Sunday 16 July 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ১ // ই-কোরাস

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ১

সরলা সিনেমাহল, গৌরা

শ্রীজিৎ জানা


সিনেমাহল নিয়ে লিখতে বসলুম জুলাইয়ে। তালা বন্ধ প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে টুকরোটাকরা কথা। জুলাই মাস আর সিনেমার কথা মানেই বাঙালির মনে সঘন বরিষণ। সিনেপ্রেমীদের নস্টালজিক করে দেয়। তারিখটা চব্বিশে জুলাই, সাল ১৯৮০, মহানায়কের মহাপ্রস্থান। অগুন্তি বাঙালিকে কাঁদিয়ে রুপোলি পর্দার নায়ক উত্তম কুমার চলে গেলেন দিকশূন্যপুরে। অমন রোমান্টিক চেহারা, মায়াবী চাহুনি, দ্যুতিময় হাসি আর চাবুকের মতো অভিনয় বাঙালিকে মাত করে দিয়েছে। ব্লাক এন্ড হোয়াইট যুগ পেরিয়ে আজকের থ্রিডি এরাতেও তাঁকে টক্কর দেওয়া বড্ড মুশকিল। কিন্তু কথা তো সিনেমাহল নিয়ে হওয়ার ছিল, তবে আচমন পর্বে এত লম্বা ফিরিস্তি কেন বাপু! আসলে যে সিনেমাহলের কথা বলব তার পথ চলা শুরু এই জুলাইয়ে।  মানে হল মহানায়কের মহাপ্রস্থান তিথিতে 'সরলা সিনেমাহল' [গোবিন্দনগর (গৌরা), দাসপুর,পঃ মেদিনীপুর] এর শুভারম্ভ। যদিও প্রদীপ জ্বালবার আগে সলতে পাকানোর একটা পর্ব থাকে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে কেন! অর্থাৎ কিনা সতের জুলাই থেকে শুরু হল ট্রায়াল পর্ব। এই পর্বে দেখানো হল "সাধক কমলাকান্ত" সিনেমা। সাতদিন ধরে দর্কদের বিনা টিকিটে প্রেক্ষাগৃহের দরজা খুলে দেওয়া হল। আর সেই নতুন 'সরলা সিনেমা হল' কে নিয়ে এলাকা ছাড়িয়ে দূরদূরান্তের জনমানসে একটা আনন্দ উত্তেজনার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল। সাড়ম্বরে চালু হল সিনেমাহল। চব্বিশে জুলাই পর্দায় দেখানো হল রঞ্জিত মল্লিক,অপর্ণা সেন অভিনীত  সিনেমা "অজস্র ধন্যবাদ"।


 আজ থেকে চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর আগের গৌরা কেমন ছিল! নিশ্চয়ই এখনকার মতো এত জমাটি বাজার, দোকানপাট ছিলা না নিশ্চয়। এলাকার অনেক বয়স্ক মানুষজনের মতে ব্রিজের দক্ষিণ পাশের বাজার ও দোকানপাতি গড়ে ওঠার পিছনে বড় অবদান ছিল সিনেমাহলের। তখন ঘাটাল-পাঁশকুড়াগামী সিঙ্গেল ওয়ে পিচ রাস্তা। ব্রিজের উত্তরদিকে ছিল গৌরা বাসস্ট্যান্ড আর দক্ষিনে সিং পাড়া মতান্তরে দোকানগড়া বাসস্ট্যান্ড। কিন্তু সরলা সিনেমাহল চালুর পর থেকেই চিত্রটা গেল বদলে। দোকানগড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বেশ কিছুটা হেঁটে সিনেমাহলে যেত হত। ফলে দর্শক-যাত্রীদের চাপে হলের সোজাসুজি রাস্তার ধারে গাড়ি থামতে শুর করে। আর সেই থেকেই বাসস্ট্যান্ডের নাম হল "সিনেমা হল মোড়" বা "সিনেমা মোড়"। অদ্যাবধি সেই নামেই বাসের কন্ডাকটর ছুটন্ত বাস থেকে যাত্রী সাধারণের উদ্দেশ্যে হাঁক দেয়,"সিনেমা মোড়", "সিনেমা মোড়"।


