Thursday 30 November 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ১০

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ১০

মল্লিকা - বকুলতলা, দাসপুর -১ ব্লক

শ্রীজিৎ জানা


কুলতলা জায়গার নাম হয়েছে বকুল গাছ থেকে। সরকারি নথিতে বকুলতলা মৌজা কোত্থাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আসলে ওই স্থানটি মামুদপুর ( জে এল নং-৬১)  গ্রামের অন্তর্ভুক্ত। তবে যেই সুবিশাল মনোরম বকুল গাছের নামে বকুলতলার নাম,সেই গাছটি আজকে আর নেই। অনেকের স্মৃতিপটে অথবা অনেকের অ্যালবামে থেকে যেতে পারে সেই ঘন সবুজ পাতায় সাজানো সুদৃশ্য বকুল গাছের ছবি। কিন্তু গাছ নিয়ে এত কথা বলছি কেন! এমন তো অনেক জায়গার নাম গাছের নামেই চেনে সকলে। তেঁতুল গাছ থেকে তেঁতুলতলা,বেল গাছ থেকে বেলতলা এরকম ঢের আছে মশাই। তা অবিশ্যি আছে কিন্তু এই বকুলতলা  এমন একটা ঠিকানা যেখানে একসময় গমগম করত লোকসমাগমে। অগুন্তি সিনেপ্রেমীদের ভিড়ে ভিড়াক্কা বকুলতলা চত্বর। ছুটন্ত বাস হঠাৎ থমকে যেত এখানে। আর স্রোতের মতো মানুষ দৌড় লাগাত ঘাটাল- পাঁশকুড়ো সড়কের পুব দিকে সিনেমাহলের দিকে। আজ সেইসব সোনালী দিন শুধুই স্মৃতি।


আজকের বকুলতলা জমজমাট বাসস্টপ। তেমাথার মোড়। কিন্তু ষাটের দশকে এই স্থান ছিল জঙ্গলাকীর্ণ।  তখনো ঘাটাল - পাঁশকুড়া পিচের সড়ক হয়নি। আনুমানিক ১৯৬৭ সালের শেষ দিকে পিচ সড়ক হয়। যদিও খুকুড়দহতে তখনো খেয়া চলত। অর্থাৎ যাকে বলে কাটা সার্ভিস। এদিকে ঘাটাল থেকে বাস খুকুড়দহ অব্দি যেত। সেখানে খেয়া পেরিয়ে ওইপার থেকে পুনরায় বাস ধরতে হত। আর এদিকে মেদিনীপুর থেকে নাড়াজোল  বাস চলাচল করলেও,তা বকুলতলা অব্দি চালু ছিল না। ঠিক এই সময়ে মামুদপুর মৌজায় কানাই প্যোড়া সহ আরো অন্য ক'জন অংশীদারদের কাছ থেকে সড়ক সংলগ্ন ছিয়ানব্বই শতা জায়গা কিনলেন তৎকালীন ঘাটাল নিবাসী সুধীর পাল। উদ্দেশ্য ছিল পেট্রোল পাম্প করবেন। কিন্তু তাঁর প্রথম থেকেই সিনেমাহল ব্যাবসার প্রতি মারাত্ম ঝোঁক ছিল। সেই ঝোঁক বশত ওই স্থানে গড়লেন 'জনতা' নামের সিনেমাহল। 'জনতা' সিনেমাহলের যাত্রা শুরু আনুমানিক সত্তরের শেষের দিক ধরা যেতে পারে। কিন্তু জনতা হলের যাত্রাপথ খুব বেশি এগোয়নি। মাত্র বার বছরের তার যাত্রাকাল। এর মধ্যে জনতা প্রেক্ষাগৃহের কাঠামোর অনেক ভাঙন গড়নের পর্ব চলে।পরে জায়গা সহ প্রেক্ষাগৃহ হস্তান্তর হয়। আশির দশকে পাল পরিবারের কাছ থেকে প্রায় নয় - দশ লাখ টাকায় জায়গা সমেত সিনেমাহল কিনে নেন আশুতোষ মাইতি, বাড়ি কামালডিহি,হরেকৃষ্ণপুর,দাসপুর। দিল্লী প্রবাসী বিশিষ্ট স্বর্ণ ব্যবসায়ী আশুতোষ মাইতি এন্ড ব্রাদার্স নতুন করে শুরু করলেন সিনেমাহল। পূর্বের 'জনতা' সিনেমাহলের নাম বদলে রাখলেন 'মল্লিকা'। আশুতোষ বাবুর একমাত্র মেয়ের নামে নাম হল 'মল্লিকা' সিনেমাহল।


