Saturday 13 November 2021

ই-কোরাস ৪৫ // আমার শিশুদিবস

 



হলুদ বনে কলুদ ফুল

সুকান্ত সিংহ 


নাকছাবির মতো ছোটবেলা তো হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে। হাতে রয়ে গেছে কখনো হারিয়ে না-যাওয়া স্মৃতি। পাখিদের যেমন কিচিরমিচির , মানুষের তেমনি ছোটবেলা। উৎসের খোঁজে গেলে সময় হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ঠিক কোনটা ছোটবেলা? সেই যে বড় মাস্টারের ভয়ে তিন পাতা হাতের লেখা করে নেওয়া নাকি ঘুমতা ঘুমাই করতে করতে একটা নদী, তার পাশে পাহাড়, তার নীচে পৃথিবীর সবচেয়ে তেজি ঘোড়াটার পিঠে চড়ে লোকের ঘরে ঘরে চিঠি পৌঁছে দেবার স্বপ্ন-- সেটাই আসলে ছোটবেলা! 

মাঠের ওই পারেই বিজন খ্যাপার আশ্চর্য আশ্রম ভেবে নেওয়া ছোটবেলা, নাকি পঞ্চাশ পয়সায় তিনটে লেবু লজেন্স পাওয়া যায় না জানতে পারার দিনটাই ছোটবেলা? কে জানে কোনটা ছোটবেলা আর কোনটাই বা বড়বেলা! 

আমাদের সময় -- এই বলে বড় রকমের একটা কথা বলার ইচ্ছে ছিল, সেটা বাদ দিচ্ছি। সময় আমাদেরও নয়, তোমাদেরও নয়। আর 'এখন' বলে যে বর্তমানের দিকে ইঙ্গিত করব, কথা শেষ হবার আগেই সে অতীত হয়ে যাবে। সময়ের যৌথ্যতার চেয়ে বলা ভাল আমার কাটিয়ে আসা সময়, যেগুলোর কাছে বয়স খুব একটা খারাপ ব্যাপার না হলেও, বয়সের একটা মাপকাঠিতে বুঝে নিয়ে হয় ছোটবেলা আর বড়বেলা। আড়াআড়ি একটা ভাগ করে নিতে হয় নিজের ওই বড় রকমের একটা কথা বলার ইচ্ছের জন্য। এ ছাড়া বড়বেলা বলেও কিছু নেই আর ছোটবেলা বলেও কিচ্ছু নেই। অন্তত আমার কাছে। 

পৃথিবীর যতটুকু অসম্ভব আছে, যার জন্যই পৃথিবী এখনো অসহ্য হয়ে যায়নি, সেই যাবতীয় অসম্ভবের একমাত্র আধিকারিক হল ছোটরা। আমি তো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যাবতীয় অসম্ভব ছোটদের হাতে আছে বলেই এখনো সাতভাই পাখির ঝগড়া ভাল লাগে। ভোর ভাল লাগে। ভোরের টুপটাপ শিশির ভাল লাগে। সবচেয়ে ভাল লাগে আমার প্রফেট সুকুমার রায়ের বলে যাওয়া পাঁউরুটি আর ঝোলাগুড়। 

ছোটবেলা মানে হল কথায় কথায় ওই হুম্ না-বলা। ছোটবেলা মানে হল সবকিছুই চূড়ান্ত অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বিশ্বাস করা। ছোটবেলা মানে হল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে একানড়ে নামে খরতনাক ভূতের গল্প শোনা। কয়লা ভাঙা, চায়ের কাপ ধোয়া, ট্রেনে প্রদীপের সলতে বিক্রি করাও ছোটবেলা। ও আমি চাই বা না চাই, বড়বেলা কোথাও না কোথাও এমন একটা ছোটবেলা ঠিক রেখে দেয়। এ নিয়ে আরো বড়বেলাদের কিছু কথা হয় বটে, তবে তাকে উপড়ে ফেলার জন্য তেমন কিছুই হয় না শেষতক। 

