রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ১৬
ধ্রুবতারার সান্নিধ্যে
মহাশ্বেতা দাস
" তারপরে একদিন
জানাশোনা হল বাধাহীন।
একদিন নিয়ে তার ডাক নাম
তারে ডাকিলাম।
একদিন ঘুচে গেল ভয়,
পরিহাসে পরিহাসে হল দোঁহে
কথা বিনিময়।"
প্রায় দেড় বছর দেশের বাইরে কাটিয়ে অষ্টাদশ রবি ফিরে এলেন - সেই ছাদ, সেই চাঁদ, সেই দখিনা বাতাস, সেই নিজের মনের বিজন স্বপ্ন আর তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা নূতন বৌঠাকুরানীর কাছে।
ঠাকুর বাড়ির মুখচোরা লাজুক ছেলেটি গিয়েছিলেন বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে আর ফিরলেন প্রগলভ যুবক হয়ে। আঠারো বছরের যুবকের পক্ষে যেরূপ পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক -- রবির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। শীতের দেশের স্বাস্থ্যকর আবহওয়ায় তাঁর সুন্দর কান্তি যেমন সুন্দরতর হয়েছিল তেমনই তাঁর কণ্ঠস্বরে এবং কথা বলার ঢঙে ও দেখাদিল পরিবর্তন।
ব্যারিস্টার না হয়ে দেশে ফিরে আসার জন্য কিছু আত্মীয় স্বজনের মনে হতাশার মেঘ ভিড় করেছিল। যদিও এই নিয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং রবি - অগ্রজদের মধ্যে তেমন কোন খেদ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ নিজেও পরিণত বয়সে বোলপুর থেকে তাঁর আদরের বিবি (ইন্দিরা দেবী) কে এক চিঠিতে লিখেছিলেন -
"ভাগ্যি আমি ব্যারিস্টার হই নি।"
আর আমরা রবীন্দ্র প্রেমিকরা তো স্বস্তির শ্বাস ফেলি এই ভেবে যে সেদিনের রবি মন দিয়ে ব্যারিস্টারি পড়লে আমরা কি রবীন্দ্রনাথ কে পেতাম!! তাই মাঝে মাঝে দূর ভবিষ্যতে ভালো কিছু, বড়ো কিছু ঘটার জন্যই বোধহয় বিধাতা এমন অঘটন ঘটিয়ে থাকেন যেটা আপাত দৃষ্টিতে খারাপ মনে হলেও আদপে আমাদের জন্য, সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য ভালো। গতানুগতিক জীবনে সৃষ্টিশীলতা কতটুকু!!!!
" আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে
তখন কে তুমি তা কে জানত
ছিল না ভয় ছিল না লাজ মনে
জীবন বহে যেত অশান্ত।"
মাত্র নয় বছর বয়সে ঠাকুরবাড়ির বধূ হয়ে যখন বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে ছিলেন কাদম্বরী দেবী তখন রবির বয়স ছিল সাত বছর। খেলার সাথী, গল্পের সঙ্গী রূপে নিরন্তর চোদ্দটি বছর কেটে গেল দুজনের। বিশেষ করে সারদাদেবীর মৃত্যুর পরে মাতৃহারা ছেলেটিকে নারী হৃদয়ের স্বভাবজাত স্নেহ উজাড় করে রবিকে আরও বেশী আপন করে নিয়েছিলেন নূতন বৌঠান। তাই বিলাতে থাকতেও তাঁর কথাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ত। তাঁর স্নেহময় চোখের চাহনি ধ্রুবতারার মতো সারাক্ষণ মনের আকাশে বিরাজ করত। আজ দেশে ফিরে আসার পর ও সব থেকে বেশি আদর আপ্যায়ন পেলেন নূতন বৌঠানের কাছ থেকেই।
রবি বিলেত থেকে ফিরে দেখলেন জ্যোতিদাদা ও অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী দেশী ও বিদেশী সুরের মিশ্রণে বাংলা গানের নূতন সুর সৃষ্টির রূপ সৃষ্টির সাধনায় তন্ময়। যে ঘটনা পরবর্তী ক্ষেত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত রচনার ইতিহাসে বিশেষ প্রভাব বিস্তারের দাবিদার। প্রাচীনপন্থীদের ঘোর আপত্তি কে দূরে সরিয়ে রেখে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে দুঃসাহসিকতার পথ উন্মোচন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সেই পথে বিচিত্র সুর, অনিন্দ্য সুন্দর ভাষা এবং অনির্বচনীয় ভাবের ধারায় যে তটিনীর সৃষ্টি করেছিলেন বাংলা গানের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তা যুগান্তরের সাক্ষ্য বহন করল।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের তখন বিভিন্ন সুরের ঘাত প্রতিঘাতে "মানময়ী" নাটক (গীতিনাট্য) লেখা প্রায় শেষ পর্যায়ে। রবীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে ফিরে এই নাটকে একটি গান সংযোজন করলেন.....
"আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি।"
নাটকটি যখন মঞ্চস্থ হল.... জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ইন্দ্রের ভূমিকায় অভিনয় করলেন, রবীন্দ্রনাথ হলেন মদন আর কাদম্বরী দেবী সাজলেন দেবী উর্বশী।
………………….
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment