Tuesday 29 August 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা - মহাশ্বেতা দাস // ই-কোরাস ৩৪

 



রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ৩৪

মাটির টানে

মহাশ্বেতা দাস 



    "রাজা সবারে দেন মান

     সে মান আপনি ফিরে পান।" 


    কখনও বোলপুর তো কখনও শিলাইদহ - কলকাতাতেও মাঝে মধ্যে…. এভাবেই নানা কাজের তাগিদে কাটছে রবির দিনগুলি, আর পাশাপশি লেখালেখির কাজ তো আছেই। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এতদিন "নৌকাডুবি"  উপন্যাসটি লিখছিলেন, এখন সে কাজ শেষ হয়েছে। লিখতে শুরু করেছেন "খেয়া" কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি। এছাড়াও জমিদারি দেখাশোনার সুবাদে তিনি উপলব্ধি করলেন আমাদের দেশের অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। তাই দেশের উন্নতি সাধন করতে হলে কৃষির উন্নতি সাধন অবশ্য কর্তব্য। 


    " ফিরে চল মাটির টানে

       যে মাটি আঁচল পেতে

      চেয়ে আছে মুখের পানে।" 


রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ভাবনায় সৃষ্টিশীলতায় যেমন আমরা বৈচিত্র্য দেখতে পাই তেমনই বিভিন্ন গঠনমূলক ও স্বাবলম্বী সমাজ সংগঠন মূলক ভাবনাতেও স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন যথেষ্ট। বিপুল পরিমাণ সাহিত্যসম্ভার রচনার পাশাপাশি গ্রামীণ ভারতের পল্লীপুনর্গঠন নিয়েও ভেবেছেন যথেষ্টই। আর সেই ভাবনাগুলিকে বাস্তবে রূপ দিতে দুঃসাধ্য কর্মের ব্রতে ব্রতী হয়েছেন তিনি। 


" জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষীর।" 


মহাজনদের শোষণ থেকে বাঁচাতে হবে প্রজাদের। তাই স্থির করলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধু শ্রীশচন্দ্রের পুত্র সন্তোষচন্দ্রকে আমেরিকায় পাঠাবেন কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্যে। সেসময়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেদের  সাধারণত ব্যারিস্টারি পড়তে বিদেশে পাঠানো হত। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের এই সিদ্ধান্ত অভিনবত্বের দাবীদার। বিদেশে যাবে ছেলেরা…. তাই দেশের কথা একটু ভালো করে জেনে যাওয়া প্রয়োজন। তাই এদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করলেন শান্তিনিকেতনে সতীশ রায়, মোহিত সেন ও বিধুশেখর শাস্ত্রীর মত শিক্ষকদের কাছে। 


   ভারতবর্ষের কৃষি ব্যবস্থায় যেমন নূতন দিগন্ত উন্মোচনের লক্ষ্যে নিজের পুত্র কে বিদেশে পাঠানোর জন্যে তৈরী করছেন তেমনি মহাজনদের শোষণের হাত থেকে প্রজাদের বাঁচাতে ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন পতিসর কালিগ্রাম কৃষি ব্যাঙ্ক । এরফলে প্রজারা মহাজনদের সমস্ত ঋণ শোধ করে ঋণ মুক্ত জীবনের সন্ধান পেল। আর রক্তপিপাসু মহাজনরা বাধ্য হলেন তাদের ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র চলে যেতে। 


     ১৯০৬ সালের এপ্রিলে কলকাতা থেকে জাহাজে প্রশান্ত মহাসাগরের পথে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র কে রওনা করিয়ে দিলেন কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্যে সুদূর আমেরিকায়। ওখানকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন তাঁরা। বিদেশে থাকা কালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক চিঠিতে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখলেন - "আমাদের দেশের হাওয়ায় কী চাষা কী ভদ্রলোক কোনমতে সমবেত হতে জানে না। তোরা ফিরে এসে চাষাদের মধ্যে থেকে তাদের মতি গতি যদি ফেরাতে পারিস তো দেখা যাবে।" 


     ১৯০৯ সালে কৃষিবিদ্যায় বি. এস ডিগ্রি অর্জন করলে রবীন্দ্রনাথ পুত্রকে কৃষি বিষয়ক গবেষণাগার পরিদর্শনের জন্য পাঠিয়ে দিলেন ইউরোপ। এরপর ৫ ই সেপ্টেম্বর রথীন্দ্রনাথ কলকাতায় ফিরে আসেন। প্রথমে কাজ শুরু করেন পতিসরে পরে বোলপুরের মাটিতে পরিপূরক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠিত হলে ওখানে চলে আসেন বাবামশায়ের নির্দেশেই। 

    

       ছেলের মুখে কৃষিবিদ্যা, প্রজনন শাস্ত্র শুনতেন খুব মন দিয়ে। রথীন্দ্রনাথের কথায় - "সেই সময়টাতে আমরা পিতাপুত্র পরস্পরের যত কাছাকাছি এসেছিলাম তেমন আর কখনও ঘটে নি।"  এভাবেই "বাবামশায়ের" ইচ্ছেপূরণকে জীবনের একমাত্র ব্রত করে নিয়েছিলেন রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ। আর রবীন্দ্রনাথ জমিদার বংশের উত্তরাধিকার হয়েও জমিদারি সত্তাকে কঠোরভাবে শাসন করে দুঃস্থ অসহায় কৃষকদের সেবায় আত্মনিবেদন করেছিলেন। জমিদারি বিলাস বহুল জীবনের ভোগবিলাসের প্রবৃত্তিকে কঠিন শাসনে বেঁধে মানবতাবোধের নজিরবিহীন বিকাশ ঘটিয়েছিলেন জীবনব্যাপী। 


         " তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে

                     করছে চাষা চাষ--

          পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,

                   খাটছে বারো মাস।

          রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে,

           ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে

             তাঁরই মতন শুচি বসন ছাড়ি 

               আয় রে ধুলার 'পরে।"  

                 …………………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ ভাবনা - মহাশ্বেতা দাস

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

1 comment:

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...