একটা কথা খুব স্পষ্ট করেই বলে রাখি, ছোটদের জন্যই শুধু ছোটবেলা থাকে তা কিন্তু নয়, এই ধাতুপৃথিবীর বুকে যে আশ্চর্য হতে পারে সেই ছোটবেলায় আছে। জল পড়িতেছে এবং পাতা নড়িতেছে দেখেই যে অবাক হতে পারে সেই ছোটবেলায় আছে। সত্যি বলতে সেই ছোট, গম্ভীর ভাষায় শিশু। আরো গম্ভীর ভাষায় তাহারই শৈশব রহিয়াছে। যে আমি তো বেশ ভাবতে পারি মনে -- সে কখনো শৈশবহীন থাকে না। ওই তার পথ আর ওই তার পাথেয়। 

এবার লুকিয়ে পড়ি। লুকিয়ে লুকিয়ে সাতভাই পাখির ঝগড়া দেখি। পারলে কেউ খুঁজে নিক আমাকে। আমার শৈশবকে। আমাদের শৈশবকে। আমাদের ছোটবেলাকে।

টুকি।

                    ............................. 


শিশুর মুখ ধরে কোটি চুমু খেতে পারি 

আশিস মিশ্র 



মাঝে মাঝে আমরা শিশুবেলায় পৌঁছতে চাই। মনুষ্য জীবনের এ এক সত্যবাসনা। সেখানে যখন পৌঁছই, তখন পেছনের অনেক কিছু ঝাপসা, আবার অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। নিজের শিশুবেলার যা যা দেখতে পাই না বা মনে পড়ে না --মৃত্যুর আগে তা কি আর দেখতে পাবো? না, তা আর দেখতে পাবো না। এটাই মানব জীবনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। তার মানে নিজের শিশুকাল থাকে এবং তা লুকিয়েই থাকে। 

এই লুকনো শিশুবেলার কথা যখন মা-বাবা, বা দাদু- ঠাকুমার কাছে গল্পের মতো শুনি, তখন আনন্দ পাই। মনে হয় তখন, সত্যি সত্যি আমি বা আমরা এমন সব ছিলাম, বা এমন কতো কাণ্ড ঘটিয়েছি! যার কিছুই মনে নেই আমার বা আমাদের। 

একটু বড়ো হওয়ার পর আমরা অনেকেই পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষের শিশুবেলার কথা পড়তে থাকি। কেমন করে তাঁদের শিশুবেলা কেটেছে। যেমন, গৌতম বুদ্ধ,রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, চার্লি চ্যাপলিন, আইনস্টাইন, গ্যালিলিও সহ আরও অনেক মানুষের শিশুকালের কাহিনি পড়ে সমৃদ্ধ হই। মনে হয়, এমন করেও এঁরা বেড়ে উঠেছিলেন! 

মনে হয় সেই ধুলো-কাদা মাখা শিশুর মুখ। বেবিফুড খাওয়া শিশুর মুখ। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর মুখ। দরিদ্র শিশুর মুখ। মধ্যবিত্ত শিশুর মুখ। ধনী বাড়ির শিশুর মুখ। এবং সমাজের নানা স্তরের মানব শিশুর মুখ। সে যাই হোক -- সকলেই তো শিশু। আজ এই কর্পোরেট ও নেট দুনিয়ার শিশু এক হাজার বছর আগের শিশুর মতো নেই। আজকের শিশুর মুখও কতো বদলে গেছে। আরও বদলে যাবে। বিবর্তনের দেওয়ালের  গায়ে আজ যে শিশুর মুখ আঁকা হচ্ছে, তা দেখে কখনো আনন্দ পাই, কখনো আঁতকে উঠি। এই পৃথিবীর ওপর বয়ে যাওয়া ঘটনার স্রোতে কত শিশু আজ দেশ ছাড়া। কত শিশু রাস্তায় শুয়ে। কত শিশু যুদ্ধে রক্তাক্ত। কত শিশু পিতৃ-মাতৃহীন, অনাথ। মনে হয়, এই সব শিশুর মুখ ও রক্ত আমি বয়ে চলেছি। এই সব শিশুও আমি। আমিও কত অসহায়। বাকরুদ্ধ। কবির মতো সেই চরণ আমি লিখেও দৃঢ় কোনো অঙ্গীকার করতে পারছি না কেন? বড়জোর শিশুর গালে কোটি কোটি চুমু দিতে পারি...।

                      ………………….. 


