Saturday 1 January 2022

ছুঁয়ে আছে গ্রিটিংস প্রেম // ই-কোরাস ৪৬

 




ভালোবাসা মানে আর্চিস গ্যালারি

মিঠু চন্দ্র 



"ভালোবাসা মানে আর্চিস গ্যালারি"---আজকের প্রজন্ম বোধহয় এই গান গায় না আর। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে স্নেহ-ভালোবাসা রাগ-অনুরাগের ছোঁয়া মিশ্রিত গ্রিটিংস কার্ড।কাগজ-কলমের আঁচড় ছেড়ে মানুষের আঙুল প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠেছে, আপন হয়েছে স্মার্টফোন-ট্যাব-ল্যাপটপ-কম্পিউটার ইত্যাদি। 


অবশ্য কিছু মানুষ এখনও সহজে ফেলে দিতে পারেননা পুরোনো সবকিছু। স্বল্প পরিসরে তাই এখনও অনেকেই গ্রিটিংস কার্ডকেই বেছে নেন শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে। আসলে প্রিয়জনকে দ্রুত ভাববিনিময়, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা পাঠানোর জন্য বর্তমানে ইন্টারনেটই ভরসা তাই গ্রিটিংস থাকলেও তা অস্তগামী। অথচ, একদিন এই গ্রিটিংস ছুঁয়েই ছিল ক্রিসমাস ডে, ইংরেজী নতুন বছরের শুভেচ্ছা থেকে শুরু করে প্রেম নিবেদন সব কিছুই। বহু চেষ্টা করেও পছন্দের মানুষটিকে "I Love you" বলতে না পারা অবুঝ মন, অনায়াসেই ওই বিশাল হার্ট আঁকা গ্রিটিংস কার্ড ও তাতে ছাপানো ভালোবাসার কিছু লাইনের মাধ্যমে সব বলে ফেলতো। কোনো কার্ডে খাঁজকাটা গোলাপের তোড়া, কোনো কার্ড খুললেই বেজে উঠতো সুরেলা মিউজিক ফলে ওই একটি কার্ডের খরচেই প্রিয়জনকে স্নেহ-ভালোবাসা সহ ফুল-মিউজিক সব দেওয়া হয়ে যেত।

আজও, অনেক বাড়ির আলমারী কিংবা অন্য কোনো গোপন স্থানে যত্ন করে লুকিয়ে রাখা পুরোনো "গ্রিটিংস কার্ড ছুঁয়ে আছে প্রেম"....কোথাও প্রেম কার্ড থেকে শুরু হয়ে পরিণতি পেয়েছে বিবাহে আবার কোথাও বিচ্ছেদের পরও দগদগে স্মৃতি হিসাবে রয়ে গেছে। আসলে কতকিছুই তো হারিয়ে যায় সময়ের সাথে সাথে। 

                         ……… ……….


