Sunday 30 July 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২ // শ্রীজিৎ জানা // ই-কোরাস ২

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২

আইভি লতা টকিজ, দুবরাজপুর, নাড়াজোল

শ্রীজিৎ জানা 



ষাট কিম্বা সত্তরের দশকে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে বিনোদের তেমন কোন মাধ্যম ছিল না। ধর্মীয় ও পারিবারিক উৎসব-অনুষ্ঠান, মেলা,যাত্রা,কীর্তন,পালাগান,কবিগান সহ নানাবিধ লোক আঙ্গিকে মানুষজন আনন্দ উদযাপন করত। যদিও সিনেমাহলে সিনেমা দেখার চল ইতিউতি শুরু হয়ে গেছে আগেই। কিন্তু যাওয়ার ঝক্কি সাথে ট্যাঁকে টানাটানি দুভাবেই নিরাশ হতে হত মানুষজনকে। তা বলে এই নিরাশা কাটিয়ে দু'চারজন উৎসাহী যে ছিলেন না, তা জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। হয়তো সংখ্যাটা বেশিই ছিল। এরই মাঝে এক্কেবারে এঁদো গাঁয়ে বাঁশ বেঁধে চট ঘিরে,ত্রিপল ছেয়ে অস্থায়ী সিনেমাহল বানানো হত। তার নাম ছিল চলন্তিকা সিনেমাহল। তাতে সিনেমা দেখানো হত। ঘাটাল নিবাসী সুধীর পাল মহাশয়ের হাত ধরে ঘাটাল এলাকায় চলন্তিকার রমারমা চলে একসময়। নাড়াজোল বাজারেও তিনি এই চলন্তিকা হলে সিনেমা দেখান বেশ কয়েকদিন। বোধহয় ভেতরের ইচ্ছের আগুনটা ওই সময় জোরালো একটা বাতাস পায়। বকুলতলায় তখনো সিনেমাহল চালু হয়নি। ওদিকে ঘাটাল,এদিকে মেদিনীপুর দুরত্ব কম নয়। মন চাইলেও এক আধবার সাধেস্বপ্নে যাওয়া যায়। তার বেশি যাওয়াটা বেশ মুশকিলের। অবশেষে সুরাহা হল। চওড়া হাসি ফুটল এলাকার সিনেেপ্রেমীদের মুখে!


কংসাবতী নদীপারের গ্রাম মগরা। থানা কেশপুর,পশ্চিম মেদিনীপুর। মগরার সিংহ পরিবার এক কালে ছিলেন জমিদার। আজও তাদের পরিবারে দুর্গাপূজা হয়। তা হোক গে। কিন্তু এ তো ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হচ্ছে। সিনেমাহল গেল কই? অত উতলা কেন হে বাপু! জান না, সবুরে মেওয়া ফলে। বাপু হে, ওই মগরার সিংহ পরিবারের হাত ধরেই নাড়াজোল এলাকায় তথা দুবরাজপুর গ্রামে স্থাপিত হল আইভিলতা সিনেমাহল। স্থপতিকার অশোক সিংহ মহাশয়। নাড়াজোল - মেদিনীপুর গামী পিচ সড়ক থেকে খানিব দূরে টিনের ছাউনি আর ঝিটেবেড়ার মাটির দেয়ালের সিনেমাহল।  অশোক বাবু মায়ের নামে সিনেমাহলের নাম রাখলেন "আইভি লতা টকিজ"। বাহারী আইভি লতা অর্কিডের মতোই বেশ মিষ্টি সিনেমাহল। মিষ্টিতে এলার্জি না থাকলে এক্ষণে দু'চারখান রসকদম্ব তথ্য পরিবেশন করতুম। আর এলার্জি থাকলেই বা কি! শাস্ত্র বলে অধিকন্তু ন দোষায়। সিনেমা হলের নাম আইভি লতা, তাই আইভি লতা সম্বন্ধে একটু না জানলে বড্ড অপরাধ হয়ে যায়। তাহলে আসুন মগরার জমিদারের সাথে মিলে যাক তমলুকের রাজ পরিবার। তাস্রলিপ্তের রাজা হরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা ছিলেন আইভি লতা। তাঁকে বিবাহ করেন মগরার জমিদার অভয়পদ সিংহ। এই অভয়পদ সিংহ মশাই আনুমানিক ষাটের দশকে প্রথম একটি সিনেমাহল খোলেন কংসাবতীর দক্ষিনে পাটনা গ্রামে (ভবানীপুর জি. পি, ডেবরা থানা)।  নাম দেন "বাণীশ্রী"। সেই হলে মেঝে ও চেয়ারে বসার ব্যবস্থা ছিল বলে জানান সিংহ পরিবারের এক সদস্য শ্রী অজয় সিংহ।  প্রায় ১০-১২ বছর চলার পর হল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সিনেমাহলের ভূত মাথা থেকে তাঁর নামে না সহজে।  "বাণীশ্রী" র মেশিন, পর্দা প্রথমে ভাড়ায় যায় আনন্দপুর,তারপর কেশপুর। ইতিমধ্যে অভয়পদ প্রয়াত হন। পিতৃদেবের ব্যবসার ঝোঁক চাপল এবার ছেলে অশোক সিংহের মাথায়। দুবরাজপুর মৌজায় জায়গা কিনে তৈরি করলেন 'আইভিলতা টকিজ'।আইভি লতার যাত্রা শুরুর সঠিক  তারিখ অজানা। তবে ১৯৭৬ সালে শুরু বলে জানান প্রয়াত অশোক সিংহের পত্নী শ্যামলী দেবী।




