Wednesday 31 January 2024

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ১৪

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ১৪

মণিহার টকিজ – গোপীগঞ্জ, দাসপুর

শ্রীজিৎ জানা 


মশাই, শুধুমাত্র তাজমহলে পড়ে থাকলেই হবে! আগে বাড়ুন। সাধে কি কবিগুরু আক্ষেপ করেছেন– 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া'। দেখার ইচ্ছে হলে শাজাহান আরও খুঁজে পাবেন। আরে মশাই সে নাইবা মুঘল সম্রাট হোলো, মনে ও মেজাজে তিনিও রাজা, তিনি রাজা, তাঁর আশ্চর্য কর্মকান্ডের। তিনি ছিলেন বড় ব্যবসায়ী। তার উপর একবার কলকাতার ধাপার মাঠে  বাঁধাকপি চাষ করে সোরগোল ফেলে দেন। খেতাব পান 'ক্যাবেজ কিং’ নামে। প্রভূত অর্থ আসে তাঁর হাতে। সেই অর্থে তিনি জনগনের চলাচলের সুবিধার্থে সড়ক নির্মান করে দিলেন। রূপনারায়ণ নদের পাড়ের গোপীগঞ্জ থেকে সোনাখালি হয়ে দাসপুর ছুঁয়ে রসিগঞ্জ ডিঙিয়ে সোজা ঘাটাল অব্দি। আর সহধর্মিণীর নামে সেই সড়কের নামকরণ করলেন রাইমণি রোড। ভাবুন পত্নীপ্রেম কারে কয়। বুঝেছি, বিরক্তি বাড়ছে কারণ সিনেমাহলের কথা বলতে গিয়ে সড়কের গল্প ফেঁদেছি। চটে চট্টগ্রাম না হলে বলি, এবারের সিনেমাহলের অবস্থান দাসপুর -২ ব্লকের গোপীগঞ্জে। সেখানে যাওয়ার রাস্তাটা তাই আগেভাগে বাতলে দিলুম। তবে আজ গোপীগঞ্জ যেতে ঘাটাল-পাঁশকুড়া সড়কের সুলতাননগর মোড় থেকে সোজা পুবের সড়ক ধরে গেলেই হাজির হওয়া যাবে গোপীগঞ্জে। রূপনারায়ণের পশ্চিম পাড়ে গোপীগঞ্জ। নদ ডিঙোলে পুব পাড়ে হাওড়া আর হুগলী জেলা। গোপীগঞ্জ সেই অতীত কাল থেকেই ছিল জমজমাট একটি গঞ্জ। গঞ্জ সংলগ্ন আরও একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম হল আরিট। আরিটের প্রসিদ্ধি তার দুগ্ধজাত দ্রব্যের জন্য। আরিটে প্রচুর গোয়ালাদের বাস ছিল। গোপী তথা গোয়ালিনীরা দুগ্ধজাত পসরা নিয়ে ওই নদের পাড়ে ভীড় জমাত বলে নাম হয় গোপীগঞ্জ। ওখান থেকে ঘি, ছানা, মাখন, খোয়া জলপথে চলে যেত মহানগরে। সেই গঞ্জেই স্বাধীনোত্তর কালে বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে স্থাপন করেন 'গণেশ টকিজ' সিনেরমাহল। হাওড়া জেলার বাগনানা নিবাসী নবকুমার রায় গোপীগঞ্জে গড়ে তোলেন 'গণেশ টকিজ' সিনেরমাহল। দীর্ঘদিন চলার পর একসময় সেই টকিজ তিনি বিক্রি করে দিতে চাইলেন। সেইসময় রহমান ভাইদল ওই টকিজ কিনে নেন।


