Thursday 31 August 2023

বৃষ্টি কথা - মৃন্ময়ী // ই-কোরাস ৯

 



বৃষ্টি প্রেম 

মৃন্ময়ী 

আমার মনের ভেতর কি আছে তুমি কী জানো বর্ষা! আমি জানি তোমার শ্রাবণ আর আষাঢ়ের ইকেবানার কথা।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ নিয়েছিলাম কোঁচড়ে, তোমায় শুধু গান শোনাবো বলে। সেদিন উপবন বর্ষার টুপটুপ বৃষ্টি আর তুমি। আমার আজও মনে আছে, আমি যাতে না ভিজে যাই, তাই তুমি আমার শরীর বর্ষাতি হয়ে জড়িয়েছিলে। বটের ওই বল্কলে সেদিন তুমি কাক ভেজা ভিজেছিলে আর আমার শরীর জড়িয়ে নিচ্ছিলে জলধারা সইবার ওম! তোমার ঠোঁট আমার ঠোঁটে! আমার অর্ধ সিক্ত বুক বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে যাওয়া তোমার বুকের নদে তার নগ্ন অবগাহন। উফ্ সেই বৃষ্টি মনে করলে আমি আজও কেঁপে উঠি! লজ্জায় লাল মুখ ঢেকে ফেলি আমার পান পাতার মতো হাতে। যেন সেই শুভ লগন আমি আবার যাপন করছি।  আচ্ছা এই যে এমন করে হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলো ছুটোছুটি করতে করতে মাঝেমাঝে সামনে এসে দাঁড়ায়! তার কী কোনো কারণ থাকতে পারে? বৃষ্টিতো প্রতিবার আসে কিন্তু সেই উপবন, তুমি আর ভিজে যাওয়া তো আর আসে না! কেন আসে না!


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Wednesday 30 August 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা- শ্রীজিৎ জানা // ই-কোরাস ৪

 


পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ৪

তনুশ্রী সিনেমাহল- টালিভাটা

শ্রীজিৎ জানা 



টালিভাটা কোথায় জানেনে? জানেন না তো? বলছি শুনুন,

 যেখানে টালির ভাটা থাকে মানে টালি তৈরীর কারখানা, সেখানকার নামই হল টালিভাটা। আরে মশাই! তেড়ে আসছেন কেন? সঠিকটাই তো বললুম। আসলে আমি হলুম জগমোহনের ডুপ্লিকেট। আবার গুবলেট করে দিচ্ছি।  জগমোহন কে? মানে বুঝলুম,সুকুমার রায়ের 'আবোলতাবোল' পড়েন নি। রায় মশাইয়ের বইয়ের কবিতার একখানা চরিত্র। জগমোহনের  মতো জিলিপির প্যাঁচ করে কথা বলা, ঠিকানার হদিশ দেওয়া আমার অভ্যেস। বদভ্যেস বললেও গায়ে মাখছি না, মাখব না। আসলে যে টালিভাটার কথা বলছি, তার অস্তিত্ব মুখে মুখে সর্বত্র। কিন্তু সরকারি কোন নথিতে টালিভাটা নামের কোন স্থানের হদিশ পাওয়া যাবে না। দাসপুর ১ ব্লকের পাঁচবেড়িয়া অঞ্চলের খাড়রাধাকৃষ্ণপুর মৌজার একটি অংশের নাম টালিভাটা। থামুন আরো খোলসা করে বলছি। ঘাটাল-পাঁশকুড়ো গামী ছুটে যাচ্ছে যে পিচের সড়ক, সেই সড়কের উপর একদিকে দক্ষিনে সুলতান নগর বাসস্টপেজ, অন্যদিকে উত্তরে বেলতলা বাসস্টপেজ, মাঝে টালিভাটা। খামোখা শুরুতেই চটে ছিলেন। টালিভাটায় টালির কারখানা ছিল। মতিলাল বেরার টালির ভাটা। টালির নামও রেখেছিলেন মতি। সেইথেকে উক্ত স্থানের নাম টালিভাটা। আবার সেই পুরানো অভ্যেস। ধান ভানতে শিবের গীত। মোটেই না। টালিভাটা গেছেন কস্মিনকালে! স্বদেশ দাদুর চায়ের দোকানে বসেছেন। নুব্জ চেহারা তার। সত্তরোর্দ্ধ বয়স। টনটনে স্মৃতি। হাত আর মুখ এখনো টাটুঘোড়ার মতো টগবগে। সিনেমাহলের কথা উঠতেই, ফোকলা দাঁত বের করে হেসে ছড়া কাটতে শুরু করে— 

