আমার পয়লা বৈশাখ
দুঃখানন্দ মণ্ডল
তখন বোধহয় ক্লাস ফাইভ কিংবা সিক্স। মাথা ফাটানো রোদ। সকালে স্কুল সেরে বাড়ি ফেরা। এর মাঝেই এক মাসের ছুটি কাটিয়ে স্কুলের নতুন ক্লাসে পা দেওয়া। বেশ নতুন নতুন আমেজ। তখনো বই আসেনি। তার পড়ার চাপও কম। বাড়ি ফিরে কোনো রকমভাবে মুখে দুটো খাবার দিয়ে নদীতে ঝাঁপ। নদী মানে শীলাবতী। আমাদের আর এক মা। কখনোই আমাদের প্রতি রাগ করেনি। তার বুকের উপর সারা দুপুর জলে ঝাঁপাই ঝুড়তাম। বহমান জলকে একটি সময়ের জন্য শান্ত হতে দিতাম না। আমরা অশান্ত থাকতাম কিন্তু জলের ধারা বরাবর এগিয়ে যেতো কাঁকড়ার বাচ্চাদের লাইন। একটা সময় আমাদের পেট জানান দিতো; খিদে পেয়েছে। মাঝ আকাশ থেকে সরে গেছে সূর্যটা। যে পাশে জল শুকিয়ে গেছে নদীর, সেইপাশ দিয়ে আমাদের বাড়ি ফেরার পথ। বালির উপর আগুন ছুটছে। আমরা রোদে পুড়তে পুড়তে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছি।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ। পয়লা বৈশাখ বলে কতরকমের তরিতরকারি ভাতের সাথে। কলাপাতায় কলমি শাকের সাথে আরো চাররকমের শাক একসাথে ভাজা, গয়না বড়ি ভাজা, বেগুন ভাজা, গোল গোল করে আলু ভাজা, পটল ভাজা, ভাত, টক ডাল, শুক্তো,
বাটা মাছের তেলঝাল, পুঁটি মাছ ভাজা আরো কি কি মা রান্না করতো। বাবা মায়ের সাথে আমরা ভাত খেতাম। আমাদের টোকা আম গাছের ডালে বসে কোকিলটা ডেকে চলেছে। দক্ষিণের দুয়ারে মা মাদুর পেতেছে। সামনের বড় পুকুরে হাঁসগুলো জল চৈ চৈ খেলছে। তখনও সব বই আসেনি বাড়িতে। যে কয়েকটি এসেছে মা স্বযত্নে পুরাতন ক্যালেন্ডারে পাতা দিয়ে বই মলাট করছে। নতুন খাতার আমন্ত্রণ পত্রগুলি বাবার হাতে। মনের পড়ে যায় বাবা কী করবেন মোটা কাগজের আমন্ত্রণ পত্রগুলি দিয়ে। পাখা তৈরী হবে। হ্যাঁ কাগজের পাখা। শীতের উচ্ছে মাঁচার অবশিষ্ট টুকরো তারে পাখাটি স্থাপন করতেন। তারপর আমাদের হাতে দিতেন। আমরা ছুট মারতাম পাকা ধানের ক্ষেতের দিকে। পাকা ধানের গন্ধে মকমক করতো আমাদের নাক। পাখাটা পৎ পৎ করে ঘুরতো। আমরা আমাদের গল্পে মেতে থাকতাম। ঐদিকে দেখতে পেতাম বাবা তার পুরাতন সাইকেল করে নতুনখাতা সারতে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। বড়মার সাথে মা আর কাকিমা কৃষ্ণ মন্দিরে প্রদীপ জ্বালাতে ব্যস্ত। জেঠুর গলায় শুনতে পেতাম গীতা পাঠ-
ধৃতরাষ্ট্র উবাচ
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।
মামকাঃ পান্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয়।।১।।
সঞ্জয় উবাচ
দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্যোধনস্তদা।
আচার্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ।।২।।
আমরা একে একে পুকুর ঘাট থেকে পা হাত মুখে ধুঁয়ে ঘরে ফিরতাম। খিদেতে পেট মোচড় দিতো। তবু অপেক্ষা করতাম নতুনখাতার লাড্ডু খাবো বলে। সেই সময় যার দোকানে নতুনখাতা তাঁর বাড়িতেই মোতিচুরের লাড্ডু হতো। বাড়ির বৌয়েরা সেই মিষ্টি যত্নসহকারে তৈরী করতেন। বেশ সুস্বাদু, সুন্দর গন্ধ, কাগজের ঠোঁঙাটি খোলা মাত্রই ছড়িয়ে পড়ত মিষ্টির গন্ধ। আমরা একটি দুটি করে মিষ্টি সাথে সাথে খেয়ে নিতাম। বাবা কোন দোকানে কি টিফিন খেয়েছে মাকে বলতে থাকতেন। বেশ কয়েকদিন ধরে সকালে এক জাম মুড়ির সাথে একটি মিষ্টি খেয়ে পাঠশালায় যেতাম। আর নতুন বইয়ের নতুন পড়া বোঝাতেন মাষ্টারমহাশয়। একটা সময় অপেক্ষার সময় গুনা শেষ হতো। বাবার সাইকেলের কিড়িং শব্দ কানে আসতো। কেমন ভাবে কেটে যেতো একটি ১ লা বৈশাখের প্রথম দিন তার টের পেতাম না সেই বয়সে।
…………………..
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - সৌতি বসাক
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
"যে পাশে জল শুকিয়ে গেছে নদীর, সেইপাশ দিয়ে আমাদের বাড়ি ফেরার পথ।" ❤️😌
ReplyDelete