Tuesday 31 October 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ৮

 


পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা -৮

শারদীয়া – রাজনগর, দাসপুর

শ্রীজিৎ জানা 



রাজার নগর রাজনগর। কোন রাজা? রাজা শোভা সিংহ। কোথাকার রজা? বরদা পরগনার। দিল্লীর মসনদে তখন রাজত্ব করছেন মুঘলরা। ষোড়শ শতকের শেষের দিকে রঘুনাথ সিংহ স্বাধীন চেতুয়া– বরদা রাজ্য স্থাপন করেন। সেই রাজ্যের রাজধানী হল রাজনগর। রাজা রঘুনাথ সিংহের পুত্র কানাই সিংহ এবং পৌত্র হলেন দুর্জয় সিংহ। আর দুর্জয় সিংহের পুত্র হলেন শোভা সিংহ। যিনি দিল্লীর বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। এই শোভা সিংহ যোগাযোগের সুবিধার্থে উত্তরের শিলাবতী আর দক্ষিণের কংসাবতীকে একটি খাল খনন করে যুক্ত করেন। সেই খাল স্থানীয়দের কাছে কাঁকি অথবা কঙ্কাবতী নদী নামে সমাদর পেয়ে চলেছে। কঙ্কাবতী নদী তীরেই ছিল সিংহ রাজাদের গড়– আনন্দগড়। রাজ্যের " কাছারি ছিল ইস্কুলের দক্ষিণ- পশ্চিম কোণের উঁচু ডিবিটি"। বর্তমানে রাজ্য সড়কের উত্তর পার্শ্বে পাল পরিবারের বসতি যেখানে। সেইসাথে  বর্তমানে নাড়াজোল- মেদিনীপুরগামী রাজ্য সড়কের উপর যেই রাজপুকুর বাসস্টপ, সেই পুকুরটি সিংহরাজারাই খনন করেন বলে জানা যায়। কারণ ওই রাজারপুকুরের উত্তর- পশ্চিম কোণে ছিল সিংহ রাজাদের প্রাসাদ ও পরিখা। এমনকি এইরূপ মিথ শোনা যায়, ওই পুকুরপাড়ে আজও নাকি মাটির তলায় চাপা রয়েছে সিংহ রাজবংশের টাকা রাখার কূপ এবং রাজহস্তীর কঙ্কাল। সিংহ রাজবংশের প্রায় দুশো আড়াইশ বছর পর রাজনগর এলাকার স্বত্বাধিকারী হন মলিঘাটীর চৌধুরী জমিদাররা।


একথা নিশ্চিত এতক্ষণে আপনাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। সিনেমাহলের কথা জানাতে গিয়ে রাজকাহিনী শোনাচ্ছি একপ্রকার জোর করেই। আসলে গোড়া না মজবুত করে বাঁধলে ঘর যে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। তাই এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা। ধৈর্য্য রাখুন হে আমার সুবোধ পাঠক,দেখুন কেমন মিলিয়ে দিই রাজপরিবারের সাথে জমিদার পরিবার শেষে বণিক পরিবারের। মানে হল শারদীয়া সিনেমাহলের জন্মস্থল এই মনোরম সুবিশাল রাজারপুকুরের দক্ষিণ পার্শ্বে। এখানে একখানা প্রশ্ন মনে উঁকি দিতেই পারে,রাজারপুকুর মাইতি পরিবারের হাতে এল কিভাবে? আসলে মাইতি পরিবারের আদি নিবাস ডেবরা থানার অন্তর্গত কালিকাগ্যেড়া গ্রাম। অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু পরিবার বলেেই পরিচিত ছিলেন। স্বর্গীয় অশ্বিনী মাইতি এবং তাঁর অন্য ভাইদল মিলে মলিঘাটীর চৌধুরী জমিদারদের কাছ থেকে রাজারপুকুর ও তার পাড় সহ মোট আট একর জায়গা কেনেন। পরবর্তীকালে সেই পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে চব্বিশ শতক জায়গা জুড়ে সিনেমাহল গড়ে ওঠে। নাড়াজোল- মেদিনীপুরগামী পিচ সড়কের উপর রাজারপুকুর বাসস্টপ থেকে কয়েক পা দূরেই শারদীয়া সিনেমাহল স্থাপন করেন অশ্বিনী মাইতির জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রী অজিত মাইতি। শারদীয়ার পথ চলা শুরু ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। কেন সিনেমাহলের দিকে ঝুঁকলেন? - প্রশ্ন করাতে অজিত বাবুর মুখে স্মিত হাসির আভা ফুটে ওঠে। বললেন—" প্রথমে আমার কংক্রিটের ব্যবসা ছিল। সিনেমা দেখতে খুব ভালবাসতাম। তার উপর বকুলতলার ( দাসপুর) মল্লিকা সিনেমাহল তখন প্রায় বন্ধের মুখে। মনের ভিতর সিনেমাহল করার ইচ্ছেটা প্রবলভাবে নাড়া দিল। ব্যস, ১৯৮৮ সাল নাগাদ সিনেমাহল নির্মাণের কাজ শুরু করলাস।" তাহলে 'শারদীয়া' নামকরণের কারণটাও একটু বলুন। " আসলে কি জানেন,আমি প্রথম থেকেই চাইছিলাম সিনেমাহলের শুভ মহরত হবে পুজোর মরশুমে। বাঙালীর বড় পুজো দুর্গাপুজো। সেইমত নির্মাণ কাজ শুরু করি পুজোতে, এমনকি সিনেমা দেখানোও শুরু পুজোর সময়ে,এইসব মিলিয়ে শারদীয়া নাম রেখেছিলাম।"