ঢকর ঢকর ডায়নামা

টালিভাটার সিনামা

চোদ্দ বার ফিলিম্ কাটে

 মতি বেরার পিছন ফাটে।

বললুম, মতি বেরার এহেন কষ্টদায়ক অবস্থা কেন দাদু? উত্তরে জানলুম মতি বেরার শুধু টালির কারখানা নয়, সিনেমাহলও ছিল। তাতে জেনারেটরে চলত প্রোজেক্টর। মাঝে মাঝেই বন্ধ হত মেশিন। তখন পর্দার সামনে হ্যাজাক লাইট নিয়ে দাঁড়াতে হত কর্মীদের। এমনো দিন গেছে টিকিটের দাম ফেরত দিতে হয়েছে সিনেমা শুরুই করা যায়নি বলে। এবার তাহলে টালিভাটায় সিনেমাহল গড়ে ওঠার হালহকিকত নিয়ে দু'চার কথা হোক। মৌজার নাম খাড়রাধাকৃষ্ণপুর হলেও টালিভাটা নামটিই বারবার উল্লেখ করব সঙ্গত কারণেই।


টালিভাটায় প্রথম সিনেমাহল গড়ে ওঠে চল্লিশ- পঞ্চাশের দশকে। আজ যেখানে গার্লস স্কুল এবং শিবমন্দির, এককালে সেইস্থান ছিল জঙ্গলাকীর্ণ শ্মশান। গ্রামের সেই খাস জায়গা পরিস্কার করে তৈরি হয় সিনেমাহল। তমলুক নিবাসী পরিতোষ দাস স্থানীয় মতিলাল বেরা, পঞ্চানন প্যোড়াদের নিয়ে সিনেমাহল চালু করেন। খড়ি কাঠির বেড়ার সিনেমা হল। সামনের দিকে দর্শকদের বসার জন্য চট পাতা থাকত। পেছনের দিকে গুটিকয়েক কাঠের পাটার উপর বসার আসন ছিল। ওই  সিনেমাহলের প্রথম ছবির নাম ছিল 'হ্যাঁ'। টিকেটের মূল্য ছিল তখন ঊনিশ পয়সা। স্বদেশবাবুর বয়স তখন সাত-আট বছর। বেড়ার ফাঁক দিয়ে তিনি উঁকি মেরে দেখতেন সিনেমা। চাঁদপুর নিবসী লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষক শ্রী ঊমাশঙ্কর নিয়োগী মহাশয় জানান,* ওই সিনেমাহলের নামছিল 'কমলা'। আমার দেখা ওই সিনেমাহলে ছবি ছিল 'লালুভুলু'।'  কমলা' সিনেমাহলের ছবি  প্রচারের কায়দা ছিল ভারী আশ্চর্যের। পাট থলির চটে পোস্টার চিটিয়ে তাকে পিঠে ঝুলিয়ে নিতেন। আর হাতে চোঙা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় প্রচার করে বেড়াতেন। কিন্তু সেই সিনেমাহল বছর তিনেক চলার পর বন্ধ হয়ে যায়। তখন মতিলাল বেরা তার বাড়ির সংলগ্ন জায়গায় গড়ে তুললেন নিজের সিনেমাহল 'মিলনী'! এই সিনেমাহলেও মেঝেতে চট পেতে আর কাঠের পাটাতনকে উঁচ করে বেঁধে সিট তৈরী করে বসার বন্দোবস্ত ছিল। সেই মিলনী সিনেমাহলও কয়েক বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। মাঝে কেটে যায় বেশ কয়েকটা সাল। ইতিমধ্যে কল্মীজোড় মৌজায় তৈরী হয় 'মহামায়া টকিজ'! যার কথা বলব পরের পর্বে। থাক সে পরের পর্বের জন্য তোলা। এদিকে তখন টালিভাটা সংলগ্ন এলাকার মানুষের মনে লেগে গেছে সিনেমার প্রতি অনুরাগের ছোঁয়া। 