নীলাভ অক্ষর অথবা নীললোহিত

নিমাই জানা



নবম শ্রেণীর গণিতের পেছনের পৃষ্ঠা মানেই বাঁকা বাঁকা হরফের কিছু ছড়া অথবা গোলাপের শুকনো পাতা। তাদের লুকিয়ে চৈতন্য চরিতামৃত আকাশের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া। কখনো নিজেকেই আবহবিকারের রোদ্দুর বলে ছড়িয়ে দিই প্রতিটি বিকেল বেলায়। আমি এক প্রেমে পড়া অলৌকিক পুরুষ। কাকতালীয় সম্পর্ককে মেনে নেওয়া উচিত অথবা অনুচিত তা নবম শ্রেণীর ইতিহাসের পৃষ্ঠা ছাড়া কেউ কোনদিন বিচার করতে পারে না। কোন কোন আবহবিকারের গল্প দীর্ঘস্থায়ী ভূমধ্যসাগরের মতো। শুধু এক আদুরে প্রেমে পড়া রক্তিম কিছু গোলাপের শুকনো কাঁটা ও বাদামি বিকেলের টেপ জামা মাখানো পিঠ নিয়ে অনেক অভিযোগ নেমে আসে। আমি তো কখনো ত্রিকোণমিতির শাড়িময় ক্ষেত্রফলের তলদেশ এড়িয়ে যেতে পারি না। লাল-হলুদ গ্রিটিংস কার্ডে লাল ভালোবাসার কথাটি লিখলেই হৃদস্পন্দন জুড়ে আসে সারা দুপুর বুকের কাছে ,  নিশ্চিন্ত ঘুমের বারান্দায় রেখে আসি লাল-হলুদের সব অমলিন সম্পর্ক কথা। আসলে প্রতিটি গোলাপের পাঁপড়ির ভেতরে একটি ক্ষয় লাগা মরুভূমি লুকিয়ে থাকে, কখনো কখনো পাথুরে অথবা বিশালাকার ছায়াছবি হয়ে। এক ঝাউয়ের নিচে দাঁড়িয়ে সামান্যতম সম্পর্ক কথার সমাপ্তি হয়। দেবদারু পাতা যেভাবে পায়ের তলায় তার ছায়াকে মনে রেখে নিচু হয়ে মালাটি অর্পণ করে, সে গোপন কথা কারো জন্য নয় শুধু নিজের জীবনের সঙ্গে বেড়ে ওঠা পরজীবী পর্ণমোচী ব্রততী মানুষটির জন্য। ফোল্ডেড গ্রিটিংস কার্ড আসলে কিছু নয় সোনালী অভ্র মাখানো ভালোবাসা শব্দটির দীর্ঘ ক্ষত মুখ, যেখানে √ { আত্মহত্যা < ফাগুন বিকেল ×শুকনো গোলাপ}=(চাঁদ বিহীন বৃষ্টির রাত)°।

...................


গ্রিটিংস কার্ড মনের গহীনে এক মায়ার সমুদ্দুর

তাহমিনা শিল্পী



কত স্মৃতি পুরনো হল।কত স্মৃতি হল মায়া।কোন কোন স্মৃতি জঞ্জাল হল।কোন কোন স্মৃতি হল উজ্জ্বল তারা।যে পারে পারুক,আমি যে কোন স্মৃতিই ফেলতে পারিনি।কোন কোন স্মৃতি জমা করে রেখেছি প্রিয় চন্দন কাঠের বাক্সে।কোনটা আবার চিরভাস্বর মনের গহীন গোপন অলিন্দে।সুযোগ বুঝে প্রায়শই স্মৃতির ডালি খুলে বসি।আলতো করে হাত বুলাই,ঝাড়পোছ করি,আবার যত্নে তুলে রাখি।আজ তেমন করেই হাত বুলালাম গ্রিটিং প্রেমের লকারে।সেখানে থরে থরে সাজানো রয়েছে হরেকরকম শুভেচ্ছা কার্ড।

তখন আমার ক্লাস নাইন। সবে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছি।কত কত কৌতূহলী চোখ সিসি টিভির মত আমাকে নজরদারীতে রাখে।দু-একজন আমায় দেখতে দেখতে পথ চলতে হোঁচট খেয়ে পড়ে।আমি আড় চোখে সব দেখি আর মুখ লুকিয়ে হাসি।

সেই চঞ্চলতম সময়ের এক নতুন বছরের নতুন দিনের শুভারম্ভে ঘুম ভাঙা চোখে ঘরের মেঝেতে সোনারবরণ গায়ে সিঁদূররঙা হৃদয় খচিত একটি গ্রিটিংস কার্ড পড়ে থাকতে দেখি।বড় বড় ইটালিয়ান ইংরেজী ফন্টে লেখা Happy New Year। কে কখন জানালা দিয়ে ফেলে গেছে কে জানে।অযুত কৌতূহলে হাতে নিয়ে কার্ডখানা খুললাম। ওমা,এ যে আমারই জন্য! কার্ডের ভিতরে দারুণ আলপনায় আমার নাম লেখা!

গোটাগোটা বাংলা হরফে ফাউন্টেন পেনের ময়ূরকণ্ঠী কালিতে লিখেছে- 'প্রিয়,তুমি আমার ভালোবাসা।নতুন বছরের প্রথমদিনের প্রথম প্রহরেই জানিয়ে দিলাম।তুমি আর কারও হতে পারবে না।একটি তুলতুলে রেশমী পালকের মত মনের সবুজ রেহেলে আজীবন যত্নে রাখবো তোমায়।বিনিময়ে একটুখানি ভালোবেসো আমায়।'

আহা! কলমের তুলিতে হৃদয়ের সবটুকু আবেগ এঁকে দিলেও বেচারা নিজের নামটি লিখতে ভুলে গেছে।নাকি আমার বাবার ভয়ে সন্তর্পণে আড়াল করে গেছে নিজেকে।নাকি খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী।ধরেই নিয়েছিল নাম না লিখলেও, আমি তাকে ঠিকই চিনে নিতে পারবো।

আমি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হাতরে খুঁজতে লাগলাম কে হতে পারে?

