Tuesday 22 August 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা - মহাশ্বেতা দাস // ই-কোরাস ৩৩

 



রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ৩৩

দুবেলা মরার আগে মরব না

 মহাশ্বেতা দাস 


      "আমার ভার লাঘব করি

       নাই বা দিলে স্বান্ত্বনা…" 


     মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু শোক কেটেছে কি কাটেনি…. মেজ মেয়ে রাণীর শরীরে দেখা দিল যক্ষ্মা। মায়ের মৃত্যুর পর মাতৃহারা সন্তানদের  সবাইকে কবি শান্তিনিকেতন এনেছিলেন ঠিকই কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হাওয়া বদলের জন্যে রানী কে নিয়ে এবার পাড়ি দিতে হল হাজারীবাগ। আলমোড়ায় বেশ কিছুদিন থাকলেন বটে কিন্তু রাণীর স্বাস্থ্যের উন্নতি হল না। শেষ পর্যন্ত রাণীর জেদাজেদিতেই ফিরতে হলো কলকাতায়। 

      গৃহিণীর অভাবে আর পাঁচটা সংসারের মতোই ছন্নছাড়া অবস্থা…. মীরা আর শমীন্দ্র জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কাছে, রথীন্দ্রনাথ স্কুল বোর্ডিং এ আর বেলা স্বামীগৃহে। অসুস্থ রাণীকে নিয়ে দুর্ভাবনা আছে ঠিকই তবু লেখালেখি চলছে যথানিয়মে। কবিমন অদ্ভুতভাবে নিরাসক্ত…. সে জানে সংসার কর্মভূমি, কর্তব্যস্থল; অফুরন্ত চাহিদা পূরণের দাবী নিয়ে সে দাঁড়ায় নিয়ত। তারই মাঝে নিজ ভাবনায় অবিচল থেকে সৃষ্টিশীলতায় মন দিতে হবে। তাই বঙ্গদর্শন পত্রিকার জন্যে লেখালেখি তো চলছেই…. হাজারিবাগে বসেই ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন "নৌকাডুবি" উপন্যাস। পাশাপাশি চলল কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনার কাজ। সুহৃদ মোহিতচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় "মজুমদার লাইব্রেরী" থেকে প্রকাশিত হলো "শিশু" কাব্যগ্রন্থ যা বাংলা সাহিত্যের শিশুতোষ ভান্ডারে হয়ে রইল এক কালজয়ী সম্পদ। 


      "খোকার মনের ঠিক মাঝখানটিতে

        আমি যদি পারি বাসা নিতে - 

        তবে আমি একবার

       জগতের পানে তার

       চেয়ে দেখি বসি সে নিভৃতে।" 


     শ্রাবণ-দিনে শিশু কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি লিখতে গিয়ে সে সম্বন্ধে কবির ভাবনা - " আমি আজকাল শিশুদের মনের ভিতরে বাসা করে আছি। তেতালার ছাদের উপর আমার নিজের শৈশব মনে পড়ছে।"  

    শিশুমনের কল্পরাজ্যে সে কখনও চাঁপা ফুল হয়ে মায়ের সাথে দুষ্টুমির খেলা খেলে…. কখনও বা নিজেকে কুকুরছানা, টিয়াপাখি ভেবে সহমর্মী হয়ে ওঠে। আবার ক্রমবিকাশমান ভাবনায় সে বীরপুরুষ সেজে ডাকাতের হাত থেকে মাকে উদ্ধার করতে চায়। কিন্তু শিশু কাব্যগ্রন্থের কবিতা গুলি বিশ্লেষণে দেখা যায়….  শিশু পাঠশালায় গিয়ে গুরুমশায় কে প্রসন্ন দৃষ্টিতে দেখতে পারে না! …. এ যেন রবির নিজেরই বাল্যস্মৃতি। তবে, এখানে কবিতাগুলির মধ্যে সবই প্রায় খোকার ভাবনা, খুকির ভাবনা একটিও নেই বলে অভিযোগ করেন মোহিতচন্দ্র সেনের স্ত্রী সুশীলা দেবী। কবি জবাবে বলেন - " যে ব্যক্তি লিখেছে সে আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে খোকাই ছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে খুকি ছিল না। ….. তাছাড়া আর একটি কথা আছে - খোকা এবং খোকার মার মধ্যে যে ঘনিষ্ঠমধুর সম্বন্ধ সেইটে আমার গৃহস্মৃতির শেষ মাধুরী - তখন খুকী ছিল না - মাতৃশয্যার সিংহাসনে খোকাই (শমীন্দ্র) তখন চক্রবর্তী সম্রাট ছিল। " 

   