অন্যদিকে 'কমলা' সিনেমাহলের চিফ অপারেটরের সঙ্গে স্থানীয় মুকুন্দ শাসমলের গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। সেই বন্ধু স্বচ্ছল পরিবারের মুকুন্দ বাবুর মাথায় সিনেমাহল তৈরীর আইডিয়া ঢুকিয়ে দেন। এরই মাঝে রাধাকান্তপুর গ্রামের জনৈক ব্যক্তির কাছ থেকে বর্তামান সিনেমাহলের জায়গাটি মুকুন্দ বাবু কেনেন স্বল্প মূল্যেই। তিনিও সিনেমার প্রতি খুবই উৎসাহী ছিলেন। ব্যস্, মিলে গেল দু'য়ে দু'য়ে চার। মেইন সড়কের ধারে উঠল কংক্রিটের দেয়াল। মাথায় চাপল টিনের ছাউনি। ১৯৮৮ সালের ১৮ই আগষ্ট টালিভাটার বুকে 'তনুশ্রী' সিনেমাহলের হল শুভ মহরত। প্রথম ছায়াছবি ছিল 'চাওয়া পাওয়া'। মুকুন্দ বাবুর ভাই দুলাল শাসমল মহাশয়কে জিগ্যেস করলুম, তনুশ্রী নামটাই কেন বেছে নিলেন? তিনি জানান, " দাদার ছোট মেয়ের নাম ছিল তনুশ্রী। তখনকার সেই মিষ্টি নামটাই দাদা বেছে নিলেন সিনেমাহলের জন্য।" রমরমিয়ে চলতে থাকল সিনেমাহল। শোয়ের পর শো হাউসফুল। দুলাল বাবু জানালেন," প্রথমদিকে যথেষ্ট ভীড় হত দর্শকদের। কয়েকটা সিনেমা, যেমন শ্যামসাহেব, ছোটবউ, গুরু, লাঠি যথেষ্ট লাভ এনে দিয়েছিল। টিকিট ব্ল্যাক পর্যন্ত হত অনেক ছায়াছবিতে।"  পাঁচবেড়িয়া রামচন্দ্র স্মৃতি শিক্ষা মন্দিরের ইংরেজি বিভাগের বিশিষ্ট শিক্ষক শ্রী অশোক গোস্বামী জানান তনুশ্রী সিনেমাহলে ছবি দেখার কৈশোরের স্মৃতি, "তখন আমরা সিনেমা বলতাম না,বই বলতাম। কৈশোরে বড়দের এড়িয়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখব--এই ভাবনা মনে আসাটাই ছিল অকল্পনীয়। তবু জোটপাট করে রব তুলতাম, চল আজ কি বই চলছে দেখতে যাব। কিন্তু বন্ধদের সাথে যাওয়া হয়নি কখনো। তবে বড়দের সাথে তনুশ্রী হলে গেছি বেশ কয়েকবার। দেখেছি 'হাতি মেরে সাথী',  'শোলে', 'বাঞ্ছারামের বাগান',  'টগরী', 'সমাধান' এর মতো আরো অনেক সিনেমা।"।

তনুশ্রী সিনেমাহলের সিট সংখ্যা ছিল চারশ। তিনটে স্টলে ভাগ ছিল দর্শক আসন।  তিনশ চেয়ার আর ফ্রন্টে একশ বেঞ্চ ছিল বসার জন্য। শুরুর দিকে ৭৫ পয়সা ফ্রন্ট,এক টাকা মিডিল আর দেড় টাকা টিকট মূল্য ছিল ফার্স্ট ক্লাস সিটের। ব্যালকনি ছিল না। প্রোজেক্টার মেশিন থেকে সবকিছুই ছিল মুকুন্দবাবুর নিজস্ব। স্টাফ ছিলেন দশজন। গোঁসাইবেড় (খুকুড়দহ) গ্রামের নারান মাইতি ছিলেন চিফ অপারেটর। তাঁকে সাহায্য করতেন রামকৃষ্ণ জানা ( টালিভাটা) এবং দুলাল বাবু নিজেও। টিকিট কাউন্টারে বসতেন মদন প্যোড়া ( কলমীজোড়)।  মেছেদার প্রেস থেকে আসত নীল সাদা আর লজল সাদা পোস্টার। কখনো বাদামী- সাদা রঙেও ছাপা হত। এলাকা ভিত্তিক পোস্টার সাঁটাতেন লক্ষ্মীকান্ত সামন্ত ( টালিভাটা) এবং প্রতাপ মন্ডল (টালিভাটা)। প্রচারের আরেক মাধ্যম ছিল মাইক। কলোড়া নিবাসী রাম প্যোড়ার ছিল নিজস্ব মাইক। তার সাথেই চুক্তি ছিল সারাবছরের প্রচারের। তনুশ্রী সিনেমাহলে তিনটা ও ছ'টার শো হত প্রথম থেকেই। ইতিমধ্যে টালিভাটা একটি গঞ্জ এলাকা হয়ে উঠেছিল। পরে হাটও বসতে শুরু করে। দোকানপাতিও যথেষ্ট গড়ে ওঠে। সেই সমস্ত স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অনুরোধে প্রতি শুক্রবার ন'টা- বারটার একটি শো চলত। প্রাপ্ত বয়স্ক ছাড়া ওই শো টাইমে কারো প্রবেশে অনুমতি থাকত না। সাধারণত ভূতের সিনেমা আর এ মার্কা কিছু ছায়াছবির আকর্ষণে শুক্রবারের  নাইট শোয়ে তনুশ্রী সিনেমাহল গমগম করত। 

