Sunday 30 October 2022

মহাশ্বেতা দাস এর গল্প // ই-কোরাস ৮০

 



অরিত্র' র দীপাবলি

মহাশ্বেতা দাস 

      

দিদি এই নে পাঁচ রকমের শাক এনেছি.... কলমী, শুস্নি, উলেখাড়া, সজনে আর নটে শাক। ওবেলা লাউমাচা থেকে লাউ শাক কেটে নেব আর ওপাড়ার টুনি দিদি আলুশাক দেবে বলেছে, তাহলে আর কত রকম বাকি রইল? কুঁড়ে ঘরের দাওয়ায় বসে মহিম পড়া মুখস্থ করছে, শিউলি উঠোনে পিটুলি গোলার আলপনা দিতে দিতে ছোট ভাই মহিমের ভুল শুধরে দিচ্ছে, এমন সময় বড়ভাই যতীন কথাগুলো বলতে বলতে উঠোনে এসে দাঁড়ালো। এমন সময় মা বেরিয়ে আসে; আমি দুপুর বেলা বাকি গুলো জোগাড় করে নেবো। বেলা হলো মুড়ি খাবি নে?


দীপাবলির সময় চোদ্দশাক খাওয়ায় কথা মহিম দিদির মুখে বহুবার শুনেছে। তবু এই কথা গুলো শুনতে শুনতে তার মন চলে গেল ভাদ্রমাসের তাল নবমী তিথির দিনে। তাল নবমী তিথিতে সরকার বাড়িতে বড়ো ধুম। গ্রামের অনেকেরই নিমন্ত্রণ থাকে। নানারকম উপাদেয় খাবারে ভরে যায় পাত। অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা মহিমের বড়ো সাধ জাগে এমন নেমন্তন খাওয়ার।


বিমলেন্দু সরকার ছিলেন বিরাট ব্যবসায়ী। বছর তিনেক হল তিনি ইহ জগতের মায়া ত্যাগ করেছেন। তাঁর সুযোগ্য দুই ছেলে শ্যামলেন্দু ও অমলেন্দু সরকার। শ্যামলেন্দু অধ্যাপনা করেন, ব্যবসায়িক দিকে তেমন আগ্রহ নেই। তাঁর স্ত্রী বিমলা সরল মানুষ, সংসারের জটিলতা তাঁকে বদলাতে পারে নি। মেয়ে রিমাও মায়ের মতোই নরম মনের আর মিশুকে প্রকৃতির। অন্যদিকে অমলেন্দু পুরোপুরি বৈষয়িক প্রকৃতির মানুষ, পিতৃদেবের ব্যবসার বেশিরভাগটাই দেখাশোনা করেন তিনি। স্ত্রী রমিতা। পূজা অর্চনা নিয়ে মেতে থাকতে ভালোবাসেন। বাকি রইল অমলেন্দুর দশ বছরের ছেলে অরিত্র। যেন খাপ খোলা তলোয়ার। বুদ্ধিতে, ব্যবহারে গ্রামের ছোট বড়ো সবারই প্রিয় পাত্র। অরিত্র লক্ষ্মী পূজা উপলক্ষে কয়েকদিন আগে গেছে একমাত্র পিসিমা প্রতিমা' র বাড়ি। দীপাবলি তে পিসিমা কে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার কথা তার। কালী পূজা উপলক্ষে চারিদিকে সাজো সাজো রব, বিশেষ করে সরকার বাড়িতে। চন্দননগর থেকে কারিগর এসেছে এতবড় বাড়ির ছাদ, দালান, সামনের বাগান, রাস্তা সাজিয়ে তুলতে হবে আলোর চমকপ্রদ রোশনাইতে। সরকার গিন্নির প্রতিষ্ঠা করা কালী পূজা। খুব জাঁকজমকে পালন হয়।