    যাইহোক, এদিকে কলকাতায় ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই রাণীর মৃত্যু হল। মাত্র দশ মাসের মধ্যেই রবি-আকাশ থেকে খসে গেল দু-দুটি তারা। 

    

   অঘটন একা আসে না! শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে ঘটে গেল আর এক অঘটন। বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন দুর্লভ চরিত্রের শিক্ষক সতীশচন্দ্র রায়। মাঘোৎসবের পর তাই ছাত্রদের এখানে রাখা নিরাপদ নয় ভেবে বিদ্যালয় আপাত ভাবে স্থানাতরিত করা হল শিলাইদহ- কুঠিবাড়িতে। এবার হেড মাস্টার হয়ে এলেন মোহিতচন্দ্র সেন। 


    রবীন্দ্রনাথ, যিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান…. তিনি কি শুধু সাহিত্য রচনা আর বিদ্যালয়ের কাজে সীমাবদ্ধ থাকতে পারেন! বিশ্বভরা প্রাণের উদ্দীপনায় মেতে ওঠেন  তাই তিনি হাজারও কাজে….. 

   

        "ধর্ম আমার মাথায় রেখে

           চলব সিধে রাস্তা দেখে 

           বিপদ যদি এসে পড়ে

        সরব না, ঘরের কোণে সরব না 

       আমি ভয় করব না ভয় করব না।" 


       ১৯০৫সালের ১৬ই অক্টোবর লর্ড কার্জনের "বঙ্গভঙ্গ" প্রস্তাব অনুসারে "Divide and Rule" নীতির কার্যকরি অভিযানের শুরু হয় । ধর্মপ্রাণ ভারতবাসীর ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে জাতীয়তাবোধকে বিচ্ছিন্ন করার ধারালো অস্ত্র হিসেবে ঔপনিবশিক ব্রিটিশ সরকার ব্যবহার করছেন ভারতবাসীর  ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসকে! তৎকালীন ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ কে লর্ডকার্জন এজন্য প্রচুর উৎকোচও প্রদান করলেন। যার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে আমাদের পরবর্তী কয়েক দশক ধরে।


          ঔপনিবেশিক কূটনীতির এই বিয়োগান্তক পরিণতি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম কিংবা পৌত্তলিকতাকে কোনদিন নিজের জীবনে স্থান দেননি তিনি। যদিও তিনটি ধারায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল (স্বদেশী আন্দোলন, চরমপন্থী বৈপ্লবিক আন্দোলন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্ব ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্যে সংস্কৃতিক আন্দোলন) । তবু অন্যান্য গুলিকে তিনি "রাজশক্তির কাছে ভিক্ষাবৃত্তি" বলে মনে করেছিলেন। 

       

        "আমাদের নিজের দিকে যদি সম্পূর্ন ফিরিয়া দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশ মাত্র কারণ দেখি না।" 

        হিন্দু-মুসলমান মিলনের সৌরভেই সুরভিত হোক বাংলার মানুষের বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের জীবন ঐতিহ্য… এই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনা। তাই সেদিন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সম্প্রীতির রাখিকেই হাতিয়ার করেছিলেন তিনি। 

          রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে , অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্যে সংস্কৃতিক ঐক্য বন্ধনের ডাক দিয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।


         অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর "রবিকা'র" সেই লড়াই কে "ঘরোয়া" তে ব্যক্ত করেছেন। সেদিন সকাল বেলা পায়ে হেঁটে গঙ্গার জগন্নাথ ঘাটে পৌঁছে গেলেন সবাই। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ছাদ থেকে রাস্তার দু-পাশে লোকে লোকারণ্য। মেয়েরা শাঁখ বাজাচ্ছে, ফুল ছড়াচ্ছে... মনিব চাকর সবাই একসাথে স্নান করে একে অপরের হাতে রাখি বাঁধলেন। সারা বাংলা সেদিন পালন করল অরন্ধন দিবস। হাঁটতে হাঁটতে পাথুরে ঘাটার বীরুমল্লিকের আস্তাবলে সহিসদের হাতে রাখি বাঁধলেন, সহিসরা তো অবাক!! তারপর চিৎপুরের মসজিদে গিয়ে মৌলবীদের হাতে ও রাখি বাঁধা হল। এভাবে সেদিন রাস্তায় যাদেরই দেখা পাওয়া গেছে.... ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কে পরানো হল রাখি আর গাওয়া হয়েছিল সেই গান - 


     "বাংলার মাটি বাংলার জল 

       বাংলার বায়ু বাংলার ফল 

পূণ্য হউক পূণ্য হউক পূণ্য হউক হে ভগবান।"

               …………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ ভাবনা - মহাশ্বেতা দাস

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪



1 comment:

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...