Wednesday 14 April 2021

e-কোরাস ৪৩ // হালখাতা

 


১লা বৈশাখ 

সুকান্ত সিংহ 



বছরভর ইংরেজি ক্যালেন্ডার ব্যবহার করলেও ১লা বৈশাখ কবে সেটা কোনোদিন ভুলিনি। না হয় তাকে ইংরেজি তারিখেই মনে রেখেছি, কিন্তু তারপরেও দিনটা সেদিন শুধুই ১লা বৈশাখের, আর অন্যকিছুর নয়। চৈত্রদহন পেরিয়ে যখন ঢুকে পড়ে বৈশাখ, দহন কমে না, তবু ওই দহনের মাঝেই মনে হয় কোথাও যেন ভাল লাগার পরশ রয়ে গেছে। সময়কে ভাগ করে দিন, মাস, বছর, বিশাল এই ব্রহ্মাণ্ডে এতটুকুও দাগ রেখে যায় না হয়তো, মনে মনে তবু খুশি হই, নতুন বছরে সব ক্ষত ভরে নেওয়া যাবে এমনটা ভেবে। ভুলগুলো শুধরে নেওয়া যাবে। ক্লান্তি ধুয়ে নেওয়া যাবে। আবার নতুন করে ভেঙে পড়া সাঁকোগুলো বেঁধে নেওয়া যাবে। 


যায় কি? না গেলেও ওই যে, নতুনের প্রতি সবসময় একটা আশা থাকে, একটা বিশ্বাস থাকে, এতদিন যা পারিনি, নতুন তা পারবে ভেবে মনে একটা জোরের জন্ম হয়, ওইটিই আসল কথা। 


ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখ মানেই ছিল মিষ্টির প্যাকেট আর নতুন ক্যালেন্ডার। মিষ্টির থেকেও ক্যালেন্ডারের প্রতি পক্ষপাতটা ছিল বেশি। মিষ্টি তো খেলেই শেষ, কিন্তু ওই যে নানান রকমের ক্যালেন্ডার পাওয়া যেত, কোনোটায় লক্ষ্ণীনারায়ণ, কোনোটায় নোনিচোরা গোপাল, কোনোটায় আবার আলপথ পেরিয়ে মাটির বাড়ি, পাশে পুকুর, তাতে শালুক ফুটে আছে, ওই ছিল ভালবাসার জিনিস। সবকটাই দেওয়ালে টাঙানো হত না অবশ্য। কিছু গুটিয়ে রাখা হত। আর পুরোনো হলে বই খাতার মলাট হত। পরে যখন দামি ম্যাপলিথো কাগজে ছাপা ঝকঝকে ক্যালেন্ডার এল, তার থেকে ছবি বেছে কেউ কেউ আবার কাঁচ দিয়ে বাঁধিয়ে রাখত ঘরে। সব ক্যালেন্ডারেই একদিকে ছাপা থাকত -- শুভ নববর্ষের প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। অন্য দিকে লেখা থাকত -- সততাই আমাদের একমাত্র মূলধন। যাঁরা খুব কেজো- লোক তাঁরা ওসব ছবি দেওয়া নয়, শুধুই তারিখ দেওয়া ক্যালেন্ডার রাখতেন। আমার চিরকাল দুচোখের বিষ ছিল ওই সব ক্যালেন্ডার। আজো আছে। এখনো ক্যালেন্ডার পেলেই আগে দেখে নিই কী ছবি আছে। এবং আজো অভাব বোধ করি সেই একটুকরো গ্রামের ছবি আঁকা ক্যালেন্ডারের জন্য। 


যেখানে আঁকা আছে একটা নদী, সে  এঁকেবেঁকে কোথায় যাচ্ছে কে জানে, তার এপার থেকে ওপারে যাওয়ার বাঁশের সাঁকোটা জেগে আছে। যেটা পেরিয়ে গেলেই একদিকে ধানখেত। অন্যদিকে বৈরাগীতলা। 


মনের মাঝে ওই সাঁকোটাই শুধু রয়ে গেছে!

                   ………………… 



চড়ক নববর্ষ আর হালসাল

সুনীল মাজি


কেশবপুরের ভেটি পাড়া। বছরের শেষ দিন। চার পয়সায় একটি গোটা পাপড় খাব বলে আধা মাইল দূরে মেলাতে যেতাম বিকাল বেলা। সাহেব মালিকের খোঁয়াড় মাঠে মেলা বসতো। কেশবপুর গ্রামটি ছিল ছত্রিশ পাড়ার গাঁ। মুণ্ডেশ্বরীর  একটি শাখানদী ছিল এই গ্রামে। তাই গ্রামটি তিন টুকরো ছিল। মাঝের খণ্ডটি ছিল ভেটি পাড়া। মুসলমান আর হিন্দুর বাস। মুসলিমদের তথা অহিন্দুদের ছিল দুটি পাড়া। আমরা বলতাম, ফকির ও শেখ পাড়া। আর ছিল স্বজাতি বাগদি পাড়া। তাছাড়া  কয়েক ঘর মুচি ছিল। কথা বলার ঢঙসঙ এক ছিল। ঠাকুরদা বলতেন, সেন রাজার পরে পরেই এখানের হিন্দুরা ধর্ম বদলায়। ধর্ম ভিন্ন হলেও নদীর জলকে পানী বললেও স্রোত বদলায়নি। সংস্কৃতি বদলায়নি।

 যাই হোক,বছরের শেষ দিনে আমরা ইজের প্যান্টের পকেটে  হাত চেপে দৌড় দিতাম। তখন আমাদের সম্পদ বলতে এক পয়সা দুই পয়সা তিন পয়সা পাঁচ পয়সা দশ পয়সা কুড়ি পয়সা আর চার আনা। আমরা মুঠো পকেটে পয়সা  চেপে মেলা ঘুরে ঘুরে দেখতাম এক পয়সায় কোনও জিনিস পাওয়া যায় কিনা। এক পয়সা খরচ হয়ে গেলে আমরা বারবার গুনতে থাকতাম হিসেব মতো সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। এক এক কয়েন খরচ হয়ে গেলে এই পর্ব চলতো। তারপর  লজেন্জুস থেকে কাঠিভাজা থেকে ফুলুরি থেকে ঘুঘনি থেকে থেকে পাপড়। অবশেষে চোঁয়া ঢেঁকুর সহ বমি হলে পাপড় ওয়ালা বা ফুলুরি ওয়ালার গুষ্টির তুষ্টি করতে করতে ঘরে ফিরতাম। ঠাকুরদা বলতেন, বছরের শেষদিনে বমি হওয়া ভালো। অনেক পচা জিনিস বেরিয়ে যায়।


বছরের প্রথম দিনে চড়কের মেলা  বসত সকাল বেলা। কুলবাতপুরের কালীতলায়। কালীমন্দির ছিল দখিন দিকে।

এখানে আমরা সব কিছুই মা কালীর নামে কিনতাম। খেতাম। পকেট ঝনঝন করতো। হারাবার ভয় ছিল না। বাতাসা কিনতাম। হাত পাখা  কিনতাম।ফটো কিনতাম। রাম সীতার। রাধাকৃষ্ণের। রামকৃষ্ণের। বিবেকানন্দের। রবীন্দ্রনাথের। অবশ্যই পাপড় খেতাম।দাম পাঁচ পয়সা।

হালখাতা হতো পয়লা বৈশাখ আর তেরো বৈশাখ। তেরো তারিখ অলক্ষুণে তবু কেন? দোকানগুলো সাজানো হতো বেশ। খুব আমপাতা ঝুলতো। ক্যালেন্ডার দিতো। মিষ্টির প্যাকেট। গণেশের ছবি  থাকতো। সিঁদুর দিয়ে ওঁ লেখা হতো। আহা, বাঙালির সেসব দিন ছিল। স্বর্ণযুগ ছিল। মাইকে গান গাইত হেমন্ত মান্না শ্যামল সন্ধ্যা। আমরা গাছের মতো লম্বা হয়ে আকাশ দেখতাম খুব। আর পতঙ্গ খেলতাম হাওয়ায় হাওয়ায়।

                     ……………………. 