সালটা ১৯৮৭, শুভ মহরত হল মল্লিকা সিনেমাহলের।  প্রথম ছবি 'বেহুলা লখীন্দর'। এরই মাঝে নাড়াজোল - দাসপুর সড়ক যোগাযোগ চালু হয়ে গেছে। মল্লিকায় উপচে পড়া সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের ভীড়। নতুন নতুন হিট বাংলা ও হিন্দি সিনেমার টানে ছুটে আসছে দর্শক। তার উপরে বেশ পরিপাটি সিনেমাহল বলা-ই যেত মল্লিকা প্রক্ষাগৃহকে। দর্শক আসনও নেহাত কম ছিল না। ফ্রন্ট স্টলে ১০৬টি, মিডিল স্টলে ২৩৬টি,রেয়ার স্টলে ২৬৭টি এবং ব্যালকনির ২২৪ টি সিট মিলে মোট আসন ছিল ৮৩৩ টি। শুরুতে ফ্রন্টে  এক টাকা নব্বই পয়সা,মিডিলে দু'টাকা পঞ্চাশ পয়সা,রেয়ারে তিন টাকা পঞ্চাশ পয়সা টিকিটের মূল্য ছিল। ব্যালকনির টিকিট মূল্য ছিল চার টাকা পঞ্চাশ পয়সা। স্পঞ্জের গদি বসানো ফোল্ডিং চেয়ারে বসে দুর্দান্ত সাউন্ড সিস্টেমে আর বড় পর্দায় দর্শক উচ্ছ্বসিত হত মল্লিকা সিনেমা হলে ছবি দেখে।  মল্লিকা সিনেমাহলে জাপানী কোম্পানির  সাউন্ড সিস্টেম বসিয়ে ছিলেন মাইতি ব্রাদার্স। তৎকালীন সময়ে যার অর্থ মূল্য ছিল প্রায় পঞ্চান্ন হাজার টাকা।  একের পর এক সিনেমা কয়েক সপ্তাহ ব্যাপী হাউসফুল হয়েছে এই মল্লিকায়। প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি অভিনীত 'প্রতিবাদ' ছবি চলে ১৫ সপ্তাহ,যা মল্লিকা সিনেমাহলের ক্ষেত্রে ছিল রেকর্ড সৃষ্টিকারী।  একইভাবে 'যুদ্ধ' ছবি চলে ১০ সপ্তাহ,'সঙ্গী' ১৩ সপ্তাহ,'লাল পান বিবি' ১০ সপ্তাহ, শ্বশুর বাড়ি জিন্দাবাদ ৮ সপ্তাহ এবং 'সজনি গো সজনি' বই চলে ৭ সপ্তাহ। বাংলা ছবির পীঠস্থান বলা যেতে পারে মল্লিক্ সিনেমাহলকে। হলের দীর্ঘদিনের ম্যানেজার আলোক মন্ডলের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে সেদিনের মল্লিকা সিনেমাহলের কথা-" সজনি গো সজনি সিনেমা চলাকালীন মল্লিকায় আসেন ওই সিনেমার নায়ক সঞ্জীব দাসগুপ্ত এবং শিশু অভিনেতা মাস্টার রিন্টু। এমনকি পরিচালক তরুণ মজুমদার মহাশয়ও আসেন সাথে। সেদিস হলের সামনে মাথা গোনা যাবে না এমন ভীড়"। 


মল্লিকা সিনেমাহলের চিফ অপারেটর ছিলেন রণজিৎ রণ ( বরদা,ঘাটাল)।  রাজা কোম্পানীর প্রোজেকশান মেশিন সিনেমাহল মালিক শুরুতেই কেনেন। প্রথম দিকে স্টাফ ছিলেন ছাব্বিশ জন,শেষে কমতে কমতে ঊনিশ জনে নামে। ছবি আসত ধর্মতলার তিন নম্বর স্যাকলাথ প্লেস থেকে। ব্রোকার ছিলেন থড়ার নিবাসী নিমাই পাঁজা। প্রথম দিকে ২/ ৫ / ৮ টার শো চলত মল্লিকায়। কিন্তু নাইট শোতে লস হওয়ার দরুণ মালিক পক্ষ ভাবনা চিন্তা করে শো-টাইম ১২ / ৩ / ৬ টা করে দেন। ছবিরশুরু এবং  মাঝে বিরতি পর্বে চলত বিজ্ঞাপন। রসিকগঞ্জের মুস্তাফা ধূপ,তারা ব্যাটারি,ঘাটালের বিখ্যাত নাগের মিঠা পান নামক পানস্টলের বিজ্ঞাপন দেখানো হত মাসিক তিনশ ( ফ্লিম) ও পঞ্চাশ টাকার ( স্লাইড) বিনিময়ে।

 ওদিকে ঘাটাল এদিকে খুকুড়দহ সহ পশ্চিমে নাড়াজোল অব্দি পোস্টারিংয়ের মাধ্যমে ছবির প্রচার করতেন পাঁজ জন স্টাফ। ন্যূনতম টিকিট মূল্যে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের দেখানো হত শিক্ষামূলক সিনেমা। প্রতিবেদক নিজেও এই হলে ছাত্রাবস্থায় দেখেছে 'সবুজ দ্বীপের রাজা' সিনেমা। বিভিন্ন মিটিং ও সভার কাজেও শো - টাইমের পূর্বে মল্লিকা সিনেমাহলকে কখনো ভাড়ায়,কখনো বিনা মূল্যে ভাড়ায় দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন ম্যানেজার আলোকবাবু। সেইসাথে জানালেন আরও একটি ঘটনা। সুরিন্দর ফ্লিমসের সুরিন্দর সিং, নিসপাল সিং ( বর্তমানে যিনি অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিকের স্বামী) প্রায়শই আসতেন চন্দ্রকোনার ভগবন্তপুর গুরুদ্বারে। আর যাত্রাপথে অবশ্যই কিছুটা সময় কাটাতেন এই মল্লিকা সিনেমাহলে। তাঁদের প্রোডাকশন হাউসের সঙ্গে ছিল মাইতি ব্রাদার্সের বিশেষত আলোক বাবুর খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সুরিন্দর ফ্লিমস্ প্রোডাকশনের সমস্ত ছবিই চলেছে মল্লিকা সিনেমাহলে।



কিন্তু সময়ের সাথে কোথায় হারিয়ে গেছে মল্লিকা সিনেমাহলের সেইসব উজ্জ্বল দিন। অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে প্রক্ষাগৃহ চললেও শুধু এলাকার নয়,বহু দূর-দূরান্তের সিনেমা পাগল বাঙালিদের প্রিয় ঠিকানা ছিল মল্লিকা। স্কুল কলেজের ক্লাস বাঙ্ক করে ম্যাটিনি শোতে কোনার সিটে বসে কত যুগল তাদের সোনালী মুহুর্ত যাপন করেছে মল্লিক্য়। আলোক বাবু আক্ষেপ করে জানান, " টিভি,ভিডিও,মিনি পর্দার রমরমা  সিনেমাহলের ক্ষতি করেছে,কিন্তু এইসবের সাথে মল্ৰিকার ক্ষতি করেছে স্টাফেদের ইউনিয়নবাজি"। মাঝে বেশ কিছুদিন মল্লিকা সিনেমাহল লিজে দিয়ে চালান মালিক পক্ষ। অবশেশে ২০০৮ সালের জুন- জুলাই মাস নাগাদ মল্লিকা সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যায়। তবে আজও দাঁড়িয়ে আছে তার কাঠামো। ভেতরে আজও পর্দা চেয়ার মেশিন সবই রয়েছে।  কিছু বিক্রি করেননি মালিকপক্ষ। তবে কান পাতলে শোনা যাবে হয়তো বোবা কান্না।


তথ্যসূত্র 

১.শ্রী আলোক মন্ডল, রাধাকান্তপুর।

২. শ্রী মোহন বেরা, দাসপুর।

৩.শ্রী বিদ্যুৎবিকাশ শাসমল,দাসপুর।

                     …………………. 