গ্রামে সরকার বাড়ি থেকে পশ্চিমে কয়েকটা বাড়ি পরেই গোপাল দত্তর কুঁড়ে ঘর। দিনমজুর গোপাল দত্তর স্ত্রী রূপালী, দুই ছেলে; যতীন ও মহিম এবং মেয়ে শিউলি কে নিয়ে অভাবের সংসার। গোপাল দত্তর মত গ্রামে আরও অনেক পরিবারই আছে যাদের ভালোমন্দ দূরে থাক দু'বেলা পেট ভরে সকলের খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়। হাতে হাতে মায়ের কাজ এগিয়ে দেওয়া, দুই ভাইকে সামলানোর মত গুরু দায়িত্ব পালন করতে করতে চোদ্দ বছরেই শিউলির মধ্যে একটা অভিজ্ঞতার ছাপ পড়েছে। তাই খিদে পেলেও কাউকে টের পেতে দেয় না! কিছুটা দিদিকে দেখে আর কিছুটা অভাবের তাড়নায় যতীনের মুখেও একটা বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব। খালি মহিমটাই এখনও অতটা বুঝদার হয়নি, খিদে পেলে তাই দিদির কাছে বায়না ধরে আর কাউকে নেমন্তন্ন বাড়ি যেতে শুনলেই তার মনে হয় তাকে কেন নেমতন্ন করা হয় নি! মুখ ভার হয়ে যায়!

 

ভাদ্র মাসে তাল নবমী তিথিতে সরকার বাড়িতে অনেকের নিমন্ত্রণ থাকলেও যতীন আর মহিমের কেন যে নেমন্তন্ন ছিল না সে প্রশ্নের উত্তর আজও তাদের অজানা! তিনদিন ধরে ভোরে উঠে তাল কুড়িয়ে সরকার বাড়িতে জেঠিমার কাছে পৌঁছে দিয়েছিল তারা। নেমন্তন্ন পাওয়ার আশায় দাদাকে সরকার জেঠিমার কাছে একটি পয়সাও নিতে দেয়নি মহিম। যতীন বারণ করেছিল, দেখিস ভাই আমাদের নেমন্তন্ন করবে না। তার চেয়ে পয়সা পেলে দু'জনে ঝালশুটি কিনে খেতাম। তবু বিকেল পর্যন্ত আশায় ছিল মহিম, ছুতো করে কয়েকবার সরকার বাড়ির কাছে ঘুরঘুর ও করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গাছের গুঁড়িতে বসে চোখের সামনে দিয়ে তার সম বয়সী অনেককেই বাপ কাকার হাত ধরে সরকার বাড়ির দিকে যেতে দেখলো।  রিমা দিদি আর অরিত্রও তো নেই....  কী একটা কাজে কলকাতা গেছে... কয়েকদিন পরে গ্রামে ফিরবে।


দীপাবলিতে তাই সরকার বাড়ির নিমন্ত্রণের আশা ছেড়েই দিয়েছে মহিম আর যতীন। সবসময় আগলে রাখা শিউলির চোখ দুই ভাইয়ের ব্যথা এড়াতে পারে নি। তাই দীপাবলির কয়েকদিন আগে থেকেই নিজে হাতে মাটির প্রদীপ তৈরী করে মুড়ি ভাজার উনুনে পুড়িয়ে ছেঁড়া কাপড় দিয়ে সলতে পাকিয়ে রেখেছে সে। হাট থেকে নকুল দানাও এনে রেখেছে তাদের মতো করে দীপাবলি উৎসব করবে, দুই ভাইয়ের হাসি মুখ দেখবে এই আশায়।


সকালবেলা সরকার বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। গাড়ী থেকে নেমেই অরিত্র এক দৌড়ে চলে গেল বাগানের পাশে দেবদারু গাছটার কাছে। দেখা পেয়ে গেল মহিমের - কী রে মহিম! আজ বিকেলে মাঠে খেলতে আসবি তো? অনেকদিন খেলা হয় নি! না রে.... আজ অনেক কাজ। দিদির সাথে হাটে যাব। মহিম উত্তর দিল। পিসি প্রতিমা ততক্ষণে অন্দরে প্রবেশ করেছে। অরু টা এমন জিদ ধরলো যে না এসে পারলাম না! ভালোই করেছ দিদি। এতদিন পরে এসেছো যখন একদম ভাইফোঁটা দিয়ে তবে বাড়ি ফিরবে। বিমলা আর রমিতার সাথে এভাবেই আলাপচারিতা এগিয়ে চললো।


বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এল। চারিদিকে শাঁখ বাজিয়ে তুলসী তলায় সাঁঝবাতি দেওয়া শুরু হয়ে গেল। বিজলি বাতির আলোর জোয়ারে ভাসতে লাগলো সরকার বাড়ি, কুন্ডু বাড়ি আর চক্রবর্ত্তীদের উঠোন। গ্রামে অন্যান্য বাড়ি গুলিও যে যার মতো মোমবাতি আর মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে আহ্বান জানাল দীপাবলিকে। শুধু প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতো পড়ে রইলো গোপাল দত্তর মত কয়েকটি কুঁড়ে ঘর। শিউলি মাটির প্রদীপ তৈরী করে কাপড়ের সলতে পাকিয়ে ছিল ঠিকই কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রদীপের আলোয় দুই ভাইয়ের হাসি মুখ দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি, কারণ প্রদীপ প্রজ্বলনের পর্যাপ্ত তেল জোগাড় করতে পারেনি সে!

 

সরকার বাড়িটা আজ আলোয় আলোয় ভরে উঠেছে শুধু মুখ ভার করে চিলে কোঠার ছাদের এক কোণে চুপ করে বসে আছে অরিত্র। মহিম কেন যে তার সাথে খেলতে চাইল না! সেই থেকে মনটা ভালো নেই তার। 

ভাই কোথায় গেলি! পিসিমার দেওয়া নতুন জামাটা পরবি না? বলতে বলতে রিমা উঠে এল। পিছন থেকে অরিত্র' র মা ছুটে এলেন, দেখ না মা রিমা! এক্ষুনি ঠাকুর মশাই এসে পড়বেন অথচ সিদে সাজাতে গিয়ে দেখি ঝুড়িতে শাক রয়েছে এগারো রকমের! কী হবে!

আমি দেখছি কাকিমা, রিমা বলতে না বলতেই অরিত্র বলে উঠলো; দিদি একবার শিউলি দিদিদের বাড়ি গিয়ে দেখলে হয় না! প্রস্তাবটা মনে ধরল রমিতার। তাই না হয় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে শিউলিদের বাড়ি যা রিমা। সব শুনে শিউলি আর মা রূপালী ঝুড়ি ভর্তি করে দিল সারাদিন ধরে জোগাড় করা অনেক রকম শাক। অরিত্র এগিয়ে এল... যতীন দাদা মহিম তোমরা শিউলি দিদিকে সাথে নিয়ে আজ আমাদের বাড়িতে চলো। আজ তোমাদের সবার নিমন্ত্রণ, পুজোর পরে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হয়েছে। আমরা সবাই মিলে একসাথে খাবো আজ। রিমা শিউলির হাত ধরে… তোর হাতে গড়া মাটির প্রদীপ গুলো নিয়ে আয়। আমি বোতলে করে তেল এনেছি এখন সবাই মিলে সেগুলো দিয়ে এই বাড়ির তুলসী তলা সাজাবো... বড়ো অন্ধকার হয়ে আছে। 


কিছুক্ষণের মধ্যেই গোপাল দত্তর কুঁড়ে ঘর প্রদীপের আলোয় স্বপ্নের মতো মনে হল। আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো মহিমের মায়ের চোখ দিয়ে। অরিত্র আজ ভীষণ খুশী। দীপাবলির আলো আজ শুধু বাইরে নয় আলোকিত করেছে ওদের মনের অন্দর। পাঁচজনে একসাথে পা বাড়ালো সরকার বাড়ির দিকে। দূর থেকে গান ভেসে এলো.... 

    " আরো আলো আরো আলো

         এই নয়নে প্রভু ঢালো, 

          সুরে সুরে বাঁশি পুরে 

তুমি আরো আরো আরো দাও তান।" 

…………………….....


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - কোরাস

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614




Saturday 22 October 2022

রাখী দে এর কবিতা // ই-কোরাস ৭৯

 




রাখী দে এর কবিতা 

 বিচ্ছেদ


কিছু ফুল কেড়েছিলে বিচ্ছেদের পরে,

রাতের ওপর সাজানো নরম আয়ু,

থরে থরে ছাই জমেছে মেঘের কোণে,

এবার শুধু ভেজালে প্রাণবায়ু।


কিছু আগুন শিখেছিল মাটির দহন,

চোখের কোলে নামে নিরাপদ ঘুম,

শ্যামাপোকা বৃথা আলো খুঁজে চলে

জোনাকি জানে শব্দকল্পদ্রুম!


কিছু কথা বেঁচেছিল নেভানোর পরে,

নাভিকূণ্ডের মগ্ন জীবনচরিত,

কান ঘেঁষে তার চলে গেছে সবটুকু 

যেটুকু সাজানো সেটুকু কল্পনারহিত!