শুধুমাত্র ওই হাঁক টুকুর ভিতর বেঁচে আছে সেদিনের "সরলা সিনেমাহল" -এর স্মৃতি। নতুন প্রজন্ম জানেনা একদিন ম্যাটিনি শোয়ে ওই হলের কোনার সিটে দুটি হৃদয় বাঁধা পড়েছে নতুন সম্পর্কের বন্ধনে। স্কুল পড়ুয়া তরুণ, কলেজ পড়ুয়া যুবক ইয়ারদোস্ত নিয়ে অনেক চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঝুপ করে ঢুকেছে হলের ভিতর। টিকিট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন।  হাউসফুল শো।  ব্ল্যাকাররা টিকিট ব্ল্যাক করেত তৎপর। দর্শক চড়া দামে সেই টিকিট নিতে মরিয়া। তা নিয়ে তুমুল বাকবিতন্ডা। এরকম কত স্মৃতি জমে আছে গোবিন্দনগরের মানুষ, মহকুমার বিশিষ্ট কবি নিমাই করণের মনে। স্কুল পড়ুয়া নিমাই করণ স্কুল থেকে শিক্ষামূলক সিনেমা দেখতে আসেন "পথের পাঁচালী " ছায়াছবি। পরে কলেজ জীবনে একাধিক বার সিনেমা দেখেছেন 'সরলা'য়। তাঁর কথায়," এই হলে মহিলা দর্শকের সংখ্যা বেশি হত। আর একটি স্থানীয় ভাবে বিশেষ ঘটনা ঘটত এই হলকে কেন্দ্র করে। তখন এত ঘড়ির প্রচলন ছিল না। চাষী মজুরদের কাছে তো নয়-ই। তাই মাঠে ঘাটের জন মজুররা যেই দুপুরের শোয়ের মাইকের শব্দ পেত অম্নি কাজ ছুটি করে নিত। মানে হলের মাইক ছিল তাদের কাজ ছুটির টাইম -ঘড়ি"।


"সরলা সিনেমাহল" এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রী নিমাই মান্না। পিতা স্বর্গীয় কুঞ্জবিহারী মান্না। মাতা স্বর্গীয়া সরলা দেবী। মায়ের নামেই সিনেমাহলের নাম রাখেন "সরলা সিনেমাহল"। নিমাই বাবু তখন বেকার যুবক। হাতে মাত্র কুড়ি হাজার টাকা সম্বল। অন্যদিকে কিছু একটা করে রোজগার করার তীব্র জেদ। তৎকালীন সময়ে বেকার যুবকদের ব্যবসার জন্য দেওয় হচ্ছিল 'বেকার লোন'। একটা ঝুঁকি নিয়েই ফেললেন নিমাই বাবু। লোন পেলেন পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা।  ইঁটের দেয়াল গেঁথে পিচের তৈরী অ্যাসবেস্টাস চাপিয়ে তৈরী করলেন বাড়ি। সিট বসানো হল। জেনারেটর আনা হল। পুরুষোত্তমপুর থেকে ভাড়া করে আনা হল প্রোজেকশন মেশিন। শুরু হল সরলা সিনেমাহলের যাত্রা। সিনেমার ব্রোকার ছিলেন খড়ার নিবাসী প্রদ্যোৎ পাঁজা এবং নিমাই পাঁজা। তাঁদের মারফত কলকাতার স্যাকলেথ প্লেস (ধর্মতলা) থেকে ছবি আসত। তখন হলে স্টাফ ছিলেন ১৭- ১৮ জন। চিফ্ অপারেটর ছিলেন বিমল পট্টনায়ক ( চাকদা)। 