যে বৈশাখ হারিয়ে গেছে

তৈমুর খান


 একটা তেলেসমাতি যুগে আমরা পৌঁছে গেছি। আমাদের নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর আমাদের বাঙালি সত্তাকে নাড়া দেয় না। এই কিছুকাল আগেও আমরা এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করতাম। নিজেরাই ছবি এঁকে, নকশা তুলে শুভেচ্ছা বার্তা লেখা একটা পত্র তৈরি করতাম। নববর্ষের দিন প্রিয়জনকে উপহার দিতাম। সেইসঙ্গে দিতাম নববর্ষের মিঠাইও। কখনো কখনো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুষ্ঠানে মিলিত হতাম নতুন লেখা কবিতা ও ছড়া নিয়ে। আবার পত্রিকা প্রকাশেরও চল ছিল কখনো কখনো। সেই দিন যে কী ব্যস্ততায় কাটত! অনুষ্ঠান মঞ্চ সাজানো থেকে প্রেসে ছুটোছুটি পর্যন্ত। তারপর প্যাকেট তৈরিও। সামান্য কিছু চাঁদা নিয়ে আমরা যেন মহৎ কাজের তদারক করছি এমনই ভাব।


আজ সেসব অতীত হয়ে গেছে। সেসব দিনের কথা যখন ভাবতে বসি তখন কষ্ট হয় বৈকি! ছেলেমেয়েদের বই পড়া তো নেই-ই তারপর আবার বিদ্যালয়েও পড়াশোনা বন্ধ। অনলাইনে ক্লাসের নামে মোবাইল মুখী হয়ে ওঠা এবং অকালপক্ষতায় বোঁটা হলুদ করা এখন মারাত্মক অসুখে পরিণত হয়েছে। সৌজন্য-শুভেচ্ছার কোনো ধার ধারে না। নববর্ষ-পহেলা বৈশাখের গুরুত্বই ওদের কাছে অর্থহীন। বয়ঃসন্ধির মুহূর্তেই যে যৌনউত্তাপে ওরা স্পন্দিত হতে থাকে তাতে সুস্থ সংস্কৃতি তথা জীবনবোধেও এক ধরনের নঞর্থক ক্রিয়ার উদ্ভব হয়। পশ্চিমী অনুকরণে হাই-হ্যালোর বাতাবরণে তারা ডুবে যায়। পর্নোগ্রাফির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এই কারণে রবীন্দ্রনাথও তাদের কাছে ব্রাত্য। সুনীল গাঙ্গুলির মতো কৈশোর ওদের নেই। ১০৮ টা নীল পদ্ম তুলতে কিংবা পাগলা ষাঁড়ের মাথায় লাল গামছা বাঁধতেও কেউ এগিয়ে যায় না। বাঙালির গৌরব কিসে সে ভাবনাও কারও নেই। যে পহেলা বৈশাখে নতুন খাতা মহরৎ করতে সবাই দোকানে দোকানে যেতাম ঋণ শোধ করতে এবং নববর্ষের রংবেরঙের মিঠাইয়ের আশায়—সে আনন্দও এখন মরে গেছে। এইদিন গ্রাম বাংলার বাড়ি বাড়ি একটা আনন্দের কলধ্বনি শোনা যেত। যাত্রাপালারও আয়োজন হত। কোথাও কবিগানের আসর বসত। নিজেকে গৌরবান্বিত বাঙালি ভাবতে ভালো লাগতো সেদিন। নতুন কাপড়ের ঘ্রাণ নিয়ে সুস্থ জীবনের স্বকীয় উচ্ছ্বাসে এক হিল্লোল বয়ে যেত। আজ সেই ঘ্রাণ নেই। সব জায়গা দখল করে নিয়েছে আমাদের মোবাইল সংস্কৃতি। এখন শুভেচ্ছা বার্তা হয়তো মেসেজ বক্সেই লিখতে হয়।

          তাহলে কি বাঙালি সত্তা ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে?

 অবশ্যই হারিয়ে ফেলেছে। এখন আর মাইক-রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত বাজে না। নজরুল গীতিও যেন প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। আবৃত্তি-নাটকের মঞ্চও আর তৈরি হয় না। তার বদলে হিন্দি গানের ডিজে বক্স বাজে। এমনকী বাঙালি পহেলা বৈশাখকে মনেও রাখে না। ইংরেজি তারিখ গণনায় তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বাংলায় কয়টি মাস আছে, কয়টি ঋতু আছে এটি তাদের কাছে জিকে-এর প্রশ্ন। বাঙালির আসল উৎসব যে এই নববর্ষ তা আজ বিস্মৃতির পর্যায়ে চলে গেছে। যে রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষমতায়ন ঘটছে পরোক্ষে তারাও বাঙালি সংস্কৃতির বদলে নিয়ে আসছে দক্ষিণী তথা হিন্দি সংস্কৃতির এক সম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছে। পহেলা বৈশাখ বাঙালির কাছে একটা অঙ্গীকার। নতুন ক্যালেন্ডার, রবীন্দ্রনাথ, আমপাতা-ঘট সাজানো, উঠোনে-দরজায় আলপনা, নতুন কাপড় সবকিছু নিয়েই একটি সমৃদ্ধির সূচনা। বৈশাখ বন্দনায় কখনো ছেদ পড়ত না। পরীক্ষার খাতাতেও লিখতে হত বৈশাখ নিয়ে রচনা। তখন আমরা উদ্ধৃতি দিতাম:

"এসো এসো, এসো হে বৈশাখ।

তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।"

 আজ শুধু দীর্ঘশ্বাস পড়ে। ফিরে আসুক আমাদের বৈশাখ। প্রখর দগ্ধ দিনে অনির্বাণ দুরন্ত যৌবন প্রজ্বলিত হোক।

                          …………………. 


১লা বৈশাখ ও রবীন্দ্রনাথ

ড. বিবেকানন্দ চক্রবর্তী


ঋতু বৈচিত্রের বাংলায় রবীন্দ্রনাথ সব ঋতুকে উপস্থাপন করেছেন অনন্য বৈশিষ্ট্যে। বৈশাখ কবির অনন্য ক্যানভাসে চিত্রিত একমাস, যা আমাদের হৃদয় জয় করেছে এই কারণে যে এই মাসে জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পৃথিবীর সব বাঙালি এমনকি রবীন্দ্র-প্রেমী বিদেশীরাও বাংলা নববর্ষ বরণ ও রবীন্দ্র জন্মদিবস পালন করেন গভীর শ্রদ্ধায় ও অন্তরীন আবেগে। কারণ, বৈশাখ মাসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন। কবির লেখা গান গেয়ে আমরা একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও বৈশাখের আবাহন করিঃ

"নমো নমো, হে বৈরাগী।

তপোবহ্নির শিখা জ্বালো জ্বালো,

নির্বাণহীন নির্মল আলো

অন্তরে থাক্‌ জাগি॥"

    ১৯৩৬ সালে বৈশাখের প্রথম দিনে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়। ফলে বর্ষবরণ ও রবীন্দ্র-বরণ অভিন্ন হয় ওঠে। পরবর্তীকালে ১লা বৈশাখ বর্ষবরণ ও ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালিত হয় যথোচিত মর্যাদায়। ১৯৪১ সালের ১৪ ই এপ্রিল অর্থাৎ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ কবির শেষ জন্মোৎসব পালিত হলো শান্তিনিকেতনে। অসুস্থ শরীরে কবি এই উৎসবে অংশগ্রহণ করলেন। ঐ অনুষ্ঠানে আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন পাঠ করলেন মানুষের প্রতি কবির শেষ বাণীঃ 'সভ্যতার সংকট'। জন্মদিনে কবি আশ্রমবাসীকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ

    "সংসারের বড় জিনিস হচ্ছে প্রীতি, খ্যাতি নয়। নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যখন তোমাদের কাছ থেকে প্রীতি ভালোবাসা পাই"। শান্তিদেব ঘোষ রবীন্দ্রনাথকে বললেনঃ "আপনি নিজের জন্মদিন উপলক্ষে কবিতা লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন অথচ একটা গান রচনা করলেন না"। রবীন্দ্রনাথ রাজি হয়ে গেলেন। তিনি লিখলেনঃ 

'হে নূতন,

দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।।

তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন

সূর্যের মতন।

রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।

ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,

ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।

উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে,  মোর চিত্তমাঝে

চিরনূতনেরে দিল ডাক

পঁচিশে বৈশাখ।।'

পঁচিশে বৈশাখ 

    এই গান রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২৩ বৈশাখ। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ কবি প্রয়াত হন। কিন্তু তাঁর এই গানের মধ্য দিয়ে তাঁকে আমরা স্মরণ করি নিরন্তর।

                              ………………. 


