Tuesday 24 October 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৪১

 


রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ৪১

সিন্ধু পারে

মহাশ্বেতা দাস 


সুদূরের পিয়াসী মনকে অধরা রূপলোকে মিশিয়ে দেওয়ার  আকুলতা বার বার ফুটে উঠেছে রবীন্দ্র কবিতায়, গানে। ১৮৯৫ সালে শিলাইদহে বসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন - 


         "তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে,    

          তোমায়  দেখেছি মাধবী রাতে,

তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী।" 


রবীন্দ্র অনুরাগীদের মনে প্রশ্ন জাগে-কে এই বিদেশিনী? কাকে শারদ প্রাতে, মাধবী রাতে কবি হৃদয়ের মাঝে দেখতে পেতেন? সেই রমণী কি শুধুই কবির কল্পলোকের মানস প্রতিমা! নাকি বাস্তবের কোন প্রিয়া!!  


আগের পর্বেই বলেছি নোবেল প্রাপ্তির পর থেকে দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কবি আমন্ত্রণের পর আমন্ত্রণ পাচ্ছেন। বিশ্ববরেণ্য কবির সুদূর পিয়াসী মন তাই এখন বিশ্বপথিক। তাঁর মতে - 


  "যে জাতির চলার পাথেয় ফুরোল, চলার সাধনায় যার জড়ত্ব এল, সে জাতি তার গতির শেষে দুর্গতিতে এসে ঠেকল।" 


জাপানে থাকাকালীন কবি দক্ষিণ আমেরিকার পেরু রাজ্য থেকে সেখানকার স্বাধীনতা- শতবার্ষিকী উৎসবে যোগদানের আমন্ত্রণ পেলেন। তাই ভ্রমণ পিপাসু কবির উৎফুল্ল মন এবার চায় পেরু রাজ্যে পাড়ি দিতে। ৩রা সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা আসার সময় সেদিন সকালে মন্দিরে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বললেন- " মানুষ ঘরছাড়া জীব, মানুষ পথিক। …. সে যে চির পথিক। " 

    

১৯শে সেপ্টেম্বর কবি রওনা দিলেন। কবির এবারের বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গী পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী এবং তাদের তিন বছরের পালিতা কন্যা নন্দিনী। আর সঙ্গে চললেন সুরেন্দ্রনাথ। কলকাতা থেকে মাদ্রাজ হয়ে সিংহল কলম্বো পৌঁছবেন এবং সেখান থেকে জাহাজে চড়ে পাড়ি দেবেন দূর দেশে। 

    

এবারে বিদেশ ভ্রমণের আগে কবি ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় বিভিন্ন স্টেশনে গুরুদেব কে অভ্যর্থনার উপদ্রব অসহ্য করে তুলেছিল। তবু এই অবসন্ন শরীরেই দেখা মিলেছে কাব্যলক্ষীর….. বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে অমর সৃষ্টি "পূরবী" কাব্যগ্রন্থ ও "পশ্চিম যাত্রীর ডায়রি" নামক গদ্যগ্রন্থ।  


যেদিন কলম্বো পৌঁছলেন ওখানে তখন খুব বর্ষা। …" আকাশে ঘন মেঘ, দিগন্ত বৃষ্টিতে ঝাপসা, বাদলার হাওয়া।"   কলম্বো থেকে "হারুনা- মারু" জাহাজে চড়লেন সবাই ২৪শে সেপ্টেম্বর।  ক্রমে "আন্ডেশ্" জাহাজ আর্জেন্টিনার রাজধানী বন্দর বুয়েনোস এয়ারিশ এ এসে পৌঁছাল। অভ্যর্থনার অতিচার পেরিয়ে আগের থেকেই অসুস্থ কবি বেশ কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। এই পরস্থিতিতে যাত্রা করা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলো আর্জেন্টিনায় কিছুদিন থাকার। সদল- বলে কবি আশ্রয় নিলেন হোটেল প্লাজা তে। তখন কে জানতো যে এই অসুস্থতা, এই যাত্রাবিরতি রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে দেবে তাঁর কল্পলোকের আরাধ্যা বিদেশিনীকে! আর্জেন্টিনার  হোটেল প্লাজাতে সহযাত্রী ও সেক্রেটারি লেনার্ড এলমহার্স্টের সাথে আছেন রবীন্দ্রনাথ…… ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কোনোভাবেই এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননা। তাই সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠে একদিন রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করা জন্য হোটেল প্লাজাতে চলে এলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো৷ ভিক্টোরিয়ার সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর এলমহার্স্ট তাকে রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেন। দেখা হলো  চৌত্রিশ বছরের  ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে তেষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথের। 


    ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো….. ১৮৯৯ সালের ৭ই এপ্রিল বুয়েনস আইরিশ এর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। ১৯১২ সালে নিজের পছন্দের পুরুষ বার্নাডো এস্ত্রাদার কে বিয়ে করলেও বৈবাহিক সম্পর্ক মধুর হলো না। ১৯২১ সালে স্বামীর ঘর ছেড়ে প্রেমিক মার্তিনেথের সাথে বসবাস শুরু করেন। এর মাঝেই ভিক্টোরিয়ার মননশীল সাহিত্যপ্রেমী মন ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতে শুরু করে দেয়। সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যের সাথে নিগূঢ় পরিচয় এই বিদুষী রমণীর। তবু মনের খিদে মিটছে না…. খুঁজে পাচ্ছেন না কোন লেখকদের লেখায় তাঁর কাঙ্খিত প্রত্যয়ের মাটি। তবু চালিয়ে যাচ্ছেন সাহিত্যচর্চা। আর এই সাহিত্যচর্চার পথ ধরেই ১৯১৪ সালে ভিক্টোরিয়ার হাতে এসে পড়ে আন্দ্রে জিদের অনুবাদে "গীতাঞ্জলি" কাব্যগ্রন্থ। ব্যাস্ গীতাঞ্জলি'র সুরের আগুন জ্বলে উঠলো এই স্প্যানিশ রমণীর মনেপ্রাণে। ক্ষত বিক্ষত বিবাহিত জীবনের অপমান যন্ত্রণার আঁধারে ডুবে থাকা এই রমণীর মনের বাগানের মরা গাছের ডালে ডালে সুরের আগুন নেচে উঠল…. সে আগুন ছড়িয়ে পড়লো সবখানে। ভিক্টোরিয়া আকাশে হাত তুলে যেন কার অপেক্ষায় থাকলেন! রবীন্দ্রসাহিত্যে আপ্লুত নূতন পথের দিশা খুঁজে পাওয়া ভিক্টোরিয়া লিখলেন….. 

 "Reading Tagore, Thinking of Tagore, waiting for Tagore". 


 সেই অপেক্ষার অবসান হলো দীর্ঘ দশ বছর পরে এমনই অপ্রত্যাশিত ভাবে। মুগ্ধ বিস্ময়ে সাহিত্যের আঙিনায় দেখা মানুষটিকে এবার ভিক্টোরিয়া দেখলেন পার্থিব জগতের আলোয়। স্প্যানিশ রমণীটি দেখলেন ঊনত্রিশ বছরের বড়ো পুরুষটির নির্ভাজ কপাল, সৌম্য, শরীরে হিরন্ময় দ্যুতি। মুহূর্তে মুছে গেল সমস্ত বিভেদ রেখা। প্রেম দেখাদিল সমারোহে। 


     " জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,

       বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে ॥" 

                  ………………….. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...