দেখো আমি বাড়ছি মামি

শ্রীজিৎ জানা


একরাশ মন খারাপ নিয়ে রোদ্দুর ফিরে যাচ্ছে তার বাড়ি। মাঠের কোণায় রোজ একা বসে থাকে নরম বিকেল। দুব্বোর সবুজে আদর মাখতে আসেনা প্রাণোচ্ছল শৈশব। তাকে বড়ো হতে হবে। বড়ো মানে টল স্ট্রং এন্ড শার্প। বড়ো মানে কমপ্ল্যান বয় কিম্বা গার্ল। বড়ো মানে 'দেখো আমি বাড়ছি মামি'। বড়ো মানে আড়ে-লম্বে-কথায়-কেতায়- কেরামতিতে। তার জন্য প্যাকেট ভর্ত্তি উচ্চমানের পুষ্টিকর খাবারদাবার। তার জন্য আধা-দাদা দাওয়াই। বড়ো মানে  এখন নম্বরে আর নোটে। নেট দুনিয়ায় ডজন ডজন এডুকেশনাল অ্যাপ। ছাতার মতো গজিয়ে থাকা কোচিং সেন্টার। দেশের সেরা নায়কের দেয়া এডুকেশনাল বিজ্ঞাপন। গিলিয়ে কিলিয়ে এক্কেবারে চোস্তপুস্ত করে বাজারে ছেড়ে দেবে। হাতে গরম পাতে গরম প্রোডাক্ট। সৌজন্যে রাইসমাইসআকাশ। চকচকে ডাক্তার,ঝকঝকে ইঞ্জিনিয়ার, টপক্লাস অফিসার সবই সেন্টারগুলোর বাঁ হাতকা খেল্! অম্নি গুচ্ছের অর্থ লাভ। জীবন পুরো জিঙ্গালালা! মা-বাবার চোখেমুখে লুটোপুটি দেবে তৃপ্তির হাসি। পাড়াপড়শি পেরিয়ে আত্মীয়স্বজন সবার কানে কানে ফেরি করে বেড়াবেন গর্বিত মা বাবা। 

চড়ুই-শালিক শৈশব কোথায়? কোথায় হাত ঝুমঝুম পা ঝুমঝুম ছেলেবেলা? দাদু-ঠাকুমার কাছ থেকে পান চিবোনো নেওয়া নেই! ওটা আনহাইজিনিক! পাড়ার ছেলেমেযেদের সাথে খেলবে না। ওতে টাইম লস! ইনডিসিপ্লিনড্ বিহেব! আনকালচার্ড টেনডেন্সি!বড়োদের পা ছুঁয়ে 'নম' করার সহবত নেই! বদলে গোরা কায়দায় গুড মর্নিং আর গুড নাইট। বাতাবিলেবুর ফুটবল পায়ে বিকেল নেই! কড়েডাং হাতের দুপুর নেই! ভাতভাতানি খেলার দলিজঘর নেই! ডুব সাঁতারের কুলিপুকুর নেই! চড়ুইভাতির মাছভাড়ারের মাঠ নেই! শৈশবের কাছে এখন একশ চ্যানেলে ট্যালেন্ট দেখানোর কায়দাবাজি। চোখা চোখা প্রশ্নের সপাটে উত্তর দেওযার দাদাগিরি।

টেনে হিঁচড়ে বড়ো করে দাও শৈশবকে। বড়ো। অনেক অনেক বড়ো। পাশের বাড়ির অর্চির চেয়ে বড়ো। কলিগের মেয়ের রেনেসাঁর চেয়ে বড়ো। মাসিমণির ছেলে অর্পণের চেয়ে বড়ো। ছোট বোনের মেয়ে তোর্সার চেয়ে বড়ো। বড়ো করতে পারাতেই তো মা-বাবা হওয়া সার্থকতা। এক ইঞ্চি সেখানে কম্প্রোমাইজ নয়। দরকারে দুজনে ঘোড়দৌড় লাগাবে।কোল্মীজোড় থেকে কোলকাতা। ছেলেকে বড় করা জরুরী, মেয়েকে বড় করা জরুরী।