নববর্ষে হালখাতার গন্ধ

অর্থিতা মণ্ডল


বাংলা বছরের প্রথম দিন সমস্ত ব্যবসায়ীরা লক্ষ্মী গণেশ পুজো করেন। এই মঙ্গলময় আহ্বানে সমৃদ্ধির কামনা নিয়ে হালখাতার সূচনা। কেনাকাটা করতে যাওয়া মানুষের কাছে আমন্ত্রণের বার্তা নিয়ে পয়লা বৈশাখ সেজে ওঠে রঙে রূপে গন্ধে। ওইদিন নতুন খাতা খুলে অগ্রিম কিছু টাকা ক্রেতার কাছ থেকে জমা নেন বিক্রেতা। ক্রেতা পান মিষ্টি আর ক্যালেন্ডার। এরই সাধারণ নাম হল হালখাতা। ইতিহাসের গভীরে এখন নাই বা গেলাম। বরং বলা যাক,”আমি দেই মিষ্টি, তুমি দাও অগ্রিম মূল্য” – মিষ্টি আর মূল্যে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক  মধুর বাঁধনে বাঁধা পড়ে।   

নববর্ষের সন্ধ্যায় সমস্ত দোকান সেজে ওঠে আমপাতায় আর মঙ্গলঘটে। ফুলের মালায় আনন্দের আমন্ত্রণ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সারি সারি দোকানেরা। কত কত যুগ ধরে কত কত রূপে ওই দিনটা আসে। চলো, ফিরে যাই ধূসর অথচ সোনালি রাংতার কোনো কোনো সন্ধের কাছে। যখন মা  বা বাবার হাত ধরে অথবা তিনজনেই নির্দিষ্ট দোকানে যেতাম। একটা,দুটো,তিনটে... সেদিন মিষ্টির প্যাকেট আর ক্যালেন্ডার নিয়ে বাড়ি ফেরার আনন্দটাই ছিল আলাদা। কোনো দোকানে আবার প্লেট সাজিয়ে খেতেও দিত। এ ছিল হাতে গোনা দু /তিনটি দোকান। এসবের মধ্যে আমি অবাক  হয়ে দেখতাম পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা অন্যান্য দোকানগুলো তো ঐরকমই সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ আমরা ওইসব দোকানে যাই না। যাওয়ার তীব্রতা নিয়ে না বোঝা ছোটবেলায় একটা নীল নীল ইচ্ছে ডানা বেঁধেছিল ছোট্ট মনের নিষ্পাপ ঘরে।


আজও হালখাতা হয় দোকানে দোকানে। আজও পয়লা বৈশাখ নতুন পোশাকের গন্ধ জড়িয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষায় যায়। অথচ ত্রিশ/বত্রিশ বছর আগের ছ / আট বছরের শৈশবে জড়িয়ে থাকা ওই অনাবিল খুশি কবেই মৃত স্মৃতির ভেতর ঢুকে গেছে।তবুও তো জানি, মৃত স্মৃতি আসলে বেশি করে জীবন্ত।বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভালোলাগার  আবেশ নিয়ে বহুদূর থেকে সে ডাকে। আমি তাকিয়ে থাকি সেদিকে,যেখানে কোনোদিন যাওয়া যাবে না,যেখানে দাঁড়িয়ে আছে আমার ছোটোবেলা।

                          ………………… 


হালখাতা ; থুড়ি বেহালখাতা

শ্রীজিৎ জানা



পয়লা নয় একলা বৈশাখ। আরশিনগরে কেউ কেউ একলা বাউল। একস্থানে বেশিক্ষণ ডেরা বেঁধে থাকতে চায় না মন। খাঁচা ভেঙে যুগল হবার আকুলিবিকুলি সবার অন্তরে।" হেথা নয় হেথা নয় অন্যকোথা অন্য কোনখানে"।আর এ তো হালখাতা নয় বেহালখাতা। কপালে গণপতির উর্ধ্বপদ হেঁটমুন্ড দশা। ভগ্যের বিধি বাম। রাহু দোসর। শনি বক্রী। বৃহস্পতি ত্রিসীমা থেকে কবেই গনফট্।ঘরে বাইরে হরবখত্ হালাল হবার জোগাড়। চারিদিকে দেহি দেহি চিৎকার। প্রাণ ওষ্ঠাগত। দিতে পারলে দাদা দিদি। নইলে হটাও গদি। সংসারের হালখাতায় ডাঁয়ে আনতে বাঁয়ে ফুস্। আয় কম বাই কম নয়-বেশি। পুত্র কন্যা সুযোগ পেলেই কাটমানি খাবে। টিউশন ফি,কলেজ ফি, বাজারের টাকা থেকে টুপ্রাইস পকেটস্থ। স্ত্রী মাওবাদীর এককাঁটা উপরে। ম্যাওবাদী। মানে সংসারে ম্যা হুঁ ডন। বাকিরা অধস্তন। জো হুজুর জাঁহাপনা। প্রথমে শাসানি। অন্তিমে কাঁদুনি। নাকটানা কান্নার সুরে সেন্টিমেন্টাল সুড়সুড়ি। কর্তা তাতেই কাত। ছলে বলে কৌশলে সংসার সমরে পুরুষের হার নিশ্চিত।

দাম্পত্যের হালখাতায় নিক্তিমাপা হিসেবনিকেষ। লেনদেন। তোমার দুাআনা আমার দুআনা। পুরুষ মনযোগানো মিনসে। স্ত্রী নিজের অধিকারে গোঁ ধরেছে কি হালখাতার হিসেবে গোলমাল। সংসারের সমূহ পতন। বিশ্বাসে -অবিশ্বাসে, প্রেমে-অপ্রেমে, দেনাপাওনায়, সুখে- অসুখে দাম্পত্যের হালখাতায় বিস্তর কাটাকুটি। গোঁজামিল। এদিকে সংসার সরকার দুজনেরই খাতায় গুচ্ছের ঋণ। চার্বাকী চালে চলছেন ফুলদা আর ফুলদি।"যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ/ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ"। আমজনতা কোনছার! হালখাতার দেনা শুধবে গৌরি সেন।


পরমার্থিক হালখাতায় খালি মন্দির মসজিদ নির্মাণের ফিরিস্তি। পাথুরে ঈশ্বরের নিমিত্তে সোনার দেউল, ষোড়শ উপাচার,আর ঈশ্বর রুইদাসের আবাস যোজনার টাকা কার উদরে দেবা ন জানন্তি! নেতার হালখাতায় অর্থসম্পত্তি বলছে-- দ্যাখো আমি বাড়ছি মামি। অভিনেতা-অভিনেত্রীর হালখাতায় মন্ত্রীত্বের প্রাপ্তিযোগ। ফজল মিঞাদের হালখাতায় কৃষিঋণের বাড়বাড়ন্ত। দেনার দায়ে অবশেষে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়া। তথাপি দেশের পন্ডিতগণ হালখাতায় লিখে চলেছেন--যায় যদি যাক প্রাণ/ হীরকের রাজা ভগবান। ভগবান নিদ্রা গ্যাছেন। হালখাতায় চোখ ফেলবার তাঁর ফুরসত নেই। উদয়ন পন্ডিতরা কবে গোঁজামিল হালখাতার হিসেব নেবে জানিনা। অগত্যা যমরাজের হালখাতার দিকে চোখ চেয়ে বসে থাকা। কবে আসবে ফরমান। ঋণ মুক্তির অবসর। " মৃত্যুতেসকল দেনা শোধ করে দিতে " 'তৃষিত মরু' ছেড়ে 'রসালো নন্দনে' পাড়ি জমানোর আশায় অপেক্ষমান এ জীবন।

                         ………………….. 



