Saturday 24 September 2022

দেবীপক্ষ : নারী শক্তি // ই- কোরাস ৭৫

 



বাজাও আলোর কণ্ঠবীণা 

রত্নদীপা দে ঘোষ

ছোটবেলার পুঁচকে চোখে মনে হয়েছিল পাঠ করে শেষ করা যায় না এমন পাঠশালা। কুয়াশাআঁকা বাতাস!  মাখামাখি কাশফুল! স্নেহপেন্সিল, নামতারোদ! ঝিলমিল হাসিফ্রক! পঙক্তিগুলি সাদাচুমকি আর লালচুমকির ঘেরাটোপ। বাঁধহীন আনন্দনদী। 

কিশোরীকালে দেবীপক্ষের সবুজশাড়ি। প্রতিমা রূপে মহামায়া। লাল আঁচলটি যেন  মহাকাশের রংতুলি। প্রথম প্রেমে পড়ে তখন আমি বিরহে কাতর, মনে হোল, মা বুঝি আমার মতোই সাধারণ মেয়ে। অভিমানী! চোখের কোলে সরোবরের ছোঁয়া, ঢেউবরফ!  


এরপরে ধীরপায়ে যৌবনপক্ষ। দেবী সূর্যসম্ভবা! অজস্রদীপ্ত। পৃথিবী যেন তাঁর দূর্দান্ত প্রতাপে জড়সড়। লাটাইয়ের সুতোর টানে দূরঘুড়িকে তিনিই ফিরিয়ে আনছেন এই দু’পয়সার সংসারে। তাঁরই স্পর্শে উদ্বেলিত হচ্ছে বসুধার পাকস্থলী হাড়মজ্জা মেদরক্ত। মানুষ যেন দিশেহারা। এই প্রবল শক্তিমতীকে উপাসনা পরায় কোন স্বরে? যুবতী আমিও তটস্থ! এর আগে দেবীপক্ষ শুনেছি অনেকবার, কিন্তু এমন মূর্তিমতী জোছনাদার বৃহৎ নারীস্পর্ধা তো দেখিনি! 


এখন দেবীপক্ষ প্রতিদিন! প্রদীপ নয়, সর্বাঙ্গে  বুনসেন-বার্ণার। তিনি আসেন বুনোমোষকে রক্তাক্ত, বাগে  করতে। কৃষ্ণচূড়ার তলোয়ার হাতে, পুষ্টডানায় ভর দিয়ে উড়ে উড়ে! মোমবাতির তৈরি মেরুদণ্ড তাঁর, উৎসর্গপত্র চোখের আকার! বৃহস্পতির রশ্মিবীণা তাঁর কণ্ঠের ভ্রূকুটি। প্রার্থনা, তিনি আসুন  বছর-বছর, তাঁর বুকভরা আশীর্বাদী ডাকবাক্স, চিঠিলেখা  মৃদুল-সজল হারমনিকা, আমাদের যেন শস্ত্র শেখায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের। 


প্রপিতামহের আশীর্বাদ তিনি। হঠাৎ খসেপড়া তারাদের ঠোঁটে উত্তুরে শরৎ।  বিধাতা যেন উজ্জ্বল চন্দ্রমা, আশা নিয়ে আসেন তিনি ধূ ধূ হতাশাপ্রান্তরে। 


মহাকালের জীবনচক্র ফুরিয়ে গেলেও দেবীপক্ষ  বারবার। যতদিন না মানুষের মনে ফুটন্ত কাশফুলের বানান। ধূলাখেলার রাতে মানুষঘুমের মধ্যে জোনাকির অন্ত্যমিল, সূর্যমুখীর কোরাস,ক্ষমার স্বরবর্ণ!

…………………............



দেবীশ্রেষ্ঠা আমার নীলা, একজন রত্নগর্ভা

তাহমিনা শিল্পী

আমার চোখে প্রত্যেকজন নারীই এক একজন দেবী। কেবল নির্দিষ্ট একটি পক্ষে বা সময়ে নয় বরং আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রতিটি মুহূর্তই নারীকে সংগ্রাম করেই বাঁচতে হয়। প্রত্যেক নারীই প্রতি মুহূর্তে কোন না কোন অন্যায়, অশুভ কিংবা অসঙ্গতির সাথে সংগ্রাম করে। সমাজ-সংসার স্বীকার করুক বা না করুক সেই সংগ্রামে কোন না কোনভাবে নারীরই জয় হয়। তাই একজন নারী হিসেবে দেবীপক্ষে আমি নিজেও অবচেতনভাবে দেবীরূপে সেজে উঠি। কেননা প্রতিমুহূর্ত আমিও কত সংগ্রামের মুখোমুখি হই। কত কায়দা-কৌশলে যুদ্ধ করি,জয়ী হই।


দেবীপক্ষ মানে অসুরের বিরুদ্ধে দেবীর সংগ্রামের পক্ষ, সংগ্রামে দেবীর জয়ের পক্ষ। আজ তাই আমি একজন দেবীশ্রেষ্ঠার কথা বলবো, যিনি আমার দেখা সর্বকালের সেরা, সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মসম্মানী এবং জীবন যুদ্ধে ভীষণভাবে সফল ও বিজয়ী একজন নারী। তিনি জীবন সংগ্রামে কাউকে পাশে পাননি। ঢাল- তলোয়ারহীন নির্ভিক সৈন্য রূপ  তিনি লড়েছেন, একদম একা।


দেবীশ্রেষ্ঠা, নীলা। তাঁর সংগ্রাম শুরু হয়েছিল বেশ অল্প বয়স থেকেই। ঠিক যখন তার মস্তিষ্কের গভীরে বোধ ও বিবেচনার জন্ম হয়েছিল। তখনই তিনি বুঝেছিলেন মেয়ে হলেও বড় সন্তান হিসেবে অসুস্থ বাবার অসহায় হাতটা ধরে সাহস দিতে হবে। মায়ের আস্থা এবং নির্ভরতা হতে হবে। ছোট সাতটি ভাই-বোনের দায়িত্ব তাকে বহন করতে হবে। নদীভাঙনে ভিটে,জমি হারানো পরিবারকে এক চিলতে ভিটে খরিদ করে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা তাঁকেই করে দিতে হবে। পড়াশুনা চলমান রেখে দিনরাত এক করে হাড়ভাঙা শ্রমের বিনিময়ে প্রতিটি দায়িত্ব পালন করে এই যুদ্ধে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন।


দেবীশ্রেষ্ঠার বিয়ের পর শুরু হয় আরেক সংগ্রাম। চাকরি চলমান রেখে বাবা ও স্বামীর দুই পরিবারে যতটুকু সম্ভব আর্থিক সাপোর্ট দেবার পাশাপাশি শশুরবাড়ির ছোটবড় সকলের চাহিদামত কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করে সকলের মন জয় করার প্রাণপণ লড়াই করছিলই। তার উপর পরপর তিনটি কন্যা সন্তান জন্মের দায়ে যখন পলে পলে লাঞ্চিত হচ্ছিল। তখন তিনি ঘুরে দাড়ালেন নতুন সংগ্রামের প্রত্যয়ে।


পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, তিনকন্যাকে নিয়ে সাজালেন সুখের সংসার। মিথ্যের ফুলঝুড়ি, অহেতুক অপমান গায়ে না মেখে,আপন আলোয় প্রদীপ জ্বালালেন। আপোষ নয়,বরং আত্মসম্মানে, সাহসে, সংগ্রামে বাঁচার সবটুকু বিদ্যা শেখালেন কন্যাদের। তথাকথিত সমাজকে বুড়ো আঙ্গুলি দেখিয়ে কারোর কোনরকম সহযোগিতা ছাড়াই এককভাবে তিনকন্যাকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। এবার সেই সমাজ,সেই পরিবারই তাঁকে বাহবা দিয়ে রত্নগর্ভা বলছে,সম্মান করছে।


আমার দেবীশ্রেষ্ঠার এই সংগ্রাম, এই বিজয় যেন অসুর বধের-ই প্রতিকী রূপ।তাই আমি তাঁকে পরম শ্রদ্ধায় হৃদয়ের সর্বোচ্চ আসনে বসিয়ে কুর্নিশ করি।তাঁর মঙ্গল ও সুস্থতা কামনা করি। আমার দেবীশ্রেষ্ঠার সবটুকু সাহস, ধৈর্য, আত্মসম্মান ও মনোবলকে সৃষ্টিকর্তা যেন প্রতিটি নারীর মনে প্রতিস্থাপন করেন।প্রতিটি নারীই হয়ে উঠে একেকজন দেবীশ্রেষ্ঠা,সেই প্রার্থনাই করি।

……………..................