পাঁচ ভাই যৌথভাবে দেড় বিঘা জায়গা সহ 'গণেশ টকিজ' কিনে নিলেন। নতুন করে সাজালেন সিনেমাহলকে। নামও বদলে দিলেন। নতুন নাম রাখলেন 'মণিহার'। পাঁচ ভাইয়ের কনিষ্ঠ সেখ হাবিবুর সাহেবকে জিগ্যেস করলুম মণিহার নাসের কারণ কী? মানুষটি অতিসজ্জন। স্মিত হাসি ছড়িয়ে জানালেন, "এই নামটার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের পারিবারিক এক মহিলার নাম। সেইজন্য নামের কারণটি বিস্তারিত ভাবে বলা যাবে না"। তাঁর অমতের কারণকে শ্রদ্ধা জানালুম। কিন্তু অন্য সমস্ত বিষয়ে সযত্নে বললেন – "মোশান পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার ছিলাম আমি। কলকাতা যেতুাম মিটিংয়ে। যখনই কোন ছবি রিলিজ হত, তার সমস্ত খবরাখবর পেতুম। তখন আমাদের সিনেমাহলের রমরমা সময়। ওপারের দ্বীপ অঞ্চলের মানে হাওড়ার সিনেমা প্রেমীরাই ছিল মূলত আমাদের হলের দর্শক"। মণিহার সিনেমাহলের পথচলা শুরু ১৯৮৭ সালে। প্রথম ছবি "ঘর সংসার"। পুবে-পশ্চিমে লম্বা প্রেক্ষাগৃহে আসন সংখ্যা ছিল সাতশ। তিনটি স্টলে ভাগ করা আসনে ছিল ঠেস দেওয়া স্পঞ্জ লাগানো চেয়ার। কোন ব্যালকনি ছিল না। তবে পারিবারের আট-দশ জন লোক একসাথে বসে দেখার জন্য একট ব্যালকনির মতো জায়গা তাঁরা বানান। মণিহারে শো টাইম ছিল তিনটা ও ছ'টা। তবে ঈদের দিনে ১২ টার শো টাইম রাখা হত। প্রথম দিকে ফ্রন্ট স্টলে দর্শনী ছিল তিন টাকা,সেকেন্ড স্টলে পাঁচ টাকা আর ফার্স্ট ক্লাসের জন্য দশ টাকা ধার্য ছিল। দশ-বার জন স্টাফ মণিহারে কাজ করতেন। নিজস্ব প্রোজেক্টরের মাধ্যমে ছবি প্রদর্শিত হত। বাংলা ও হিন্দি উভয় ছবিরই কদর ছিল এই সিনেরমাহলে। তবে বাংলা ছবিতে দর্শক আসন উপচে পড়ত। বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না,লাঠি প্রভৃতি ছবি প্রায় দু'মাস করে চলে। 

মণিহার বন্ধ হয় ২০১৩ সাল নাগাদ। বন্ধের কারণ আশেপাশের অন্য সব সিনেরমাহল বন্ধের কারণের সঙ্গে মিলবে না। মূলত পারিবারিক কারণেই তাঁরা সিনেমাহল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন। হবিবুর সাহেবরা ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারভূক্ত। বড় ভাই সেখ্ খলিলুল রহমান একসময় তাঁদের নিজস্ব ধর্মমতকে আঁকড়ে ধরেন। বিনোদনের এই মাধ্যম থেকে পরিবারের অর্থ আয়কে তাঁরা অন্যায় মনে করলেন। স্বাভাবিকভাবে নিজেদের ধর্মকে শ্রদ্ধা জানিযে এবং দাদার আবেগকে সম্মান জানিয়ে সিনেমাহল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। আজকের জমজমাট গোপীগঞ্জ বাজারে ঢুকতেই রাস্তার বাম দিকে চোখে পড়বে মণিহারকে। একসময় এলাকার সিনেপ্রেমীদের সত্যিকারের কন্ঠহারের মতো ছিল মণিহার। কিন্তু আজ জীর্ণ চেহারা নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাকের মতো। সেখ হবিবুর সাহেব জানালেন কাঠামো ভেঙে একটা মার্কেট কমপ্লেক্স গড়ার চিন্তা ভাবনা করছেন তাঁরা।


তথ্যসূত্রঃ—

সেখ হাবিবুর রহমান – গোপীগঞ্জ, দাসপুর

                 ……………… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Saturday 27 January 2024

বর্ণালী ভুঁইয়া এর কবিতা // ই-কোরাস ১৬৫

 



