Tuesday 28 March 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ১৩

 



রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ১৩ 

প্রথম প্রেম

মহাশ্বেতা দাস


     ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলেটিকে লেখাপড়া শেখাবার জন্য বহুরকম চেষ্টা করা হলেও প্রায় সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে ছেলের বয়স যে প্রায় সতেরো!! ঠাকুরবাড়ির লোকজনের তাই রবিকে নিয়ে মহা উদ্বেগ..... কেবলমাত্র কবিতা, গান,

গদ্য লিখেই কাটিয়ে দেবে! 


      এমন সময় মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কয়েকদিনের জন্যে কলকাতায় এলেন। কিছুদিন আগে তিনি তাঁর স্ত্রী - পুত্র - কন্যাকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন। এবার তিনিও বিলেত যাবেন -- যাবার আগে কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় এলেন। সে যুগে বড়লোক বাড়ির ছেলে লেখাপড়া না করলে তাকে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত পাঠানো হতো। সত্যেন্দ্রনাথ ও তাই পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানালেন.... ছোট ভাই রবিকে বিলেত নিয়ে যেতে চান। মহর্ষি এই প্রস্তাবে রাজি হলেন। বিলেত যাত্রার জন্য রবির নতুন জোব্বা - চাপকান - পেন্টুলেন তৈরী করানো হল। কিন্তু রবি বিলেতে গিয়ে করবেন কী?!! বিলেত যাত্রার আবশ্যক ইংরেজি ভাষাও তেমন আয়ত্ত হয় নি। তাই ঠিক হল কয়েকমাস আমেদাবাদে মেজদাদার বাড়িতে থেকে ইংরেজিটা সড়গড় করিয়ে নেওয়া হবে। 


      আমেদাবাদ শাহিবাগে মেজদাদা যে বাড়িতে থাকেন, মোগল আমলের ছোটখাট প্রাসাদ সেটা। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সবরমতি নদী। সত্যেন্দ্রনাথ আদালতে চলে গেলে এতবড় নির্জন বাড়িতে রবি বেশিরভাগ সময় কাটান মেজদাদার লাইব্রেরীতে। বিভিন্ন ইংরেজি বই পড়ে রপ্ত করতে চেষ্টা করেন বিলিতি ভাষা। তার সাথে নির্জন পরিবেশে সবরমতী নদীর বহমানতায় রবির মনে জেগে উঠে কত কল্পনা। দূর থেকে ভেসে আসে মনে গানের সুর -- স্বভাব কবি ছেলেটি সেই সুরে ভাষা দেন। "ভারতী" দ্বিতীয় বছরে.... তাই পত্রিকার জন্যেও লেখা পাঠান। এভাবেই দিন কাটছিল। কিন্তু মেজদাদা অনুভব করলেন একা একা এখানে ছোট ভাইটির ইংরেজি বলা - কওয়া অভ্যেস হচ্ছে না। তাই রবিকে পাঠিয়ে দিলেন বোম্বাইয়ে বন্ধু আত্মারাম পান্ডুরঙ্গের বাড়িতে। 


    "প্রতিদিন আসি, প্রতিদিন হাসি, 

           প্রতিদিন গান গাহি -- 

     প্রতিদিন প্রাতে শুনিয়া সে গান

           ধীরে ধীরে উঠ চাহি। 

     আজিও এসেছি, চেয়ে দেখ দেখি

           আর তো রজনী নাহি। 

      সখি শিশিরে মুখানি মাজি

      সখি লোহিত বসনে সাজি,

    দেখ বিমল সরসী - আরশির' পরে

              অপরূপ রূপ রাশি।" 


      এখানেই অপেক্ষা করেছিল রবির জীবনে প্রথম প্রেম -- প্রথম ভালোবাসা। পান্ডুরামের মেয়ে আন্না তড়খড় তাঁর শিক্ষা বিলেত থেকে ঝকঝকে করে মেজে এনেছিলেন। আন্নার উপরই ভার পড়লো রবিকে ইংরেজি শেখানোর জন্য। আন্নার কাছে ইংরেজিয়ানার মকস করার ফাঁকে ভাবে ভঙ্গিতে রবিও জানিয়ে দিলেন তিনি স্বভাব কবি। রবির মুখে কবি কাহিনীর তর্জমা শুনতে শুনতে অনেক কবিতাই মুখস্থ হয়ে যায় আন্নার। ধীরে ধীরে সদ্য যৌবনে পা রাখা ঠাকুরবাড়ির সুদর্শন ছোট ছেলেটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন মারাঠি মেয়েটি। মেয়েটির অনুরোধে কবি তাঁর নাম দিলেন "নলিনী"। কাব্য ভাবনার সুতোয় নামটিকে গেঁথে দিলেন একটি কবিতায়..... 