ছেঁড়া পাতা

জয়া গুহ

খুঁদকুড়ো জীবনের ঝোঁকে পরমান্নের মত জুটে যায় লতাকলমীর স্বাদ। উপোসি পেটে উবুড় করা সানকি-ভাত। লাল রেখা ধরে পাহারাদার পিঁপড়ের দল, ছিনিয়ে নেওয়া নেই কারো থেকে, ভাগ-বাঁটোয়ারা সেরে নেবে যে যার মত। ঝাঁকি মেরে সানকি থেকে ঠুকে নামাবে খুদেদের, আবার ফাঁকফোকর বুঝে লাইন লাগাবে নিরুত্তাপ একবগ্গার দল। এই অদ্ভুত সমঝোতায় হাততালি দিয়ে বলে উঠি " হা! অপূর্ব খিদে, শুধু তোমার জন্য ভাগাভাগির পৃথিবী আর লাঠিবাজদের রমরমা"।

তাবৎ অহংকারকে ফুসমন্তরে ফুটপাথে নামাও তুমি, বুনো মানুষের দ্বীপে ভেলা ভাসিয়ে অনায়াসে কাঁচা মাংস দাঁতে ছিড়ে নিয়েছিলাম কতবার শুধু তোমার নির্লজ্জতায়। এখন আমার দুহাতে ধুলোবালি, কেটে ছিঁড়ে একসা, গায়ের জামায় তিলা পড়া, স্যাঁতসেঁতে, ফুটো অগুনতি, মুখে বলিরেখা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম কেটে যাচ্ছে আর আমি ঠায় কাড়াকাড়ি করে তিনমাথা এক করে এঁটো কাটায় উদরপূর্তি করছি। পিঠে কালশিটে, খোসপাঁচড়া। তুমি সমাজতত্ত্ব ঘেঁটে উদ্ধার করবে আমায় ভাবছো, ভেবেই চলেছো। এখন প্রশ্ন হল

তুমি কে? আর আমিই বা কে? তুমি শিক্ষা-সমাজ- মানবতা আর আমি? তোমাদের সক্কলের ঘুণপোকা ধরা বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। সবকিছুর ভিড়ে কাশফুল মাথা নাড়ে, সবকিছুর ভিড়ে মানুষ তার নিজস্বতা খুঁজে চোখ ধাঁধানো আলোর মাঝে।      

……………....................


দেবীপক্ষ

ড. অন্তরা ঘোষ

অভিনিথি,নবচেতনার এক ফিনিক্স পাখি।যে পাখিটা ডানা মেলে উড়তে চাইতো আপনগতিতে।মিথ্যে কুসংস্কারের বেড়াজালকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতো মনের জোর তার যথেষ্ট ছিল।

অভিনিথির দেশের বাড়ির দুর্গাপুজো বোলপুরের খুব নামকরা পুজো।সেই পুজোতে অর্পণসহ আরো দুজন বন্ধু সৌমিক ও ইরাবান আসতে চেয়েছিলো।

কলকাতায় পড়তে গিয়ে অনেকের সাথে আলাপ হয়,বন্ধুত্ব হয়,সেটা গাঢ় রঙ নেয় কিছুদিন পরেই।

বন্ধুত্বের ব্যাপারে অভিনিথি খুব দিলখোলা।ইউনিয়নের বখাটে ছেলেটা থেকে ক্লাসের মুখচোরা সন্দীপন সবাই অভিনিথির বন্ধু।

মেয়েদের কাছে ও হেসেহেসে বলে,"আমার নামের অর্থই হলো 'বন্ধুত্ব'।তো তা সার্থক করার পেটেন্ট তো আমাকেই নিতে হবে বল?"

সত্যিই নিখাদ বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রেমে পৌঁছলো অর্পণের সাথে।কীভাবে যেন!

অনেক ছোট ছোট মুহূর্তকথা অর্পণ আর অভিনিথির সম্পর্কে সেতুবন্ধনের কাজ করেছে।

সেইজন্যই নির্দ্বিধায় অভিনিথি মহালয়ার ভোরে  বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পড়েছিলো।

দুটো বাইকে চারজন যখন চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো,তখন দাদুর ঘর থেকে রেডিওতে "বাজলো তোমার আলোর বেণু" শুরু হয়েছে।কেয়ারটেকার গুলাটি দাদুকে আগের রাতেই অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছিলো অভিনিথি।তাতেই আজ ভোরবেলা কোপাইয়ের তীরে বসে সূর্যোদয় দেখার সুযোগ হয়েছে।

কিছুটা অন্ধকার এখনো রয়েছে।

অভিনিথির হাতে একটা লালপাড় সাদা গরদের শাড়ী তুলে দিলো অর্পণ,আর একগোছা কাশফুল।সৌমিক ব্যাগ থেকে একটা DSLR বের করলো।অভিনিথি পরে আছে একটা ব্লু জিনস আর রেড টপ।

একটা মিষ্টি গন্ধে চারপাশটা ভরপুর।ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে প্যাকেট খুলে খানিকক্ষণ শাড়ীটার গন্ধ নিলো সে।

তারপরই কেমন ঘোরঘোর ভাব।মগ্ন চৈতন্যের গভীরে যেতে যেতে অভিনিথি শুনতে পেলো ইরাবানের গলা,"তোরা দুজন এসব নোংরা প্ল্যান করেছিস জানলে আমি কখনোই অভিনিথিকে এখানে আসতে দিতাম না।"

―"নিরিমিশ থাকতে চাইলে ক্যামেরার পিছনে যা ব্রো।আমাদের দুজনকে একটু মজা নিতে দে।

কোপাইয়ের তীরে এমন দেবী আরাধনার সুযোগ কস্মিনকালেও কেউ পায়নি রে ভাই।"সৌমিকের গলাও শুনতে পাচ্ছে অভিনিথি।কিন্তু হাত পা শরীর কেমন ঝিম ধরা অসাড়।ইরাবানকে বেঁধে ফেললো ওরা ওরই জামা খুলে ।মুখে ভরে দিলো বাইকে গুঁজে রাখা নোংরা কাপড়ের টুকরো।

অভিনিথি কী মরে যাচ্ছে?

নইলে এমন নিস্পৃহ হয়ে পড়ে আছে কেন?

অভিনিথির টপটা আলতো আদরে খুলে নিলো অর্পণ।কোনো তাড়া নেই।অখন্ড অবসরে যেন মিলনাভিসারের আয়োজন।চোখের পাশ দিয়ে নোনতা সমুদ্র অভিনিথির।

সৌমিকের ক্যামেরায় বন্দী হচ্ছে   আবছা মুহূর্ত।

হঠাৎ স্থির হয়ে গেল অভিনিথির মনিকর্ণিকা।চোখ বন্ধ করে ফেললো সে সামনে দাঁড়ানো দুই আলিঙ্গনাবদ্ধ পুরুষের নগ্ন মূর্তি দেখে।

একটু দূরেই ইরাবানের গোঙানির আওয়াজে কান্না মিশছে ক্রমশ।

এদিকে অভিনিথির পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে দুটো নগ্ন পশু।মুহূর্তের মধ্যেই পিছন থেকে ভারী কিছুর আঘাত পেয়ে তারা দুজনেই আছাড় খেয়ে পড়লো অভিনিথির ওপরেই।

গলা চিরে বেরিয়ে এলো আর্তনাদ!

কিছুক্ষণ ছটপট করে দুটো শরীরই স্থির হয়ে গেল।

চোখ খুললো অভিনিথি।

আবছা অন্ধকারেই দেখতে পেল কয়েকটা লালপাড়,সাদা শাড়ি।

―"ই তো মোদের ডাকতর বাবুর বিটি বঠে।"

―"আর ল্যাংটাদুটা কুথাকার জন্তু বঠে ? ইখানের ত লয়!"

