Wednesday 30 August 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা- শ্রীজিৎ জানা // ই-কোরাস ৪

 


পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ৪

তনুশ্রী সিনেমাহল- টালিভাটা

শ্রীজিৎ জানা 



টালিভাটা কোথায় জানেনে? জানেন না তো? বলছি শুনুন,

 যেখানে টালির ভাটা থাকে মানে টালি তৈরীর কারখানা, সেখানকার নামই হল টালিভাটা। আরে মশাই! তেড়ে আসছেন কেন? সঠিকটাই তো বললুম। আসলে আমি হলুম জগমোহনের ডুপ্লিকেট। আবার গুবলেট করে দিচ্ছি।  জগমোহন কে? মানে বুঝলুম,সুকুমার রায়ের 'আবোলতাবোল' পড়েন নি। রায় মশাইয়ের বইয়ের কবিতার একখানা চরিত্র। জগমোহনের  মতো জিলিপির প্যাঁচ করে কথা বলা, ঠিকানার হদিশ দেওয়া আমার অভ্যেস। বদভ্যেস বললেও গায়ে মাখছি না, মাখব না। আসলে যে টালিভাটার কথা বলছি, তার অস্তিত্ব মুখে মুখে সর্বত্র। কিন্তু সরকারি কোন নথিতে টালিভাটা নামের কোন স্থানের হদিশ পাওয়া যাবে না। দাসপুর ১ ব্লকের পাঁচবেড়িয়া অঞ্চলের খাড়রাধাকৃষ্ণপুর মৌজার একটি অংশের নাম টালিভাটা। থামুন আরো খোলসা করে বলছি। ঘাটাল-পাঁশকুড়ো গামী ছুটে যাচ্ছে যে পিচের সড়ক, সেই সড়কের উপর একদিকে দক্ষিনে সুলতান নগর বাসস্টপেজ, অন্যদিকে উত্তরে বেলতলা বাসস্টপেজ, মাঝে টালিভাটা। খামোখা শুরুতেই চটে ছিলেন। টালিভাটায় টালির কারখানা ছিল। মতিলাল বেরার টালির ভাটা। টালির নামও রেখেছিলেন মতি। সেইথেকে উক্ত স্থানের নাম টালিভাটা। আবার সেই পুরানো অভ্যেস। ধান ভানতে শিবের গীত। মোটেই না। টালিভাটা গেছেন কস্মিনকালে! স্বদেশ দাদুর চায়ের দোকানে বসেছেন। নুব্জ চেহারা তার। সত্তরোর্দ্ধ বয়স। টনটনে স্মৃতি। হাত আর মুখ এখনো টাটুঘোড়ার মতো টগবগে। সিনেমাহলের কথা উঠতেই, ফোকলা দাঁত বের করে হেসে ছড়া কাটতে শুরু করে— 

ঢকর ঢকর ডায়নামা

টালিভাটার সিনামা

চোদ্দ বার ফিলিম্ কাটে

 মতি বেরার পিছন ফাটে।

বললুম, মতি বেরার এহেন কষ্টদায়ক অবস্থা কেন দাদু? উত্তরে জানলুম মতি বেরার শুধু টালির কারখানা নয়, সিনেমাহলও ছিল। তাতে জেনারেটরে চলত প্রোজেক্টর। মাঝে মাঝেই বন্ধ হত মেশিন। তখন পর্দার সামনে হ্যাজাক লাইট নিয়ে দাঁড়াতে হত কর্মীদের। এমনো দিন গেছে টিকিটের দাম ফেরত দিতে হয়েছে সিনেমা শুরুই করা যায়নি বলে। এবার তাহলে টালিভাটায় সিনেমাহল গড়ে ওঠার হালহকিকত নিয়ে দু'চার কথা হোক। মৌজার নাম খাড়রাধাকৃষ্ণপুর হলেও টালিভাটা নামটিই বারবার উল্লেখ করব সঙ্গত কারণেই।