      " শুন নলিনী, খোল গো আঁখি -- 

         ঘুম এখনও ভাঙিল নাকি! 

       দেখ, তোমারি দুয়ার - 'পরে

       সখী, এসেছে তোমারি রবি।" 


     তরুণ কবির কণ্ঠে কবিতা শুনতে শুনতে আন্না একদিন বললেন -

     "তোমার গান শুনলে আমি বোধহয় মরণ দিনের থেকেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।" 


      কবির পরবর্তী জীবনে নানা অভিজ্ঞতার আলোছায়া খেলে গেছে, বিধাতা ঘটিয়েছেন কতইনা অঘটন তবু এই মেয়েটিকে কবি ভুলতে পারেন নি। বিভিন্ন কবিতায় তাই এসেছে মেয়েটির প্রসঙ্গ। একসময় কবি লিখছেন -- 


   "জীবন যাত্রার মাঝে মাঝে জগতের অচেনা মহল থেকে আসে আপন মানুষের দ্যুতি, হৃদয় দখলের সীমানা বড় করে দিয়ে যায়। না ডাকতেই আসে, শেষকালে একদিন ডেকে আর পাওয়া যায় না।" 

                ………………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - সম্পাদক

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614

Saturday 25 March 2023

সুমন বিশ্বাস র কবিতা // ই-কোরাস ১০২

 



সুমন বিশ্বাস র কবিতা

১.

বসন্ত উৎসব 


দোল পূর্ণিমার চাঁদ শুধু তোমার জন্যই ওঠে,

তোমার জন্যই বসন্ত আসে,

নদীর জল খেলা করে জোছনা আলোয়,

বালুকণাগুলোকে মনে হয় হীরে-মানিক।


তোমার জন্যই সোঁদা মাটির বুকে ঝরে পড়ে পলাশ-শিমুল

বুলবুলি আর কোকিল গেয়ে ওঠে বসন্তের গান।

তোমার জন্যই মুকুল আসে গাছে গাছে।

তোমার জন্যই সেজে ওঠে বসুন্ধরা।


তোমার শরীরেও বসন্ত আসে…

প্রকৃতির রঙ আর গন্ধ তোমার শরীরে লেগে থাকে।

বসন্তের উপস্থিতি জানান দিয়ে যায়,

খোলা চুল নিয়ে খেলা করে বসন্তের বাতাস।


বসন্ত বড় বিরহের ঋতু, আবার প্রেমেরও…

গাছে নতুন পাতা, ফুলের সমারোহ…

এসব দেখে কিশোরী বেলার প্রেম বড্ড মনে পড়ে।

হারিয়ে যাও তুমি কোথায় বালিকা?


আমিও কোথায় হারিয়ে যাই…

শিমুল-পলাশ আর শাল ফুলে বেলা ডোবার মাঠে।

বীরভোগ্যা রুক্ষ মাটির রূঢ়তা ঢাকা বসন্তে।

কালবেলা হয়ত একেই বলে সুন্দরী।


খোয়াই এর বাঁকের মতই তোমার শরীরের বঙ্কিম ভঙ্গিমা,

বসন্ত হওয়া কে খুব হিংসে হয়,

তোমার অবিন্যস্ত চুলে আর পেলব শরীর

বসন্ত হাওয়ার সাথে নির্ভেজাল খেলা করে।

কালিদাস কে বলে দিও মেঘদূত নয়,

আমায় যেন বসন্তের হাওয়া রূপে জন্ম দেন পরের রচনা তে।

আমি অদৃশ্য হয়ে খেলে বেড়াবো তোমার শরীর আর মন জুড়ে।

বসন্ত বাতাস হয়ে তোমায় বনফুলের গন্ধ বিলাবো।


দোলপূর্ণিমার রাতে একলা ছাদে খোলা চুলে দাঁড়িও,

কথা দিলাম চাঁদের আলোয় ডানা মেলে আমি আসবো।

মনে রঙের জোয়ার নিয়ে আমি আসবো…

তোমার মনে বসন্তের ছোঁয়া নিয়ে আসতে আমাকে হবেই।


বসন্তে যদি শাল মহুয়ার জঙ্গলে আসো,

নতুবা নাম ভুলে যাওয়া ছোট্টো নদীর পাড়ে।

সোনাঝুড়ির সাথে বসন্তবিলাপে আমি সাড়া দেবো।

আমায় তুমি উপেক্ষা কোরো না তখন।


তোমার পাটভাঙা সিফনের শাড়ির আঁচল,

কপালের লাল টকটকে টিপ

আর খোলা চুলের বনফুলের শোভাতেই আমি আসবো।

আমি আসবো বসন্তের সমীরণ হয়ে।

কথা দাও যদি আসি অবজ্ঞা করবে না…

ফিরিয়ে দেবেনা আমায়।

              …………………….......


