Saturday 14 October 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা// ই-কোরাস ৭

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ৭

রূপছায়া, কলাইকুন্ডু, দাসপুর

শ্রীজিৎ জানা 


মাথার উপর হুসহুসিয়ে এরোপ্লেন ছোটানের কৃতিত্ব রাইট ভাতৃদ্বয়ের নামে লেখা আছে। আহারে, মানুষের পাখি হয়ে উড়বার সাধকে খানিকটা হলেও পূরণ করেছে ওই ভাইদল। একইভাবে আরো একটি ভাইজোড়া মানুষকে মাতিয়ে রেখেছে আজঅব্দি। অবাক হওয়ার কিচ্ছু নেই, তা হল একমেবাদ্বিতীয়ম সিনেমা। অগাষ্ট এবং লুই ভাইদের দৌলতে ওদেশে শুরু হল সিনেমা তৈরি এবং প্রদর্শন। সালটা ১৮৯৫। তার ছ'মাস পরেই শুরু হয়ে গেল মুম্বাইয়ে ছবি দেখানো। ভারতের রাজধানী তখন কলকাতা। এক ডিসেম্বরে ফ্রান্সে যেমন সিনেমার জয়যাত্রা শুরু,আরেক ডিসেম্বরে কোলকাতায় তেমন সূচনা হল নির্বাক চলচিত্র প্রদর্শনের। বাংলায় প্রথম  নির্বাক চলচিত্র বিল্বমঙ্গল প্রদর্শিত হল ১৯১৯ সালে ম্যাডোনা কোম্পানির প্রযোজনায়।

এইখানে একটা মজার বিষয় নিয়ে একটু নাড়াচাড়া না করলে জমবে না। মানে একটু রসালাপ। বাঙলায় একখান প্রবাদ আছে, ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবার একথাও তো আছে– ভরত ছিল রামের ভাই / তুলনা তার কোথাও নাই। আচ্ছা প্রবাদ, ছড়া ইত্যাদি নিয়ে কেন বাড়া বিস্তর কচ্ছি বলুন তো!  কারণ আছে মশাই। ওদেশে এরোপ্লেন করল ভাইজোড়া, সিনেমা শুরু করল ভাইজোড়া আর এদেশে মানে আমাদের দেশে কি ভাইজোড়া মানে জুডো - ক্যারাটে। মোটেই না। এদেশেও মানে বঙ্গে প্রথম বায়োস্কোপ কোম্পানি তৈরী করলেন বাঙালি ভাইজুটি— হীরালাল সেন আর মতিলাল সেন। আরো কেমন মজার কান্ড দেখুন, সেই তো ফ্রান্সে ডিসেম্বরে শুরু,কোলকাতায় শুরু আরেক ডিসেম্বরে আবার সেই ডিসেম্বর মাসেই শুভ মহরত সবাক চলচ্চিত্রের। ভারতে প্রথম সবাক চলচিত্র দেখানো হয় ডিসেম্বর মাসে। ভারতের প্রথম সবাক সিনেমা হল 'আলম আরা'। কিন্তু ১৯৩১ -এর এপ্রিলে বাংলা সবাক চলচিত্র জামাইষষ্ঠী দেখানো হয়।


অনেক গৌরচন্দ্রিকা হল। এবার আসল কথায় এসো তো বাপু। আসল বলতে আপনারা যা বোঝেন,তা হল সিনেমাহলের ইতিবৃত্ত। সপ্তম পর্বে যেই সিনেমাহল নিয়ে কথা হবে তার সঙ্গে এই লম্বা গৌরচন্দ্রিকার একটা যোগ আছে। কেনকি 'রূপছায়া' সিনেমাহলের জন্ম স্বাধীনতার পূর্বে অথবা অনেকের মতে স্বাধীনতা লাভের সমসাময়িক। ফলত তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নিরাশ হতে হয়েছে অনেকখানি। যেটুকু মিলেছে সেটুকুই যত্নে রাখার প্রয়াস রইল।