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪




Wednesday 29 November 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৪৬

 



রবীন্দ্র পরম্পরা 

পর্ব - ৪৬ 

শেষ প্রশ্ন, তবু মেলে নি উত্তর

মহাশ্বেতা দাস 


     ২৫শে জুলাই ১৯৪১ সাল, রবীন্দ্রনাথ চিরতরে তাঁর প্রাণের শান্তিনিকেতন ছেড়ে  জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে চলে এলে  মহর্ষি ভবনের দোতলায় 'পাথরের ঘরে' কবির থাকার বন্দোবস্ত হল। 

   

      পরের দিন, অর্থাৎ ২৬শে জুলাই কবির কাছে এলেন প্রাণ প্রিয় ভাইপো 'অবন'। সেদিন কাকা- ভাইপো আলাপচারিতায় বোধয় স্মরণ করেছিলেন অতীত দিনের অনেক স্মৃতি…. 

              

        ঠাকুর বাড়ির দুই সন্তান, বয়সের ফারাক মোটে দশ বছর হলেও তাঁরা সম্পর্কে কাকা- ভাইপো। সম্পর্ক যাইহোক জীবন সমুদ্রে একাধিক দিক থেকে তাঁরা ছিলেন পরস্পর দোসর। 

          জীবনের শুরুতে একজনের হাতে কলম আর একজনের হাতে তুলি। কিন্তু যিনি সবসময় অনেক কিছুতেই মেলবন্ধন ঘটিয়ে এসেছেন সেই বিশ্বের বিস্ময় কবিগুরু এবারেও পারেন নি থেমে থাকতে! 'অবন' কে যে তাঁর চাই-ই-চাই। সুযোগ বুঝে ডেকে নিয়েছেন নিজের কাছে নিজের কাজে।

             

         ১৮৯২সাল , লিখলেন কাব্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা । লেখার সময়ই অবনীন্দ্রনাথের উপর নির্দেশ এলো ছবি দেওয়ার জন্যে । অবনীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন,- "....এই হল রবিকাকার সঙ্গে আমার প্রথম আর্ট নিয়ে যোগ । তারপর থেকে এতকাল রবিকাকার সঙ্গে বহুবার আর্টের ক্ষেত্রে যোগাযোগ হয়েছে, প্রেরণা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে । আজ মনে হচ্ছে আমি যা কিছু করতে পেরেছি তার মূলে ছিল তাঁরই প্রেরণা ।"

         

          এখানেই শেষ নয়! ছোটদের উপোযোগী লেখা চাই । কবি লক্ষ্য করেছেন অবন ভালো গল্প বলতে পারে। প্রিয় অবনকে বললেন- "তুমি লেখো না, যেমন করে তুমি মুখে মুখে গল্প কর তেমনি করেই লেখো ।"  তুলির আঁচড়ে দাগ টানার মতোই অবন এবার হাতে তুলে নিলেন কলম….. লিখলেন 'শকুন্তলা' । রবীন্দ্রনাথ লেখাটির প্রশংসা করলেন। এরপর প্রবল উৎসাহে অবনীন্দ্রনাথ পর পর লিখে ফেললেন ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী, বুড়ো আংলা ইত্যাদি।

     

      রবীন্দ্রনাথের রাখিবন্ধন উৎসব থেকে স্বদেশী আন্দোলন- সবেতেই অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন কবির অন্যতম সঙ্গী ও উদ্যোক্তা।

            



             অন্যদিকে ৭ই আগস্ট অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। ঠাকুরবাড়ির প্রথা অনুসারে জন্মাষ্টমীর দিনই জন্মদিন পালন করা হত। এই উপলক্ষে একবার রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেতেই ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় কলাভবনের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী মিলে পালিত হয়েছিল অবনীন্দ্র জয়ন্তী। 

         

           মনুষ্যজন্ম মানেই সুখ দুঃখে ভরা জীবন। আর এই জীবনে হাজারও প্রশ্ন থাকবে আজীবন ধরে এটা যেমন  স্বাভাবিক তেমনই সব প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যায় না বোধয় আজীবন ধরে, সে সাধারণ মানুষ হোক বা বিশ্বকবি! প্রশ্নের ধরণ আলাদা হলেও উত্তর মেলা বা না মেলার ক্ষেত্র টি বোধয় একই রকম। 