কথায় কথায় দেখা হয়ে গেল সেদিনের স্টাফ বিশ্বনাথ ভূঞ্যা ওরফে কুচাদার সাথে। সিনেমা হলের কথা বলতেই আবেগতাড়িত হয়ে যান। বলেন,"গেটে থাকতাম আমি। তখন হলের রমরমা বাজার। তিনটা আর ছটার শো প্রায় দিন হাউস ফুল থাকত। একটা করে হপ্তায় পাশ পেতম। তারপর টিভির বাজার এল। হলে লোক কমতে লাগল। বাধ্য হয়ে অন্য কাজে লেগে গেলম"। হল মালিক নিমাই বাবু জানান, "হলে আটশ সিট ছিল বসার। ফ্রন্ট, মিডিল আর ফার্স্ট মিলিয়ে তিনটে রো। শুরুতে ফ্রন্টের টিকটি মূল্য দেড় টাকা, মিডিল দু'টাকা আর ফার্স্ট ক্লাসে ছিল সাড়ে তিন টাকা। এক একটা ছবিতে হাউসফুল হত শো। ব্যালকনি ছিল না। বাধ্য হয়ে ছাদের নীচ থেকে দেয়ালের গায়ে রেকের মতো করে বসার ব্যবস্থা করেছিলাম"। 


তবে ভাড়া করা প্রোজেক্টর দিয়ে বেশিদিন সিনেমা চালানো হয় না। তার মাঝেই  শ্যামবাজার থেকে আনা হয় নতুন প্রোজেক্টর মেশিন। একই সাথে সবং থেকে নিমাই বাবুর বাবা একটি পুরানো মেশিনও কেনেন। সেই দুটোতেই ছবি দেখানোর কাজ চলতে থাকে। বিরতিতে স্লাইডে বিজ্ঞাপন দেখানো হলেও তা খুব কম ছিল। ছবির প্রচার করতেন নিজামপুরের গোপাল প্রামাণিক।  সাইকেল এবং টলির পিছনে বাঁশের চাঁচে পোস্টার সেঁটে মাইকে চলত প্রচার। 'খেলার পুতুল','পুতুলের প্রতিশোধ', 'ছোটবউ' প্রভৃতি সিনেমা সরলা হলে সর্বোচ্চ পাঁচ সপ্তাহ ধরে চলে।

মাঝে ঝড়ে হলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। চাল ভেঙে পড়ে। তখন পিচের অ্যাসবেসটস বদলে টিন চাপানো হয় ছাদে। সাউন্ড সিস্টেমকে নতুন করে সেটিং করা হয়। কিন্তু কয়েক মাস হল সেভাবে চলে না। ধারদেনা করে ছবি আনতে হয়। তার উপর অতগুলো স্টাফের বেতন। চাপে পড়ে হল বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন নিমাই বাবু। এমন সময় বেশ কয়েকটা ছবি দর্শককে হলমুখী করে। হাউসফুল হতে থাকে শোয়ের পর শো। আবার রমরমিয়ে চলতে থাকে সিনেমাহল। 


কিন্তু ইতিমধ্যে বিনোদনের অন্য মাধ্যম গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। চৌকা বাক্স গৃহবন্দী করতে থাকে সাধারণকে। দর্শক আসন ফাঁকা পড়ে থাকে। লসে রান করতে থাকে হল। বাধ্য হয়ে বন্ধ হয়ে যায় "সরলা 'সিনেমাহল'। প্রায় দুহাজার-দুহাজার এক  নাগাদ সিনেমা হলে পুরোপুরি তালা পড়ে যায়।তবে এখনো গেলে দেখতে পাওয়া যাবে 'সরলা সিনেমাহল'। কিন্তু তার পরিচয় এখন সে "সরলা ভবন"। বিভিন্ন উৎসব,অনুষ্ঠান, মিটিংয়ের জন্য তাকে ভাড়ায় দেওয়া হয়। কাজের প্রয়োজনে নতুন করে ভাঙাগড়া হয়েছে কাঠামোকে। হয়তো আজও দেয়ালে  কান পাতলে শোনা যাবে সেদিনের  আলো আঁধারি হলে ভিড় করা দর্শকদের সিটির আওয়াজ। করতালির শব্দ।


কৃতজ্ঞতা :—

নিমাই মান্না  (গৌরা)

নিমাই করণ  (গৌরা)

মনোরঞ্জন মান্না ( গৌরা)

বিশ্বনাথ ভূঞ্যা  ( গৌরা)

             …………………….. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...