ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ দ্বিতীয় খন্ড-বদরুদ্দীন উমর, প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ১৯৮৫

ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস- আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন; প্রকাশকাল ২০০০।

                    ………………….. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

ছবি - তাহমিনা শিল্পী

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614

 

ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...