     শ্রাবণের আকাশ মানেই কখনও মেঘের ঘনঘটা আবার কখনও রৌদ্রজ্জ্বল দিন। কিন্তু ১৯৪১ সালের শ্রাবণের আকাশে মেঘের ঘনঘটার প্রাবল্য  ছিল বোধয় খুব বেশী। রবির আলো ক্ষীণ.... নিভু নিভু প্রায়। 

  

        জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে  "পাথরের ঘরে" কবি কাটিয়ে দিয়েছেন দু-দুটি দিন। "সময়ের হৃদয় হরণ" করা তো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়.... কিন্তু জীবন-প্রদীপের আলোও  শ্রাবণমেঘে ঢাকা সূর্যের মত ক্রমশঃ ক্ষীণ হচ্ছে।  তাই বলে আজীবন সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, ভ্রমণে- কর্মব্যস্ততায় যাঁর কলম থেমে থাকেনি ফুটিয়েছে শত শত ফুল....  কবির সে কলম আজও থেমে থাকল না! রোগশয্যায় শায়িত কবি তাই নিজের ভাবনা ছন্দে বেঁধে আমাদের উপহার দিয়ে চললেন একের পর এক কবিতা। নিজে আর কলম ধরতে পারেন না। তাই কবি মুখে মুখে বলে চলেন আর সেগুলি লিখে রাখেন কবির ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দ'র স্ত্রী,  রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ভাজন রাণী চন্দ। এভাবেই ১৯৪১সালের ২৭ শে জুলাই  ঠাকুরবাড়িতে বসে কবি  "প্রথম দিনের সূর্য"  কবিতাটি আমাদের উপহার দিলেন। 


     দূরদ্রষ্টা, মহামানব আজীবন ঈশ্বরে যাঁর অগাধ বিশ্বাস, উপনিষদের মন্ত্র যাঁর জীবনের মূল মন্ত্র তিনিও হয়তো নিজে …   

                 "কে তুমি?" 

  

       এই প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারেন নি!!! 


        কে তুমি? - এই একটি প্রশ্নের মধ্যেই রয়েগেছে অনেক বড় একটি জীবন জিজ্ঞাসা! কবি আসলে কাকে  প্রশ্ন করছেন? ….. ঈশ্বর? না সূর্যকে প্রশ্ন করছেন? না কি প্রশ্ন করছেন নিজেকেই নিজে ? যা ধরা দিচ্ছে কখনো ঈশ্বরের হিসেবে.. কখনো মহাকাল.. আবার কখনো বা আমাদের আত্মা হয়ে  দাঁড়াচ্ছে সম্মুখে। আর আমরা তখন যেন নিজেকেই প্রশ্ন করছি- কে আমি?


    প্রসঙ্গত মনে পড়ে  সক্রেটিসের সেই বিখ্যাত উক্তি- "নিজেকে জানো" । নিজেকে জানার চেষ্টা মানব জাতির ইতিহাসে অনেক পুরানো। মনীষীরা বারবার বলেছেন- নিজেকে জানো.. নিজেকে খোঁজো.. নিজের মধ্যেই তুমি স্রষ্টাকে খুঁজে পাবে..

কিন্তু আমরা সারাজীবন ধরে কতটুকু বা নিজেকে জানতে পারি??

     

       কবিও পারেন নি। আর তাই…..

     

            রয়ে গেল "শেষ প্রশ্ন"!

            পেল না উত্তর.....! 


                  ………………….. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Saturday 25 November 2023

তুষার কান্তি ঘোষ এর কবিতা // ই-কোরাস ১৫৬

 



তুষার কান্তি ঘোষ এর কবিতা

১.

 মন কেমনের রাত


বাজি রেখে হেরে যেতাম

যেদিকে তাকাতাম সেদিকেই তোমার চোখ


সামনে গেট, একচিলতে বাগান, পিছনে পাঁচটা নিমগাছ

বাড়িটি তেমনই আছে 


তিনবছর পরে গোধূলি অতিক্রম করে তোমার কাছে এসেছি


অনেক শান্ত হয়ে গেছ, অনেক গভীর

কি জানি কুঞ্জবনে নজরবন্দী আছো কিনা! 


সাফল‍্যের মত ব‍্যর্থতাও অভ‍্যাস


কেউ কেউ কিছুদিন ভালোবাসে কেউ কেউ আজীবন 

কেন যে মন খারাপের রাত বারে বারে ফিরে আসে!