ক্ষতি নেই যদি পাশের ঘর থেকে শৈশব শুনে তার মা-বাবার চিৎকার এবং শীৎকার। শৈশবকে শেখানো হবে কিভাবে নিজেরটা শুধু বুঝে নিতে হয়। শৈশব দেখবে বাবা-কাকার সম্পত্তি নিয়ে ছুরিকাটারি। বিজ্ঞাপন শেখাবে 'দাগ ভালো'। চরিত্রের দাগও এখন ডিটারজেন্টে ধোয়া যায়(?) আজকের শৈশব সহজেই বলতে পারছে ' মাম্মিকেই বদলে দেব, খাবারের বদলে'।

অধুনা স্মার্ট কালচার। স্মার্ট বয়,স্মার্ট গার্ল। স্মার্ট ফোন। শৈশবের হাতে হাতে ঘুরছে আলো আর অন্ধকার। ইউটিউবের কানাগলি বেয়ে শৈশব পাড়ি দিচ্ছে অন্য দুনিয়ায়। লোভ শিখছে,ঈর্ষা শিখছে,প্রতিহিংসা শিখছে।শিখছে রগরগে যৌনতা। এমন সব খেলা শিখছে যাদের  খেলার কোন সংজ্ঞায় ফেলা যাবে না। শৈশবের আইকন এখন বেনটেন,অগি। পছন্দের খাবারে যুক্ত হচ্ছে পাস্তা,প্যাগেটিস,চাউ,কেলক্স। উৎসব নয় তারা শিখছে পার্টি কালচার। শৈশব দেখছে মা বাবা মাসি মেসো কাকা কাকিমা এক টেবিলে মদের গ্লাস হাতে বেসামাল।

আজকের মা বাব চাইছে বড় ডাক্তার হোক তার সন্তান। ভালো ডাক্তার নয়। ভালো মানের ও ভালো মনের। বড় ইঞ্জিনিয়ার হোক। বড় মনের নয়। বড় অফিসার হোক। বড় মনের নয়। মানুষ না হলেও চলবে,মানি আর্নিং মেশিন হলেই খুশ। "দোষ কারো নয় গো মা"!  সবই সময়ের ফের! মানলে থাকো নইলে রাস্তা দেখো। আমরা অভিভাবক হতে শিখেছি, মা-বাব হতে শিখিনি। অভিভাবক বড়লোক হতে শেখায়,মা- বাবা শেখায় বড় মানুষ হতে। পচন তো আমাদের নিজেদের শিকড়ে। কুন্তী মানুষ করেছেন তার পাঁচ সন্তানকে। আর ধৃতরাষ্ট্রও মানুষ করেছেন তার একশ সন্তানকে। ইতিহাস কতকিছু শেখায়। আমরা শিখিনি।

এতসবের মাঝে চাপে পড়ে কাতরাচ্ছে শৈশব। গন্ধরাজ রঙের শৈশবের চোখমুখ থেকে ক্রমে মুছে যাচ্ছে হাত ঝুমঝুম পা ঝুমঝুম হীরণ্ময় আলো। অমন অমলধবল আলোর স্পর্শ যদি সমাজ না পায় আঁধারের পথ প্রশস্ত হবেই হবে। 

শৈশব কাঁদলে প্রকৃতি কাঁদে; ঈশ্বরও।

                    ………………….. 