কিন্তু ক্রমেই খালি পড়ে থাকে দর্শক আসন। আশেপাশে তখন গড়ে উঠেছে মিনি পর্দার ভিডিও হল। লসে রান করছে দেখে তনুশ্রী হল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় মালিকপক্ষ।  সালটা ২০১০ তনুশ্রী সিনেমাহলে তালা পড়ে। বর্তমানে মূল কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকলেও, তা গুদামঘরে পরিণত হয়েছে। তবু চলতি পথে চোখ পাতলে দেখবেন এখনো দেয়ালের উঁচু জায়গাটায় তনুশ্রী নামটা ফিকে রঙের রেখায় কোনক্রমে টিকে আছে। আর আছে কত অনেক সিনেপ্রেমীদের স্মৃতিতে।



তথ্যঋণ :—

শ্রী ঊমাশঙ্কর নিয়োগী , চাঁদপুর

শ্রী স্বদেশ মাইতি, খাড়রাধাকৃষ্ণপুর 

শ্রী দুলাল শাসমল,খাড়রাধাকৃষ্ণপুর 

শ্রী অশোক গোস্বামী,  কাদিলপুর

                 ……………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


Tuesday 29 August 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা - মহাশ্বেতা দাস // ই-কোরাস ৩৪

 



রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ৩৪

মাটির টানে

মহাশ্বেতা দাস 



    "রাজা সবারে দেন মান

     সে মান আপনি ফিরে পান।" 


    কখনও বোলপুর তো কখনও শিলাইদহ - কলকাতাতেও মাঝে মধ্যে…. এভাবেই নানা কাজের তাগিদে কাটছে রবির দিনগুলি, আর পাশাপশি লেখালেখির কাজ তো আছেই। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এতদিন "নৌকাডুবি"  উপন্যাসটি লিখছিলেন, এখন সে কাজ শেষ হয়েছে। লিখতে শুরু করেছেন "খেয়া" কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি। এছাড়াও জমিদারি দেখাশোনার সুবাদে তিনি উপলব্ধি করলেন আমাদের দেশের অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। তাই দেশের উন্নতি সাধন করতে হলে কৃষির উন্নতি সাধন অবশ্য কর্তব্য। 


    " ফিরে চল মাটির টানে

       যে মাটি আঁচল পেতে

      চেয়ে আছে মুখের পানে।" 


রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ভাবনায় সৃষ্টিশীলতায় যেমন আমরা বৈচিত্র্য দেখতে পাই তেমনই বিভিন্ন গঠনমূলক ও স্বাবলম্বী সমাজ সংগঠন মূলক ভাবনাতেও স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন যথেষ্ট। বিপুল পরিমাণ সাহিত্যসম্ভার রচনার পাশাপাশি গ্রামীণ ভারতের পল্লীপুনর্গঠন নিয়েও ভেবেছেন যথেষ্টই। আর সেই ভাবনাগুলিকে বাস্তবে রূপ দিতে দুঃসাধ্য কর্মের ব্রতে ব্রতী হয়েছেন তিনি। 


" জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষীর।" 


মহাজনদের শোষণ থেকে বাঁচাতে হবে প্রজাদের। তাই স্থির করলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধু শ্রীশচন্দ্রের পুত্র সন্তোষচন্দ্রকে আমেরিকায় পাঠাবেন কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্যে। সেসময়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেদের  সাধারণত ব্যারিস্টারি পড়তে বিদেশে পাঠানো হত। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের এই সিদ্ধান্ত অভিনবত্বের দাবীদার। বিদেশে যাবে ছেলেরা…. তাই দেশের কথা একটু ভালো করে জেনে যাওয়া প্রয়োজন। তাই এদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করলেন শান্তিনিকেতনে সতীশ রায়, মোহিত সেন ও বিধুশেখর শাস্ত্রীর মত শিক্ষকদের কাছে। 


   ভারতবর্ষের কৃষি ব্যবস্থায় যেমন নূতন দিগন্ত উন্মোচনের লক্ষ্যে নিজের পুত্র কে বিদেশে পাঠানোর জন্যে তৈরী করছেন তেমনি মহাজনদের শোষণের হাত থেকে প্রজাদের বাঁচাতে ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন পতিসর কালিগ্রাম কৃষি ব্যাঙ্ক । এরফলে প্রজারা মহাজনদের সমস্ত ঋণ শোধ করে ঋণ মুক্ত জীবনের সন্ধান পেল। আর রক্তপিপাসু মহাজনরা বাধ্য হলেন তাদের ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র চলে যেতে। 


     ১৯০৬ সালের এপ্রিলে কলকাতা থেকে জাহাজে প্রশান্ত মহাসাগরের পথে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র কে রওনা করিয়ে দিলেন কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্যে সুদূর আমেরিকায়। ওখানকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন তাঁরা। বিদেশে থাকা কালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক চিঠিতে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখলেন - "আমাদের দেশের হাওয়ায় কী চাষা কী ভদ্রলোক কোনমতে সমবেত হতে জানে না। তোরা ফিরে এসে চাষাদের মধ্যে থেকে তাদের মতি গতি যদি ফেরাতে পারিস তো দেখা যাবে।" 