২.

স্পর্শ


কিছু দৃশ‍্য  স্পর্শের মত

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি করি নিজেকে


বনপথে ভেসে আসে রোদের গান

অন্ধকার-আকুলতা শেষ হলে হাতের তালুতে বসে একাকী চাঁদ


ভয় করে 

বহুদিন কেটে গেছে 

যদি তুমি আমার স্পর্শ বুঝতে না পার আমার কান্না পাবে খুব 


৩.

করনীয় যা


ভাঙাচোরা সময়ের কাছে সবাই হার মানে একদিন

তবু যা করার তা করতে হয়


কান পাতলেই শুনতে পাই সিংহের গর্জন, আত্মগত কান্নার ধ্বনি 


কি হবে কবিতা লিখে? কি হবে ক‍্যানভাসে ছবি এঁকে?

হৃদয়-জুড়ে ধূসর সম্মোহন,    বসন্ত-দরজার কাছে বারবার  যাওয়া ও ফিরে আসা 


কিছু গান জীবন-মৃত‍্যুর   মাঝে বাজে, কেউ কেউ শোনে তা

আমার কাজ আমাকেই খুঁজে নিতে হবে,  করনীয় সব কিছু করতেই হবে 


অন্ধকার জানে আলোর খবর 

সেই যে কবে মদনমোহন তর্কালংকার লিখে গেছেন "পাখি সব করে বর., রাতি পোহাইল ""------


৪.

শর্ত


প্রশ্ন তো অনেক

সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই

নীরবতাই শ্রেয়


বুকের অলিন্দে হাত রেখে ক"জন আর শর্তহীন হতে পারে?


একদিন পদচারনা ছিল বনপথে

টবভর্তি গোলাপে ছিল মুগ্ধতা 

তৃষা ছিল প্রকৃত গভীর


সামান‍্য পুঁজিতে সব জানা সম্ভব নয়


তবু শর্ত, মানুষ শর্ত দিয়ে বেঁধে রাখতে চায়

বুকের ভিতর চড়ুই পাখির  দল ছটপট করে!


৫.

উড়ার অধিকার


এত উর্পাজন কি কাজে লাগবে? এত অর্থ?

 ছেঁড়া ছেঁড়া ভাসমান  প্রেম তোমাকে কি দিয়েছে অলৌকিক জীবন?


এত কি দেখছো দর্পণে?

নিজেকে সার্থক ভাবা একটি ভূল বার্তা 

কোন কিছুই অর্থ দিয়ে যায়  না কেনা 


আকাশ অনেক উদার

সেখানে সকলের সমান অধিকার 

সমুদ্র ও আকাশের সখ‍্যতা একটি শ্রেষ্ঠ অবলোকন


পৃথিবীর ছাত্ররা নিয়মত ভুলছে বানান

তাদের ক'জন  আর  মাঘের শীত থেকে মাটির আখর তুলে আনতে পারে ?


এখানে অনেক যুদ্ধ, অনেক ঈর্ষা , অযথা দখলদারি,

অধিকারহীন সংসার 

এখানে উড়ার অধিকার  কেউ কাকেও দিতে চায় না

উড়তে  চাওয়া মানুষেরা এখানে বড় মনকষ্টে  থাকে 

                            ………………………. 

সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Tuesday 21 November 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৪৫

 



রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ৪৫

শেষ কথা কে বলবে

মহাশ্বেতা দাস 

          

    

          "সাঙ্গ হয়ে এল পালা

       নাট্যশেষের দীপের মালা

     নিভে নিভে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে;

        রঙিন ছবির দৃশ্যরেখা

     ঝাপসা চোখে যায় না দেখা,

    আলোর চেয়ে ধোঁয়া উঠছে জমে।"


প্রদীপে যে আর তেল নেই….. ফুরিয়ে আসছে একটু একটু করে। চিকিৎসা, সেবা… কোন কিছুর ত্রুটি নেই। তবু দেহ আর চলছে না। চিকিৎসকরা পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন কবির অস্ত্রপ্রচারের। অস্ত্রপ্রচার হবে কলকাতায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। দিনক্ষণ স্থির করা হলো ২৫শে জুলাই কবিকে নিয়ে যাওয়া হবে কলকাতায়।