আত্মীয়তার বন্ধন ; বাঙালীর হালখাতায়

তাহমিনা শিল্পী


বৈশাখ এলেই যে স্মৃতিটা শৈশববেলায় ফিরে যাবার উস্কানী দেয় সেটি হল হালখাতা। তখন গোলাপী রঙের কাগজে চমৎকার আলপনায় নকশা আঁকা শুভ হালখাতা'র নিমন্ত্রণ কার্ড আসতো বাড়িতে,বাবার নামে।পহেলা বৈশাখের সকালে বাবা ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পড়তেন। আমিও সুন্দর পোশাক পড়ে সাজুগুজু করে বাবার হাত ধরে বাড়ির কাছের বাজারে স্বর্ণকার ও মনোহারী দোকানে যেতাম নেমতন্ন খেতে।শুধু আমরাই না, আরও অনেকেই যেতো। সবার মনেই থাকতো দারুণ আনন্দ আর উৎসবের আমেজ।

যদিও দোকানে নেমতন্ন বিষয়টি নিয়ে আমার বোকা বোকা একটা ভাবনা ছিল। ভাবতাম,ওরা ভীষণ কিপটে। তাই বাড়িতে না ডেকে দোকানেই অল্পসল্প আপ্যায়নে অতিথিসেবা সেরে নেয়। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই অল্পসল্প আপ্যায়নের বিরাট মানেটাই আমাকে বড় বেশি আবেগী আর বাঙালী রীতিনীতির প্রতি অনেকখানি মমতা তৈরী করেছে।

পূজোর সিঁদুর দিয়ে মলাটের উপর স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা লাল রঙের খাতাটা ছিল তখন আমার কাছে হালখাতার কৌতুহল। আর রসগোল্লা ছিল একমাত্র আকর্ষণ। বড় হবার পর এসব ছাপিয়ে অন্তর্নিহিত অর্থটাই মুখ্য আর গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে।

বছরের শুভারম্ভে ব্যাবসায়ীরা পুরাতন বছরের দেনাপাওনার হিসেব করে ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে নতুন হিসেবের খাতা খোলেন।আর ক্রেতারও ব্যাবসার সফলতা কামনা করে পুরাতন পাওনা মিটিয়ে দেন।এই যে জাতি, ধর্ম-বর্ণ, উঁচু-নিচু বিভেদকে এড়িয়ে সকলকে এক কাতারে এনে, একে অন্যের সাথে হৃদ্যতায় বাঁধা পড়েন এতো সমাজজীবনের উপর হালখাতার-ই শুভ ও অপরিসীম অবদান।পুরাতন জীর্ণতা ঝেড়ে নব উদ্যমে এগিয়ে যাবার নাম জীবন।অস্বীকার করবার সুযোগ নেই,এ শিক্ষাও হালখাতার।

বর্তমান সময়ে দাড়িয়ে জীবন,বাস্তবতা এবং প্রযুক্তির বিরোধে বাঙালীসুলভ অনেককিছুই ম্লান হয়েছে। হারিয়ে গেছে খাঁটি বাঙালীর অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য।তবু রসে টইটুম্বুর রসগোল্লার মনভোলানো স্বাদ,গরমগরম জিলাপি,নিমকি আর বাহারী মিষ্টি পানের সুবাসে হালখাতা আর পহেলা বৈশাখ আমাদের অন্তরে পাকাপোক্ত স্থান দখল করে রেখেছে।আর যা ভোলে ভুলুক, বাঙালী পরম্পরাক্রমে গর্বের সাথে আঁকড়ে থাকবে এই দুটি পার্বণকে।আর লাল খাতাটাই বাঙালীকে বেঁধে রাখবে আত্মীয়তার বন্ধনে। এ যেন সকলেরই অঘোষিত অঙ্গীকার। 

                          ……………………. 



হালখাতা

বিকাশ চন্দ



হাল খাতা বাংলা বছরের শুরু ১লা বৈশাখ, ফেলে আসা বছরের হিসেব নিকেশ চুকিয়ে আবার নতুন করে হাল নাগাদ প্রক্রিয়া বলা চলে। ছোটবেলায় দেখেছি গ্রামাঞ্চলে ছোট ছোট দোকান পট্টিতে দেবদারু বকুল ঝাউ পাতা কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুল শাখা আমপাতা দোকানের চালার সামনে সাজানো, সাজানো দোকানের সাথে মজুদ বাঙলা ক্যালেন্ডার সাথে মিষ্টি ঠোঙা। ঠোঙাতে মুচুর মিঠাই নিমকি খাস্তা গজা। দোকানের এক পাশে লক্ষ্মী গণেশের পূজার্চনা। খদ্দেরদের বাকি থাকা টাকা কড়ির আদায় প্রক্রিয়া চলে। ইতিহাসের কথায় বোঝা গেল বর্ষারম্ভ "পুণ্যাহ" আরম্ভ করেন সম্রাট আকবর, সহযোগিও ছিলেন তোডরমল। উদ্দেশ্য  ছিল চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রজাদের কাছে বাকি থাকা খাজনা আদায় করা। পরবর্তী কালে জমিদারেরাও করতেন তাঁদের প্রজাদের থেকে খাজনা আদায়ের জন্য, তাদের ব্যাবসার বকেয়া আদায়ের জন্য হালখাতা, হতো মিষ্টান্ন বিতরণ খাওয়া দাওয়া। 

আবার বাঙলা ক্যালেন্ডার আর পঞ্জিকা সৃষ্টির ইতিহাস যাই থাক না কেন এদুটোর প্রভাব অস্বীকার করার কোন বাস্তবতা কিন্তু নেই। বাঙালির জীবনে শুভ নববর্ষের মতোই হালখাতার সাথে এরা একদম সম্পৃক্ত। আবার শুধু হাল কথাটি হলো লাঙ্গল, সে ভাবেই চালু আছে হাল চার---প্রথম আচট মাটিতে হাল কর্ষণ। সেও বাঙলা পাঁজি দেখে হাল পরব সূচনা। 

যাই হোক ১ লা বৈশাখ নববর্ষের রীতি শুরু সম্ভবত (?) ৯৬৩ সালে। পঞ্জিকা গণনা শুরু ১লা বৈশাখ ধরে।  যাই হোক না কেন বিশ্ব জোড়া ইংরেজি নববর্ষের দাপটেও এখনো ১লা বৈশাখ তার ঔজ্জ্বল্য ধরে রাখার প্রক্রিয়া বর্তমান সমকালীন সকল মানুষের আন্তরিকতায়। মিষ্টি মুখ

বাংলা ক্যালেন্ডার আর কোথাও কোথাও বর্ষ বরণ উৎসব এখন আবহ ধারায় মিলেছে ভাষা জাতি ধর্মের মেলবন্ধনে। এখন গ্রাম শহরে রিডাকশন বা চৈত্র সেল- যাঁরা কেনেন তাঁরা বলেন সেলে কেনা রঙিন শাড়ি পোশাক  জলে ধুলে কাপড় উঠে আসে হাতে আর রঙ থেকে যায় জলে, তবুও ফি বছর দিব্যি অঢেল বেচা কেনা। 

সোনাপট্টি ও আক্রার বাজারে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। ১লা বৈশাখের যাত্রার বাজারের গদিঘর আর তার জৌলুশ বেপাত্তা, টিভি আর সিনেমার নায়করা গ্রামের উৎসবে পা রাখার সাথে যাত্রার জাত গিয়েছে। ছোট ছোট ব্যাবসায়ীদের অনেকের বিপদ শুরু ৮ই নভেম্বর ১৬ এর মাঝরাত নোট বন্দী খেলায়, বিগত চারটি বৈশাখ ওই বন্ধ দোকানগুলির ঝাপ খোলেনি, হাল ফেরেনি- তায় আবার হাল খাতা! দুরস্ত। গত বছরের হালখাতায় আবার থাবা মেরেছিল করোনা। দেশ নায়ক বাজালেন থালা, জ্বালালেন প্রদীপ, উচ্চনিনাদে বাজলো শাঁখ, মানুষ মরলো মরছে করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে। কর্মহীন মানুষ ঘরে ফিরলো, ওরা ঘরে বাইরে পরিযায়ী শ্রমিক। ওদের জীবনে আরেক মহামারি লক ডাউনের মর্মান্তিক ভয়াবহ রূপ যা কেড়ে নিয়েছে সব কিছু।  এ বছর ও তাই। সাবেক বছর বৈশাখে হাল খাতা খুললেও এদের জীবন এখনো বেহাল। 

তবুও চৈত্র সংক্রান্তির শেষে ১ লা বৈশাখ আসে প্রতি বছর। জানি না শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, মানুষের নিরাপত্তা, মানুষের  নূন্যতম বেঁচে থাকার চাহিদা টুকু পূরণের নতুন কিছু দেবে কী- হে নববর্ষ, ১ লা বৈশাখের শুভক্ষণের সকাল সূর্যের জবা সঙ্কাশ ভোর !!! 

বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যের ধারা এখন প্রায় পৃথিবীর সর্বত্র। ভারতের প্রায় সকল অঙ্গ রাজ্য ছাড়াও বাংলাদেশ কম্বোডিয়া থাইল্যান্ড সহ সমস্ত বিদেশে বসবাসকারি বাঙালিরা একত্রিত হন এই দিনে। কোথাও মঙ্গল যাত্রা, শোভাযাত্রা,  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে বাংলার শুভ নববর্ষ বরণে। নববর্ষ তো শুধু আনন্দের নয়, জন্ম দেয় বিভেদহীন ঐক্যের চেতনা বোধ, পুরাতন আর জীর্ণ কালিমা ভুলে নতুনের আবাহন আগামী আনন্দ ধামে। পূর্ণ কলস আম শাখা শিক ডাব শাঁখের মাঙ্গলিক আওয়াজ মেলবন্ধনের সানন্দ সূচনা -"এসো হে বৈশাখ।"

ভয় করে, চিরায়ত সংস্কৃতি চেতনার মূলে অধূনা সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস যা অনভিপ্রেত তা গ্রাস করে ফেলবে না তো !!!  বাঙলা নববর্ষের আত্মাভিমান আছে- আত্মাভিমান আছে বাংলা ভাষার অবমাননার, খোলা চোখে শুভ নববর্ষের বাঙলার স্বাভিমান অক্ষুণ্ণ রাখার দায় ভার যে সকল বাঙালির- বাংলা  ভাষাভাষীর- পৃথিবী জোড়া বাংলা ভাষা প্রেমীদের, বাংলার শুভ নববর্ষের অন্তর আহ্বানের ডাকে আমি, আপনি, আপনারা- যারা ছড়িয়ে বিশ্বময় বিনি সুতোর বাঁধনে,

তাদের কোটি কণ্ঠে বহুল স্বরে নিনাদিত হোক বাংলায় "শু ভ ন ব ব র্ষ... "।

                                 …………….. 



সেদিনের পহলা বৈশাখ

শিশিরকুমার বাগ


ছোটবেলায় দেখতাম রোজকার একঘেঁয়ে দিন যাপনের মাঝে পহলা বৈশাখের দিনটা একটু যেন বদলে যেত। খুব ভোরবেলা ঘুম ভাঙলেই দেখতে পেতাম চারিদিকটা ধোঁয়া ধোঁয়া।  বাবা মনের আনন্দে আমাদের স্বল্প জমিজমার প্রতিটি অংশে আলাদা আলাদা করে খড়নাড়ার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতে করতে একসময় বাবা বেসিক ট্রেনিং নিয়েছিলেন। সেখানেই বেশ কিছু গান শিখেছিলেন। বেশ মনে পড়ে ওই পহলা বৈশাখের ভোরে বাবা খালি গলায় "আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো, ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো " গানটি খুব দরদ দিয়ে গাইতেন। তারপর ঠাকুরমা ওই খড়নাড়ার আগুনে আঁশবঁটির প্রান্তভাগ তপ্ত করে আমাদের কবজিতে খুব আলতো করে ছুঁইয়ে দিতেন। এই সংস্কারগুলো আজ প্রায় হারিয়ে গিয়েছে। 

এ তো গেল সকালের ব্যাপার। দুপুরের রোদ কমলে আমরা ছোটরা কাচা জামাপ্যান্ট পরে প্রস্তুত থাকতাম বাবার সঙ্গে সুতাহাটা বাজারে একটি নির্দিষ্ট জামা-কাপড়ের দোকানে যাওয়ার জন্য। সেখানে গেলে বাবা দোকানের গদিতে বসে দোকানদারের সঙ্গে কথাবার্তা বলা শুরু করতেন। আমরা দুই ভাই দোকানের সামনে পেতে রাখা একটা বেঞ্চে বসে থাকতাম। আমাদের জন্য দোকানের কর্মচারি চিনামাটির প্লেটে করে একটি মিষ্টি ও কাঁচের গ্লাসে করে খাওয়ার জল এনে দিতেন। আমরা যে কী আনন্দের সঙ্গে সেই মিষ্টিটা উদরপূর্তি করতাম তা বুঝিয়ে বলা যাবে না। এখন যে সচ্ছ্বলতা আমাদের আছে, তাতে করে সবচেয়ে মুখরোচক ও মনোলোভা মিষ্টি খেয়েও সেই আনন্দ খুঁজে পাওয়া যাবে না। পরিশেষে দোকানের কাজ মিটিয়ে বাবা এক প্যাকেট মিষ্টি আর একটা নতুন ক্যালেন্ডার হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতেন।  আমরা বাবার হাত ধরে মহা আনন্দে মাঠের রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম।

                        …………………. 



সেই আলোকে প্রাণের প্রদীপ জ্বালাও

দেবাশিস কুইল্যা 


বিশ্বাস ছিল, সে আসে ঐ তিল ক্ষেত পেরিয়ে বাউলের একতারা হাতে, উদাসী সুরে। তার পিঙ্গল বাসে লেগে থাকে বাতাবি ফুলের রেণু। হিজল ফুলের নুপুর পায়ে তার ছান্দসিক সুর। তার গানের সুরের আলাপনে নবীনের আহ্বান। দখিনা বাতাসের গায়ে উড়ে নতুন বৈশাখের রঙিন উত্তরীয়। রুদ্রের দীপ্তি তার আভরণে। দীপ্তময় চৈত্রের রোদ্দুর পথে পথে যত গড়িয়েছে দুরন্ত বিকেলের দিকে তখনই তার পথ মিলেছে বৈশাখে। 

     ১লা বৈশাখের রঙিন খামে লেখা চিঠি কড়া নেড়ে বলে যেত সে আসছে জীর্ণতা মুছে আর ক্লান্তি দূর করে পূর্ণতার আশ্বাসে। যে চিঠিতে ছোটদের রঙিন আহ্বান,সেই আবার হালখাতায় গৃহস্থের জন্য ঋণ শোধের সতর্ক হুইসেল। চিঠির কাগজে তৈরি পতিঙ্গা বাতাসে ঘোরার সাথে সাথে সময়ের খণ্ডিত অস্তিত্বের এক একটি প্রহর শেষ। বুঝেছি জীবনের অনেক একলা বৈশাখ পার হওয়ার পর।