২.

বসন্তের ছোঁয়া



পূব আকাশে ঊষার কিরণ দোলের প্রতিভাস

ডালে ডালে পাতায় পাতায় ফাগের উচ্ছ্বাস ।

শিলাবতী আজ খেলছে হোলি নীল আকাশের সনে

বসন্তের রঙ লেগেছে আমার অবুঝ মনে।

রঙ খেলছে শিমুল পলাশ, কোকিল ডাকে ওই,

রঙের জোয়ার এলো মনে, তুমি এলে কই?


পুর্ণিমার জ্যোৎস্না ভেজা বিশ্ব চরাচর

দোলের আবেশ জড়িয়ে গায়ে স্বপ্নের নির্ঝর।

ফুলের গন্ধে বসন্তের এই মাতাল সমীরণ,

ফাগুনের এই আগুন মেখে উতলা হল মন।

প্রকৃতির এই ফাগুন খেলায় বিভোর হয়ে রই,

রঙের জোয়ার এলো মনে তুমি এলে কই?

                     ……………….....




গ্রাম সংখ্যা দ্বিতীয় পর্ব পাওয়া যাচ্ছে।


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614

Tuesday 21 March 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ১২

 



রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ১২

যৌবনের পথে

মহাশ্বেতা দাস



  সারদাদেবীর মৃত্যুর পর থেকে ইস্কুল কামাইয়ের পরিমাণ বেড়েই চলল। মা - হারা ছোট ছেলে... তাই দিদি এবং বৌদিদিদের আদর এই বিষয়ে আরও ইন্ধন যোগাল। স্বাভাবিক ভাবেই এরপর ধীরে ধীরে ইস্কুলের সঙ্গে আর কোন সম্পর্কই রইলো না রবির। 


      সাহিত্য সৃষ্টির দক্ষতা ঠাকুর বাড়ির লোকজনের জন্মর্জিত ক্ষমতা। বড়োদাদা দার্শনিক এবং কবি। সেজদাদা বহু গুণের অধিকারী। আর রবির জীবনে পঞ্চম দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রভাব তো অপরিসীম। নানা কর্মদ্যোগ, স্বদেশী ভাবনা, সাহিত্য রচনা, গান, নাটক, ছবি আঁকা.... বিবিধ বিষয়ে উৎসাহী মানুষ তিনি। নিজে উৎসাহী এবং অন্যকে উৎসাহ দিয়েও আনন্দ পান তিনি। দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মদ্যোগে ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় গড়ে উঠলো এক সাহিত্যচক্রের আড্ডা আসর। যেখানে অক্ষয় চৌধুরী, বিহারীলাল চক্রবর্তীর মতো সেকালের বহু খ্যাতনামা ব্যাক্তিরা আসেন। ছোটবেলা থেকে নিজের পরিবারে এসব দেখেই বড় হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই স্কুলের গণ্ডিবদ্ধ জীবন যেমন করে তাঁকে বেঁধে রাখতে পারে নি ঠিক তেমনই সিলেবাসের বাঁধাধরা পড়ার মধ্যেও নিজেকে সন্তুষ্ট রাখতে পারেননি তিনি। মনের সুখে বাংলা বই, পত্রিকা.... হাতের কাছে যা পান তাই পড়ে ফেলেন। জ্যোতিদাদার সংগ্রহে ছিল প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ। বিশেষ মনযোগ দিয়ে পড়া শুরু হলো বৈষ্ণব পদাবলী। বিদ্যাপতি রচিত মৈথিলি পদ গুলি কৈশোর থেকে যৌবনের পথে পা বাড়ানো ছেলেটির মনযোগ বেশী করে আকর্ষণ করত। এছাড়াও জ্যোতিদাদা পিয়ানোতে সুর তুলেন আর রবির ডাক পড়ে সেই সুরে কথা বসানোর জন্য। পিতার সাথে গঙ্গায় বোটে বেড়ানোর সময় হাতে পেলেন গীতগোবিন্দ কাব্য। জয়দেবের কাব্যের সবটা বুঝতে না পারলেও ছন্দ ও কথা মিলেমিশে রবির মন ভরিয়ে তুলেছিল। এইভাবে বই পড়া, কবিতা রচনা এবং গান গাওয়ার মধ্যে সেদিনের দিনগুলিতে খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের স্বাধীনতা ও আনন্দের বিষয়। 