  ঘাটাল নিবাসী সুধীর পাল প্রথম একটি চলন্তিকা সিনেমাহল তৈরী করেন সয়লা গ্রামে [সোনাখালি, দাসপুর, পঃ মেদিনীপুর]। অস্থায়ী সেই সিনেমাঘরের কোন মাটির অথবা পাকার দেওয়াল ছিল না। চট - ত্রিপল ঘেরা খড়ের ছাউনি দেওয়া 'রূপছায়া' সিনেমাঘর। তা প্রায় দুশো দর্শক বসে ছবি দেখতে পারত। বেশিরভাগ দর্শকের জন্য মাটিতে চট বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা ছিল। পেছনের দিকে গুটিকতক  কাঠের তক্তা বিছানো বসার আসন করা ছিল। খাড় রাধাকৃষ্ণপুরের বাসিন্দা স্বদেশ মাইতি, যিনি টালিভাটা বাজারহাট এলাকার মানুষের কাছে পুনা মাইতি নামে বেশি পরিচিত (পুনা মাইতির চা দোকান) তাঁর স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল সয়লা গ্রামের 'রূপছায়া' সিনেমাহলের কথা। তিনি জানান,"সোনাখালি– সয়লার ওই হলে আমি ছোটবেলায় বাবার সাথে একবার কথা না বলা সিনেমা দেখতে গেছি"। অর্থাৎ কিনা নির্বাক সিনেমা রূপছায়া -তে চলেছে সেইসময়। কলাইকুন্ডু গ্রামের রঞ্জিত পাঁজা মহাশয়,যিনি রাজনগর ইউনিয়ন হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন,তিনি জানালেন," স্মৃতি খুব কাজ করছে না ঠিকই। তবে বাবার নাথে এক'দুবার রূপছায়াতে ছবি দেখতে গেছি। তখন টিকিট মূল্য ছিল দু'আনা"। তবে একথা বলতে খুশিই বোধ করছি যে সয়লার এই সিনেমাহলের নাম যে রূপছায়া ছিল, তার প্রথম হদিশ দেন এই রঞ্জিত বাবু।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সয়লাতে রূপছায়া মাত্র দু'বছরের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়।  কলাইকুন্ডু গ্রামে রাবণতলা বলে একটি জায়গা রয়েছে।  সেইখানে পাঁজা ব্রাদার্স মানে গোপাল পাঁজা,বটু পাঁজা,মুকুন্দ পাঁজা মিলে ওই রূপছায়া সিনেমাহলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।তবে এবার মাটির দেয়াল ও খড়ের ছাউনি দিয়ে রীতিমতো স্থায়ী ভাবে রূপছায়ার জয়যাত্রা ষুরু হল। এবারো মাটিতে চটা- ত্রিপল আর পেছন দিকে তক্তার পেতে উঁচু করে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা হল। এক্ষেত্রেও সিনেমার টেকনিক্যাল  বিষয়ে সহযোগিতা করলেন ঘাটালের সুধীর পাল,ফণী পাল এবং জলধর পাল। এমনকি চোঙা ফুঁকে ছবির প্রচার করতেন ঘাটালের মদন পাল। আরো মজার বিষয় রূপছায়ার ছবির প্রচারে শুধু চোঙা নয়,ড্রাম বাজিয়ে পাড়ায় পাড়ায় তিনি প্রচার সারতেন। 

কলাইকুন্ডু গ্রামের রূপছায়া সিনেমাঘরের আসন সংখ্যা প্রায় তিনশোর মতো ছিল। সেইসময় টিকিট মূল্য দশ, কুড়ি ও পঁচিশ পয়সা ছিল বলে জানালেন রঞ্জিত পাঁজা মহাশয়। রূপছায়াতে তিনটা এবং ছ'টার শো হত। পৌরাণিক সিনেমায় ভীড় যথেষ্ট হত সিনেরমাহলে। আর একটি বিশেষ ঘটনা হল,দোলযাত্রা উৎসবের সময়ে সারারাত ছবি দেখানো হত 'রূপছায়া' তে।


তথ্যঋণ :–

শ্রী রঞ্জিত পাঁজা - কলাইকুন্ডু

............................


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...