বর্ণালী ভুঁইয়া এর কবিতা

স্বরলিপি


থমকে থমকে ভোর নেমে আসে

ঘরের ভেতর আতর মাখা কেউ

জেনেটিক রোগে ঘেমে যাওয়া শরীর

ছড়িয়ে দেয় দুর্বোধ সংলাপ।

আলকচিত্রে সাজানো স্মৃতিকথায়

পাখির চোখ ভেসে ওঠে

আলতো হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যায় 

গ্রামের বুকে জমা থাকা স্বরলিপি


চাঁদের দেশ


প্রতিরাতে একবার খোলা ছাদে গিয়ে দেখি

লাজলজ্জাহীন আলিঙ্গনে ব্যস্ত চাঁদ ,তারারা।

ওদের দিকে আঙুল তুলে কেউ বাড়তি জবাব চায় না।

যতবার মেকাপ হীন শরীরে নাভি দেখা গেছে শাড়ীর ভাঁজে

ততবারই মনুষ্যত্বের চামড়ায় কালি ছিটিয়ে জন্ম দিয়েছে এক একটা অধ্যায়ের


আমি একবার লজ্জাহীন দেহে হেঁটে যাবো চাঁদের দেশে....

রেখে যাবো মৃত্যুর আগে জন্মের আলো।


আত্মকথা


যতবার আঙুলের পাশে আঙুল রেখেছি

সরে সরে গেছে রোদ্দুর,বৃষ্টি ,মুনিয়াটার কলরব,বনেদিয়ানা


ফিরেও এসেছে শীতের সকাল, বসন্ত উৎসব,

মুখার্জী বাড়ির ঢাকের আওয়াজ


থেকে গেছে কেবল বৈষ্ণব পদাবলির কিছু খন্ড, ছোট কপালেশ্বরীর আত্মকথা।


মুখোমুখি


প্রতিটি গোধূলি সন্ধ্যা তানপুরার সুর ওঠে না

বিকেলের সূর্যাস্ত কালো মেয়ের ভালো থাকা নিয়ে কাব্যি করে না

মেঘলা মেঘ বৃষ্টি আনে না


কেবল একটা পৌঢ় দুপুর নৌকোর মুখোমুখি

ঠিক গড়তে জানে।


ভার্জিন বুক


এক পশলা বৃষ্টি

লেগে আছে চিবুকে

ফিরে আসা পথে লাল সূর্য

বিবাগী মনের হিসেব।


রাতের জমানো শোকে

পাশ বালিশের গভীরতায়

অন্তহীন আলাপ চারিতা


থমথমে নিস্তব্ধতায়

ভার্জিন বুকে উপবাসী জ্যোৎস্না।

             …………………… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


Sunday 21 January 2024

বর্ণালী ভুঁইয়া এর কবিতা // ই-কোরাস ১৬৪

 



বর্ণালী ভুঁইয়া এর কবিতা

অভিলাষ


ঘুম একটা রোমাঞ্চ ঘোর

লুকোচুরি আর ভেসে যাওয়া কথা

 জিরিয়ে নাও স্বপ্নে

যা কিছু এলোমেলো থাক পড়ে

চলো ঘুরে আসি শিলং পাহাড়ে।


মন একটা বসিকরণ তাবিজ

 ভুলে যাও সকালের খিদে

উপন্যাস লিখতে হবে না সমুদিকে নিয়ে

একটা বসন্ত জমা হোক কাব্যিক চিলেকোঠায়।

পরের বছর বইমেলায় যাবো।


শরীর সে তো ঊর্ধ্বমুখী আগুন

নিভিয়ে নাও দাউদাউ জ্বলন

ধোঁয়া ওঠা ভাত ঠান্ডা হোক

তুমি ব্রাশ করে এসো।

কাজে বেরোতে হবে হেঁটো পথে।



অরৈখিক আখ্যান


গাছের ভেতর ধীরে ধীরে প্রবেশ করেছে সূর্য

বাড়িয়ে দিচ্ছে সময়ের হাত

আঙুলের ফাঁক দিয়ে রোদ ওঠা দেখি

আগুন হতে হতে বিতশোক মন

ধুয়ে নিচ্ছি পথের বালি কাদা।


 কখন দগদগে ক্ষতের ভেতর

আয়ূরেখার হাত ধরে

সংগোপনে ব্রম্ভতালু ছুঁয়ে ফেলেছে ঈশ্বর

সূর্যাস্ত তখন পশ্চিম ঘাটে চিকচিক আলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে

নীরবতা ঘেমে উঠেছে,শীতের দুপুরে আর একটু কুয়াশা থাক

মাংস পোড়ার গন্ধ,বুদবুদ জলের ফেনা মুছে ফেলে নিকোটিন পুড়তে পুড়তে পিছিয়ে গেল ধোঁয়া....


মৃত্যুর গন্ধে  অযাচিত সময় নষ্টের অরৈখিক আখ্যান।



ঈশ্বর অপেক্ষায়


ঘুমের মধ্যে জন্ম হয় বোধ

বোধের মধ্যে বিরতি

ঘুমোতে ঘুমোতে জেগে উঠি রোজ

ঈশ্বর অপেক্ষায় কথা হবে মুখোমুখি।

 

রাতের শূন্যতায় শান্ত হচ্ছে মন

তোমাকে না জানিয়ে নিজেকে ভেঙেছি অনেকবার

ঈশ্বর জেগে আছে বিছানায়

কুয়াশা সরিয়ে বিছিয়ে দিচ্ছি চাদর

গাঢ় ঘুমে এখনো পাখিদের চোখ বন্ধ

তুমিও শান্ত হয়ে ঘুমাও


ভোরের ঘুম ভেঙে গেলে জমিতে ধান বোনা হবে।



আলোর কাছে


শূন্য পথে ডুবে গেছে চাঁদ

জোৎস্নার খোঁজ রাখা হয়নি এখন

ঘরে ফেরার তাড়া,মাঝপথে বিচ্ছেদ

মুছে নিই স্মৃতির দৈর্ঘ্য

গাছেদের বেড়ে ওঠার মতো পারদ বেড়েই চলেছে শীর্ণ শরীরে

আসলে নরম হতে হতে নদী হয়ে গেছি 

তবুও সূর্যোদয় দেখেছি বিছানার ঘর থেকে।

ছায়াপূর্ণ পথে  হেঁটে যেতে যেতে ঘাস মাটিদের দেখেছি সতেজ হয়ে উঠতে

সেই থেকে আমি মাটির রাস্তা খুঁজে চলেছি আলোর কাছে পৌঁছব বলে।



আলোর ভ্রমণ


নড়বড়ে কিছু শব্দ হেঁটে গেল রাস্তার ওপর দিয়ে

আলোর ভ্রমণ,হয়তো অন্ধকারে ঘুমিয়ে পড়া

ঘুমের মধ্যে জাগতে জাগতে নিভে যায় চোখের আলো,

কে চায় মৃতদেহে আগুন জ্বলে উঠুক

চিল উড়ে যাক মাথার ওপর

তার'চে মাটির মধ্যে জল ঢালো ,শ্বাস নিতে নিতে বেড়ে উঠুক গাছ,


আমি বরং দেবী হয়ে উঠি

চিলেকোঠার ঘরে সাজানো হোক আলোর সংসার।

রেখে যাবো গাছেদের নামে আলাপন পত্র।

                 …………………


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


Monday 15 January 2024

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ১৩


 