  দূরদর্শী মহামানবের বুঝতে বাকী রইলো না- 

   

       'সময় হয়ে এল এবার, 

     স্টেজের বাঁধন খুলে দেবার।'  


  শান্তিনিকেতনের সাথে কবির বাঁধন কী আজকের! শৈশব, যৌবন, প্রৌঢ় ও বার্ধক্য…. কবির জীবনের সমস্ত অবস্থার স্মৃতি জড়িয়ে আছে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে। দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে গাঁথা হয়েছে যে স্মৃতির মালা- তার বাঁধন খুলতে গেলে তো বাজবেই!!


      ১৯৪১ সালের ২৫শে জুলাই (৯ই শ্রাবণ) ভোরবেলায় কবি পোশাক পরে তৈরী হয়ে বসে আছেন উদয়ন গৃহের পূব জানালার ধারে। যেন শেষবারের মতো তাঁর প্রাণপ্রিয় শান্তিনিকেতনের রূপ- রস- গন্ধ কে প্রাণ ভরে গ্রহণ করছেন । আশ্রমের ছেলেমেয়ের দল দেখা করতে এসে জানালার ধারে গিয়ে গাইল- 

  

  "এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার"। 

 

      কবির মন ক্রমশ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। শরীর তো অনেকদিনই খারাপ। আজ তার সাথে পাল্লা দিয়ে খারাপ কবির মন। চোখের জল আড়াল করতে কবির চোখে আজ কালো চশমা। তবু কোপাইয়ে বান এলে তা কী আর কারো বারণ মানে! সবকিছু ঠেলে শুষ্ক গাল বেয়ে নেমে এল মুক্তোদানার মতো অশ্রুধারা। আশ্রমের ছেলেমেয়েরা এবার গাইল- 

      "আমাদের শান্তিনিকেতন, 

              সে যে সব হতে আপন।" 

        

         যাওয়ার আগে মোটরগাড়িতে চেপে শান্তিনিকেতন আশ্রমের সবার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ। গাড়িতে করেই গোটা আশ্রম ঘোরানো হলো কবিকে। আশ্রমের চিকিৎসক শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে ডেকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন…..  'শচী, আমার আশ্রম রইল, আশ্রমবাসীরাও রইলেন। তুমি দেখে রেখো।'

    

         স্ট্রেচারে করে কবিকে গাড়িতে তোলা হলো। উপাসনা গৃহ, ছাতিম তলা, আম্রকুঞ্জ পেরিয়ে গাড়ি গড়িয়ে চলল স্টেশনের দিকে। তাদের অতি প্রিয় মানুষটিকে চোখের জলে শেষ বিদায় জানাতে  রাস্তার দুপাশে ভীড় করে দাঁড়িয়ে রইলো বোলপুরের বাসিন্দারা। স্টেশনে এসে অতি সাবধানে কবিকে তুলে দেওয়া হল রেলের নির্দিষ্ট কক্ষে। ১৮৭৩ সালে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি,  ১১ বছর ৯ মাস বয়সে ছিল কবির জীবনের প্রথম রেল যাত্রা, হাওড়া থেকে বোলপুর। … আর জীবনের শেষ রেল যাত্রা  ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই, বোলপুর থেকে হাওড়া।  আশ্চর্যজনক ভাবে কবির দীর্ঘ জীবনের প্রথম ও শেষ রেলযাত্রা একই পথে! এ যেন, কবির জীবনের যাত্রা-পথ  এভাবেই এক সুরে বেঁধে দিল রেলের বন্ধনহীন গ্রন্থি! গাড়ী বোলপুর স্টেশন ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল হাওড়ার দিকে--

           

         "তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ,

                           তাই তব জীবনের রথ

        পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার

                            বারম্বার।" 


       বেলা ৩টা ১৫ মিনিটে রবীন্দ্রনাথ এলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। কবির কলকাতা আসার খবরটা সাধারণ মানুষের কাছে গোপন রাখায় স্টেশনে কিংবা বাড়িতে বিশেষ ভিড় ছিল না। পুরোনো বাড়ির দোতলায় ‘পাথরের ঘর’-এ স্ট্রেচারে করে কবিকে নিয়ে যাওয়া হলো। 

                   ……………………. 



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...