       নীল সংক্রান্তির অনেক আগে থেকেই প্রকৃতির নিয়ম বদলানোর সাথে সাথে গৃহস্থের উঠোনও বদলে যেত গোবর জল দেওয়া হাতের স্পর্শে। নিকানো উঠানে বৈশাখের প্রথম ভোর কেমন করে আসে সেই জিজ্ঞাসা নিয়ে ঘুম চোখে রাত্রি পার করা। পয়লা বৈশাখের সূর্যের আলো মাটি স্পর্শ করার আগেই জাগিয়ে দিত ভেতরের কৌতূহল। প্রভাতে ঘুম জড়ানো চোখে দেখতাম বাবা কাকারা জমিতে জমিতে উগান দিতে ব্যাস্ত। মায়েরা সব সারাবছরের মঙ্গল প্রদীপের আলো জ্বালানোর কামনায় ব্যস্ত  নববর্ষের পূজা আয়োজনে। মন্দিরে মন্দিরে ধুপ ধুনার গন্ধ আর মঙ্গল ধ্বনি যেন নূতন করে জেগে ওঠার, প্রাণের মন্দিরে আত্মজ্ঞানের, আত্মদর্শণের পূর্ণ হওয়ার সঞ্জীবন সুধা। সকাল দুপুরে গড়িয়ে যাওয়ার মাঝে ষোল আনা বাঙালীয়ানায় রান্নার আয়োজন। সবার সাথে হৈ হুল্লোড়ে উদরস্থ করার মধ্যে বাজত যেন সারা বছরের ঐক্যের সুর। মায়েদের বিশ্রাম ছিল বলে মনে হত না। বিকেলের গোধূলি বেলায় নববর্ষের সূর্য চুম্বন এঁকে যেত সীমান্ত প্রহরীর মত। বেল, জুঁই, গন্ধরাজে সুবাস ছড়ানো সন্ধ্যার দখিনা বাতাসে বড়রা দোকানে দোকানে হালখাতা সেরে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে যখন বাড়িতে ফিরত তখন জেগে থাকার ধৈর্য্য হারিয়ে ভাইবোনেরা ঘুমিয়ে পড়তাম। মা ডেকে ঘুম ভাঙাত আমাদের। ঘুম জড়ানো চোখেই মায়ের ভাগ করে দেওয়া সেই মিষ্টির স্বাদ এখন স্পষ্ট অনুভব করি। আমার সেদিনের একলা বৈশাখ এখন পয়লা বৈশাখ হয়ে আসে সময়ের প্রান্ত সীমানায়। অনুভব করি বদলে যাওয়া সময়ের অন্তহীন নির্লিপ্ততা। ভাল্ লাগেনা কথার মাঝে ফিরে দেখা সময়ের সেই আলোকে প্রাণের প্রদীপ জ্বালাও আমার প্রথম পয়লা বৈশাখ।

   

                               …………………. 

নববর্ষের ডাক

মিঠু রাজবংশী 


ছোটবেলার পয়লা বৈশাখ মনে করতেই মনে পড়ে যাচ্ছে একরাশ ভালোলাগা। এখনকার মতো তখন পয়লা বৈশাখে এত জামাকাপড় হতোনা। আমাদের মেয়েদের জন্য ছিল পাখি টেপজামা আর ছেলেদের জন্য ছিল স্যান্ডো গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যেতাম ফুল কুড়োতে। এরপর মা আমাদের স্নান করিয়ে দিতেন। তারপর আমরা আমাদের দোকানে চলে যেতাম। বেশ কয়েকটা দোকান ছিল আমাদের। মুদি দোকান, স্টেশনারি দোকান, সিডির দোকান আর জামা কাপড়ের দোকান। তবে খুব জাঁকজমকপূর্ণ দোকানপাট নয়, গ্রামে যেমন হয় আরকি। দোকানে হতো গণেশ পুজো । ঠাকুরমশাই পুজো করতেন আর আমরা সকলেই পাশে বসে পুজো দেখতাম আর আমাদের চোখ থাকতো নতুন ফলের দিকে আম, তরমুজ, আরো কতকি। সন্ধ্যায় দোকানে হালখাতা হতো। আসতো অনেক খরিদ্দার। নতুন ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির প্যাকেটের গন্ধে দোকান ম ম করতো। 

    আগের দু'দিন ধরে আমাদের বাড়িতেই তৈরি করা হতো বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি। অনেক মিষ্টির কারিগর রাতভর বানাতো লাড্ডু, মিষ্টি, ঝুরিভাজা, অমৃতি। আসতো নতুন রঙের গন্ধমাখা প্রচুর ক্যালেন্ডার রাধাকৃষ্ণ, গোপাল অনেকেই। বাড়িতে ভিড় জমে যেত মিষ্টির প্যাকেট করার জন্য প্রতিবেশীদের। আমরা সকলে বসে  সারাদিন ধরে মিষ্টির প্যাকেট বানাতাম। শেষে ওদের সবার হাতে বড় বড় মিষ্টির প্যাকেট দিতাম। 

   দোকানে গণেশ পূজো হয়ে গেলে প্রসাদ খেয়ে আমাদের আসল কাজটা শুরু হতো। নতুন বছরের শুভ নববর্ষ কার্ড বানানোর কাজ। তখন আমাদের রংয়ের খুব অভাব ছিল। তাই আমরা পাতার রস, ইটের গুঁড়ো, আলতা, নীলের গুঁড়ো, হলুদ এইসব দিয়ে রং তৈরি করতাম। আগে থেকেই ঠিক করা থাকতো, বাড়ি থেকে যে যার চাটাই আর রং, কাগজ পেন্সিল নিয়ে আমাদের মন্দির বাড়ির বিরাট উঠোনে বসে পড়তাম।  আঁকতে শুরু করতাম কার্ড। লিখতাম নববর্ষের নানা কবিতা। সব কথা মনে পড়েনা। দু'একটা কবিতা এখনো অস্পষ্ট মনে রয়ে গেছে।

"ডালে ডালে ফুল ফুটেছে

ববর্ষের ডাক উঠেছে

তুমি আমার বন্ধু হও

 নববর্ষের কার্ড নাও।"

"আম মিষ্টি, জাম মিষ্টি তেঁতুল বড় টক 

তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার আমার বড় শখ।"

"আম গাছে আম ধরে, তাল গাছে তাল

 তোমার আমার বন্ধুত্ব থাকবে চিরকাল।"

  সেই সময় বন্ধুদের নববর্ষের কার্ড না দিতে পারলে মনে হত যেন রাষ্ট্রীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। ফলে সবাইকে কার্ড দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। কার্ডে আঁকা হতো ফুল, পাখি, পাহাড়ের ছবি আরো কত কি। শেষে আমরা কবিতা লিখে বন্ধুর জায়গায় প্রিয় বন্ধুর নাম আর ইতিতে নিজের নাম লিখে একে অপরকে সেখানে আদান-প্রদান করতাম কার্ড। কারো আঁকা যদি খুব ভালো হতো, যেমন আমার দাদা খুব ভালো আঁকতো, ওর কাছ থেকে আমরা দশ পয়সা করে কিনে নিতাম সেগুলো।

    এখনো নববর্ষে আসে তবু সেইসব দিনের কথা মনের ভেতর দোলা দিয়ে যায়। বেঁচে থাকুক আমার ছোটোবেলা আর নববর্ষের ডাক।

                           ……………………. 



আমার একলা বৈশাখের কথা

মহুয়া ব্যানার্জী


বাংলা নববর্ষ এলেই আমার এখনো সেই ছোট্টবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। তখন পয়লা বৈশাখ আমার উচ্চারণে একলা বৈশাখ। যৌথপরিবারের মেয়ে হওয়ার সুবাদে চৈত্র মাস এলেই অপেক্ষা করতাম চৈত্র সেলের। কাকু তার পরিচিত দোকান থেকে সব ভাইবোনেদের জন্য প্রায় একই রকম অথবা একই বাজেটের জামা কিনে আনত। পয়লা বৈশাখের দিন সকালে স্নান করে নতুন জামা পরে বাড়ির মন্দিরে পুজো দেখতাম। তারপর অপেক্ষা কখন বিকেল হবে। দাদু বা জেঠুর সাথে হালখাতা পুজো দেখতে যেতাম দোকানে দোকানে। পুজোর ফাঁকে অপেক্ষা করতাম কখন কাগজের প্লেটে ক্ষীরের সিঙ্গাড়া আর বড় তিনকোণা নিমকি খেতে দেবে। ঠাকুর মশায়ের নাতনী বলে বাড়তি খাতির। হালখাতার অত মিষ্টি মা জ্যেঠিমারা আলাদা পাত্রে রেখে থালায় জলের ওপর বসিয়ে রাখত। ফ্রিজের বদলে তখন এটাই ছিল সংরক্ষণ পদ্ধতি।

 আজকের এই সব পেয়েছি জীবনে সেদিনের ওইটুকু পাওয়া পেতে মন চায়। তখন অল্পতেই যে তৃপ্তি ছিল আজকালকার ফ্রিজভর্তি খাবার পেয়েও তা নেই। বুকের ভেতর ব্যথা নিয়ে সত্যিই একলা আমার বৈশাখ।

                          ……………….. 