     ১৯০৯ সালে কৃষিবিদ্যায় বি. এস ডিগ্রি অর্জন করলে রবীন্দ্রনাথ পুত্রকে কৃষি বিষয়ক গবেষণাগার পরিদর্শনের জন্য পাঠিয়ে দিলেন ইউরোপ। এরপর ৫ ই সেপ্টেম্বর রথীন্দ্রনাথ কলকাতায় ফিরে আসেন। প্রথমে কাজ শুরু করেন পতিসরে পরে বোলপুরের মাটিতে পরিপূরক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠিত হলে ওখানে চলে আসেন বাবামশায়ের নির্দেশেই। 

    

       ছেলের মুখে কৃষিবিদ্যা, প্রজনন শাস্ত্র শুনতেন খুব মন দিয়ে। রথীন্দ্রনাথের কথায় - "সেই সময়টাতে আমরা পিতাপুত্র পরস্পরের যত কাছাকাছি এসেছিলাম তেমন আর কখনও ঘটে নি।"  এভাবেই "বাবামশায়ের" ইচ্ছেপূরণকে জীবনের একমাত্র ব্রত করে নিয়েছিলেন রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ। আর রবীন্দ্রনাথ জমিদার বংশের উত্তরাধিকার হয়েও জমিদারি সত্তাকে কঠোরভাবে শাসন করে দুঃস্থ অসহায় কৃষকদের সেবায় আত্মনিবেদন করেছিলেন। জমিদারি বিলাস বহুল জীবনের ভোগবিলাসের প্রবৃত্তিকে কঠিন শাসনে বেঁধে মানবতাবোধের নজিরবিহীন বিকাশ ঘটিয়েছিলেন জীবনব্যাপী। 


         " তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে

                     করছে চাষা চাষ--

          পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,

                   খাটছে বারো মাস।

          রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে,

           ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে

             তাঁরই মতন শুচি বসন ছাড়ি 

               আয় রে ধুলার 'পরে।"  

                 …………………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ ভাবনা - মহাশ্বেতা দাস

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Saturday 26 August 2023

মানবেন্দ্র পাত্র এর কবিতা // ই-কোরাস ১৪৩

 



মানবেন্দ্র পাত্র এর কবিতা 

১.

মে 'মাস


কেউ কেউ বেঁচে থাকে।


সহজে মরে না।


আজকেও মে মাসের বিকেলে 

এমনই ঝরে ঝরে পড়ছে আবেশ

তাই—

এখনও বিকেল দাঁড়িয়ে আছে রক্তিম…


মে মাস ফিরে এলে 

নির্জনতা ফিরে এলে 

আমিও ফিরে আসি


শান্ত আলোঘরে 

কার মুখ গাঢ় হয় 

আমৃত্যু, মায়ায়… 


২.

পাখি


পাখি পোষার শখ ছিল না কোনোদিন। 


অথচ একটি পাখি ডানা মেলত

আকাশে, গাছে, ডালে তার জন্য 

আকুলতা ছিল,আনন্দ ছিল।


পাখিটি আসে। 


আমি তার ডাক পুষে রাখি।


আমার আকাশ পুষে রাখে সে। 


৩.

ঘুম


বহুকাল ঘুমোই নি।

বহুকাল জেগে আছি রাতের পাশে। 


মানুষের আত্মার কাছে 

রাতেরও কি আত্মা জেগে আছে! 


এমন ঘুমের ভেতর 

ডেকে আনি কোন্ আচমন… 


বহুযুগ স্বপ্নময়, জেগে আছে ঘুমের দু-চোখ। 



৪.

পুষ্পমঞ্জরি 


আমি তোমাকে দেখি

অদ্ভুত ঘোর লাগা চোখে

ফুটে ওঠো---

আমি আর কিছুই দেখি না,

মায়াহীন বিবশ সময় এসে বসে থাকে একা

ফুলের জন্য কার আর কান্না পায়?

তবু, তুমি রোজ দেখো 

সূর্য-আকাশ।


আমাকে দেখি না আমি

কেবলই নিজের জন্য 

ফুটিয়ে তুলি এই তোমার নিবিড় একক।


কেউ ডাকেনি আজও কাউকে...


অদ্ভুত ঘোর লাগা চোখ 

কোনোদিন ফোটাতে পারি না 

বাগানে।

                 —-----------


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Thursday 24 August 2023

বৃষ্টি কথা - মানবেন্দ্র পাত্র // ই-কোরাস ৮

 



ও মেঘ,ও শ্রাবন—কতকিছু মনে পড়ে…

মানবেন্দ্র পাত্র


১.