টালিভাটায় প্রথম সিনেমাহল গড়ে ওঠে চল্লিশ- পঞ্চাশের দশকে। আজ যেখানে গার্লস স্কুল এবং শিবমন্দির, এককালে সেইস্থান ছিল জঙ্গলাকীর্ণ শ্মশান। গ্রামের সেই খাস জায়গা পরিস্কার করে তৈরি হয় সিনেমাহল। তমলুক নিবাসী পরিতোষ দাস স্থানীয় মতিলাল বেরা, পঞ্চানন প্যোড়াদের নিয়ে সিনেমাহল চালু করেন। খড়ি কাঠির বেড়ার সিনেমা হল। সামনের দিকে দর্শকদের বসার জন্য চট পাতা থাকত। পেছনের দিকে গুটিকয়েক কাঠের পাটার উপর বসার আসন ছিল। ওই  সিনেমাহলের প্রথম ছবির নাম ছিল 'হ্যাঁ'। টিকেটের মূল্য ছিল তখন ঊনিশ পয়সা। স্বদেশবাবুর বয়স তখন সাত-আট বছর। বেড়ার ফাঁক দিয়ে তিনি উঁকি মেরে দেখতেন সিনেমা। চাঁদপুর নিবসী লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষক শ্রী ঊমাশঙ্কর নিয়োগী মহাশয় জানান,* ওই সিনেমাহলের নামছিল 'কমলা'। আমার দেখা ওই সিনেমাহলে ছবি ছিল 'লালুভুলু'।'  কমলা' সিনেমাহলের ছবি  প্রচারের কায়দা ছিল ভারী আশ্চর্যের। পাট থলির চটে পোস্টার চিটিয়ে তাকে পিঠে ঝুলিয়ে নিতেন। আর হাতে চোঙা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় প্রচার করে বেড়াতেন। কিন্তু সেই সিনেমাহল বছর তিনেক চলার পর বন্ধ হয়ে যায়। তখন মতিলাল বেরা তার বাড়ির সংলগ্ন জায়গায় গড়ে তুললেন নিজের সিনেমাহল 'মিলনী'! এই সিনেমাহলেও মেঝেতে চট পেতে আর কাঠের পাটাতনকে উঁচ করে বেঁধে সিট তৈরী করে বসার বন্দোবস্ত ছিল। সেই মিলনী সিনেমাহলও কয়েক বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। মাঝে কেটে যায় বেশ কয়েকটা সাল। ইতিমধ্যে কল্মীজোড় মৌজায় তৈরী হয় 'মহামায়া টকিজ'! যার কথা বলব পরের পর্বে। থাক সে পরের পর্বের জন্য তোলা। এদিকে তখন টালিভাটা সংলগ্ন এলাকার মানুষের মনে লেগে গেছে সিনেমার প্রতি অনুরাগের ছোঁয়া। 

অন্যদিকে 'কমলা' সিনেমাহলের চিফ অপারেটরের সঙ্গে স্থানীয় মুকুন্দ শাসমলের গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। সেই বন্ধু স্বচ্ছল পরিবারের মুকুন্দ বাবুর মাথায় সিনেমাহল তৈরীর আইডিয়া ঢুকিয়ে দেন। এরই মাঝে রাধাকান্তপুর গ্রামের জনৈক ব্যক্তির কাছ থেকে বর্তামান সিনেমাহলের জায়গাটি মুকুন্দ বাবু কেনেন স্বল্প মূল্যেই। তিনিও সিনেমার প্রতি খুবই উৎসাহী ছিলেন। ব্যস্, মিলে গেল দু'য়ে দু'য়ে চার। মেইন সড়কের ধারে উঠল কংক্রিটের দেয়াল। মাথায় চাপল টিনের ছাউনি। ১৯৮৮ সালের ১৮ই আগষ্ট টালিভাটার বুকে 'তনুশ্রী' সিনেমাহলের হল শুভ মহরত। প্রথম ছায়াছবি ছিল 'চাওয়া পাওয়া'। মুকুন্দ বাবুর ভাই দুলাল শাসমল মহাশয়কে জিগ্যেস করলুম, তনুশ্রী নামটাই কেন বেছে নিলেন? তিনি জানান, " দাদার ছোট মেয়ের নাম ছিল তনুশ্রী। তখনকার সেই মিষ্টি নামটাই দাদা বেছে নিলেন সিনেমাহলের জন্য।" রমরমিয়ে চলতে থাকল সিনেমাহল। শোয়ের পর শো হাউসফুল। দুলাল বাবু জানালেন," প্রথমদিকে যথেষ্ট ভীড় হত দর্শকদের। কয়েকটা সিনেমা, যেমন শ্যামসাহেব, ছোটবউ, গুরু, লাঠি যথেষ্ট লাভ এনে দিয়েছিল। টিকিট ব্ল্যাক পর্যন্ত হত অনেক ছায়াছবিতে।"  পাঁচবেড়িয়া রামচন্দ্র স্মৃতি শিক্ষা মন্দিরের ইংরেজি বিভাগের বিশিষ্ট শিক্ষক শ্রী অশোক গোস্বামী জানান তনুশ্রী সিনেমাহলে ছবি দেখার কৈশোরের স্মৃতি, "তখন আমরা সিনেমা বলতাম না,বই বলতাম। কৈশোরে বড়দের এড়িয়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখব--এই ভাবনা মনে আসাটাই ছিল অকল্পনীয়। তবু জোটপাট করে রব তুলতাম, চল আজ কি বই চলছে দেখতে যাব। কিন্তু বন্ধদের সাথে যাওয়া হয়নি কখনো। তবে বড়দের সাথে তনুশ্রী হলে গেছি বেশ কয়েকবার। দেখেছি 'হাতি মেরে সাথী',  'শোলে', 'বাঞ্ছারামের বাগান',  'টগরী', 'সমাধান' এর মতো আরো অনেক সিনেমা।"।