হালখাতার সেদিন ও এদিন

ভবেশ মাহাত


বাবার মুখে শুনেছি, বাবা কলেজ পাশ করে বেরানোর পর থেকেই বাড়িতে ভূষিমালের দোকানে। আমরা যখন ক্লাস ফাইভ তখন থেকে বেশ মনে আছে আমাদের দোকানের হালখাতা উৎসবের কথা। সপ্তাখানেক আগে থেকে দোকানে রঙ করা শুরু হতো, একটা সাজো সাজো রব আমাদের মনের ভিতরে। হালখাতার অনুষ্ঠানে যাদেরকে নেমন্তন্ন করা হতো তারা সবাই আমাদের দোকানের ক্রেতা। স্বভাবতই এবিষয়ে আমার যেমন আনন্দ হতো, তেমনই দুঃখও হতো তাদের জন্য - যাদেরকে নেমন্তন্ন করা হতো না। বিশেষ করে আমার বন্ধু তপন, সুদীপ আর অমল দের জন্য। তবে তাদের কেউ ঐদিন দোকানে এলে বাবা মিষ্টি না দিয়ে ফেরাতেন না। 

                            সকাল সকাল পুজো শেষ করেই মিষ্টির প্যাকেট করা শুরু করতাম- আমি, ভাই, বাবা-মা, এরপর সারাদিন ধরে চলতো হালখাতা অনুষ্ঠান। আমাদেরকে আশপাশের যে দোকান থেকে আমন্ত্রণ জানানো হতো, তাদের কাছে যেতাম পরের দিন। মিষ্টি আর ক্যালেন্ডারের লোভ আমদেরকে আত্মসংযমী হতে বাধা দিত। ক্যালেন্ডার এনে মাটির ঘরের দেওয়াল ভরিয়ে দিতাম। কেউ না দিতে চাইলে জোর করতাম, দিতেই হবে। কাকু একটা ক্যালেন্ডার দিন, দাদা একটা ক্যালেন্ডার দিন। 

                            মিষ্টির লোভ আর নেই, তবে নতুন ক্যালেন্ডারের গন্ধ আজও ভুলতে পারিনা। আজ ঘটনাচক্রে তপন, সুদীপ, অমল এবং আমি বহুদিন গ্রাম ছাড়া, তবে একই শহরে থাকি আমরা, প্রায় প্রতিদিন দেখা হয়। হালখাতা উপলক্ষে শহরের দোকান থেকে যে ক'বার মিষ্টির প্যাকেট এনেছি, প্রতিবারেই তা রাস্তাতেই ভাগ করতে হয় ওদেরকে, এমনকি ক্যালেন্ডারও। ওরা বোধহয় ছোটবেলার নেমন্তন্ন না করার শোধ তুলতো। বাড়িতে ফিরে গিন্নীর সহজ স্বীকারোক্তি-তোমার বন্ধুদের যদি ছোটোবেলায় দোকানের হালখাতায় আমন্ত্রণ জানাতে, তাহলে আজ হয়তো মিষ্টি না এলেও ক্যালেন্ডারটি বাড়ি পৌঁছাতো। আমি শুধু একটা মুচকি হাসি, আর সেই সঙ্গে আমার নীরবতা আরও বেড়ে ওঠে।

                         …………………… 

 


নতুন বছর মানেই হৃদরোগের মহৌষধ

নিমাই জানা


একটি হাতে বিবর্ণ শুকনো পাতা আর অপর হাতে উচ্ছল সবুজপাতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম , তোমাদের বয়স কত?  

পাতা দুটো আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলো, "তুমি যে গহ্বর থেকে বেরিয়ে এলে সেখানে এত ঠান্ডা কেন " ?

তা তুমিও তো অনেক বিবর্ণ পাতাকে পুড়িয়ে ফেলেছে মনের ভেতর। পাতা পুড়লে কেউ অশৌচ পালন করেনা বলে আমি মেহগিনি ফুল তাদের চোখে গেঁথে দিলাম । 


পাখিদের ব্রাকিয়েলের কাছে স্পন্দন নিতেই, পাখিটি আমার চোখের কাছে একটি আতশকাচ ধরে রাখল কিছুক্ষণ। ভালো করে দেখে নিলো আমার ভেতরের নতুন ঈশ্বরকে। দেখতে পাচ্ছে বালি মাটি খুঁড়ে আমার চোখের কর্নিয়ার ভেতর বসন্ত আমারই মতো কাউকে ডুবিয়ে গেছে রং গোলা জলের ভেতর। তখন থেকেই আমার ভেতর অসংখ্য ছত্রাক বাসা বেঁধেছে। আমি কেমন অবান্তর অসুখেই পরিণত হয়ে গেছি। এইভাবে বসন্ত আমাকে চির রোগী করে গেছে। নিমফুল অথবা নরম পাতায় কিভাবে বিছানা পেতে রাখতে হয় সে সমীকরণ শিখিয়ে গেছে বৈশাখের সকল পারদের অস্থিসন্ধি গুলো ‌।

তার মাঝেই বিছানার উপর কতকগুলো গণেশ ঠাকুর মিষ্টির থালাকে আঁকড়ে রেখেছে। ক্রমশ রসালো করে গেছে আমার ঠোঁটকে। ইঁদুর ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। আমি অনেক দূরের অর্জুন গাছের পাতা দেখতে পাচ্ছি। যে কেবল হৃদরোগের মহৌষধ হতে পারত। কিন্তু হয়নি। পহলা বৈশাখ মানে কি? এর অর্থ খুঁজতেই ছোট্টবেলার একটি ভাঙা বাক্সের ভেতর ঢুকে গেলাম। মিষ্টির গন্ধ আর পোকা কাটা ক্যালেন্ডার। 

পঞ্জিকার শেষ পৃষ্ঠা উড়ে যেত অনেক দূরে জঞ্জালের মত। নতুনকে স্বাগত জানাই ধুপধুনা দিয়ে। অ্যাখান। গন্ধ নিতাম বুক ভরে। বাবাকে বলতাম আমাদের বাড়িতে মিষ্টি ঠোঙা এলে নাকি ঠাকুরেরা দেওয়াল জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্রমশ ঈশ্বরেরও বয়স বেড়েছে এখন। বুঝেছি পহেলা বৈশাখ এলে লাল খাতার ওপর সিঁদুরের ছাপ দেওয়া বেলপাতা। গণেশ ঠাকুরের পা ছুঁয়ে যায় এক ঘন বরষা। ঘনঘোর বর্ষার ভেতর ভালো মানুষগুলো স্নান করছে।

                              ………………. 


আমার বৈশাখ

সুজাতা চক্রবর্তী

  

"হে ভৈরব,হে রুদ্র বৈশাখ,

ধূলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,

তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু ,মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল

কারে দাও ডাক--

হে রুদ্র বৈশাখ?" 