ছোটবেলার বইয়ের রাজত্ব

অর্থিতা মণ্ডল


ছোটবেলার সঙ্গে রূপকথা সম্পর্ক  নিবিড়। একদম ছোটোবেলায় মায়ের মুখে ঠাকুরমার ঝুলির গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়ে ওঠা। আমি তখন ঘুমন্ত পুরীর রাজকন্যা। আমি তখন পাতাল কন্যা মণিমালা। একটু বড়ো হতেই ঠাকুরমার ঝুলির সঙ্গে সঙ্গে পড়ে ফেললাম দক্ষিণারঞ্জনের দাদা মশাইয়ের থলে। এই সময় লুইস ক্যারলের এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড পড়েছি। পড়েছি সুকুমার রায়ের হ-য-ব-র-ল। ওঁরই লেখা পাগলা দাশু পড়তে পড়তে স্কুলের দুষ্টুমিগুলো মনের মধ্যে গেঁথে গেছে। সুখলতা রাও, শান্তা দেবী, সীতাদেবীর নাম তখন চিনি। আমার দাদামশাই গ্রিমস ফেয়ারি টেলস - এর গল্পগুলো বাংলা করে বলতেন। আরও একটা মজার কথা, নয় দশ বছর বয়সের মধ্যেই শুনে ফেলেছি বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলা এবং দেবী চৌধুরানী গল্প। নতুন বইয়ের গন্ধ তখন থেকেই অদ্ভুত একটা আনন্দ দিত। গত শতাব্দীর আটের দশকের শেষ এবং নয়ের দশক জুড়েই বই কিনতে হলে যেতে হত কলেজস্ট্রিট। সে যাওয়া তো আর এত সোজা ছিল না ! বছরে হয়তো একবার/ দুবার যাওয়া হত। তাছাড়া অন্য কেউ গেলে তাকে দিয়ে আনানো হত। যেদিন নতুন বই হাতে পেতাম সেই দিনগুলো ছিল উৎসবের মতো। এখনো মনে পড়ে, মা বাবার হাত ধরে কলেজস্ট্রিট থেকে এক ব্যাগ বই কিনে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন নিজেকে সব পেয়েছির দেশের রাজকন্যা ভাবতাম। ওই সময়ই হাতে পেয়েছি সেরা সন্দেশ, সুজন হরবোলা, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী।আমি তখন জয়ন্তের সঙ্গে বন্ধুতা পাতিয়ে ফেলেছি মনে মনে। কখনো বা সুজন হরবোলার সঙ্গে গল্প করেছি নিজের মনে। এইরকম একটা সময় উপহার পাই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কিশোর কাহিনীর  খণ্ডগুলো। সে বইয়ের লাল রঙের মলাট আর সোনালী অক্ষরে লেখা নাম, আর আমি তার পাতা সরাতে সরাতে পেয়ে গেছি হাইডিকে। জাহানা স্পাইরির লেখা হাইডি।ওই ছোট্ট মেয়েটার সঙ্গে সঙ্গে আমিও ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছি আল্পস পর্বতের আনাচে কানাচে। হাইডি এবং হাইডির দাদুর ঘরটা আমার খুব পছন্দ ছিল। ওরকম একটা ঘর ও নরম টাটকা ক্রিম রোলের স্বপ্নে বিভোর হয়েছি কতদিন। 

 টম সয়্যার -এর অভিযান পড়তে পড়তে আমিও অ্যাডভেঞ্চারে মেতে উঠেছি। এর পরপরই অবনীন্দ্রনাথের রাজকাহিনী পড়ে রাজস্থানে যাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়েছে। শঙ্করের চিরকালের উপকথা পড়তে গিয়ে কান্নায় ভরে উঠেছে আমার  মন।

আমাদের ছোটবেলায় বইয়ের জন্য অপেক্ষা ছিল। ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। ভালোবাসাটা আর বই কেনার নেশাটা আজ আরও বেড়েছে। তবে ক্ষীরের পুতুল, টুনটুনির গল্প ভরা সেই শিশুবেলা এবং  কাকাবাবু ,পান্ডব গোয়েন্দা, ফেলুদাকে জড়িয়ে থাকা সেই কিশোরবেলার রাজত্ব এখন আমার কাছে ‘ স্লিপিং বিউটি’। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে থাকা স্মৃতির রাজ প্রাসাদ।এখন ওই রাজত্বটায় ইচ্ছে করলেই যেতে পারি না। আমায় সে ছুঁতে না পারা দূরত্ব থেকে ডাকে।

                       …………………….. 