শারদীয়া সিনেমাহলের প্রথম ছবি ছিল 'মথুরা বিজয়'।  প্রথম পৌরাণিক সিনেমায় সিনেমাহলে ভীড় উপচে পড়ে। ওদিকে গৌরা,দাসপুর নিয়ে এদিকে কেশপুর অব্দি প্রচার চলতে থাকে। ভালো কোন ছবি এলে মাইক প্রচার থাকত। তাছাড়া মোহন দাস ( গোকুলনগর), সুজিত মালাকার ( রাজনগর), বিশ্বনাথ বেরা ( রাজনগর) পোস্টার লাগাতেন বিভিন্ন এলাকায়। শারদীয়ার স্টাফ ছিল ১৬ জন। শুরুর দিকে চিফ অপারেটর ছিলেন রবিদাসপুরের গোপাল বাবু। পরে শক্তি গুছাইত ( রাজনগর) এই দায়িত্ব সামলাতেন।  ফার্স্ট, সেকেন্ড ও থার্ড ক্লাস মিলে মোট ছয়শ দর্শক আসন ছিল শারদীয়ার। সেইসময় থার্ড ক্লাসের টিকিট মূল্য ছিল দ'টাকা,সেকেন্ড ক্লাসের দু'টাকা পঞ্চাশ পয়শা আর ফার্স ক্লাসের টিকিটের মূল্য ছিল তিন টাকা। মাঝে অর্থনৈতিক কারণে সিনেমাহল প্রায় দু'বছর বন্ধ থাকে। পরে সিনেমাহল মালিক এবং তৎকালীন জেলার সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের আলোচনার ভিত্তিতে টিকিটের মূল্য সামান্য বাড়িয়ে ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। 