স্কুলে যাওয়া আসার পথে গলির মাথায় শেষ বাড়িটির খোলা জানালায় যার গোপন ইশারা দেখতে পাই, সে? না,বোধহয় টিউশন শেষে বাড়ি ফেরার পথে সাইকেল চালিয়ে যে ছেলেটি গুনগুন করে 'আমি একদিন তোমায় না দেখিলে।তোমার মুখের কথা না শুনিলে।পরাণ আমার রয় না পরাণে.....' গান গাইতে পিছনপিছন প্রায় বাড়ি অবধি আসে। না,তার এতটা সাহস হবার কথা নয়।আচ্ছা,ওই ছেলেটি কি হতে পারে? যে পাশের বাড়ির চিলেকোঠায় ভাড়া থাকে।রোজ বিকেলে কখন ছাদে যাবো,অপেক্ষাতে প্রহর গোনে।আমি ছাদে গেলে কচ্ছপের মত লাজুক মুখটি গুটিয়ে নিয়ে পালায় ঘরে।

এইসব সাতপাঁচ হিসাব মিলাতে গিয়ে মাথাটা যখন ঘুরছে বনবন।ঠিক তখনই সব ছাপিয়ে গ্রিটিংস কার্ডের উজ্জ্বল এবং আলোকিত এক স্মৃতি উঁকি দিলো চোখের পাতায়।ফের হাত বুলালাম স্মৃতির গায়।রঙবেরঙের কতগুলো শুভেচ্ছা কার্ড মায়ার জাল ছড়িযে দিলো আমার চারপাশে।আমি ডুব দিলাম বছর দুয়েক আগের এক স্মৃতির সরোবরে।

বাবার সরকারী চাকরির সুবাদে ছোট্ট এক মফস্বল শহরে থাকতাম।আমার ক্লাস সিক্সের পর বাবা বদলি হলেন ঢাকায়।পরিবারের সাথে রাজধানীতে স্থায়ী বসবাস শুরু করবো।ছেড়ে দিতে হল পুরনো স্কুল,পুরনো বন্ধু।

স্কুলে আমার শেষদিনে গোটা ক্লাসের ভিতরটা ছিল ভীষণই থমথমে।আমি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে ছিলাম শ্রেণীশিক্ষকের পাশে।সহপাঠী বন্ধুরা চোখ মুছতে মুছতে একে একে আমার সামনে এসে একটি করে শুভেচ্ছা কার্ড আমার হাতে দিয়ে যাচ্ছিল।আর আমি অধিক শোকে পাথর,খটখটে শুকনো চোখ।কিন্তু বুকে প্রচন্ড অক্সিজেনের অভাব বোধ করছিলাম।সবগুলো কার্ড ব্যাগে পুরে কোনরকমে দৌঁড়ে পালিয়ে এসেছিলাম।

বহুবছর পেরিয়েছি।উন্নত প্রযুক্তির এইসময়ে এসে সেইসব গ্রিটিংস কার্ডের হয়ত আর কোন প্রয়োজন নেই।এপ্রজন্মের কাছে কার্ডে শুভেচ্ছা জানানোর বিষয়টির ততটা গুরুত্বও নেই।তবু সেইসব শুভেচ্ছা কার্ডগুলো আজও আমি ভীষণ আদরে রেখেছি।মাঝেমাঝে ছুঁয়েছুঁয়ে দেখি।সেইসব কার্ডের হাতের লেখায়,অনুভবে আমি বন্ধুদের প্রাণের সুবাস পাই।সেইসব ভালোবাসার স্মৃতিগন্ধে আজও আমি বাঁচি।আর বলি,বন্ধুত্বের চেয়ে বড় কোন প্রেম পৃথিবীতে নাই।