ছেলেবেলা

কেশব মেট্যা


শরৎ যখন হেমন্ত কে জায়গা ছেড়ে দ্যায় বিষণ্ণতা নিয়ে, যখন মাঠে সোনারঙ ধানের গালে  দু এক ফোঁটা শিশির গড়িয়ে পড়ত টুপটুপ করে... আর কচি কচি গঙ্গা ফড়িং হালকা হিমেল হাওয়ায় তিড়িং বিড়িং–তখন আমার ছোট ছোট পা, হাফ প্যাটেল সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যেত মোড়ের গোপালকাকার দোকানে। এবার কেমন রঙ-বেরঙ এর ঘুড়ি এসেছে দেখতে। 

কদিন পরেই তো ধান কাটা। কদিন পরেই তো ধূধূ মাঠ। কদিন পরেই তো জয়নগরের পাটালি। কদিন পরেই তো মায়ের কাঁথা সেলাইয়ের সরু সুতো নিয়েই সারা দুপুর ছুটে বেড়ানো মাঠে মাঠে। হাতে প্যাকাটির সরু লাটাই। তখন কী আর লাটাই এই গাঁয়ের দোকানে বিক্রি হতো! বেশীরভাগ সময়ই আমাদের খবরের কাগজের ঘুড়ি। বনবাদাড়ের আঠাফলের রস দিয়ে লাগাতাম ইয়াব্বড় লেজ। যার যত বড় লেজ তার যেন তত বীরত্ব। আর যদি ২০ এর ঘর পর্যন্ত নামতা মুখস্থ করে ঠিকঠাক লিখতে পারতাম তাহলে হয়তো জুটে যেত স্বপ্নের সেই রঙিন ঘুড়ি। 

স্বপ্ন...এখন কি শিশুরা স্বপ্ন দ্যাখে? আমরা কি তাদের স্বপ্ন দেখাই? দত্যি দানোর স্বপ্ন দেখে ভয়ে জড়িয়ে ধরে ঠাকুমাকে? আমরা কি আর বলি...বাবান ওই দ্যাখো প্রজাপতি। এটা খঞ্জনা। ওই যে খয়েরি রঙা হাড়িচাচা। 

ওরা কি কখনো এমন বায়না করে–আমাকে কটা ফড়িং ধরে দাও। লেজে ঘাসের ডগা ভরে দিয়ে এরোপ্লেন বানিয়ে দেব। 

কখনো বলেছি আমরা খোলা মাঠে কিংবা ছাদে চিৎ হয়ে আকাশ দেখতে। কখনো বলেছি ওই দ্যাখো আকাশ ভরা  লক্ষ প্রদীপ। ওই যে বামদিক ঘেঁসে উজ্জ্বলটা, সে তোমার বড় ঠাকুমা।

কিংবা পাড়ার দাদা দিদির সাথে গ্রীষ্মের দুপুর ফলের গাছে ছোঁ মারা, একজনের কামড়ে আর একজনের দাঁত বসানো সে আত্মীকতা দিতে পারিনি আজকের শিশুদের। ঘুড়ির বদলে আমরা তাদের কালীপূজোর ফানুস কিনে দিয়েছি, তারা ফানুস চিনেছে। তারা প্যারাসুট রাইডিং জেনেছে কিন্তু তাদের পা মাঠ ভেঙে দৌড় লাগানো শেখেনি ওড়ার আনন্দে। আমাদের ছেলেবেলায় ঘুড়ি তো একাই ওড়েনি...ঘুড়ির সুতোর টান আর ঢিলেতে আকাশে উড়েছে আমাদের মন, কল্পনা, শৈশব।  নামতার সুরবাঁধা ছন্দে আমরা তো আসলে সমবেত কবিতায় বলেছি... সেই দৌড় সেই সমবেত গান তাদের মজ্জায় আমরা আর বুনতে পারলাম কই...