       এর মধ্যেই ঘটে গেল আর এক কান্ড। বাড়ির বড়োদের মনে হল.... ভাই-বোনেরা মিলে ঠাকুর বাড়িতেই লেখকের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়! প্রত্যেকেই কম বেশী লেখালেখি করেন। এছাড়া ঠাকুরবাড়ির সাহিত্যিক আড্ডায় যেসব বন্ধুবান্ধব, খ্যাতনামা ব্যাক্তিরা আসেন... তাদের কাছ থেকেও লেখা জোগাড় করে যদি একটা মাসিক পত্রিকা বের করা যায়! যেমনি ভাবনা তেমনি কাজ। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় সেবছর শ্রাবণ মাসে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলো। মাসিক পত্রিকাটির নাম দেওয়া হল "ভারতী"।

   

       রবির বয়স তখন ষোল। ভারতী পত্রিকার আবির্ভাবে রবির লেখার আগ্রহ বেড়ে গেলকয়েক গুণ। স্বাভাবিক ভাবেই ঠাকুর বাড়ির ছোট ছেলেটির লেখনী স্পর্শে সৃষ্টি হতে শুরু করল অজস্র লেখা। ভারতী পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় "ভিখারিনী" গল্প দিয়ে শুরু।" করুণা" উপন্যাসটিও এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও ভারতী পত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ দেব। এই প্রচ্ছদ চিত্রকে উদ্দ্যেশ্য করে লিখেছিলেন "ভারতী" নামক কবিতা। 


     আজও আকাশে মেঘ দেখা দিলে... রিমঝিম করে বৃষ্টি শুরু হলে বাঙালির আবেগঘন মন গুনগুনিয়ে ওঠে.... 

      "শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা

           নিশীথ যামিনী রে

      কুঞ্জ পথে সখী কৈসে যাওব

         অবলা কামিনী রে...." 


  ব্রজবুলি ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলীর ঢঙে মাত্র ষোল বছর বয়সেই ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলেটি লিখে ফেললেন " ভানুসিংহ" ছদ্মনামে "ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী" । জীবনস্মৃতিতে এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন.... "একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ করিয়াছে।..... একটা শ্লেট লইয়া লিখলাম".... 


     " গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে

         মৃদুল মধুর বংশী বাজে, 

      বিসরি ত্রাস লোক লাজে

         সজনি আও আও লো।" 

               ………………


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - সম্পাদক

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614

Saturday 18 March 2023

সুমন বিশ্বাস র কবিতা // ই-কোরাস ১০১

 



সুমন বিশ্বাস র কবিতা

১.

আমি সেই মেয়ে


আমি সেই মেয়ে যে মাতৃ জঠরে খুন হতে হতে হইনি।

ভ্রূণে মরিনি বলে জন্মের সময় মুখে নুন দিয়ে প্রাণে মারার নিদান দিয়েছিলেন কেউ। 

জন্মের সময় মুখে মধু দিতেও ভুলে গেছিল বাড়ির লোকজন,

শঙ্খ ও উলু পড়েনি আমার জন্মক্ষণে, বাজেনি মঙ্গলঘণ্টা।

“ইবারো বিটি” – বলে বাপ-মায়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়েছিল।

কলিকাল তাই হয়ত যোগমায়া হতে হয়নি।

কলির কোনো কেষ্টকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়নি আমায়।

বুড়ো ঠাকুরদা বলেছিল মাটির হাড়ি করে জলে ভাসিয়ে দিতে।

অভাবের সংসারে দুই দিদির পিঠে আবার আমি,

আমি সেই মেয়ে যে পরিবারের সবার বোঝা।

হিন্দু মুসিলিম সব ধর্মই নারীকে পড়িয়েছে বেড়ি।

নারী অন্তঃপুরবাসী, ইসলামে তার মসজিদে যাওয়া নিষেধ। সনাতন ধর্মে নিষেধ অনেক কিছুতেই।


সবাই বলতো বিটি না মাটি, তার উপর গায়ের রং আবার চাপা।

নাম রাখা হল ‘ফেলি’