……………….........


সন্ধ্যা


সন্ধ্যা গাঢ় হতে চাইলে 

নিঝুম পাখিটির মতো আকাশের রঙ বদলানো দেখি,

দূরে ধূসরে একাকী জেগে আছে সংকোচহীন টাওয়ার,

ধুলোর গন্ধ মিশে যাচ্ছে বিষণ্ণ অবয়বে!

………………......


আমরা


মুখের আদলে মুখ খুঁজি,

ছায়ার ভেতর থেকে গেঁথে আনি দৃশ্যপট,

মোড়ের কাছে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে সার সার প্রশ্নের বিন্দু,

একটি সমূহ বিকেল এসে ধরা দেয় অভিমানের কাছে,

জ্যোৎস্না চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে নরম ঘাসের গোড়ায়,

মাটি ভিজে গেলে জন্ম ছুঁয়ে যায় প্রতিটি আলপথ,

আমরা তখনও হেঁটে চলি…

………………….........


জ্যোৎস্না


একটি সমূহ জ্যোৎস্নার মুখোমুখি আমরা,

দূরে, বহু দূরে কেউ এঁকে দিচ্ছে চারণভূমির 

জোনাক জ্বলা ঘাস,

নিরুদ্দেশী তারারা একে একে ডুব দিচ্ছে মায়ার পুকুরে,

নিভন্ত পাখিটি শুনছে ডুবডুব ..

একটু একটু করে ঘাই মারছে তলিয়ে যাওয়া শব্দ!

……………………........



আলো


হাত ধুয়ে চলি,

যতক্ষণ না ধুলো পড়া পাতা নড়ে ওঠে,

লেবুর রস মাখিয়ে কচলে কচলে তুলি স্থায়ী দাগ।

মাঝে মাঝে গলা খাকারি দিই, দৃশ্য কেঁপে ওঠে।

হেলে যাওয়া সূর্যের মুখোমুখি আয়না ও আমরা!

দেওয়ালে আঁকা হিজিবিজি রেখার ওপর ঠেসে দিয়ে জাবর কাটি, ঠোঁটের কষ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে মুহূর্ত!


হাত ধুয়ে চলি,

ফসফরাসের গুঁড়ো বেরিয়ে গেলে

আলো ঠিকরোয়!

………………….......


আতর


অন্ধকার নিভে গেলে পতঙ্গের মতো আড়মোড়া ভাঙি,

ডানায় ছিটে রোদ পড়ে,

আলোর আতর মেখে মেখে সাজিয়ে তুলি ঘরবাড়ির দৃশ্য, মৃদু আকাশ চেয়ে থাকে,

একটা ঘটি ডুবিয়ে ছড়িয়ে দিই ছায়ার উঠোনে,

ছায়ামুখ সরে গেলে নদী জেগে ওঠে!

…………………........



মুঠো


মগ্ন সন্ন্যাসীর মতো দৃশ্য মুঠো করে বসে আছি,

সজল চোখের ডোবাটির পাশে ঝুঁকে আছে অনন্ত ঘাস,

ভাঙা ভাঙা ঢেউয়ে দুলে যায় জলফড়িং,

শিরশিরে গা নিয়ে পথ চলি,

কৌতূহলী জাল ছড়ালে ঘোলা হয় জল,

আমি মুঠো আলগা করি!

……………………..



ঘোর


ঘোরের মধ্যে বসে আছে কুবো পাখি এক,

অনর্গল প্রশস্তির মতো ভেসে আছে ছায়ামুখগুলি,

ঘাসের ডগা ছুঁয়ে যায় হামাগুড়ি রোদ,

ভোরের হাওয়া এসে ঝাপটা দিলে পোড়া গন্ধ গুলো প্রকট হয়ে ওঠে,

একে একে শব্দ জাগে

ঝিরঝিরে পাতার ফাঁকে!

.………………......


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - নিজস্ব

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614












Saturday 15 October 2022

অলক জানা এর কবিতা // ই-কোরাস ৭৮

 




অলক জানা'র কবিতা 

অস্ত্র 



গাছের ছায়ার মতো নিঃস্ব 

পেছনে পড়ে থাকে বিতর্কিত 

কোন এক অতীত পালক, 

যেটুকু বোধ তোমাকে স্পর্শ করে 

জ্বলে ওঠে, আলো তাপ অক্ষর 

সাজায়, একজন কবির কাছে 

সেটাই নগদ কবিতা---

পুনশ্চঃ হতে পারে রক্ষাকবচ হাতিয়ারও।

…………………........