―"হিথাকে দ্যাক ক্যানে,একটা মরদ ক্যামন বাঁদা পড়ি আছে।

শাড়ির আঁচলে কাড়ান ছাতু সামলে স্থানীয় সাঁওতাল রমণীরা যখন লাল শাড়িটা জড়িয়ে অভিনিথিকে ধরে তুলে দাঁড় করালো, পুবের আকাশে তখন লাল সূর্যটা মা দুর্গার কপালের লালটিপের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

ইরাবান দেখলো,অভিনিথি নিজের শরীরের শেষ শক্তিতে  পা দিয়ে অচেতন দুটো নগ্ন শরীরকে ঠেলে সরিয়ে চিৎকার করে উঠলো,

―"আজ দেবীপক্ষ!".

.................................





দেবী পক্ষ

মিঠু মণ্ডল

মানবজাতির লিঙ্গ বিভাজন অনুযায়ী পুরুষ ও নারী দুই ভাগে বিভক্ত। উভয়েই সৃষ্টির পরম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এবং একে অপরের পরিপূরক। পুরুষ যদি একটি সভ্যতা ধারণ করে, তাহলে নারী সেই সভ্যতার বাহক। প্রত্যেক নারী এক একজন ত্রিনয়নী, অর্থাৎ দেবী। এই দেবী সংসার, সমাজ তথা দেশের একটি বলিষ্ঠ স্তম্ভ। আর এই দেবীর বিশেষ কোনো তিথি বা পক্ষ নেই। প্রতিমুহূতেই ভীষণ প্রয়োজনের। পৃথিবীতে এই দেবীর গুরুত্ব অপরিসীম। এবং দেবী ব্যাতিত সৃষ্টিও অকল্পনীয়।

ভারতীয় ঐতিহ্যে নারীকে দেবীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। যে কাল্পনিক অসুর বধে পৃথিবীর পুনরুত্থানের হোতা।  সংসারে দেবী তার প্রজ্ঞা ও ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখে সবকিছু।

ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনতম ঐতিহ্য সিন্ধু সভ্যতার সময় কাল থেকে পাওয়া যায় বিভিন্ন নিদর্শনে দেবীর ভূমিকা। আবার তারই অমর্যাদার ব্যাপক অবমাননা দেখা যায় আদি মধ্যযুগের সময় থেকে। বৌধিক সভ্যতার স্থান যখন থেকে পেশী শক্তির দখলে, তখনই সভ্যতার ধারক নারীত্বের তুলনায় পৌরুষ হয়ে উঠলো অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায় অপব্যবহারে এই ব্যাপক সম্ভাবনাময় শক্তিকে পিছনে রেখে সামগ্রিকভাবে একটি সভ্যতাই পিছিয়ে পড়লো নিশ্চিতভাবেই।

নারীরা দেবীর ক্ষমতার সাথে নিজেদের ক্ষমতায়নে একাত্ম বোধ করেন। দেবী পুজো তাই নারীদের কাছে খুবই কাঙ্খিত। কিছু মানুষ ধর্ম ও প্রথার দোহাই দিয়ে নারীকে আগলে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে নিরন্তর।

পুরুষের পেশী শক্তির ব্যাবহার তথা দানবীয় শক্তি প্রয়োগ থেকে গেছে বহুলাংশে। পাশবিক শক্তি আস্ফালন, হুঙ্কার, চোখরাঙানি ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। কোনো কালেই একা জয়লাভ করেনি পুরুষের তরবারি। তাকে সাহস, শক্তি, প্রেরণা দিয়েছে কোনো এক নারী। পিতৃ তথা পুরুষ পক্ষ, নারী তথা দেবীপক্ষের তর্জমায় না গিয়েও বলা যায় ভালোবাসাটাই সব থেকে জরুরী।

মিষ্টি রোদের উঁকি ঝুঁকি, আবহ মনোরম থাকলে স্বপ্ন দেখা যায় অনায়াসে। মাটি ফুঁড়ে যদি সময় সামনে এসে দাঁড়ায় তার ক্ষতবিক্ষত মুখ তুলে, তাহলে সন্ধে নামা একলা পথে কতটাই আর হেসে ওঠা যায়! তখন পক্ষ যাই হোক না কেন, বিষন্নতা স্থির হয়ে থাকে চারপাশে। আর মনখারাপ শেষে শুরু হয় এক অসুস্থ দিনের উৎসব।।

…………………...........



বোধন

শুভশ্রী নায়েক

ফোনের ওপার থেকে নির্দেশ এসেছিলো পরের দিন বাড়ি যাওয়ার জন্য। সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া মেয়েটি ভীষণ বাধ্য। যথারীতি নির্দেশ পালন করে বাড়ি ফেরে মেয়েটি। ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসার কথা জানতে পারা গেলো বাড়িতে ঢোকার পর। সেই বারের দূর্গা পুজোটা এসব নিয়েই কাটলো মেয়েটার। পনেরো টা দিনের ব্যবধানে পাকা কথা, তার পনেরো দিনের ব্যবধানে বিয়ে। লেখা হয়ে গেলো ভবিতব্য। বিয়ের এক একটা জিনিস, বাবা মা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী মেয়েটির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে পেয়ে গেলো কন্যা দায়ভার থেকে মুক্তি।

শুরু হলো নতুন করে সামঞ্জস্য সাধনের প্রয়াস। পরিবেশের সাথে অভিযোজনের যে সূত্রটা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ ছিলো, একটু একটু করে শুরু হলো তার সাথে সখ্যতা। অসম্ভব দ্বন্দ্ব আর ডুব সাঁতারে অনভিজ্ঞতার সুনামির সূত্রপাত। এ ও একধরনের বোধন। অকাল বোধন। দায়িত্ব আর কর্তব্য বোধের পঠন-শৈলী। আজও ফোনের ওপার থেকে নির্দেশ আসে। তবে বাড়ি ফেরার বার্তা নয়, মানিয়ে নেওয়ার বার্তা। অস্ফুট স্বরে আজও সম্মতি স্বর শোনা যায়। শুধু বদল এসেছে ভাবনায়।  মুক্তির সুখ খোঁজার ক্ষীণ বাসনা। অপেক্ষা সেই নবজাগরণের।

………………...............




দেবীপক্ষ আভা সরকার মন্ডল

১২ মাসে ২৪ টি পক্ষ হয়।আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষ তিথি হল পিতৃপক্ষ, অপরদিকে শুক্লপক্ষ তিথিকে বলা হয় দেবীপক্ষ। পিতৃপক্ষের শেষকাল এবং দেবীপক্ষের সূচনা কালই হল মহালয়া। শোনা যায় মহালয়ার দিনই অসুর ও দেবতাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল ।মহালয়ার দিনকেই দুর্গাপুজোর প্রারম্ভ দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই দিনেই দেবীর চক্ষু দান করার নিয়ম। শরতের সুনীল আকাশে রোদ-মেঘের খেলা আর কাশফুলের সমারোহ আগে থেকেই জানিয়ে দেয় মা আসছেন। শিউলি ঝরা সকালে আলোর রেখা ফুটতে না ফুটতেই রেডিওতে ভেসে আসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে গা শিহরণ করা চণ্ডীপাঠ , নদীর ঘাটে ঘাটে চলে তর্পণ .... শুরু হয় দেবীপক্ষ। মাতৃরূপে, পিতৃরূপে, শক্তিরূপে, শান্তিরূপে ও বিদ্যারূপে পূজিতা দেবী দুর্গা এক মহাশক্তি। তিনি সম্মিলিত দেবশক্তির প্রতীক । ষষ্ঠী থেকে দশমী --- ভক্তিভরে ভক্তরা মায়ের আরাধনা শেষে বিজয়া দশমী পালন করেন। বিসর্জনের পর থেকেই আবার শুরু প্রতিক্ষা --- কবে মা আসবেন !---- মাটির মায়ের জন্য এত আয়োজন অথচ রক্তমাংসের মায়েরাই আজ অবহেলিত, অত্যাচারিত, ধর্ষিত । নারী জন্মদাত্রী , সকল শক্তির আধার । যে সংসারে নারীর সন্মান অক্ষুণ্ন থাকে, সকলেই জানে সেই সংসার থাকে ফুলে ফলে সুশোভিত । নারীকে অসম্মান করে দেবীর আরাধনায় মোক্ষলাভ হয় না । এদিকে নারীও যতদিন পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে, ততদিন তাঁর মুক্তি নেই। নারী চাইলে সব পারে । তাঁরা শিক্ষারূপী অস্ত্র হাতে তুলে নিলেই, আদায় করে নিতে সক্ষম হবে সম্মান । জ্ঞান হয়ে উঠবে তাঁদের বর্ম , আপন শক্তিতেই নারী হবে বলিয়ান। সকল মঙ্গলকর্মে এবং পুরুষাসুর নিধনে নারী তখন দশভূজা --- একাই একশ ! পর নির্ভরতা ছেড়ে স্বমহিমায় ঘরে ঘরে নারী যেদিন প্রকট হবেন দুর্গা রূপে--- শুরু হবে নারী জাগরণ --- সেদিন প্রতিটি পক্ষই হয়ে উঠবে দেবীপক্ষ। নারী শক্তির জয়ের মধ্যেই নিহিত আছে জগতের মঙ্গল ।

...........................