তনুশ্রী সিনেমাহলের সিট সংখ্যা ছিল চারশ। তিনটে স্টলে ভাগ ছিল দর্শক আসন।  তিনশ চেয়ার আর ফ্রন্টে একশ বেঞ্চ ছিল বসার জন্য। শুরুর দিকে ৭৫ পয়সা ফ্রন্ট,এক টাকা মিডিল আর দেড় টাকা টিকট মূল্য ছিল ফার্স্ট ক্লাস সিটের। ব্যালকনি ছিল না। প্রোজেক্টার মেশিন থেকে সবকিছুই ছিল মুকুন্দবাবুর নিজস্ব। স্টাফ ছিলেন দশজন। গোঁসাইবেড় (খুকুড়দহ) গ্রামের নারান মাইতি ছিলেন চিফ অপারেটর। তাঁকে সাহায্য করতেন রামকৃষ্ণ জানা ( টালিভাটা) এবং দুলাল বাবু নিজেও। টিকিট কাউন্টারে বসতেন মদন প্যোড়া ( কলমীজোড়)।  মেছেদার প্রেস থেকে আসত নীল সাদা আর লজল সাদা পোস্টার। কখনো বাদামী- সাদা রঙেও ছাপা হত। এলাকা ভিত্তিক পোস্টার সাঁটাতেন লক্ষ্মীকান্ত সামন্ত ( টালিভাটা) এবং প্রতাপ মন্ডল (টালিভাটা)। প্রচারের আরেক মাধ্যম ছিল মাইক। কলোড়া নিবাসী রাম প্যোড়ার ছিল নিজস্ব মাইক। তার সাথেই চুক্তি ছিল সারাবছরের প্রচারের। তনুশ্রী সিনেমাহলে তিনটা ও ছ'টার শো হত প্রথম থেকেই। ইতিমধ্যে টালিভাটা একটি গঞ্জ এলাকা হয়ে উঠেছিল। পরে হাটও বসতে শুরু করে। দোকানপাতিও যথেষ্ট গড়ে ওঠে। সেই সমস্ত স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অনুরোধে প্রতি শুক্রবার ন'টা- বারটার একটি শো চলত। প্রাপ্ত বয়স্ক ছাড়া ওই শো টাইমে কারো প্রবেশে অনুমতি থাকত না। সাধারণত ভূতের সিনেমা আর এ মার্কা কিছু ছায়াছবির আকর্ষণে শুক্রবারের  নাইট শোয়ে তনুশ্রী সিনেমাহল গমগম করত। 

কিন্তু ক্রমেই খালি পড়ে থাকে দর্শক আসন। আশেপাশে তখন গড়ে উঠেছে মিনি পর্দার ভিডিও হল। লসে রান করছে দেখে তনুশ্রী হল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় মালিকপক্ষ।  সালটা ২০১০ তনুশ্রী সিনেমাহলে তালা পড়ে। বর্তমানে মূল কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকলেও, তা গুদামঘরে পরিণত হয়েছে। তবু চলতি পথে চোখ পাতলে দেখবেন এখনো দেয়ালের উঁচু জায়গাটায় তনুশ্রী নামটা ফিকে রঙের রেখায় কোনক্রমে টিকে আছে। আর আছে কত অনেক সিনেপ্রেমীদের স্মৃতিতে।



তথ্যঋণ :—

শ্রী ঊমাশঙ্কর নিয়োগী , চাঁদপুর

শ্রী স্বদেশ মাইতি, খাড়রাধাকৃষ্ণপুর 

শ্রী দুলাল শাসমল,খাড়রাধাকৃষ্ণপুর 

শ্রী অশোক গোস্বামী,  কাদিলপুর

                 ……………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


No comments:

Post a Comment

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...