………………… 


গৌরীর জন্য একটি চিঠি

রাজেশ্বরী ষড়ংগী 



প্রিয় গৌরী,

এই নববর্ষের দিনে যে কার্ড তোকে পাঠানো হয়নি কখনো তার পুরাতনী বন্ধুত্বের পাতায় তোর নাম লিখে যেতে ইচ্ছে করে খুব। আমাদের পুরনো দুর্গামন্ডপের বারান্দায় নারিকেলখোলার তৈরি যে খেলনা বাটির সংসার, তার একখোলা জলের দূরত্ব ছিল আমাদের বন্ধুত্বের  বিকেল ও সকাল। একবুক ভয় নিয়ে কত স্বাচ্ছন্দ্যের সেই রন্ধনপ্রণালী। আমার হঠাৎ হঠাৎ থমকে যাওয়া পথে চিরকাল তুই ছিলি সর্বদা আগে। যদিও আমাদের জীবনে নতুন বন্ধুত্বের ভিড়ে কেউ কাউকে কখনও বিনিময় করিনি শুভেচ্ছার আলোক বার্তা। অথচ একটা কার্ডের ভেতর কতজন লিখে গেছে  কত বলা ও না বলা কথা। সেই সব কথার ভেতর কখন যে একটি অগভীর সমুদ্র হয়ে যায়, জানি না! এখন একা একা সেই সমুদ্রের পাড়ে এসে দাঁড়াই তোর ফেরার অপেক্ষায়। একা একাই পড়ে আছে ভগ্ন দুর্গামণ্ডপ, আমাদের স্মৃতি মেদুরতাময় সেই শিশুকাল। ভাগাভাগি করে পড়তে চাওয়া কিছু গল্প। হঠাৎ উইয়ে কেটে ফেলা একটি দশ টাকার বইয়ের মূল্য তোর চেয়ে নিছকই কম বিশ্বাস করিস। 

 জানি জীবন বড় অদ্ভুত !

এই কার্ডের লেখা তুই পড়বি না জেনেও তোকেই লিখছি। আজ পুরনো ফাইল থেকে যে ক'টা কার্ড  খুঁজে পেলাম তাদের সাথে নতুন করে যোগাযোগ আজকাল কেবল তুই ছাড়া,তারা সকলে যত্নের ফাইলে ও প্রোফাইলে।আর তুই কেবল এই ছোট্ট হৃদয়ের ভেতর। জেঠিমার একটা ডাকে ছুটে পালিয়ে গিয়েও পরের দিন ঠিক ফিরে আসতিস। কিন্তু জীবন সংসারে খেলনাবাটির খেলা থেকে সেই যে ছুটে পালালি, একেবারে না ফেরাব দেশে।প্রতিটি নতুন বছরের এই না বলা কথারা যেন তোর অনিত্যের দেশে  উড়ে উড়ে মুকুল ফোটায়।

জানি সুগন্ধি গোলাপের মতোই আজীবন থেকে যাবি আমাদের হৃদয় বাগানে। তবু নতুন বছরের ভোরে এক একটি আলোক ফুটে উঠুক তোর চন্দনরাঙা কপালের গায়-।

ইতি- 

তোর গৌরী ফুলের বনে, এই খেলনাবাটির সংসারে মাত্র কয়েক দিনের ভ্রমণ সাথী।

              ………………….. 