সবাই বলতো "ফেলি, যমে নিলেও গেলি আর পরে নিলেও গেলি।"

যমের অরুচি হয়ে বেঁচেই গেলাম,

আমি সেই মেয়ে যে ফেলনার মতই কাদা মাটি ঘেটে মানুষ হয়েছিলাম।

পাড়ার ইস্কুলে মিড-ডে-মিল খেয়ে প্রাইমারি স্কুল যখন শেষ হলো।

বাবা বললো, "মেয়েছেলের আর পড়ার দরকার নেই।

দুই দিদির মত এখানেই পড়া শেষ তোমার।"

দিদিদের তেরোতেই বিয়ে হয়েছে, এবার ফেলির পালা।

এক ছুটে সেদিন চলে গেছিলাম স্কুলের মতি মাস্টারের কাছে।

পড়াশোনায় মন্দ ছিলাম না,

এই নিশ্চিন্তপুর গাঁয়ের ইস্কুলে আমার আগে কেউ বৃত্তি পাইনি।

মতি মাস্টার তাই খুব স্নেহ করতো আমায়।

সেদিন সন্ধ্যায় মতি মাস্টার বাড়ি বয়ে এসে বাবাকে বুঝিয়ে গেল।

বাবা তবুও বোঝেনি।

সুকেশ ঘটককে তলে তলে লাগিয়ে দিল।

যেদিন বিয়ের দিন ঠিক হলো, সেদিন ছিল আমার পুতুলের বিয়ে।

আমাকে ভুল বুঝিয়ে বলা হয়েছিল পুতুল বিয়ের জন্যে আয়োজন।

যখন বুঝলাম আমারই বিয়ে আজ তখন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা,

বাড়ি থেকে পালিয়ে এক দৌড়ে গেলাম মতি মাস্টারের বাড়ি।

আমার কান্নায় মতি মাস্টার কি বুঝলো জানিনা।

শেষে বিডিও আর পুলিশ এসে সেদিন আমার বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছিল।

বাপ-মায়ের মুখ পুড়িয়ে আমি লগ্নভ্রষ্টা হলাম।

বিডিও আর পুলিশ বাপ-মা কে বুঝিয়ে বড় স্কুলে ভর্তি করালো,

এর পর মাধ্যমিকে আমি জেলার মধ্যে হলাম প্রথম।

আমি নাকি সবার গর্ব এই বলে হেডস্যার বুকে টেনে নিয়েছিল।

অনেক বড় হতে হবে আমায়... অনেক বড়।


এরকম অনেক ফেলি পেটের মধ্যেই খুন হয়,

কুঁড়িতেই নষ্ট হয় শৈশব,

রান্নবাটি খেলা ছেড়ে সংসারের ঘানি টানতে হয়,

আমি ফেলি নাকি সবার গর্ব!

চোখের সামনে অনেক দৃশ্যপট হাজির হল,

অনেক ফেলি ঘিরে ফেললো আমার চারিপাশ।

সমাজে অনেক  ফেলি হারিয়ে যাচ্ছে।

আমি সেদিন হেড স্যারের পা ছুঁয়ে শপথ করেছিলাম,

সব ফেলিদের স্বপ্ন আমি সফল করবোই।


ইতিহাসে ফেলিদের কথা লেখা নেই,

লেখা নেই মহাকাব্যেও।

আমাদের কথা কেউ লিখে রাখেনি।

কৃষ্ণ মানে ননীগোপালের জন্য দুধের শিশু যোগমায়াকে অবলীলায় মেরে ফেলেন মহাকবি ব্যাস।