ধরায় মায়ের আগমন ও সাজ সাজ রব

সোমা মুৎসুদ্দী

মা দেবী দূর্গা ত্রিনয়নী দশভুজা ধরায় আসবেন নীল আকাশে সাদা মেঘেরা তাই খুশিতে ভাসছে। মা আসবেন তার সন্তানদের নিয়ে, মৃদুমন্দ বাতাসে  কাশফুল দুলে দুলে মাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। বরণ ডালা নিয়ে শিউলি ফুলও গন্ধ ছড়িয়ে মায়ের আগমনের অপেক্ষায়। শিশির ভেজা দূর্বাঘাস ও পদ্মফুলও মায়ের চরণ স্পর্শ করার জন্য আকুল হয়ে আছে। ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আজ সাজ সাজ রব। সবাই ব্যস্ত কেনাকাটা ও পূজার উপকরণ নিয়ে, সেই সাথে ঠাকুরপাড়াও সরগরম বিশেষ করে পুরোহিত ঠাকুররা দেবী মায়ের পূজার উপকরণ কেনাকাটায়। দূর্গাপূজা বসন্তে চালু হলেও শরতেই সবখানে পূজিত হন দেবী। সবাই মন খুলে অপেক্ষায় আছেন কখন আসবেন দেবী মা দূর্গা। এবং তার সন্তানেরা। মা আসবেন মানুষের মনের পশুকে দমন করতে ও অসুরবৃত্তি দমন করতে সেই সাথে ধরনীকে ধন ধান্যে পুস্পে সম্পদে ও শান্তিতে ভারিয়ে দিতে। দেবীপক্ষ বা পিতৃপক্ষ হলো বছরের ১২ মাসে ২৪ টি পক্ষ রয়েছে তারমধ্যে দু'টি পক্ষ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমটি পিতৃপক্ষ ও অপরটি দেবীপক্ষ। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের তিথিকে বলা হয় মহালয়া। এই কৃষ্ণপক্ষকে বলা হয় অপর পক্ষ বা মহালয়া কিংবা পিতৃপক্ষ। পিতৃপক্ষের স্বর্গত পিতৃপুরুষের জন্য পার্বন শ্রাদ্ধ তর্পণ করা হয়। পিতৃপুরুষেরা এই সময় যমালয় থেকে মর্ত্যলোকে আসেন। তাঁদেরকে তৃপ্ত করার জন্য তিল, জল দান করা হয়। তাদের যাত্রা পথকে আলোকিত করার জন্য উল্কা দান করা হয়। পুরান মহাভারতে বলা আছে যে মহাবীর কর্ণের আত্না স্বর্গে গেলে সেখানে তাকে খেতে দেওয়া হলো শুধু সোনাদানা ও ধনরত্ন। 'ব্যাপার কী' কর্ণ জানতে চাইলেন ইন্দ্রের কাছে, ইন্দ্র উওরে বললেন তুমি সারাজীবন সোনাদানাই দান করেছো পিতৃপুরুষকে জল দাওনি তাই তোমার জন্য ধনরত্ন। কর্ণ বললেন আমার কী দোষ? আমার পিতৃপুরুষের কথা আমি জানতে পারলাম যুদ্ধ জয়ের আগের রাতে। মা কুন্তী আমাকে এসে বললেন আমি নাকি তার ছেলে, যুদ্ধে ভাইয়েরও মৃত্যু হলো, পিতৃত্বর্পনের সুযোগই পেলাম না। ইন্দ্র বুঝলেন কর্ণের দোষ নেই তাই তিনি কর্ণকে মর্ত্যে গিয়ে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিতে অনুমতি দিলেন। এই অমাবশ্যায় পিতৃপূজা সেরে পরের পক্ষে দেবী পূজায় প্রবৃত্ত হতে হয়। তাই দেবী পূজার পক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ বা মাতৃপক্ষ।মহালয়া হলো পিতৃপক্ষের শেষ দিন ও দেবীপক্ষের শুরুর দিন।পিতৃপক্ষে আত্নসংযম করে দেবীপক্ষে শক্তি সাধনায় প্রবেশ করতে হয়। দেবী শক্তির আদিশক্তি, তিনি মঙ্গলদায়িনী, করুণাময়ী সাধক সাধনা করে দেবীর বর লাভের জন্য। দেবীর মহানালয়ে প্রবেশ করার সুযোগ পান বলেই এই দিনটিকে বলা হয় মহালয়া। মহালয়ার পর প্রতিপদ তিথি থেকে দেবী বন্দনা শুরু হয় কোনও কোনও অঞ্চলে দেবীর আরাধনা প্রতিপদ থেকেই শুরু হয়।আমাদের এখানে ষষ্ঠী থেকে দেবী বন্দনা শুরু হয় দুই মতেই দেবী পূজার রীতি প্রচলিত আছে।মা আমাদের মাঝে আসেন আমাদের মনের পশুকে দমন করে আমাদের সুখ ও শান্তি বর্ষণ করার জন্য আবার যখন চলে যান তখন সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে যান। তবুও প্রতিবছর অপেক্ষায় থাকি মা আবার আসবেন হৃদয়ে বাজবে সেই সুর বাজলো তোমার আলোর বেণু। 

…….....................



জাগো দশপ্রহরণ ধারিণী

সুস্মিতা কৌশিকী 

উঠোন জুড়ে ছায়াছন্দোপ গাছ। কুবলাখানের শ্বেতপাথরের প্রাসাদের মতো শীতল বারান্দায় আলোর ছায়ারঞ্জিনী। উঠোনের মস্ত লিচুগাছটার ডালে শরতের মায়াবী দুপুর টাঙিয়ে রাখা। 


অতি বৃদ্ধ পুরোহিতের হাতে ঘন্টা বেজে ওঠে। নিত্য আরাধ্যদেব শালগ্রাম শিলা। হাত পেতে একখন্ড বাতাসা দাও। মায়া দাও, আয়ু দাও, বোধ, সৃজন, ইহকাল... ।


গন্ডূষ জল ...ইহা গচ্ছ ইহা গচ্ছ, ইহা তিষ্ট ইহা তিষ্ট... খড়ম যুগলের খটাখট মিলিয়ে গেছে বাতাসে...ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ জলনারায়ন নম:..  ভাদ্রমাস , কৃষ্ণপক্ষের শেষদিন অমাবস্যা তিথৌ মকররাশি শ্রী ভাস্করে...হে আমার পূর্বজ, তোমরা আকাশে  অবলম্বনহীন নিরাশ্রয়,এই জল গ্রহনপূর্বক সুখী হও।


দোল..দোল ..দোল..দোলনায় দুলে পাক খায় শৈশব। প্রবল জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে থাকে মেয়েটা --- একটা ময়ূরপালক চাই তার । কেউ তাকে এনে দেবে বলেছিল। নৈ:শব্দ্যের মোহঘরে বন্দী স্বপ্নালু কিশোরীবেলা। ব্যাকুল রূপকথার রঙিন ফানুস, যার হাত ধরে এখন নীলছবিতে আটকে ঝাপসা জীবন। 

অথচ সামান্য মেয়ে নয়, নারী হয়ে গড়ে ওঠার কথা হয়েছিল। আপোসবর্জিতা-অপ্রতিরোধ্যা-অসামান্যা। স্বপ্ন দেখা আর হয়না...মায়ের হাতের শীতল স্পর্শ হয়না..শিউলি-শিশির হয়না... কবিতা হয়না...জীবন হয়না...কী হয় তবে ?