যে সন্ধ্যায় তোমার জন্য আমি আকুল। মাঠের শূন্যতায় বসে আছি।দুপা ছড়িয়ে। গান গাইতে গাইতে একটা হাওয়া এসে সাথে বসে।বারবার দেখা হয় তার সাথে। দেখা হয় । তার ঘরে যাই৷ সে আমায় টেনে নিয়ে যায় তুমুল বরষায়। কথা বলে। কত কথা। কি গভীর আলাপ।নদীর কাছে প্রিয় ডুলুঙয়ের পাশে গিয়ে দেখি— শুয়ে আছি৷ আমার পূর্বেকার শ্রুতিকবিতাগুলো জোনাকির আলো জ্বেলে রেখেছে এ রাতে। 

আমি এক অদ্ভুত তোমাকে দেখে কুড়িয়ে নিচ্ছি জল। এরকম শ্রাবনমাসের কাছে আর কি কেউ যেতে পেরেছিলে?আরও অনেকেই বৃষ্টির, মেঘের নাভির কাছে চলে আসে। সারারাত হাঁটতে বেরিয়েছিলাম সেইসব বৃষ্টিলেখায়।

আমাদের অনুযোগ ছিল না।এই জন্ম থেকে হেঁটে এসেছিল কত জন্ম-কত জন্মান্তর-কত বৃষ্টি। কেউ কি আমায় চিনত– আমি কি তাকে? 


বৃষ্টির মাসে যদি বলি—একজন এলোকেশি আমাকে টেনে নিয়ে যাক। পাশাপাশি আমিও যেন কতকাল বিরহযাপন করে আজ তাকে পেয়েছি বলে নিশ্চিত মরে যেতাম। অথবা-  তার সেই আশ্চর্য মায়াগন্ধের পাশে অদ্ভুত ঘোর লাগা জলের গন্ধ জেগে থাকত।এই গল্পের কোনো সূত্র নেই৷ কোনো বিপ্লব নেই।


মানুষের জন্য কান্নাকাটি নেই।আমাদের ঘর ও আসবাব চুরমার করে দেওয়া প্রতিটি মুহুর্ত আছে।ভেঙে ফেলা একজন ভাঙচুর জানা লোক। এই বর্ষনের রাতে সাতসমুদ্র ঢেউএ নেচে উঠছে তার হত্যা। পাশাপাশি উত্তর আকাশের

কালপুরুষের উজ্বল চোখের ভেতর সেই অতল আবিস্কারের নেশায় ডুবে যাচ্ছেন মায়ালোভি।

জলের জন্য মরে যাওয়া যে সব অলিক ঘাস, তারাও বেঁচে উঠছে বিচিত্র অন্ধকারে। এমনই বৃষ্টির রাতে কার হৃদয়ের বাঁশি ফুঁকে ফুঁকে এক এক এক, দুই দুই দুই,তিন তিন তিন—অলীক মানুষ এসে বসে থাকো এত যুগ!


২.

আলো জ্বেলে কুড়োতে কুড়োতে থাকা সেই দেহ ও শরীরের সাতপাঁচ ঘেঁটে খাওয়া অসুখ—ঘুমের বিভিন্ন স্তরের ভেতর তার বিছানা। আর মনে পড়ে না। এই গল্পের চরিত্ররা সবাই জন্মলোভি। মনে পড়তে পড়তেই আবছা হয়ে ওঠে জানালা। 

বৃষ্টির রাতে জেগে উঠে দেখি— আমাদের ঘর ভেসে গেছে৷ খড়ের চাল ফুটো হয়ে নামছে শ্রাবন। 


আমার পূর্বজন্মের নৌকো নেই। নদী নেই।  কালপুরুষের এই রাতের আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। 

'সে যেন অনেক রাত্রি জেগে হয়েছে উন্মাদ

সে যেন আমার

হৃদি বরাবর রাখে তার পদপল্লব।

তুমুল— আত্মবিষাদ'...


৩.

আজ ছুটি।  আজ শ্রাবন। বউয়ের বেনি করে দেওয়া প্রতিটি চুলের সংলাপে আমি ক্ষ্যাপা লোক। চুমু খাই৷ ছিঁড়ে দিই পাতলা ধাতব। তারপরও যেন তৃষ্ণা জেগে থাকে। 


ময়ূর নাচবে। এই বর্ষা ঋতূ ভেসে যাবে ডুলুং এ। 

আমি কি তখনও সাদা— মেঘ খুঁজে খুঁজে আনব 

রোগের সিমটোম! আহা! বজ্রপাত, এসো।

জানালায় এসেছে ঋতুবতী হওয়ার চোয়াল 

জানালায় মন্ত্রতন্ত্র জানা এসরাজ জেগে উঠেছে। 

জানালায় নিতম্ব- হলুদরঙ, ময়ূরীর আত্মালাপ আমি দেখেছি বলেই— পোশাক আশাক খুলে রাখি। সে আমায় চিনতে পারে যদি৷ সে আমায় স্নানের ভেতর নিয়ে চলে যাক। জলের দেবীর কাছে আমি আমার গোপন আসন দেখাবো। 


তাতে আর আশ্চর্য কি!