বড়োপিসিমা, মেজোমাসি, ন'কাকা এনারাও সেদিন পর্যন্ত  গেস্ট হয়ে ওঠেননি–একবাড়ীরই সদস্য ছিলাম সকলে। পিসিমার হাতের সেই তিলের নাড়ুর আব্দার আজ শোনা যায়? বড়োপিসিমার হাতের সেই পিঠে, ছোটোপিসিমার ঘরের সেই বড়ি আজ সবই মেলায় চেখে দ্যাখে আজকের শৈশব। আমাদের ছেলেমেয়েরা বাংলা ক্যালেন্ডারের সাথে বাঙালীর এই স্বাভাবিক অনুষ্ঠানেও স্বাদ পেতে ভুলে গেলো। আমরা ভুলিয়ে দিলাম। 

তাহলে কি ছেলেবেলা হারিয়ে গেলো, নাকি শৈশব এগিয়ে গেছে! আসলে কোনোটিই হয়তো নয়। যে মনের বাঁধন দিয়ে আমাদের সারল্য বাঁধা ছিলো অভাব অনটনের গাঁটছড়ায়,  প্রাচুর্য ও আধুনিকতা এসে মাটির ঘরের দেওয়ালটিকে যেমন শক্ত ও মজবুত করে ঝড় আটকে দিলো চিরতরে, তেমনি আমাদের মনের পলল অংশটিকেও কংক্রিটের বাড়ীতেই আবদ্ধ করে দিল অনায়াসে। দৃষ্টি আর দৃশ্যের মধ্যে অনুভব আর সেতু বাঁধবার ফুরসত পেলো না৷ মোবাইল ল্যাপটপের কি-বোর্ডের প্রতি যত্ন আগ্রহ পেতে দিচ্ছি শিশুআঙুলে। লাটাইয়ের কাঠের বাঁট কিংবা ফেলে দেওয়া সাইকেল টায়ার তো আজ আবর্জনা। রান্নাঘর থেকে হঠাৎ হঠাৎ ভেসে আসে না আচারের শিশি ভাঙার শব্দ। কেননা আজ প্যাকেট ভর্তি জ্যাম আর জেলি। 

যে শৈশব সাঁতার থেকে ঘুড়ি হয়ে হ্যারিকেনের আলোয় ঢুল হয়ে গড়িয়ে পড়েছে মুছে যাওয়া শ্লেটের লেখার উপর; আজ সেই শৈশবকেই অনলাইন ক্লাস থেকে গিটার হয়ে টিউটরের নজরদারিতে শৈশবকে বিপন্ন করে আমরা প্রশ্ন করতে শিখিয়ে দিলাম–

সময় কোথা সময় নষ্ট করবার!

                      ………………….. 


স্বপ্ন

মিঠু মণ্ডল


বাবার আদর আর প্রশ্রয়ে ছন্নছাড়া তৈরী হচ্ছে ঐশী। সারাদিন উৎপাত আর উদ্ভট প্রশ্নে নাজেহাল করে দিচ্ছে সবাইকে। এই অভিযোগটা অবশ্য ঐশীর মায়ের। সবাই বলতে মা, বাবা, পিসি, দাদু ,দিদা। আর হ্যাঁ দুটো বিড়াল ছানাও। কেউ রাস্তায় ফেলে গেছে। বাবার সাথে বাজারে গিয়ে দেখতে পেয়ে ঘরে এনেছে বিড়াল ছানাদের। আগে পায়ে পায়ে ঘুরতো। এখন ঐশীর উৎপাতে ওরাও নাজেহাল। দেখতে পেলেই পালায়। একচামচ কয়েতবেল, না হোক আখের গুড়, কিংবা আমের পানা ছানাদের মুখের সামনে রেখে চেপে ধরে বলবে--- খা না খা, খুব টেষ্টি। খেয়ে দেখ। বিড়াল ছানাদুটো ছটফট করতে করতে ছুটে পালায়।

একদিন ঘুমের ঘোরে হাত পা ছুঁড়ে ভয়ে কেঁদে উঠলো ঐশী। তারপর থেকে চুপচাপ। আর বিড়ালদের উৎপাত তো করেই না। বরং দেখতে পেলেই ছুটে পালায়।

ব্যাপার কি!!!