লিভ-ইন্ অদৃশ্যবাদ 



সেই কবে বেচারা জন্ম ! যাকে ভুল বলে 

ডাকি, মাত্র একটিবার বাঁশপাতা গ্রামে 

আমাকে পৌঁছে দিয়ে সেই যে গেছে 

আর দেখা নেই, কেবল মৃত্যু নামক অপেক্ষা আমার সঙ্গেই হাঁটে, আমার সঙ্গেই লিভ-ইন্। প্রিয় নির্ভরতা ছেড়ে যাওয়ার পর 

আরো কাছ থেকে ওর সঙ্গে চোখাচোখি, ভাগাভাগির দুঃখসুখ, প্রেমালাপ, ক্ষয়ে যাচ্ছে চন্দ্রকলা-শব, প্রতিটি জন্ম লিখে যায় 

মৃত্যুর টিকা, ঘড়ির কাঁটার মতো বারোমাস অংক নিয়ে বসে থাকে অদৃশ্যবাদ ললাট। 

…………………......


বৃষ্টির জন্য দুকলম 



একটি নেশার সমার্থক প্রিয়ংবদা বৃষ্টি

তার গায়েপড়া স্বভাব,

উদাস আক্রান্ত আমি, গায়ে তখন 

আমার ছেলেবেলার দারুণ সুখের জ্বর----

জড়ায়,জড়িয়ে ধরে আমার

সমগ্র বাড়ি-ঘর! স্পর্শের অনিবার্য 

কোলাহলে, অসময়ে ভিজে যাওয়া 

একটি নিপাতন সন্ধির নাম।

বৃষ্টি বোঝেনা লাভক্ষতির অঙ্কশাস্ত্র

আসলে বৃষ্টিতে ভেজার কোন বয়স হয় না। 

…………………........


প্রতিবেশী 



নির্মল বাদানুবাদের পর, আমাদের প্রায় মুখ দেখাদেখি বন্ধ, ইতিহাস যাকে ঠান্ডা লড়াই বলে, এভাবেই আমাদের পশুজন্ম অবিচল অটুট। ভিটে সীমার গাছপালাও সহজ সারল্যে শিখে নেয় তীব্র পক্ষপাতিত্বের তুকতাক জলপোড়া---আমরা উভয়ই সামনের দিকে এগিয়েছি, কত মাইল ? তৃতীয় কেউ জানে 

যে আমাদের প্রতিটি গতিবিধির খতিয়ান সযত্নে রেখেছে গচ্ছিত। তবুও---তবুও একদিন হয় তুমি নয় আমি আমাদের পালিত জেদের কাছে হেরে গিয়ে হঠাৎ নিস্পন্দ থেমে গেলে আমাদের চোখ এবং পা প্রধান বিরোধী, সকলের আগে এগিয়ে যায় আর ঝরেপড়া চোখের দুফোঁটা জল তো গতজন্মের বরাদ্দ সহবৎ ! 

………………........


বাটখারা 



কাটাপোনা অথবা মাংস, নোনা-আতা সন্দেশ, তোমার কানের ফুল, ওজন দরে আরো কত কি? 

ক্রেতা সুরক্ষার বিশ্বস্ত কবচ, পাল্লার একপাশে বসে কেমন রাষ্ট্রনায়ক ! পায়রা ও নীল খামে চিঠি বিনিময় গল্প, এর বিপরীতে, অপেক্ষার হাতে বেজে চলে অধৈর্য্যের রিংটোন, লাল নীল মুখবন্ধ গোলাপি খামের ওজন জানে ডাকঘর, শুধু কোন্ খামে কতখানি প্রেরকের 

হৃদয় মজুত সেই ওজন জানে না বাটখারা। 

………………….....


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - নিজস্ব

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614



Sunday 9 October 2022

তুষারকান্তি ঘোষ এর কবিতা // ই-কোরাস ৭৭

 




তুষারকান্তি ঘোষ এর কবিতা  

আত্মানুসন্ধান


রাত্রি যখন গ্রাস করে, সাপের মতন গিলতে আসে

আমি পথ চলতে শুরু করি


শহর জুড়ে নিঃস্তব্ধতা 

ছায়াপথ এঁকেবেঁকে চলে যায় নক্ষত্র-সান্নিধ‍্যে 


আমি কে? আমি কি আমিই আছি?