হাতে হাতে আলোআঁধারি রাতের সঙ্গে মরে যেতে হয় রোজ। তবু তো জীবন! মানুষ-হারানো স্মৃতিকে সঙ্গ দিয়ে চলা। পিঁপড়ের মতো সারি সারি মানুষ, দায় বহনে অক্ষম, অসংখ্য, অসাড়, অসংগত...কোথায় যায় ? মিশে যায় মানুষের নৈমিত্তিক ভীড়ে।


তবু সমাপ্তি বিন্দু পেরিয়ে বিশল্যকরণী মন্ত্রে জেগে ওঠে দুর্গারা। দু'হাতে অনুকল্প দশ অস্ত্রের ঝনঝন। মৃন্ময়ী তাঁর চিন্ময় চোখে চেয়ে দেখেন রক্তমাংস প্রতিমার অপ্রতীম রূপ।

………………..............






দেবীপক্ষ আসলে নারী শক্তি 

পিঙ্কি পাল

ওঁ প্রথমং শৈলপুত্রীতি দ্বিতিয়াং ব্রহ্মচারিণী, তৃতীয়ং চন্দ্রঘণ্টেতি কূষ্মাণ্ডে চতুর্থকম।

পঞ্চমং স্কন্দমাতেতি ষষ্ঠম কাত্যায়নী তথা, সপ্তমং কালরাত্রিতি মহাগৌরি তিচাষটমাম,

নবমং সিদ্ধিদাত্রীতি নবদুর্গা প্রকীর্তিতা।


এমনই একাধিক۔নামে ভূষিতা দেবী মহামায়া। যার অংশ হিসাবে ভাবা হয় সমগ্র নারীকূল কে, যিনি কখনো মমতাময়ী মা, বধূ, ভগিনী বা কন্যা রূপে প্রতিটি গৃহে বিরাজ মান।


বরিষনের প্রেম মেখে প্রকৃতি নব সজ্জায় অপেক্ষা করে  সুরোভিত শরতের। কাশ ফুল, পিঞ্জে মেঘমালা এক জাগরিত প্রত্যুষের উপহার দেয়। যে আলোক মঞ্জুরী সমগ্র জগৎ কে খবর পাঠায় 'মা আসছেন'।


পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে সূচনা হয় দেবীপক্ষের। সেই বিশেষ দিনটি মহালয়া নামেই গুরুত্ব পায়। মহালয়া আক্ষরিক অর্থে মহান আলয় বা আশ্রয় কে বোঝায়। মহালয়ার প্রভাত হল দুর্গা পুজার সূচনা লগ্ন আর মা মহামায়া হলেন জগৎ সংসারের আশ্রয় অন্য মতে, এই আলয় হল পিতৃলোক। এই দিনটি নিয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ গুলিতে একাধিক মত প্রচলিত আছে।

তবে মহালয়ার তাৎপযপূর্ণ সকাল এই মান্যতাই দেয় নারী শক্তির আরাধনা করার সুন্দর বার্তা বহন করে। অনন্ত কাল ধরে মহালয়ার মহত্ত্ব  নারী শক্তির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসাবে নিজ ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।

কর্মদক্ষতায়, দায়িত্বপালনে ও সহনশীলতায় অদ্বিতীয়া নারী সমাজ সর্ব শক্তির আধার, মানবকূলের জননী। যার জঠরে লালিত হয় সমগ্র মনুষ্য। দশভুজার মতোই ঘরে ও বাইরে সমান তালে নারী আজ নিজের সফলতার ছাপ রেখে চলেছে প্রতিক্ষণ। বাড়ীর অন্দর মহলে নারী যেমন সংসার যাপনে পটু তেমনি কর্মক্ষেত্রে। পিতৃ গৃহের আদরের উমা অপমানের প্রতিবাদে কাত্যায়নী রূপ ধারণ করতে পারে এমন ঘটনার সাক্ষী অসংখ্য।


রূপে, গুনে নারী আজ বিশ্ব পুজিতা। ধরিত্রীর প্রগতির কর্ম  যজ্ঞে নারী অন্যতম কারিগর।


বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পুজা যার প্রহর গোনা সারা বছর ধরে চললেও মহালয়ার শিউলি গন্ধ মাখা প্রভাতই প্রকৃত অর্থে উৎসবের প্রারম্ভ। সেখানে মাতৃ রূপেণ নারী শক্তির প্রতীকী হিসাবে ঘরের উমার আরাধনার সূচনা হয় মহালয়া দিন থেকেই ۔۔পিতৃ পক্ষের অবসান ঘটে সূচনা হয় দেবী পক্ষের। সুতরাং দেবী পক্ষ  আসলে নারী শক্তি আরাধনার মধুর লগ্ন।

…………………….......


নারী, আদ‍্যাশক্তির আধার

মহুয়া ব্যানার্জী

'ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা'


দেবী, এক অসীম শক্তির আধার। তাঁকে সৃষ্টি করা যায় না। ধ্বংসকরা যায় না। তিনিই এই ব্রহ্মাণ্ডের সব শক্তির পুঞ্জীভূত আকর। তাঁর থেকেই সৃষ্টি, তাঁর মধ‍্যেই ধ্বংস। কেবল জগৎ কল‍্যাণে, দুষ্ট দমনে তিনি এক রূপ থেকে অন‍্য রূপে পরিবর্তিত হন। শক্তির নিত‍্যতা সূত্র মেনে এভাবেই দেবী হয়ে ওঠেন জগৎপ্রসবিনী মা আদ‍্যাশক্তি, অসুর দলনী মা দূর্গা, কালী, চণ্ডিকা আবার তিনিই জগৎ পালনকারী মাতৃমূর্তি মা অন্নপূর্ণা। জগতের ধারণকারী মা জগৎধাত্রী।তিনিই নারী। এক পরিপূর্ণ নারী। তাঁর সেই সব রূপ যত্ন করে সঞ্চিত রয়েছে আমাদের মত পৃথিবীর সব নারীর কোষে কোষে, দেহের প্রতিটি অনু পরমানুতে।তাই তো আমরা, নারীরা সর্বংসহা আবার প্রয়োজনে রণচণ্ডী। 


আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাস বলছে সেই নারীশক্তির কথা। ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাঈ, রাণী শিরোমনি, আদিবাসী সমাজের সমস্ত বীর রমনী, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা মাতঙ্গীনি ও আরও বহু নারী আমাদের বার বার মনে করিয়ে দেয় আমরা দেবী দুর্গার অংশজাত। চাইলে আমরা সব পারি। প্রত‍্যন্ত গ্ৰামের যে রমনী ভোর থেকে রাত পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে তার সংসারের শ্রী ধরে রাখেন, তিনিই তো দেবী লক্ষ্মী। বিদ‍্যালয়ে, কলেজে, ঘরে যে রমনীরা সমাজের সংস্কারের জন‍্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম সু শিক্ষা দান করেন, নিজের সন্তান ও ছাত্রছাত্রীদের মননশীল, সৃজনশীল, সৎ হতে শেখান তাঁর মধ্যেই দেবী সরস্বতীর বাস। শিল্পকলায় কৃষ্টিতে যে সব রমনী উৎকর্ষ আনেন, চর্চায় থাকে তিনিও তো সারদা। বিজ্ঞান, শিল্প, কর্পোরেট হোক বা সেনাবাহিনী, ক্রীড়াঙ্গন হোক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্র অথবা সমাজসেবা,গৃহকোণ হোক অথবা পথ সব ক্ষেত্রেই নারীরা নিজের সেই দৈবী ক্ষমতার প্রকাশ দেখিয়েছেন আমাদের। দেখিয়ে চলেছেন ক্রমাগত। তবুও সমাজের অসুরশ্রেণীর দাপট কমছে না। মাঝে মাঝেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আসুরিক শক্তির অন্ধকার।


পরে বলি, যৌন ইর্ষার বলি হয়ে চলেছে নারীরা। এর কারণ একটাই, কিছু নারী এখনো তাদের অন্তরের সেই আদ‍্যাশক্তিকে চিনতে পারছে না। তারা বুঝতেই পারছে না যে তারাই পারে। সব পারে। তারা অবলা নয়। তারা আসলে প্রচণ্ড শক্তিময়ী। 


 এই  অন্ধকার ভেদ করে আলোর দিশা দেখানোর জন‍্য প্রতিটি নারীকে তাঁদের ভেতরের সেই দেবীকে জাগাতে হবে। ভয় নয়, সাহস হোক প্রতিটি নারীর অস্ত্র। নারী ভয় পাবে না, বরং সমস্ত অশুভকে ভয় দেখাবে।  প্রতিটি নারীকেই হতে হবে মহিষাসুর মর্দিনী, চামুণ্ডা। তবেই সমাজের তমসা কেটে আলো আসবে। তাই এই দেবীপক্ষে আমাদের এটাই প্রার্থনা।


'সৃষ্টিস্থিতি বিশানানং শক্তিভূতে সনাতনী। 

গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়নী নমহস্তুতে'

…………………............