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা - ১৩

ভারতী টকিজ– ঘাটাল 

শ্রীজিৎ জানা 


পুণ্যতোয়া শিলাবতীর দুই প্রান্তের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে কত গল্পকথা। কত জানা অজানা ইতিহাস। বিশেষত ঘাটাল শহরের অন্দরেই কতনা মিথ। সেই প্রথম নাকি এখানে ঘাঁটি গেড়েছিল ডাচেরা। তাদের অফিস আজকের মহকুমা কার্যালয়। পরে ইংরেজদের হাতে হস্তান্তরিত হয়। তাঁরা কার্যালয়ের উল্টোপারে গড়লেন নীলকুঠি। তখনো পোনটুন্ ব্রিজ গড়ে ওঠেনি। খেয়া পারাপারের মাধ্যমে যোগাযোগ চলত। এখানেই একটি মিথ শোনা যায়। নাকি সুড়ঙ্গ পথের মাধ্যমে নদীর পূর্ব পাড় থেকে পশ্চিম পাড়ে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করেছিলেন সাহেবরা। মিথের সপক্ষে যুক্তি হল, বর্তমান মহকুমা অফিসের  (১৫ নং ওয়ার্ড, ঘাটাল পৌরসভা) উত্তরদিকের একটি সুড়ঙ্গপথ। যার মুখটি আজ প্রায় আশি নব্বই বছর সিল করে রাখা হয়েছে। তারপর তো পোনটুন ব্রিজ হল। নীলকুঠি থেকে পশ্চিমপাড়ের নাম হল কুঠিবাজার (৪ নং ওয়ার্ড,ঘাটাল পৌরসভা)। সেই কুঠিবাজার স্বাধীনোত্তর কালেই সাহেবদের কাছ থেকে কিনে নেন কলকাতার মাড়োয়াড়ী ব্যবসায়ী রামজি দাস সুরেখা,শ্রীনিবাস সুরেখা ট্রাস্টি এস্টেটের নামে। তাঁরা কুঠিবাজার এলাকায় দোকানপাট বসাতে শুরু করেন। ইত্যবসরে কয়েকজন মানুষের প্রচেষ্টায় ঘাটালে তৈরী ঘাটাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড। মনে করা হয় সেই সালটা ছিল ১৯৪১। ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড সেই স্বাধীনতা উত্তরকালে স্থাপন করলের বিনোদনের এক পীঠস্থান 'ভারতী টকিজ'। কর্পোরেশন লিমিটেডের অন্যতম অংশীদার ছিলেন তৎকালীন নামকরা আইনজীবী ভবানীরঞ্জন পাঁজা। বিশেষ সূত্র মারফত জানা যায়, 'ভারতী টকিজ  নামটি 'ভবানীরঞ্জন পাঁজা মহাশয় কর্তৃক প্রদত্ত। স্বারস্বত সাধনার দেবী স্বরস্বতীর আরেক নাম ভারতীর নামে তিনি এই নামকরণ করেন।


প্রাক স্বাধীনতা কালে 'ভারতী টকিজ' এর পথচলা শুরু বলে বরিষ্ঠ মানুষজনের মত। তখন ভারতী টকিজ সংলগ্ন নীলকুঠির চিমনি বর্তমান ছিল। শুরুর দিকে সিনেমাহল ছিল নাকি  মাটির। পর্দার অংটি এবং মেঝে চুন সুরকি দিয়ে তৈরী হয়েছিল। তখন বন্যার সময় সিনেমাহলের মেঝেতে জল ঢুকে গেলে হল বন্ধ থাকত। কিছুদিন পরে কংক্রিটের দেয়াল তুলে পাকাপোক্ত ভাবে প্রক্ষাগৃহ চলতে থাকে। মাটির হলে পর্দার সামনে চটে বসার ব্যবস্থা ছিল। তারপর থাকত চেয়ার। অনেকেই জানাচ্ছেন একেবারে শুরুর দিবকে ভারতী টকিজে পুরুষ মহিলা আলাদা বসার আসন নির্দিষ্ট ছিল। ফ্রন্ট স্টলের টিকিট মূল্য ছিল ১৯ পয়সা,মিডিল স্টলের মূলবয ছিল ৭৫ পয়সা আর রেয়ার স্টলের টিকিট মূল্য ছিল ১ টাকা। শো টাইম ছিল ৩ টা এবং ৬ টা।  পরবর্তী নতুন করে সেজে ওঠা ভারতী টকিজের শো টাইম ১২টা,৩টা এবং ৬টা ছিল। তার সিট সংখ্যা ছিল ৫২৭, ব্যালকনি সহ। সেই সময় রমরমিয়ে চলতে থাকে সিনেমাহল। হিন্দি বাংলা ছবি তো ছিলই, সাথে ঘাটালের থিয়েট্রিকেল সোসাইটির মত বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া নিয়ে বিখ্যাত সব ইংরেজি ছবি দেখানো হত। 