জ‍্যোৎস্না ভাঙতে ভাঙতে এক একাকী পাখির মত বিচরন করি  


দিন নয়,রাত নয়, সব শূন‍্যতা শেষে 

খুব ভোরে গন্ধরাজের গন্ধ  নিই, শিশিরভেজা শিউলি কুড়াই তোমার জন‍্য 


আমি কে? আমি কি নারী অথবা পুরুষ?

এক শরীরে অসংখ‍্য যুগলমুর্তি

বিক্রীত স্থাপত‍্য নই, নই বিকারগ্রস্ত


এই নাটকে দুটি চরিত্র, তুমি আর আমি 

কাছে আসি,দূরে যাই, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাাঁদি, চুমু খাই…

……………………



বৃষ্টি-সন্ধ‍্যা


সন্ধানী চোখ খুঁজতে থাকে লতানো গাছের মত সন্ধ‍্যার অলস ভঙ্গিমা।


তখন বৃষ্টি পড়ছিল খুব। সব সীমাবদ্ধ ঘরের ভিতরে।ঈশাণের খ‍্যাপা হাওয়া সোঁ সোঁ ডাকে। 


মালতীসন্ধ‍্যার বাসনা  সঙ্গী পাখিকে চায়। পাখিরা যথারীতি ঘরে ফিরে যায়।


কেউ নামতা পড়ে, কেউ নামাজ, কেউ কেউ বিরক্ত বোধ করে আজ পরকীয়া হল না বলে। 


শ্বশানে নিভেছে চিতা, সব আকাঙ্ক্ষা কি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে?


একা স্বৈরিণী ল‍্যাম্পপোষ্টের নীচে দাঁড়ায়।তার মত কেউ জানে না বাঁচতে গেলে কি কি করনীয় আর!


কবি খুব ক্লান্ত বোধ করে, খুব ক্লান্তিতে ঘুম আসেনা তার।

………………….......


জন্মদিন


মরুভূমির মাঝে হেঁটে যেতে যেতে যখন আমার চামড়া আধপোড়া বাদামী হয়ে যায়, আমি  এ নদী সে নদী পেরিয়ে এসে ঝর্ণা থেকে জলপ্রপাতের শব্দ শুনতে পাই,

স্নান করি প্রাণভরে


সমুদ্র রক্তে লাল হয়ে উঠলে আমি ছোট্ট ডিঙিতে  উঠে তীরে চলে যাই,, ভাসানের বাজনা পেরিয়ে আমি আকাশ থেকে  প্রর্থনা সংগীত  শুনি 


ঠিক মৃত‍্যুর আগে জীবনে এক অনিবার্য সংকেত থাকে।

এ পৃথিবী চিরকাল গোপন ও রহস‍্যময়, উদাসীন, সারল‍্যের কিছু পুরষ্কার থাকে, গাছের প্রতিটি পাতায় ধরে রঙ, জন্মদিন  ফিরে ফিরে আসে

…………………...........



প্রিয়তমাসু

( কিশোর তব দুয়ারে আজি পরান মম জাগে )


তোমার নীরবতার ভিতর জেগে থাকে শিশিরবিন্দু

চোখের পাতায় ফুটে থাকে ভারহীন শব্দমালা 

তুমি আমার সেই তারা যাকে দেখে নাবিকেরা দিক ঠিক করে 


 কতদিন একসাথে কেটে গেল!  স্মৃতি ফিরিয়ে দেয় দুপাশের মেহগিনি গাছ, চেনা নদী, ধূলোমাখা পথ ,

পানগুমটি পেরিয়ে  এসে তোমাকে দেওয়া প্রথম প্রনয়-প্রস্তাব… মনে পড়ে?


আজন্ম-চেনা বাড়িতে এসে তুমি সরিয়ে দিলে সব ঝরাপাতা, সব ভূল ক্ষমা করে আশ্রয় দিলে তোমার স্তনের ছায়ায় 


আমি জানি, আমি তোমার ব‍্যক্তিগত পাখি,  যাত্রীবিহীন স্টেশনে শীতের অবেলার সাথী, কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে  চিরদিন বাঁশি হাতে প্রতীক্ষায় থাকা   নওল-কিশোর, যাকে ছাড়া  একদিনও থাকতে পার না তুমি… 

…………………........