দেবীপক্ষ আসলে নারী শক্তি   

অজন্তা রায় আচার্য

 আগের দিন রাতেই মা রেডিওতে নতুন ব্যাটারি ভরে রাখতেন। ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া থাকত। পূর্ব আকাশে   যখন সবে মাত্র আলোর আভাষ দেখা দিয়েছে, আধোঘুম আধো জাগরণে, তখনই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের  গমগমে ঐশ্বরিক গলায় বেজে উঠত,

”আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর; ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;

প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।”মহালয়া। এইদিনই পিতৃপক্ষের অবসান, দেবীপক্ষের  সূচনা। মহালয়া কথার অর্থ হলো মহান আলয়। দেবী দুর্গাই হলেন সেই আলয় অথবা আশ্রয়। এই দিনই মহিষাসুর বধের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।  


দেবী দুর্গা মহাশক্তি মহামায়া শ্রী আদি আদ্যাশক্তির কেন্দ্রীভূত চিৎ-শক্তি।দেবী হলেন সত্ত্ব-রজো-তমো,এই ত্রিগুণের অধিষ্ঠাত্রী এবং ত্রিগুণাত্মিকা। তিনি ত্রিগুণে বিরাজিতা আবার ত্রিগুণাতীতা।    


দেবীমাহাত্ম্যম ১১.৬ স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে মা দুর্গা সমস্ত নারী জাতীর প্রতীক।


“তব অংশ-ভূতা হয় ভবে নারী সবে।” তাই এই পুজোর উদ্দেশ্য সমস্ত নারী জাতীকে সম্মান প্রদর্শন করা  আমরা জানি দুর্গা প্রতিমা গড়তে যে দশবিধ জিনিস লাগে তার মধ্যে একটি পতিতার উঠোনের মাটি। আসলে এই মাটি ব্যবহার করে পতিতার নারীত্বকে সম্মান জানানো হয়।


 এই দেবী আরাধনার মাধ্যমে যুগে যুগে আমাদের সমাজে,সংসারে প্রতিটি নারীকে এক মান্যতায় প্রতিষ্ঠিত করার পবিত্র অনুভূতি রয়েছে। সেই বোধের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই স্বামী বিবেকানন্দ শুরু করেছিলেন কুমারীপূজা, যে পূজা প্রাচীনকালে ঋষি মুনিদের আশ্রমে অনুষ্ঠিত হতো। নিত্য দিনের সংসারে সমাজে প্রতিটি নারীর মধ্যেই দেবী দশপ্রহরণধারিণী মা দুর্গা বিরাজিতা। মাতা রূপে ভগিনী রূপে জায়া রূপে কন্যা রূপে সহকারিণী রূপে, বিভিন্ন রূপে। 

…………….....................

                                 


কলম থেকে কলাম

রাখী দে

কলম শাখা থেকে গজিয়ে উঠেছে নতুন পাতা।

শিউলির মতো ঝরছে নরম সদ্যজাত আখর।

উপচে উপচে পড়ছে কবির কলাম!

ফুলের রেণু ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে

নতুন জন্মের অপেক্ষায়, স্পর্ধার অপেক্ষায়!


পোয়াতি মেঘগুলো শেষ বর্ষণ ঝরিয়ে লঘু পায়ে হেঁটে চলেছে অসীমের দিকে। কাশবাতির উদ্ধত ঝাড় ভুলিয়ে দিচ্ছে জীবনের সর্পিল গতিপথ। কাঁচ রোদে উদ্ভাসিত ঝলমলে প্রকৃতির মধ্যে ফুটে উঠছে নতুন সম্ভাবনার ফুল; মাতৃপক্ষের শুভ সূচনা! সদর্পে ঘোষিত সমস্ত পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে রেণু খাতুন স্পর্ধার আরেক নাম! একবিংশ শতাব্দীর নারী যখন আজও অস্তিত্ব সংকটে বিপর্যস্ত। পুরুষ যখন নারীর সীমানা নির্ধারণ করে, গতিপথ বাতলে দেয়, রেণু সরকার সেখানে চিরজাগ্রিক এক অগ্নিশিখা। তার আলোকিত ছটায় পথ খুঁজে পাবে বহু দিকভ্রষ্ট নারী। কাটা জিভ, কাটা হাতকে সম্বল করে এগিয়ে যাবে নারী আত্মপ্রকাশের পথে, নব জন্মের পথে! কলম চারাটি নতুন ফুলে ফলে পল্লবিত হয়ে ভরিয়ে দেবে প্রতিটি কলাম! যে কলামে লেখা থাকবে প্রতিটি নারীর একেকটি স্পর্ধা হয়ে ওঠার কাহিনী! বৃষ্টি ধোওয়া রোদ্দুরে ঝলমল করে উঠবে নীলাভ আকাশ। টলটলে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে হারিয়ে যাবে কাশের বনে, মুক্তির অপেক্ষায়, নতুন জন্মের অপেক্ষায়!

………………….........


দেবীপক্ষ

মৃত্তিকা মুখোপাধ্যায় 

ভোরের নরম হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে জলদগম্ভীর কন্ঠস্বর।যেন শিউলির সুবাসে মিশছে ভারি ঢাকের শব্দ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণর কন্ঠস্বরের সঙ্গে বাঙালি সেই কবে থেকে যে দেবীপক্ষের শুরুকে একাত্ম করে ফেলেছে, তা তার নিজের‌ই মনে নেই। সম্ভবত ঐ একটি দিন‌ই এখনো বহু বাঙালি বাড়িতে ধুলো ঝেড়ে তাক থেকে নামিয়ে আনা হয় 'রেডিও' নামক বিস্মৃতপ্রায় যন্ত্রটি। শহরের ইট কাঠ পাথরের ভিড়ে ঝরে পড়া শিউলি বা বিস্তৃত কাশবন আর কোথায়! অত্যাধুনিক নাগরিক জীবনে রাস্তায় রাস্তায় বাঁশের বেড়াজাল আর রাস্তা আটকে প্যান্ডেল বা বড়জোর শপিং মলে সিডিতে বেজে ওঠা ঢাকের শব্দে বুঝতে পারি পুজো এসে গ্যাছে। ছোটবেলার মফস্বল শহরের পুজোর উন্মাদনা এখন নেই বললেই চলে। সারা বছর কিছু না কিছু কিনতে থাকার কারণে বা অনেকটা বয়েস বাড়ার কারণেও পুজোয় কেনাকাটার আনন্দ আর তেমন নেই আলাদা করে। এখন পুজো ঘরে বসে নিজের মানুষদের সঙ্গে কাটানোতেই আনন্দ। বারান্দায় বসে পথ বেয়ে চলা সুসজ্জিত অগুনতি উৎসাহী মানুষের ঢল দেখেই পুজো কেটে যায়। ভিড়ের মধ্যে গিয়ে প্রচুর লাইন দিয়ে প্রতিমা দর্শনের তাগিদ নেই যে। তাই নতুন জুতোয় পায়ে ফোস্কা পড়া নেই। প্রিয় পোশাকটি ভিড়ের ঠেলায় নষ্ট হবার সম্ভাবনা নেই। নেই পেটপুরে ফুচকা, এগরোল খাওয়া। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন উপলব্ধি করতে পারি, পুজোর আসল অর্থ তার উৎসবে, মানুষের মিলনমেলায়। ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একসাথে জড়িয়ে নেওয়ায়, সব কোণে, সব মনে আলো পৌঁছে দেওয়ায়।

…………………..............