গোলাপ আঁকা গ্রিটিংস আর কেওকারপিনের সৌরভ

শ্রীজিৎ জানা



সেই এক সোনা দিন ছিল! এমন কথার গায়ে লেগে থাকে নস্টালজিক সুড়সুড়ি! থাকারই তো কথা। আশির দশক। 'আশিকী' সিনেমা লুকিয়ে ভিডিও হলে দেখেছি পাড়ার দাদার সাথে। যদিও তখনো হাগুকে পটি বলা চালু হযনি গাঁয়ে। তখনো অনেকটাই ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট হাবভাব। চুমু চামাটি তো দূর কি বাত্,হাত ধরতেই পুরো সিনেমা কাবার। বেঞ্চে আঁচড় কেটে আর পেচ্ছাপখানার দেয়ালে এ প্লাস বি লেখার সাহসী রোমিও মার্কা ছেলের আমদানি হয়েছে দুএকটা। তখনো বাবু,সোনা,জানু,সুইটি,হানি,বেবি বলার নেকু প্রেম শুরু হয়নি। হাতে পিন ফুটিয়ে রক্ত দিয়ে কেউ কেউ প্রেমিকার নাম লেখার দুঃসাহস দেখিয়েছে ঠিকই।  কিন্তু প্রত্যাখানে মেয়ের মুখে অ্যাসিড ছুঁড়েনি বা নিজে সিলিং থেকে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলেনি। লাভার শব্দটাই তখনো মুখে মুখে ফেনেনি। তখনো খুল্লমখুল্লা শরীর মাপামাপি চালু হয়নি।চিঠি লেখা,গ্রিটিংস দেওয়া ঘোর অপরাধ বলে গন্য হতো। তবে প্রেমে বিনে গতি নাই ভুবনে বলেই,তখনো প্রেম ছিল জবরদস্ত। প্রেম থেকে যায়। অনন্ত। অনিঃশেষ। 

সবেমাত্র ক্লাস সিক্স। বুকে খানিকটা সাহস জোগাড়পাতি করেছি। নিউ ইয়ার ভেঁপু বাজাচ্ছে মনের বারান্দায়। ঘুমের ভিতর উড়ে বেড়াচ্ছে নীল সাদা স্কার্টের পজ্জাপতি! মাঝেমধ্যেই টের পাচ্ছি মিহি কেওকারপিনের খুশবু। পয়সা বাঁচিয়ে গোলাপ আঁকা গ্রিটিং কার্ড কিনলুম ডাব্লাদার দোকান থেকে। ইংরেজিতে কিসব ছাইপাঁশ লেখা। তখন মানে বোঝার মতো বিদ্যে হয়নি। একে ওকে ধরে কয়েকটা লাইনের বন্দোবস্ত করলুম। লাল কালিতে যত্নে লিখলুম--

    গোলাপ ফুল তুলতে গেলে হাতে লাগে কাঁটা 

    তোকে না দেখতে পেলে মনে লাগে ব্যাথা।

 অন্যটা দেবো দেবুকে। তার জন্য লিখলুম- গাঁদাফুল হলদে, জবাফুল লাল/ তোর আমার বন্ধুত্ব থাকবে চিরকাল। পয়লা জানুয়ারি আসতে তখনো হপ্তাখানেক বাকি। ইতিমধ্যে দেবুর সাথে খাম বিনিময় হোয়ে গেছে। ওর কার্ডটা আরো সুন্দর। এত পালিশ করা চকচকে যে রোদ্দুরে পড়লে আলো ঠিকরায়। তাতে আমার দেখাদেখি দেবুও কবিত্ব ফলিয়েছে-- রান্নাতে দেয় লঙ্কা হলুদ আর নুন জিরা/ ইস্কুল যেতে ভাল লাগে না তোকে ছাড়া। কথাটা মিথ্যে না। তবে আজকাল কেওকারপিনের জন্যও মন কেমন করে। ওই মনকেমনের স্নিগ্ধ সৌরভটুকু না পেলে দিনটা ভাল কাটতো না মোটেই। কিন্তু গ্রিটিংস কার্ড কিভাবে দেব থই পাচ্ছি না। শেষমেশ দোতালার সিঁড়ি যেখানটায় বাঁক নিয়েছে, সেখানটায় ছুটির তাল বুঝে হাতে গুঁজে দিয়েই ছুট্।

পরের দিন দুরুদুরু বক্ষে স্কুলে হাজির। সেদিন আবার দেবু বেপাত্তা। চারিদিক যেন থম্ মেরে আছে। ক্লাসময় চোখ কয়েকবার চরকিপাক দিয়েও কেওকারপিনের হদিশ পেল না।শীতেও ভেতরে গরম টের পাচ্ছি। প্রেয়ারের পর ডাক পড়লো কমনরুমে। কাঠগড়ায় তখন দাঁড়িয়ে আছি লেধুস মাছের মতো মুখ করে। টেবিলের উপর সেই গোলাপ আঁকা গ্রিটিংস কার্ড। সালিশিসভা শুরু। শান্তিবাবু চোখ নাচিয়ে কবিতাখানা পড়েই বল্লেন-- 'ছন্দ মিলের কি ছিরিছাঁদ!  কাঁটার সাথে ব্যাথা! ব্যাটা কালিদাসের খুনি!ওটা হবে গোলাপ ফুল তুলতে গেলে হাতে লাগে কাঁটা/ তুমি একটি আস্ত পাঁঠা'।