এখনো পর্যন্ত আলোচনার কেন্দ্রেবিন্দুতে আছে কুঠিবাজারের ভারতী টকিজ। আজকের ভৌগলিক মানচিত্র মাফিক সঠিক অবস্থান বোঝাতে গেলে বলতে হবে, যেইখানে মতি সিনেমা রয়েছে, সেখানেই ছিল ভারতী টকিজ। মানে নিউ মার্কেট প্লেস, ঘাটাল পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ড। ওই ভারতী টকিজের প্রচার ব্যবস্থাও ছিল অভিনব। ঘাটাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের নিজস্ব একটি প্রেস ছিল,যার নাম ভারতী প্রেস। সেই প্রেসে নীল-সাদ এবং লাল-সাদা রঙে ছাপা হত সিনেমার পোস্টার। উপরে কোণায় লেখা থাকত,'চলিতেছে', 'সগৌরবে চলিতেছে', 'হৈ হৈ কান্ড, রৈ রৈ ব্যাপারে' প্রভূতি শব্দবন্ধ। তবে সবচেয়ে নজরকাড়া প্রচারের মুখ ছিলেন জগন্নাথ বাবু। তিনি পায়ে হেঁটে ঘাটাল বাজার এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রচার করতেন। বিশিষ্ট আইনজীবী দেবপ্রসাদ পাঠকব্যানার্জী জানালেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা,"আমাদের তখন কিশোর বয়স। জগন্নাথ বাবু মুখে রঙ মেখে বহুরুপী সেজে পাড়ায় আসতেন। হাতে থাকত চোঙা মাইক। বুকে পিঠে থাকত বাঁশের চাঁচেসাঁটানো সিনেমার পোস্টার। হরবোলার মতো বিভিন্ন আওয়াজ করে সকলকে আকৃষ্ট করতেন। এমনকি মুকাভিনয় করে দেখাতেন। তারপর চোঙা ফুঁকে ছবির প্রচার চালাতেন"। প্রসাদবাবুর মতে "এই প্রচারের টানেই ভারতীতে দর্শকের সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে যেত। আর আমাদের মতো ছোটদের কাছে হরবোলা জগন্নাথ বাবু ছিলেন সবচাইতে বেশি আকর্ষণের"।


কুঠিবাজারের ভারতী টকিজ পরে স্থানান্তরিত হয়। তা পিছনের কাহিনী বিস্তর। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ঘাটাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের সঙ্গে সুরেখা ট্রাস্টিবোডের জসির লিজ সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ বাধে। ঘটনা গড়ায় কোর্ট অব্দি। কেসে সুরেখা ট্রাস্টি বোর্ড জেতে। কোর্টের রায় মোতাবেক ট্রডিং কর্পোরেশন লিমিটেড তাদের ভারতী টকিজের কাঠামো ভেঙে দেন ১৯৭৩ সাল নাগাদ। আর পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে ঘাটালের কৃষ্ণনগর (৩ নং ওয়ার্ড, ঘাটাল পৌরসভা) অঞ্চলে নিজস্ব জায়গায় পুনরায় গড়ে তোলেন ভারতী টকিজ। শিলাবতীর পাশেই সুন্দর করে সাজিয়ে তোলেন তাঁরা। নবনির্মিত ভারতী টকিজের প্রথম ছবি ছিল 'চৈতন্য মহাপ্রভু'। তারাশঙ্কর পাল, বিজন গুঁই,ফণীন্দ্র পাল প্রমুখরা চিফ অপারেটর এবংয অ্যাসিস্ট্যান্ট অপারেটরের কাজ করতেন। তখন আর জগন্নাথ বাবু নেই। এই হলে প্রচারের একমাত্র মাধ্যম ছিল পোস্টার। রাধু রুইদাস পোস্টারিংয়ের কাজ করতেন। তবে মাঝেসাঝে মাইক প্রচারও হত। নতুন ভারতীর শো টাইম ছিল ১টা,৪টা এবং ৭টা। প্রেক্ষাগৃহের সিট সংখ্যা ছিল ৮০০,স্টাফ ছিল ৩২ জন। ভারতীর নাম দূরধূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর বাংলা ছবি প্রদর্শনের জন্য। এই সিনেমাহলের ব্লকবাস্টার হাউসফুল ছবিগুলি হল 'অন্যায় অবিচার',  'অনুসন্ধান' এবং 'বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না'। এই প্রত্যেকটি ছবি ছ'মাস করে চলেছিল।