শক্তি রূপেণ সংস্থিতা

বনশ্রী রায় দাস 

 দেবীপক্ষের সূচনা হয় ব্রহ্মকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গুরুগম্ভীর কন্ঠে চন্ডীপাঠ শুনে "যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।" মহালয়ার পুণ্য লগ্নে ঊষাকালে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে জলদান করা হয় তাঁদের আত্মার শান্তি কামনায় এবং ওইদিনই হয় দেবীপক্ষের সূচনা। এই মহালয়া শব্দের অর্থ মহান আলয় বা আশ্রয় আর মা দুর্গা হলেন আমাদের সেই পরম আশ্রয়। ভোরের হিরকদ্যুতি শিশির ছড়িয়ে পড়ে নরম ঘাসে, হাইতোলে হিরণ্ময় শিউলি, মেঘে মেঘে দোদুল কাশের চামর, পান্না খচিত প্রকৃতির হাসিতে লাবণ্য ছড়িয়ে জানান দেয় যে আমরা এখন থেক শক্তিরূপের নির্ভয় ছায়ায় নিশ্চিন্ত।

             অহং সুরে পিতরমস্য মূর্ধন

                   মম যোনিরূপস্বন্তঃ সমুদ্রে।

             ততো বিতিষ্ঠে ভুবনানু বিশ্বো 

                  তামং দ্যাং বর্ষ্পণপোপস্পৃশ্যমি ।

                        ( শ্রী শ্রী চণ্ডী দেবীসুক্তে -- ৭)

অর্থাৎ আমি সর্বাধার পরমাত্মার উপরে, দ্যুলোককে প্রসব করিয়াছি। বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যস্থ যে ব্রহ্মচৈতন্য উহাই আমার অধিষ্ঠান। আমিই ভূরাদি সমস্ত লোকে সর্বভূতে ব্রহ্মরূপে বিবিধভাবে বিরাজিতা। আমিই মায়াময় দেহদ্বারা সমগ্র দ্যুলোকে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছি।

      মহাপ্রলয় রূপে মহিষাসুর ব্রহ্মার বলে বলিয়ান হয়ে ত্রিলোকের অধীশ্বর হওয়ার জন্য স্বর্গ রাজ্যে গিয়ে যুদ্ধে দেবতাদের পরাস্ত করে স্বর্গ রাজ্য দখল করল আর দেবতাগণ ভয় পেয়ে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিলেন। পুনরায় স্বর্ণ রাজ্য ফিরে পেতে দেবতাগণ আরাধনা করলেন সেই ব্রহ্ম স্বরূপিনী আদ্যা শক্তি মহামায়া"র। তিনি সেই ভয়ঙ্কর অসুরকে বধ করে স্বর্গ রাজ্য উদ্ধার করে দেবাতাগণের হস্তে অর্পণ করেন। 

শুধু একবার নয় যতবারই অশুভ শক্তির উত্থান ঘটেছে এই নারী শক্তিই বিভিন্ন রূপ ধারণ করে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে সৃষ্টিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছে।

যুগ যুগ ধরে সুখে দুঃখে, শোকে আনন্দে, সমগ্র মানবের অনন্ত শান্তির আশ্রয় হয়ে উঠেছে এই নারী শক্তি। এ বিশ্ব সংসারে একজন নারী পারেন নিজেকে সহস্রাধিক ভেঙে ভাবিকালের হাতে তুলে দিতে একজন সুযোগ্য উত্তরসুরি। কন্যা, জায়া অথবা মাতা হয়ে একজন নারী পারেন সংসারে সর্বংসহা হতে আর দেবীপক্ষই সেই নারী শক্তির উত্থানকাল ।

……………...............



বসুন্ধরা

জয়া মুখার্জী 

যেমন ধরো ভালোবাসার উঁচু আকাশ থেকে তোমায় কেউ একটানে মাটিতে আছড়ে ফেলল কিংবা ধরো একটা বসরাই গোলাপ তুলবে বলে মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে দেখলে ধূ ধূ  মরু। আগেই গোলাপ তুলে কেউ কাঁটা ছড়িয়ে রেখেছে। এসব তোমার জীবনে কোনো না কোনো সময় ঘটেছে। আসলে এসব‌ই  হল আশাভঙ্গের গল্প। তবু তুমি বুকের ভেতর জমিয়ে রাখো  নিদাঘ বেলায় আলতো ছোঁয়ার শিশির কনা। চোখের পাতায় আঁকতে থাকো গভীর রাতের আঁধার কাজল। কেউ নাই বা এল, এই অসময়, শুধুই তোমার জন্য বাঁচো। নিজের আঁচল নিজেই সাজাও পারিপাট্যে সযতনে। পারলে তুমি উড়িয়ে দিও আঁচলখানি জলভরা ঐ মেঘের গায়ে। তুমিই নারী তুমিই দেবী। তোমার অহং তোমাকেই ঘিরে। তুমিই দাও ধূলোমাটি ভালোবাসা। সর্বংসহা আলো দাও। দাও নিষ্ঠার জীবন। লতার মতো আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেল এই মানব জীবনের স্নেহগুলিকে। আত্মস্থিত হ‌ও। অতঃপর আগুনপাখি হয়ে গিলে নাও সমস্ত গরল। নির্বিষ জীবন দাও।আশায় বুক বাঁধি। আশাভঙ্গের দাহ আর পুড়ায় না। তুমি হয়ে উঠলে সজল বসুন্ধরা।

……………...............




মা আসছে

মৃণালিনী ভট্টাচার্য 

"জাগো… জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিনী"

 চারিদিকে আনন্দের ঢেউ, সবাই বলছে মা আসছে, আমিও তোড় জোড় করছি তোমাকে আনার।


 মা তুমি নাকি অসুর নিধনকারীনি, তাহলে রাস্তার ধারে ওই ফুটপাথে কেন পড়ে আছে ওই দুর্গার দল? প্রতিনিয়ত লোলুপ দৃষ্টিতে ওদের গিলে খায় কত মানুষ নামের অসুর, ওদের কেন বধ করো না তুমি?


 মা কোথায় থাকো তুমি? যখন ছোট ছোট বাচ্চারা ছেঁড়া জামা পরে রাস্তার ধারে সবার কাছে একটা টাকা চায়, দুমুঠো খাওয়ার চায়, কেন তুমি দিতে পারো না ওদের দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার?


এ কেমন মা তুমি? পণ না দিতে পারার জন্য কত দুর্গার দেহ আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। কত বাবা ছোট থেকে আগলে রাখা দুর্গার নিধর দেহের পাশে বসে অঝোরে কাঁদতে থাকে। এর কি বিচার করেছো তুমি মা?


 কোথায় থাকো মা তুমি? যখন জ্যান্ত দুর্গারা না খেতে পেয়ে সেজেগুজে রাস্তায় দাঁড়ায় বাবুদের ধরবে বলে, শুধুমাত্র পেট চালাবার জন্য, কে দেবে ওদের কাজ? কি করে মিটবে ওদের পেটের খিদে? তুমি তো মা কেন আসো না ওদের পাশে?


 মা তুমি আসবে বলে লক্ষ লক্ষ টাকার বাঁশ বাধা হচ্ছে, আলোর ঝলকানিতে ভরে যাবে রাস্তা-ঘাট, আর ওই আলোর পিছনে অন্ধকারে কত দুর্গা ভাববে সামনে শীত আসছে কি করে বাঁচাবে তার বাচ্চাদের? তুমি তো মা, তুমি তো শুধু বড়লোকেদের মা নও! মায়ের আবার ভেদাভেদ হয় নাকি? কিন্তু এখানে যে তুমি আসছো ধনীদের মা হয়ে! এসো মা তুমি সকলের মা হয়ে।

………………….........