        

 বৈশাখ তার রুদ্ররূপ নিয়ে আবির্ভূত হলেও তার মধ্যে একটা প্রশান্ত মায়া আত্মগোপন করে থাকে,যা মানুষ দু'হাত প্রসারিত করে বিপুল বৈভবের আনন্দে জীবনের আনন্দর সঙ্গে মিশিয়ে নেয় একটি বছরের নতুন প্রত্যাশার আনন্দে।

        

 বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসব হল নববর্ষ। বছরের প্রথম দিন কত চেনা অচেনা স্মৃতিকে উস্কে দেয়-শৈশবের স্মৃতি,কিশোরবেলার স্মৃতি শুধু উদযাপন না অনেক সুবাসিত স্মৃতির ঝাঁপি খুলে যায়, ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে এই দিনটা কীভাবে কাটিয়েছিলাম ফেলে আসা দিনগুলোতে।

  উত্তর ও মধ্য ভারতে নতুন বছর বৈশাখী,আসামে রঙ্গালি বিহু, তামিলনাড়ুতে তামিল পুঠান্ডু,কেরালায় বিশু, ওড়িশায় বিষুব সংক্রান্তি এবং পশ্চিমবাংলায় পয়লা বৈশাখ নামে পরিচিত নববর্ষ উৎসব। ইতিহাস থেকে জানা যায় মোগল সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। আর এর সঙ্গে শুরু হয় বাংলা বছরের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনগদ করার প্রক্রিয়া। মোগল আমল থেকেই পয়লা বৈশাখে অনুষ্ঠান করা হত। প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করতেন এবং পয়লা বৈশাখে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করানোর পাশাপাশি আনন্দ উৎসব করতেন‌।

       বাঙালিদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজো হলেও নববর্ষের আলাদা গুরুত্ব আছে। অতীত তো বাঙালিদের ভ্যাংচাতে ভ্যাংচাতে চলে যায়,বর্তমান বাঙালির কাছে 'মড়ুন্বেঞ পোয়াতীর বুড় বয়সের' ছেলে,তাই বছরের শেষ দিন ধুমধাড়াক্কার চৈত্র সংক্রান্তির ল্যাজেই হাজির হত।

 বাঙালি ব্যবসায়ীরা নতুন আর্থিক বছরের সূচনা করেন এদিন লক্ষ্মী গণেশ পুজো ও হালখাতার মাধ্যমে। এই দিনটিতে মিষ্টিমুখ, বাড়িতে বাড়িতে মিষ্টি বিতরণ, আলপনা আঁকা,বাড়ির লক্ষ্মীকে পুজো করা বাঙালির জীবনে অন্য রং আনে‌। বাঙালিরা নতুন পঞ্জিকা কেনে।সবথেকে বড়ো যেটা আকর্ষণ বাংলা ক্যালেন্ডার! মিষ্টি খাওয়ায় সাথে সাথে নতুন ক্যালেন্ডার না দুচোখ ভরে দেখলে মনে হয় না এটা পয়লা বৈশাখ।

 

     ২০১৬ সালে , ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে "মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য" হিসেবে ঘোষণা করে। বাঙালির এই উৎসবে নতুন বস্ত্র পরার রীতি একটা আলাদা আমেজ আনে তা সে অতি সাধারণ বস্ত্রই হোক না কেন।গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে, বাংলা নববর্ষ সাধারণত ১৪বা১৫ এপ্রিল পড়ে। বাংলা সৌর ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম দিন।এই বছর ১৪২৮ -এ পা দেব আমরা। ১৫ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার পড়েছে ১ লা বৈশাখ। সুতরাং চৈত্র সংক্রান্তি পালিত হবে তার আগের দিন অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল।

     

খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং এই বিশেষ দিনে দোকানে আমন্ত্রণ জানানো সাথে সাথে খদ্দেরদের মিষ্টিমুখ করানো ও ক্যালেন্ডার হাতে তুলে দেওয়ার রীতি কোথাও যেন একটা অদৃশ্য ভাতৃত্বের বন্ধনে বেঁধে দিয়েছে বাঙালিকে, শুধু হালখাতা করা না ভালোবাসা ভাগ করাটাও যেন অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত। নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্ৰামীন জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির এক নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সেবছর পয়লা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

  ‌‌

 পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করার একটি রীতিও রয়েছে যদিও মারীর আবহে তা ভার্চুয়াল মাধ্যমেই সারতে হবে। কিন্তু প্রথম এই জাতি(পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, ত্রিপুরা সহ সমস্ত অঞ্চলই ) করোনা ভাইরাসের তান্ডবে রয়েছে গৃহবন্দী। সমগ্ৰ বিশ্ব আজ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এ মৃত্যুর আতঙ্কে দিশেহারা। তবুও নতুন পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর বাঙালি,সবার শুভ হোক এবার এই আশায় বর্ষবরণ এবং মনের চিলেকোঠায় বাঁশিতে আশাবরী বেজে উঠুক কবির এই কথার ধ্বনি সাথে -

  "আসছে নবীন জীবনধারা অসুন্দেরে

  করতে ছেদন 

  তাই যে এমন কেশে-বেশে 

  মধুর হেসে

  ভেঙে আবার গড়তে জানে সে 

  চিরসুন্দর"।

                                ……………… 


পয়লা বৈশাখ

জয়া মুখার্জী   


"কুলপি মালাই.. কুলপি মালাই" ... বলে হাঁক দিতে দিতে শেষ দুপুরে আইসক্রিমওয়ালা ঠেলা গাড়ি নিয়ে আমাদের পাড়ায় যেই ঢুকল ওমনি সিংহি বাড়ীর বড় গিন্নী ছাদের ব্যালকনি থেকে প্রায় অর্ধেক শরীর ঝুলিয়ে চিৎকার "মুখপোড়া তোরা আসার আর সময় পাস না। রোজ রোজ দুপুরের ঘুম ভাঙিয়ে দিস "। আইসক্রিম ওয়ালা উপরপানে তাকিয়ে দাঁত ছরকুটে একটা হাসি দিয়ে চুপচাপ গাড়ীটা নিয়ে পেরিয়ে যাবে। আর আমরা যাদের সারা দুপুরেও চক্ষে ঘুম নেই ছুটব আইসক্রিমওয়ালার পেছন পেছন। আহা ঐ ঠান্ডা কুলপি না খেলে হয় ! বড় গিন্নী কি বুঝবে ওর স্বাদ! খালি চেঁচাতেই জানে। কুলপির স্বাদ নিতে নিতে কখন আমরা  কিশোরীবেলায় পৌঁছে যায় টের‌ই পাইনা। মধ্যদুপুর থেকে সন্ধ্যে নামার সন্ধিক্ষণগুলো কি দুরন্ত আনন্দে কেটে যেত। চৈত্র শেষে এক আকাশ জমজমাট খর রৌদ্রের ভেতর দিয়ে এসে যেত হালখাতার পার্বণ। পয়লা বৈশাখ। একা একা আসে বলে একলা বৈশাখ। এরকম‌ই ভাবতাম। নিজেদের একান্নবর্তী পরিবার না হলেও মামাবাড়ির পাড়ায় থাকার জন্য গুচ্ছের ভাই বোন দিদির কোনো অভাব ছিল না। দল বেঁধে মামাদের সাথে হালখাতা করতে যেতাম। কোলড্রিংক্সের দুর্দমনীয় হাতছানি যে কতখানি লোভী বানিয়ে দিতে এখন মনে পড়লে হাসি পায়। দোকানের সামনে পাতা টেবিলে বসে কোলড্রিংক্সে চুমুক দিতে দিতে নিজেদেরকে বেশ মান্যিগন্যি মনে হতো। একদিনেই যেন সবাই বড় হয়ে যেতাম। হৈচৈ অকারণ হাসিতে ভরে উঠত বৈশাখের প্রথম সন্ধ্যাটি।

আজ‌ও কেমন সব অমলিন। বুকের ভেতর শেতলপাটির ছায়া মেলে দেয় সেইসব স্মৃতি। আজ জেনে গেছি বৈশাখ আমার মতো একলা নয় সে পয়লা।

                           ………………… 


১লা বৈশাখ আর হালখাতা

প্রিয়াঙ্কা মজুমদার


পহেলা বৈশাখ হলো বাংলা সনের প্রথম দিন। এটি বাঙালীর একটি সার্বজনীন লোক উৎসব। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হল নববর্ষ। অতীতের ভুল ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ। একসময় নববর্ষ পালিত হতো, আতর্ব উৎসব বা ঋতু ধর্মী উৎসব হিসেবে। একসময় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদারদের খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীদের তাদের মিষ্টিমুখ করতেন। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসব মুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।

অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল  হালখাতা। গ্রামে,গঞ্জে,নগরে ব্যাবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাদের পুরোনো হিসাব নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এই উপলক্ষ্যে তারা নতুন পুরাতন খদ্দের দের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিস্টি বিতরণ করতেন এবং নতুন ভাবে তাদের সঙ্গে ব্যাবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এই অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়।পহেলা বৈশাখ এবং হালখাতা বাঙালীর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

......................


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - সুকান্ত সিংহ

ঠিকানা - সুরতপুর, হরিরামপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614











ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...