ঘাটাল শহরের বিশিষ্ট কবি ও শিক্ষিকা মহাশ্বেতা দাস জানালেন ভারতী টকিজকে নিয়ে তাঁর সেদিনের স্মৃতি, "ভারতী সিনেমাহলে আমার প্রথম দেখা ছবি 'ভালবাসা ভালবাসা'। তবে ভারতীতে সিনেমা দেখার বাইরে আরেকটা বিষয় হল,যখন যতীশচন্দ্র স্মৃতি সদন (ঘাটাল টাউন হল) হয়নি তখন "বীণাপাণি কলাকেন্দ্র" সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক অনুষ্ঠান হত ভারতী প্রেক্ষাগৃহে। ছোট বয়েসে ওই পর্দা ঘেরা মঞ্চে, যেখানে সিনেমা দেখানো হয়,সেখানে আমরা নাচগান করছি,তার আনন্দই ছিল আলাদা"। পাশাপাশি ঘাটাল শহরের আরেকজন বিশিষ্ট শিক্ষিকা ইতি মণ্ডল জানালেন তাঁর স্মৃতির কথা, "একসময় ভারতীতে ছিল মহিলাদের জন্য স্পেশাল একটি গেট। আসলে সিনেমাহলের স্টাফ কার্ত্তিক দাস মারা গেলে তাঁর স্ত্রী গীতা দাস ওই গেটকিপারের কাজে যোগ দেন। এক পাড়ায় থাকতাম বলে ভাল সিনেমা এলে তার সৌজন্যে দিব্যি নির্ঝঞ্ঝাটে দেখা হয়ে যেত"। 

ভারতী সিনেমাহলের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট ব্যবসায়ী উত্তম মালাকার মহাশয়ের দেয় তথ্য থেকে জানা যায়,যখন সিনেমাহলে করমুক্ত ছবি আসত তখন দু'টাকা মূল্যের টিকিটের বিনিময়ে ছবি প্রদর্শিত হত। 'বিদ্যাসাগর', 'শহর থেকে দূরে' প্রভৃতি ট্যাক্স ফ্রি সিনেমা ভারতী টকিজে চালানো হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে দর্শক সংখ্যায় ভাটা পড়তে থাকে। আয়ের চেয়ে ব্যয় অধিক হতে থাকায় সিনেমাহল বন্ধের কথা ভাবতে বাধ্য হয় ঘাটাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের অংশীদাররা। অবশেষে ২০১৮ সালে ভারতী টকিজে ছবি প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রাচীর ঘেরা তালাবন্দী আজকের ভারতী টকিজ। ঘাড় উঁচিয়ে দেখতে হয় তার ভেতরের বর্তমান অবস্থা। কিন্তু দৃষ্টি উঁচু প্রাচীর টপকাতে পারে না।অগত্যা পাশের চা দোকানের আড্ডায় খোঁজ নিলে স্মৃতি হাতড়ে টুকরোটাকরা ছবির হদিশ দেয় অনেকেই। সেইটুকুই প্রাপ্তি।


তথ্যসূত্র :—

দেবপ্রসাদ পাঠকব্যানার্জী,  আইনজীবী, ঘাটাল

মহাশ্বেতা দাস, বিশিষ্ট শিক্ষিকা, ঘাটাল

ইতি মণ্ডল, বিশিষ্ট শিক্ষিকা, ঘাটাল

উত্তম মালাকার, বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী, ঘাটাল

                     …………………… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...