আগমনী

প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্ত্তী মজুমদার



শরতের আকাশী নীল মেঘের রঙে রোদেল লুকোচুরি ঘিরে। খুশীর ফানুস,শিশির ধোয়া শিউলী ভোরে মিষ্টি সুগন্ধের। বাতাসে তরতাজা প্রাণময়তা আর মহালয়ার ধার্মিক সুর, সাদা পায়রার ঝাঁক ঘরবাড়ীর ছাদে পেতেছে স্বস্তি নীড়ের আবাসন, কাশফুলের সৌন্দর্যে

পূজোর গন্ধ আবহমান,নতুন জামার গন্ধে প্রাণময়তার ছোঁয়া।


আসছে মা, রূপং দেহী, জয়ং দেহী, যশ দেহী,বিশজয়ী,

সকল দুঃখ নিবারণের জন্য আশাবাদী মন চেয়ে আছে 

সন্ধি পুজোর একশ আট প্রদীপের দিকে, একফালি চাঁদ, তারাদের সাথে কথোপকথন করতে ব্যাস্ত, সৃষ্টির ছন্দ গতিময়তা ধরে এগিয়ে চলেছে।


ক্ষুধার্থ, উস্কোখুস্কো চুল ছেঁড়া রঙ চটা জামা থেকে

খিদের তাণ্ডব ভুলে যায় অষ্টমী পূজোর অঞ্জলী সকাল। গরম খিচুড়ির অপেক্ষায় ঘোলাটে চোখে ধুঁকছে খইষ্ণু সমাজের মেরুদন্ড।


পারলে  মা ই পারেন ত্রিশূল আঘাতে অশুভ শক্তির

নাশে শাপ মুক্ত করতে দিন ও রজনীকে।প্রতিটি মানুষ তায় একসাথে মন্ত্রচ্চারণে বন্দিত করে মাকে

 ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃ রুপেনো সংস্থিতা 

নমস্তসয় নমস্তসয় নমস্তসয়নমঃ নমহা। 

মঙ্গলময়ী মা গো তুমি সর্বজনিন হয়ে বিরাজিত

প্রতিটি মানুষের মনের গোপন কক্ষে, প্রণমী তোমার চরণ যুগল শ্রদ্ধান্বিত বক্ষে। এ ধরাধামে  তুমি অনন্যা দশভূজা হয়ে থেকো ত্রিনয়নী রূপী চক্ষে সকল শুভর লক্ষ্যে। প্রার্থনার সুরধ্বনি তায় বাজে মর্ত্য পূজার

সর্বত্র এক রঙ্গীন কারুকার্য ময়তার ব্যাপ্তি তে।

…………………..............



দেবীপক্ষের আগমনে সুজাতা চক্রবর্তী


"এসেছে শরৎ, হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার ’পরে। সকাল বেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের রেখা ধরে।" আলমোড়া ভাঙছে কাদা রাস্তাগুলো...শরতের হাওয়া, আকাশে মেঘের ভেলা এসবের হাত ধরে আবার উমা আসছেন ঘরে যাই - যাই করেও থেকে যাওয়া বৃষ্টি আর আর মাঝে মধ্যে মেঘ সরিয়ে ওঠা রোদের লুকোচুরির মাঝেই দেবী এবার বন্দনার প্রস্তুতি।আগমনীর সুরের ছোঁয়ায় দেবীপক্ষের সূচনা হতে চলেছে। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই বর্ধমানে সদরঘাটে দামোদর নদীতে নেমে নিয়ম মেনে নিষ্ঠা ভরে মন্ত্রপাঠ হয় উত্তরের জেলা কোচবিহারে সেখানে তোর্ষার জলে , হুগলির ত্রিবেণী ঘাটেও তর্পণ শুরু হয়ে গিয়েছে সকাল হয়তো।তর্পণ করতে দূরদরান্ত থেকে মানুষ এসে পৌঁছন নদিয়ার নবদ্বীপ ঘাটে। বাঁকুড়াতে গন্ধেশ্বরী আর দারকেশ্বরের ঘাটে ঘাটে চলে পূর্বপুরুষকে স্মরণ.. পূব আকাশে তখন ভোরের আলোর সবে একটা রেখা দেখা গিয়েছে। আর ঠিক সেই সময়ই প্রায় সব বাড়ি থেকেই ভেসে আসে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের গলায়, 'আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর; ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা; প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।' বেশিরভাগ বাঙালির মহালয়ার দিনটা ঠিক এভাবেই শুরু হয়। আসলে এই দিনই পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে ও দেবীপক্ষের সূচনা হয়। আর সেই সূচনা লগ্নই মহালয়া নামে পরিচিত। আক্ষরিক অর্থে মহালয়া থেকেই দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। কথিত আছে মহালয়ার দিন অসুর ও দেবতাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল।মহালয়া শব্দটির অর্থ, মহান আলয় বা আশ্রম।এই দিন পিতৃপুরুষরা মনুষ্যলোকের অনেক কাছাকাছি চলে আসেন। পুরাণ মতে, ব্রহ্মার নির্দেশেই এই মিলন ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছিল। তাই এই দিন পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেন অনেকেই। তর্পণ কথার অর্থ হল, যাতে অন্যের তৃপ্তি হয় সেই উদ্দেশ্যে জলদান। তর্পণ তাই শুধু পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যেই নয়, সর্বভূতের উদ্দেশেই করতে হয়। আসলে মহালয়া নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। অনেক মত বিরোধও রয়েছে। আসলে মহালয়ার তর্পণের মধ্য দিয়েও সর্বভূতের সঙ্গে মানুষের একাত্মতার কথা বলা হয়েছে। আর বিষয়টিই মহলয়াকে সবথেকে বেশি সুন্দর করে তুলেছে। দেবীপক্ষ সেই একাত্মতার সূচনা করে। সেই একাত্মতা শুধু বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানের শুকনো খোসার মধ্যে আবদ্ধ না শুধু ... সেই একাত্মতা সর্বভূতে বিরাজিত । আর দুই চারদিন পেরোলেই শিয়ালদহ বা হাওড়া স্টেশনের বাইরে বসবে ঢাকিদের সমারহ। দূর দূরান্ত থেকে ঢাকিরা এসে জড়ো হন এখানে। পুজোর উদ্যোক্তাদের সঙ্গে চলে দরাদরি। দাম ঠিক হলে বায়না করে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। আধুনিকতার গতিতে এখনও হারিয়ে যায়নি এই ঢাকের আওয়াজ। দুর্গা পুজো মানে ঢাক বাজবে না তা কি হয়। হুগলির দেবানন্দপুরের মানুষপুর-ইডেন পার্কের মানুষরাও তাই এই কয়দিনের অপেক্ষায় দিন গোনে সারা বছর‌। এই এলাকায় বেশ কয়েক ঘর ঢাকির বাস। বংশ পরম্পরায় ঢাক-ঢোল বাজানোই তাঁদের পেশা। সারা বছর ছোটখাটো বায়না হলেও বছরভর দুর্গা পুজোর দিকেই তাকিয়ে থাকেন তাঁরা। কলকাতা তো বটেই, ডাক আসে ভিন রাজ্য থেকেও। সেখানেই কিছু আয় হয়। করোনার কারণে গত দু’বছরে পুজোর আনন্দ ফিকে হয়ে গিয়েছিল তাঁদের। কেউ রিক্সা-কেউ টোটো চালিয়ে রুজিরুটি চালিয়েছেন। তবে এবার পরিস্থিতি বদলেছে। দেড় মাস আগেই বিভিন্ন বারোয়ারি বায়না দিয়ে গেছে। অন্যান্যবারের তুলনায় এবারে ঢাকের দরও একটু বেশি। বাজার দর বেড়েছে, তাই দর বাড়িয়েছেন ঢাকিরাও। পুজোর চারদিন ঢাক বাজানোর জন্য একজন ঢাকি সাধারণত বারো থেকে তেরো হাজার টাকা পান। এবার সেটাই পনেরো-ষোলো হাজার। এরপর বকশিস তো আছেই। দেবী পক্ষ শুরু হলেই একে একে ঘর ছাড়বেন তাঁরা। মা দুর্গার টানে পৌঁছতে হবে মণ্ডপে। পুজো মিটিয়ে যখন বাড়ি ফেরেন তখনই তাঁদের উৎসব শুরু হয়। দেবীপক্ষ মানে কারও কাছে একচিলতে আশার আলো আনন্দের খোঁজ ... অনাথ আশ্রমের বাচ্চাগুলোর হাতে নতুন জামা-কাপড় তুলে দিয়ে যিনি আনন্দ ভাগ করে নেবেন তাঁর কাছেও দেবীপক্ষ আনন্দের হাতছানি দিয়ে যায়... কর্মসূত্রে বা পড়াশোনার জন্য বাড়ির বাইরে থাকা মানুষগুলোর জন্য দেবীপক্ষ মানে ঘরে ফেরার ডাক.. গভীর তত্ত্বকথা ইন্টেলেকচুয়াল তর্কবিতর্কের পথ না ধরেই বলা যায়... দেবীপক্ষের মাহাত্ম্যটা যেন বহুমাত্রিক সব ধরনের মানুষের জীবনে এর ছায়া ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পড়ে ...মনের উঠোনে.... গোধূলির আকাশে যেমন কালো , গেরুয়া হলুদ , গোলাপি রঙের খেলা দেখা যায় দেবীপক্ষের সূচনা সেই একাত্মতার আকাশ ... রঙগুলোও একাত্মতার সম্পৃক্ত রূপ।

...............................





সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - শায়ননেন্দ্র বেরা

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614







ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...