পাশ থেকে দ্বিজেনবাবুর যোগদান-- 'ওর কানের নীচে চাঁটা'

সঙ্গে সঙ্গে পুলিনবাবুর হুকুম-- 'ওর বাবাকে ডেকে পাঠা'।

কমনরুম তখন হাসিকলরব ভরা কবিতার অন্ত্যাক্ষরিতে সরগরম। এদিকে হাতপায়ের কাঁপুনি রিখটার স্কেলে নয়- দশ ছাপিয়ে গেছে। চোখের জলস্তর বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে।আরেকটু হলেই হড়পা বান নিশ্চিত। অম্নি দেবদূতের মতো হাস্যময় অশোকবাবু হাজির হয়ে শাস্তি মকুব করে দিলেন।এদিকে স্কুলময় চাউর হোয়ে গেছে গ্রিটিংস কান্ড। পরে বাড়ি পর্যন্ত অপরাধের সংবাদ পৌঁছায়।লজ্জায় স্কুল যেতে পারিনি কদিন। সেই থেকে আর কথা হয়নি কেওকারপিনের সাথে। তারপর 'আমার গল্পটি ফুরোলো নটে গাছটি মুড়োলো'!  তারও পর গ্রিটিংসও দিতে পারিনি সাহস করে আর কাউকে।

নিউ ইয়ার আসে, আবার সময় মেনে সে চলেও যায়। শুধু বুকের ভাঁজে যত্নে রাখা থাকে গোলাপ আঁকা গ্রিটিংস কার্ড ! চোখ বুজলে ভেসে ওঠে একটা নরম মুখ! পাতলা ঠোঁটে বট ফলের মতো রক্তিম আভা! কিশোরী চোখের চাহুনিতে যেন একটা মায়াময় নীল সমুদ্র! কষ্ট লাগে,কষ্ট লাগে! কার্ডের ভিতরে ওই যে হার্ট সেপ,ওতেই যেন সব উষ্ণতাটুকু উজাড় করে দেওয়া থাকে। ভাঙাচোরা ছন্দের বাঁধনে হৃদয় নিঙড়ানো আবেগ মাখা থাকে। মুঠোযন্ত্রের দৌত্যকর্মে সেই ওম্ পাওয়া দুষ্কর। স্মৃতি তাই দীর্ঘ ইন্টারভেল এর পরেও শোনায় ভাঙাচোরা সেই ছন্দতান--গোলাপফুল তুলতে গেলে হাতে লাগে কাঁটা/ তোকে না দেখতে পেলে মনে লাগে ব্যাথা।

কমনরুম জানবেনা কোনদিন আজও একলা বিকেলে মনপবনে স্নিগ্ধতা ছড়ায় কেওকারপিনের সৌরভ।

                 ……………. 


আমার রাইকে

পার্থপ্রতিম গোস্বামী 



আমি এখন তোমার দিকে ছুটে চলেছি, তোমার থেকে দূরে। এ কেমন ছুটে চলা কে জানে, সব পথই মনে হয় গিয়ে পৌঁছোয় তোমার মনের দরজায়। যে দরজায় কড়া নাড়তে হয় না, মনে মনে ডাক দিলেই চলে। তবু আমি ছুটে চলেছি,সরষে ক্ষেতের পাশ দিয়ে, শাল গাছের পাশ দিয়ে, নক্ষত্রের পাশ দিয়ে। এইমাত্র একটি হরিনী রাস্তা পার হলো, তার পিছু পিছু একটা হরিণ। গাছের ডালে একটি পাখি গিয়ে বসলো আর একটা পাখির পাশে। ওদের কারুর হাত নেই, ওরা মনে মনে হাত ধরে থাকে। 

কখনও মনে হয় জন্মান্তরে আছি, আর তোমাকে ডাক দিচ্ছি, ওগো রাই। এসো। তুমি কি করে খবর পাও কে জানে। জন্মান্তর থেকে সাড়া দিয়ে ওঠো। আমি স্পষ্ট শুনতে পাই পাখির গানে, বাতাসে পাতা কাঁপার শব্দে বেজে ওঠে তোমার পায়ের আহ্লাদ। তুমি জড়িয়ে ধরে আমাকে। 