আমার কবিতা


কবিতা লিখতে গেলে স্থিরতা চাই,

আলো ও জ‍্যোৎস্না চাই এমন কোন মানে নেই 


এ জীবন সন্দেহ আর অবিশ্বাসে ভরা 

মানুষ নিজের ছায়াকেও ভয় পায়, তবু

 আমরা সবাই জানি; চাঁদের কলঙ্ক

পূর্ণিমারাতেই বেশি প্রতিভাত হয়   

ছায়া দীর্ঘ হলে শৃগালের মত আমাদের ধূর্ততাও বাড়ে 


কবিতা লেখার জন‍্য এক গোধূলিবেলায়  আমি এক চন্ডালিকার হাত থেকে জল পান করেছিলাম, হারিয়েছিলাম নিকটজনের বিশ্বাস 


আমার কারো কাছে কিছু প্রমান করার নাই  

স্বাভাবিক নিয়মেই নদী পথ বদলায় 

 ম‍্যাজিকের মত ভালোবাসার নারী মিলিয়ে যায়, ফিরে আসে  


আমি জানি বিপুল অগ্নিদাহ নিয়েও কবিতা লেখা যায় 

কবিতা লেখার জন‍্য স্থির ও সংযত হতে হবে এমন কোন মানে নাই 


আমার কবিতায় সর্বনাশের ভিতর লেখা হয় সুখ  

 জমাট অন্ধকারে ফুটে ওঠে  ভেলভেটের মত কালো গোলাপ, শুধু  বেঁচে থাকার জন‍্য এক বিরল ও বিস্ফোরক ভালোবাসা 

……………………........


ভরা আশ্বিন


ভাদ্রও শেষ হয়ে গেল

যা কিছু অবহনযোগ‍্য তা ত‍্যাগ করাই ভালো 


নদী ভরন্ত, ভেসে যেতে নৌকা চাই 

চাই স্নিগ্ধ বাতাস, কমলা-কোয়া রোদ

কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে 

সূর্যস্তব করতে চাই ব্রাহ্মণের মত


সবুজ ধানের খেত, ফুল এসেছে সবে, গাছ ফলবতী হবে

সীমাহীন দিগন্তরেখা পেরিয়ে সব কথা ব‍্যপ্ত হবে রাত্রির  আকাশে 


অতীত প্রেমিকারা সুখে থাক

দিকভ্রান্ত নাবিক খুঁজে পাক হারানো কম্পাস


 আশ্বিনের ভরন্ত চিবুক আধফোটা শিউলির মত ছুঁয়ে থাক বুক 


যে ভালোবাসা একদিন হারিয়ে গেছল সে আবার ফিরে আসুক বাতাবি-লেবু-ফুলের গন্ধ নিয়ে আশ্বিন-সকালে 

………………….........


আত্মপোলব্ধি 


কোনদিন গায়ের উপর এমন আলো পড়বে ভাবতেও পারিনি


সন্ন‍্যাসীর পদপ্রান্তে এতদিন বসে থেকেও পায়নি

কোন শুভ সংকেত কেউ দাম দেয়নি চোখের জলের

একা একাই দিন কেটেছে এমনই কি ভবিতব‍্য ছিল?


উড়নচন্ডী জীবন ভুল মানুষের কাছে যায়, ভুল কাজ করে, উপেক্ষা করে আলোর ডাক পৃথিবী ঘুরছে


গ্রীষ্ম বেরিয়ে বর্ষা আসে, বর্ষা পেরিয়ে শরৎ,  একদিন আশ্বিনের প্রথম সকালে নন্দনকাননের অলিন্দে ফুল ফোটে, আয়নায় মুখোমুখি হই নিজের, পর্দা সরিয়ে জানতে পারি ভেতর বাড়ির গল্প 


তখন পাখির চোখ ফোটে, পাখি ডানা মেলে,পাখি উড়ে,পাখি গান গায় 


গুপ্তঘাতকেরা সর্পাষদ গুহার ভিতর ঢুকে গেলে, আমি নৌকা ভাসাই বাওরের জলে 

………………….




সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - নিজস্ব

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614







ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...