আমাদের মেরে ফেলতে কাঁপে না কবির কলম।

ডাক্তারের নিপুন হাত আমাদের অঙ্কুরেই বিনাশ করে।

সে দিক থেকে আমি ভাগ্যবান।

তবুও ভয় হয়,

নির্ভয়ারা আজও শিকার হয় পিশাচের।

শ্বসুড় বাড়িতে আত্মঘাতী হয় নববধু।

গৌরী লঙ্কেশ কেও প্রাণ দিয়ে প্রমান করতে হয় সাহসিকতা।

শবরীমালার আয়াপ্পান স্বামীর কাছে আমরা ব্রাত্য।

কিন্তু সে এক দিন ছিল আমাদের,

দেবী দুর্গাও নারী ছিলেন, অস্ত্র হাতে রক্ষা করেছিলেন ত্রিভুবন।

বেদের যুগে অপালা লোপামুদ্রা তোমরাও ছিলে।

ইতিহাস মনে রেখেছে রিজিয়া আর লক্ষীবাঈকে।


তবুও সহমরণে আমাদের সতী করেছো, 

নিয়েছো সীতার অগ্নি পরীক্ষা।

দ্রোপদীর কাপড় খুলেছো রাজদরবারে।

তুমি, তুমি, তোমরা তারিয়ে তারিয়ে পড়েছো,

দেখেছে গোটা হস্তীনাপুর।

মনেপড়ে সীতা হয়ে জন্মালাম যখন,

বাবা মায়ে মাটির কলসীতে করে

পুঁতে দিয়েছিল চাষের জমিতে।

শেষে সেই মাটিতেই মিশে যেতে হয়েছিল আমায়।

তবুও তোমাদের সন্দেহ দূর করতে পারিনি আজও।

অভিশাপে পাষান হতে হল সুন্দরী অহল্যাকে।

কাব্যে সাহিত্যে ছত্রে ছত্রে অপমান করেছো আমায়।

পুরুষার্থ পালনে নারী অনুসঙ্গ মাত্র।


আজও ফেলিদের অনেক অবজ্ঞা সয়ে বড় হতে হয়।

গর্জে উঠতে হয় পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে।

এভাবেই ফেলিরা বেড়ে উঠুক,

কবির কল্পনায় নয় বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে।

             ………………….. 


২.

বসন্ত এসে গেছে


ভোরের আকাশে আজ উদয় ভানুর রক্তরাগ,

স্নিগ্ধ জলে নরম রোদের পরশ বিলি কেটে দেয়।

কচি পাতারাও রোদের আভাতে লাজুক হাসিতে মগ্ন আজ।

ঠিক যেন শিবালয়কে মদনদেব সাজিয়েছেন নিপুন হাতে।

পুষ্প,পল্লব আর পত্রে সেজেছে আজ প্রকৃতি দেবী,

ঠিক সেদিন যেমন সেজেছিলেন অষ্টাদশী পার্বতী।

হে কুমারসম্ভবের কবি,

আজও কি তোমার কলম স্থবির থাকবে স্থানুর মত?


এই প্রভাতে এসো সেজে উঠি প্রকৃতির মত করে।

একাত্ম হই অন্তরঙ্গে আর বহিঃরঙ্গে,

মনের রঙ আজ দেহেও লাগুক,

ঠিক যেমন বনে লেগেছে ফাগুনের রঙ।

এসো প্রিয়, তোমায় রাঙিয়ে দিই আজ,

আপন মনের মাধুরী মিশায়ে যেমন ছবি আঁকে কবি,

ঠিক তেমন করে আজ সাজিয়ে দেবো তোমায়।


এসো ভ্রমরের মত আজ ফুলের সৌরভে মেতে উঠি।

মনের মদিরায় মিশে যাক বসন্তের সমীরণ আর ফুলের সুবাস।

এসো দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায়  জ্যোৎস্না পান করি চকোরের মত,

ঠিক যেমন করে বলরাম পান করতেন  কারণসুধা।

শেষ রাতে চাঁদ ডুবে গেলে মাতালের মত আবেশিত হবো।


যুগে যুগে এই বসন্তে মেতেছে কপোত-কপোতিরা,

ভ্রমরের গুঞ্জন যেন গান হয়ে বেজেছে বসন্তে।

কত কবির প্রলাপ হয়েছে কবিতা।

নগরের পানশালায় কত জারজ কবিতার সমাধি হয়েছে,

তা পানশালার মদিরার পাত্ররা মনে রেখেছে।


এরকমই এক বসন্তে নন্দদুলাল খেলেছিলো দোল,

শতেক গোপিনীর মনেও সেদিন লেগেছিল বসন্তের রঙ।

সেদিন যমুনার বক্ষেও খেলা করেছিল চাঁদের আলো,

বৃন্দাবনের কুঞ্জে কুঞ্জে ভ্রমরের গুঞ্জন গান হয়ে বেজেছিল।

গোপের ধেনুরাও সেদিনি নেচে উঠেছিল সেই গানে।


আজও বসন্ত আসে, প্রকৃতি দেবী সেজে ওঠে,

আমাদের মনেও লাগে বসন্তের দোলা।

আরও সহশ্র বছর পরেও বসন্ত আসবে…

দেহ-মন সেজে উঠবে বসন্তের ছোঁয়ায়।

            ……………………..






গ্রাম সংখ্যা দ্বিতীয় পর্ব পাওয়া যাচ্ছে।


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614


ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...