যাইহোক, আজ নতুন বছরের প্রথম দিন। আমি তো চাইবোই তুমি খুব ভালো থাকো,সারাবছর তোমার খুব ভালো কাটুক। ভালোবাসার কথা আর কি বলি, তার জন্য চোখ আছে, আছে হৃদয়, যারা কখনও মুখের মতো মিথ্যে বলতে পারে না। আমি আছি তোমার পাশে, তোমার হয়ে। তুমিও থেকো কিন্তু, জন্মজন্মান্তর। 

  অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসায় ভরানো। 

তোমার সোনাই

.......................


                         

ফেলে আসা রঙিন গ্ৰিটিংস

সোনালী মিত্র



জীবনের কিছু স্মৃতিকে মন থেকে কখনোই ফেলে দিতে পারিনি। বেলা শেষে আজো সেই মধুর স্মৃতি সুখের ঘরে উঁকি মারে। স্কুল জীবনের কথাই বলবো কারন তখন মন ছিলো ফুরফুরে রঙ্গিন প্রজাপতি। কতো কথা কতো গল্প ঝর্ণার মতো দুরন্ত গতিতে চলতো। বছর শেষ হবার আগেই বন্ধুরা সবাই মিলে প্রতিযোগিতার আসরে নেমে কে কতোটা উৎকৃষ্টমানের উপহার স্বরূপ গ্ৰিটিংস কার্ড  বানাবো ও একে অপরকে দেবো। এই ব্যাপারে মাও কিছুটা সাহায্য করতেন। বাবার আলমারিতে মজুত থাকতো সবরকম পড়াশোনার প্রয়োজনীয় জিনিষ। যেমন খাতা পেন ব্লটিং পেপার পেনসিল। আমরা যখন স্কুলে পড়েছি সেসময় দোয়াত কলমের প্রচলোনটাই বেশী ছিল যার জন্য ব্লটিং পেপারের দরকার হোতো। পরবর্তী সময়ে পেন এর ব্যবহার এসেছিল সেটা মনে হয় নাইন থেকে। যাইহোক যে স্মৃতি আজো অমলিন সেটি হোলো ঐ ব্লটিং পেপার মা বাবার আলমারি থেকে বের করে কাঁচি দিয়ে বেশ সুন্দর করে কখনো পানের মতো কখনো ফুলের মতো করে কেটে দিতেন তারপরের কাজ আমার  ছিলো। সেটিকে সুন্দর করে রঙপেন্সিল দিয়ে ফুল প্রজাপতি নানান ধরনের ছবি এঁকে চুমকি বসিয়ে একটা কার্ড তৈরি করতাম। এবার কে কতো সুন্দর করে বন্ধুকে ও ক্লাস দিদিমণি কে লিখে দিতে পারবে তার ও প্রতিযোগিতা চলতো। তখন তো আর এতো লেখার দখল ছিলোনা এ ব্যাপারে বড়দের সাহায্য নিতাম। দাদার হাতের লেখাও খুব সুন্দর ছিলো, বেশ সুন্দর করে লিখে দিতো। এবার স্কুল তো বন্ধ থাকতো বড়োদিনের, দু তারিখের প্রতীক্ষায় থাকা। দু তারিখেও বন্ধুদের মধ্য একটা প্রতিযোগিতার আসর বসে যেতো কে সবার আগে ক্লাস দিদিমণি কে নতুন বছরের কার্ড টি হাতে তুলে দেবে। আর দিদিমণি কার কার্ডের লেখা সবচাইতে সুন্দর হয়েছে শোনার জন্য মনের ভিতর ছটফটানি শুরু হতো কিন্তু কোনোদিন ই দিদিমণি বিশেষ কারোর নাম বলেন নি সবার কার্ড ও লেখার খুব প্রশংসা করতেন আর সকলকে লজেন্স (দুধ লজেন্স) দিতেন। বছর শেষের অপেক্ষা শেষ হয়তো বছরের প্রথম দিনের স্কুল ক্লাস রুমে। তারপরে খুব প্রিয় বন্ধুদের দেওয়া।বালিকা বেলা কিশোরী বেলা রোদ ঝলমলে সজীব দিন যখন কুমারী মনকে স্পর্শ করলো তখন সেখানে একটা দেওয়াল তৈরি হয়ে গেছে খুব অসতর্কে। বুঝতে পারিনি সেখানে একটি শ্রেনীবিভাগ তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেই ফুরফুরে মনটা উধাও হয়েছে কলেজের চৌকাঠে এসে। 