দাদা চেপে ধরতেই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো ঐশী। সেদিন স্বপ্ন দেখেছে একটা বিড়াল চেপে ধরে আছে। আর অন্য বিড়াল একটা মরা ইঁদুর মুখের কাছে রেখে বলছে--- খা না, ঐশী মরা ইঁদুরটা খা। হেব্বি টেষ্টি। ঠিক কয়েত বেলের মতো। তুই বল দাদা, আমি কি মরা ইঁদুর খেতে পারি!! তখনো ঐশীর চোখে জল। আর দাদার মুখে হাসি। বিড়াল দুটো পালোয়ানের মতো ঘরে ঢুকতেই ভয়ে দাদার পিঠে মুখ রাখলো ঐশী।

                       ………………… 



তোমার শিশু দিবস

দুঃখানন্দ মণ্ডল  

চেনা পথ, চেনা পথের বাঁক। তবু ওরা বলে পথের বাঁক সোজা নয়। হাত ধরো পথের সাথী হবো। সেদিন হাত ধরে ছিলাম। প্রতিটি বাঁকে বাঁকে শিশুর দল। এই পয়সা দে। কি আশ্চর্য বিষয় ওরা কেউ বিনা পারিশ্রমিকে টাকা নিতে ইচ্ছুক নয়। কেউ টক লেবু আর নুন নিয়ে বসেছে, কেউ বড় নালা পারাপার হওয়ার জন্য কাঠের গুড়ি দিয়ে রাস্তা করে, কেউ রাস্তার বড় পাথরটা সরিয়ে দিয়ে, কেউবা আপনার বাচ্চাকে পার করিয়ে। চাহিদা নেই কিন্তু চাওয়া আছে। নিজের জন্য নিজের বাড়ির জন্য।     

কথার ছলে সুজন হয়ে ওঠে অনিতা, রীতা, দামু, টুকাই, সত্যরা। তোরা স্কুলে যাস?  হঁ যাই তো। এখোন যাঁতে পারি নাই। ইস্কুল বন্ধ হোইং গ্যাছে। কি যেন ভাইরাস ছড়াইং গ্যাছে চারধারে। এখোন দিদিমণিরা আসেক নাই ইস্কুলে। তাই একটু তোদের সাহায্য করছি। দে দে আমার পাওনা টা দেয়। ওরা বুঝে না তুই আর তুমি এর মানে, ওদের মা আর বাবারা রোজ সকালে গভীর জঙ্গলে চলে যায় শালপাতা ভাঙতে আর বড় দিদি নিজের মতো করে সেরে নেয় রান্নাবান্না। ওরা ঝর্ণা দেখায় ওদের বয়সী তোমার আমার ছেলেমেয়েদের। ওরা কাজ করে ওরা সন্ধ্যাবেলায় মায়ের হাতে তুলে দেয় ওদের রোজগার। 

ওহ্ আজ শিশু দিবস। তুমি প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছো মেয়েকে অনলাইনে কি করাবে। তবে সেটা নিজের বুদ্ধি থেকে নয়! একেবারে ইউটিউব দেখে উৎসব ষ্টোর থেকে সব কিনে নিয়েছো। ও কি মজা মেয়েকে প্রথম সারিতে রাখতে চাও অনলাইনে। অনিতা গতকাল তোমার মেয়েকে দীর্ঘক্ষণ কোলে নিয়ে ঝর্ণা দেখিয়েছে। একটিবারও তোমাকে বলেনি কোল থেকে একবার নামাবো? ভয় পায় যদি তুমি পঞ্চাশ টাকার কম দাও! সামনে এক তারিখ আসছে বাবার ওষুধ কেনার দিন। 

আজ সকালে তোমার মেয়ে তোমার অলক্ষ্যে বাড়ির পাশে রাখা ইট সরাচ্ছে তুলতুলে হাতে। ও দেখেছে ওর মতো একটি মেয়েকে পাথর সরিয়ে সরিয়ে কাঁকড়া খুঁজতে। অবশেষে পেয়েছি বলে চিৎকার করতে। তুমি খুব ব্যস্ত মেয়ের অনলাইনে শিশু দিবসের কাজ শেষ করতে। এদিকে তোমার মেয়ে একটি একটি করে ইট সরিয়ে চলছে কাঁকড়ার খোঁজে।    

                          ...................  








সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - লিপি সেনগুপ্ত

আঁকিবুঁকি - অরণ্য মণ্ডল, আরাধ্যা জানা, অস্মিতা দে

ঠিকানা - সুরতপুর, হরিরামপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614





ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...