এরূপ বৃষ্টি কবে হবে?

আমি গান গাইবো — সাওন রাতে যদি….

.......................................



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - অভিষেক নন্দী

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


Tuesday 22 August 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা - মহাশ্বেতা দাস // ই-কোরাস ৩৩

 



রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ৩৩

দুবেলা মরার আগে মরব না

 মহাশ্বেতা দাস 


      "আমার ভার লাঘব করি

       নাই বা দিলে স্বান্ত্বনা…" 


     মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু শোক কেটেছে কি কাটেনি…. মেজ মেয়ে রাণীর শরীরে দেখা দিল যক্ষ্মা। মায়ের মৃত্যুর পর মাতৃহারা সন্তানদের  সবাইকে কবি শান্তিনিকেতন এনেছিলেন ঠিকই কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হাওয়া বদলের জন্যে রানী কে নিয়ে এবার পাড়ি দিতে হল হাজারীবাগ। আলমোড়ায় বেশ কিছুদিন থাকলেন বটে কিন্তু রাণীর স্বাস্থ্যের উন্নতি হল না। শেষ পর্যন্ত রাণীর জেদাজেদিতেই ফিরতে হলো কলকাতায়। 

      গৃহিণীর অভাবে আর পাঁচটা সংসারের মতোই ছন্নছাড়া অবস্থা…. মীরা আর শমীন্দ্র জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কাছে, রথীন্দ্রনাথ স্কুল বোর্ডিং এ আর বেলা স্বামীগৃহে। অসুস্থ রাণীকে নিয়ে দুর্ভাবনা আছে ঠিকই তবু লেখালেখি চলছে যথানিয়মে। কবিমন অদ্ভুতভাবে নিরাসক্ত…. সে জানে সংসার কর্মভূমি, কর্তব্যস্থল; অফুরন্ত চাহিদা পূরণের দাবী নিয়ে সে দাঁড়ায় নিয়ত। তারই মাঝে নিজ ভাবনায় অবিচল থেকে সৃষ্টিশীলতায় মন দিতে হবে। তাই বঙ্গদর্শন পত্রিকার জন্যে লেখালেখি তো চলছেই…. হাজারিবাগে বসেই ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন "নৌকাডুবি" উপন্যাস। পাশাপাশি চলল কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনার কাজ। সুহৃদ মোহিতচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় "মজুমদার লাইব্রেরী" থেকে প্রকাশিত হলো "শিশু" কাব্যগ্রন্থ যা বাংলা সাহিত্যের শিশুতোষ ভান্ডারে হয়ে রইল এক কালজয়ী সম্পদ। 


      "খোকার মনের ঠিক মাঝখানটিতে

        আমি যদি পারি বাসা নিতে - 

        তবে আমি একবার

       জগতের পানে তার

       চেয়ে দেখি বসি সে নিভৃতে।" 


     শ্রাবণ-দিনে শিশু কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি লিখতে গিয়ে সে সম্বন্ধে কবির ভাবনা - " আমি আজকাল শিশুদের মনের ভিতরে বাসা করে আছি। তেতালার ছাদের উপর আমার নিজের শৈশব মনে পড়ছে।"  

    শিশুমনের কল্পরাজ্যে সে কখনও চাঁপা ফুল হয়ে মায়ের সাথে দুষ্টুমির খেলা খেলে…. কখনও বা নিজেকে কুকুরছানা, টিয়াপাখি ভেবে সহমর্মী হয়ে ওঠে। আবার ক্রমবিকাশমান ভাবনায় সে বীরপুরুষ সেজে ডাকাতের হাত থেকে মাকে উদ্ধার করতে চায়। কিন্তু শিশু কাব্যগ্রন্থের কবিতা গুলি বিশ্লেষণে দেখা যায়….  শিশু পাঠশালায় গিয়ে গুরুমশায় কে প্রসন্ন দৃষ্টিতে দেখতে পারে না! …. এ যেন রবির নিজেরই বাল্যস্মৃতি। তবে, এখানে কবিতাগুলির মধ্যে সবই প্রায় খোকার ভাবনা, খুকির ভাবনা একটিও নেই বলে অভিযোগ করেন মোহিতচন্দ্র সেনের স্ত্রী সুশীলা দেবী। কবি জবাবে বলেন - " যে ব্যক্তি লিখেছে সে আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে খোকাই ছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে খুকি ছিল না। ….. তাছাড়া আর একটি কথা আছে - খোকা এবং খোকার মার মধ্যে যে ঘনিষ্ঠমধুর সম্বন্ধ সেইটে আমার গৃহস্মৃতির শেষ মাধুরী - তখন খুকী ছিল না - মাতৃশয্যার সিংহাসনে খোকাই (শমীন্দ্র) তখন চক্রবর্তী সম্রাট ছিল। " 