অজিত বাবু তীব্র উৎনাহ নিয়েই সিনেমাহল চালু করেছিলেন। পলশপাই ( দাসপুর) - এর 'গোপাল টকিজ'  সিনেমাহলের প্রোজেক্টর মেশিন ভাড়ায় এনে প্রথম সিনেমা দেখানোর কাজ শুরু করেন। পরে নিজস্ব মেশিন সহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি কেনেন। কলকাতার লেনিন সরণী ( কমারসিয়াল পয়েন্ট)  থেকে নিজেই ছবি আনতেন। সেখানে ব্রোকার ছিলেন প্রীতিরঞ্জন মজুমদার। পরে এই কাজে নিযুক্ত হন জগন্নাথ আলু ( রাজনগর)। তাঁকে সেইসব দিনের কথা জানতে চাইলে খুব আবেগাপ্লুত হন। বলেন – " মাত্র সত্তর টাকা মজুরির বিনিময়ে সেইসময় কলকাতা থেকে আমি ছবি আনতাম। বৃহস্পতিবার ছবি আসত আর শুক্রবার সেই ছবি দেখানো হত। একটা ছবি দু'তিন সপ্তাহ চলা মানে আমার মজুরি বন্ধ। তবে খুব আনন্দ পেয়েছি ওই কাজে"।  কেমন চলত শারদীয়া সিনেমাহল? কোন কোন ছবি হাউসফুল হয়েছিল? অজিতবাবু জানান, " 'মথুরা বিজয়' ',তুফান'  'শোলে' প্রভূতি ছবি দারুণ লাভের মুখ দেখিয়েছিল"। জগন্নাথ বাবু জানালেন, " অহংকার ছবিটা চলে চার সপ্তাহ,সেইসঙ্গে বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না সিনেমাও চলে একমাস"। তিনটা - ছ'টার শোয়ে যথেষ্ট ভিড় থাকত শারদীয়া সিনেমাহলে। স্থানীয় রাজনগর ইউনিয়ন হাইস্কুলের 'বাণীবীথি' ছাত্রাবাসের অনেক ছাত্রদের স্মৃতির পাতায় এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে শারদীয়া সিনেমাহলে লুকিয়ে ছ'টা– ন'টার শোয়ে লুকিয়ে সিনেমা দেখার স্মৃতি। কত প্রেম জুটি বেঁধেছে আলোআঁধারি প্রক্ষাগৃহের কোণার সিটে। রমরমিয়ে চলেছে গুরুদক্ষিণা,প্রতিবাদ,জোয়ার ভাঁটা,প্রতিদান,অঙ্গার সহ কত বাংলা ও হিন্দি ছায়াছবি। মাঝে মাঝে কঠোরভাবে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য শুক্রবার ন'টা - বারোটার শোয়ে ব্লু ফ্লিম দেখানো হত। কিন্তু গ্রামগঞ্জের ভিতরে 'শারদীয়ার' অবস্থান বলে খুব ঝক্কিঝামেলা সামলে,অনেক চোখকে আড়াল  করে প্রাপ্তবয়স্করা ওইদিন সিনেমাহলে প্রবেষ করত। কিন্তু ক্রমে ভাটা পড়তে থাকে দর্শকের ভিড়ে। অজিত বাবুর গলায় আক্ষেপের সুর শোনা যায়," আসলে প্রথমে সিনেমাহল নিয়ে আবেগটাই বেশি কাজ করেছিল। টেকনিক্যাল বিষয় সম্পর্কে অত জানা ছিল না। বিশেষ করে ছবির উপর ট্যাক্সের পরিমাণ যে যথেষ্ট বসত, সেই বিষয়ে অতটা ধারণা ছিল না। বাংলার চেয়ে হিন্দি সিনেমায় বেশি ট্যাক্স পড়ত। ফলে সিনেমাহল চালানো ক্রমেই চাপের হয়ে যাচ্ছিল। সেইসাথে টেলিভিশনের সংখ্যা বাড়তে থাকে গ্রামে। ফলে হলমুখী দর্শক সংখ্যা কমতে থাকে। বাধ্য হয়ে সিনেমাহল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিই"। সালটা ২০০০, শারদীয়া সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যায়। শেষ ছবি ছিল 'ধন্যি মেয়ে'। 


আজ যখন রাজ্য সড়ক ধরে রাজারপুকুরের পাশ দিয়ে যাবেন,সহজে চোখে পড়বেনা শারদীয়া সিনেমাহলকে। চিলতে ভাঙা অংশটুকু কোনক্রমে বেঁচেবর্তে আছে মাত্র। বেশিরভাগ অংশ ভেঙে বাড়ি তৈরী হয়েছে। একদিন 'শারদীয়া' এই মফস্বল এলাকাকে সিনেপ্রেমীদের ভিড়ে ভরিয়ে রাখত। নিতাই প্রামাণিক (অভিরামপুর), দুর্গাপদ গুছাইত (রাজনগর),বিশ্বনাথ বেরা (রাজনগর),  শশাঙ্ক বেরা (রাজনগর)- র মতো স্টাফেদের কেউ গেটকিপার,কেউ টিকিট কাউন্টারে, কেউ টর্চ জ্বলে সিট চেনানোর কাজের দায়িত্ব সামলাতেন। সিনেমাহলের সামনে রাস্তার পাশেই ছিল ঝন্টু ছাতিকের পান গুমটি,সন্ন্যাসী ঘাঁটীর চপ দোকান। কোনকিছুরই চিহ্ন নেই আর। সবই এখন স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে অনেকের মনে।


তথ্যসূত্র :–

১. শ্রী অজিত মাইতি ( রাজনগর) 

২. শ্রী জগন্নাথ আলু ( রাজনগর) 

৩. রাজনগর ইউনিয়ন হাইস্কুল পত্রিকা, এপ্রিল সংখ্যা , ১৯৬১,

                     ……………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...