খুব মিস করি আজো সেই ক্লাস রুমের গ্ৰিটিংসকে খুব ফিরে যেতে ইচ্ছে করে ব্লটিংপেপারের ওপর নিজের হাতের আঁকা ফুল প্রজাপতি কে।লাল নীল সবুজ পেন্সিল এর আঁকায় ভরে ওঠা সেই নতুন বছরের গ্ৰিটিংস কে। 

                   ……………… 



লুকোনো ভালোবাসা

প্রিয়াঙ্কা মজুমদার



সংযুক্তা ব্যালকনিতে বসে কফি খাচ্ছে, হালকা শীতের রোদ সাথে মিষ্টি সকালের মৃদু হাওয়া সুজাতার মন কে আরো তাজা করে দিচ্ছিল। ক্যানভাস,রং ,তুলি জল কত কিছুই না আয়োজন। আজ বানাতে বসেছে সে তার হাতে আঁকা গ্রিটিংস কার্ড। কোন আল্পনা কোন কারুকাজে কোথায় পুথি এবং চুমকি বসাবে এসব ভাবছিল আর নিজের মনেই হাসছিল সংযুক্তা। এর আগে অনেক এরকম কাজ করেছে সে,কিন্তু এটা তার খুবই বিশেষ গ্রিটিংস কার্ড। অতন্ত্য প্রিয় একজন সত্যিকারের ভালো মানুষের জন্য বানানো।

সংযুক্তা জানেনা যে সেই মানুষটার মনে কি আছে,কিন্তু তার সম্পর্কে যে ওই মানুষটার ভালো মানসিকতা আছে তা সংযুক্তা বুঝেছিল হোয়াটসঅ্যাপে এ দু একবার তার নিজস্ব লেখা পাঠিয়ে।

অনেক বছর তা প্রায় বছর চারেক আগে সে ওই ভালমনের মানুষ টাকে দেখেছিল একটি অনুষ্ঠানে। মঞ্চের চেয়ারে বসেছিলেন অনেক গুণী জনের সাথে। বক্তৃতা দেওয়ার সময় কিছু কথা। এমন বলেছিলেন যা সংযুক্তার বেশ ভালো লেগেছিলো।উনি একটি স্কুলের শিক্ষক।সমাজ কল্যাণকর বিভিন্ন ভালো কাজে যুক্ত। যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন সকলে হাতে বই দিচ্ছিলেন। সংযুক্তা ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল , ডায়েরী টা এগিয়ে দিয়ে বলেছিল একটা সই দেবেন।

সংযুক্তা র মুখের দিকে চেয়ে হাত থেকে ডায়েরী টা নিয়ে সই করে দিয়েছিলেন। সাথে দিয়েছিলেন ফোন নম্বর।

একটি  অনুষ্ঠান থেকে সংযুক্তা ডাক পেয়েছ। ঐ কার্ডেই রয়েছে আবার সেই শিক্ষকের নাম প্রধান অতিথি হিসেবে।

 

দেখেই বুক ধড়পড় সংযুক্তা।একটা সুখানুভূতির ঠান্ডা বাতাস যেনো বুকের গভীরে বয়ে গেলো।


ভাবনার  জলআল্পনায় সংযুক্তা ভাসতে ভাসতে অনন্য সুন্দর একটি গ্রিটিংস কার্ড বানালো তার প্রিয়জনের জন্য।

ভেতরে লিখে দিল পরম যত্নে সুপ্রিয়কে দিলাম

নক্সী কাঁথার নক্সার মাঝে হৃদয় আমার, মনের সাথে মনের সেতু বন্ধন হোক চিরন্তনী। 

শুধু তোমার সংযুক্তা।

                     ………………… 



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - মঞ্জুরী হেমব্রম

ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614


ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...