   

    যাইহোক, এদিকে কলকাতায় ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই রাণীর মৃত্যু হল। মাত্র দশ মাসের মধ্যেই রবি-আকাশ থেকে খসে গেল দু-দুটি তারা। 

    

   অঘটন একা আসে না! শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে ঘটে গেল আর এক অঘটন। বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন দুর্লভ চরিত্রের শিক্ষক সতীশচন্দ্র রায়। মাঘোৎসবের পর তাই ছাত্রদের এখানে রাখা নিরাপদ নয় ভেবে বিদ্যালয় আপাত ভাবে স্থানাতরিত করা হল শিলাইদহ- কুঠিবাড়িতে। এবার হেড মাস্টার হয়ে এলেন মোহিতচন্দ্র সেন। 


    রবীন্দ্রনাথ, যিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান…. তিনি কি শুধু সাহিত্য রচনা আর বিদ্যালয়ের কাজে সীমাবদ্ধ থাকতে পারেন! বিশ্বভরা প্রাণের উদ্দীপনায় মেতে ওঠেন  তাই তিনি হাজারও কাজে….. 

   

        "ধর্ম আমার মাথায় রেখে

           চলব সিধে রাস্তা দেখে 

           বিপদ যদি এসে পড়ে

        সরব না, ঘরের কোণে সরব না 

       আমি ভয় করব না ভয় করব না।" 


       ১৯০৫সালের ১৬ই অক্টোবর লর্ড কার্জনের "বঙ্গভঙ্গ" প্রস্তাব অনুসারে "Divide and Rule" নীতির কার্যকরি অভিযানের শুরু হয় । ধর্মপ্রাণ ভারতবাসীর ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে জাতীয়তাবোধকে বিচ্ছিন্ন করার ধারালো অস্ত্র হিসেবে ঔপনিবশিক ব্রিটিশ সরকার ব্যবহার করছেন ভারতবাসীর  ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসকে! তৎকালীন ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ কে লর্ডকার্জন এজন্য প্রচুর উৎকোচও প্রদান করলেন। যার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে আমাদের পরবর্তী কয়েক দশক ধরে।


          ঔপনিবেশিক কূটনীতির এই বিয়োগান্তক পরিণতি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম কিংবা পৌত্তলিকতাকে কোনদিন নিজের জীবনে স্থান দেননি তিনি। যদিও তিনটি ধারায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল (স্বদেশী আন্দোলন, চরমপন্থী বৈপ্লবিক আন্দোলন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্ব ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্যে সংস্কৃতিক আন্দোলন) । তবু অন্যান্য গুলিকে তিনি "রাজশক্তির কাছে ভিক্ষাবৃত্তি" বলে মনে করেছিলেন। 

       

        "আমাদের নিজের দিকে যদি সম্পূর্ন ফিরিয়া দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশ মাত্র কারণ দেখি না।" 

        হিন্দু-মুসলমান মিলনের সৌরভেই সুরভিত হোক বাংলার মানুষের বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের জীবন ঐতিহ্য… এই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনা। তাই সেদিন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সম্প্রীতির রাখিকেই হাতিয়ার করেছিলেন তিনি। 

          রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে , অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্যে সংস্কৃতিক ঐক্য বন্ধনের ডাক দিয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।


         অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর "রবিকা'র" সেই লড়াই কে "ঘরোয়া" তে ব্যক্ত করেছেন। সেদিন সকাল বেলা পায়ে হেঁটে গঙ্গার জগন্নাথ ঘাটে পৌঁছে গেলেন সবাই। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ছাদ থেকে রাস্তার দু-পাশে লোকে লোকারণ্য। মেয়েরা শাঁখ বাজাচ্ছে, ফুল ছড়াচ্ছে... মনিব চাকর সবাই একসাথে স্নান করে একে অপরের হাতে রাখি বাঁধলেন। সারা বাংলা সেদিন পালন করল অরন্ধন দিবস। হাঁটতে হাঁটতে পাথুরে ঘাটার বীরুমল্লিকের আস্তাবলে সহিসদের হাতে রাখি বাঁধলেন, সহিসরা তো অবাক!! তারপর চিৎপুরের মসজিদে গিয়ে মৌলবীদের হাতে ও রাখি বাঁধা হল। এভাবে সেদিন রাস্তায় যাদেরই দেখা পাওয়া গেছে.... ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কে পরানো হল রাখি আর গাওয়া হয়েছিল সেই গান - 


     "বাংলার মাটি বাংলার জল 

       বাংলার বায়ু বাংলার ফল 

পূণ্য হউক পূণ্য হউক পূণ্য হউক হে ভগবান।"

               …………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ ভাবনা - মহাশ্বেতা দাস

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪



ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...