প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের বসবার জন্য  আসন ছিল সাড়ে চারশ। সব কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার। থ্রি টায়ার আসন ফ্রন্ট,মিডিল আর ফার্স্ট ক্লাসে সাজানো। কোন ব্যালকনি ছিল না। শুরুর দিকে ফ্রন্ট আসনের টিকিট মূল্য ছিল সত্তর পয়সা,মিডিল আসনে এক টাকা আর ফার্স্ট ক্লাসে দেড় টাকা। শো হত দুটো টাইমে, তিনটা আর ছ'টা। সেই সময় আইভি লতার প্রত্যেকটা শো হত হাউস ফুল। দূরদূরান্তের সিনেমাপ্রেমী দর্শক ভীড় করত হলে। ভালো ছবি মানেই শোয়ের পর শো টিকিট ব্ল্যাক হবেই হবে। সাইকেল মাইকে প্রচার চলত সকাল বিকাল। সাইকেলের পেছনে বাঁশের চাঁচে সাঁটা থাকত পোস্টার। এদিকে নাড়াজোল বাসস্ট্যান্ডের যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে,ওদিকে সিঙ্গাঘাই বাজারে লাগানো থাকত ছবির পোস্টার।


আইভি লতা সিনেমাহলের প্রথম ছবি ছিল ' সাধক বামাক্ষ্যাপা'। পৌরাণিক এই সিনেমা দিয়ে হলের শুভ মহরতের পেছনে একটা কারণ ছিল। দুবরাজপুর গ্রামে যেখানে সিনেমাহল গড়ে ওঠে আগে সেইস্থানে ছিল শ্মশান।  আর তার পাশেই ছিল কালীমন্দির। আজও কালীমন্দিরে তিথি মেনে পূজা হয়। শ্মশান এবং কালীমন্দিরের কারণে সিনেমাহলের শুভাশুভের কথা ভেবে ওই সিনেমা প্রথম দেখানে হয় । তারপর একের পর এক হিন্দি ও বাংলা মুভির টানে আইভিলতা টকিজ ভিড়ে ভিড়াক্কা হতে থাকে। হলের অনতিদূরেই নাড়াজোল রাজ কলেজ। টকিজের অনেক সিট থাকতে কলেজ পড়ুয়াদের দখলে। কত যুগলের হৃদয় বাঁধা পড়েছে,কত অভিমানের মেঘ কেটে গেছে,অথবা প্রথম প্রেম ছুঁয়ে দেখার শিহরণ, প্রেম নিবেদন – সবটুকুই ঘটেছে  আইভিলতা টকিজের আলোছায়ায় ভিতর। এক সময় রমরমিয়ে কয়েক সপ্তাহ চলেছে 'বাবা তারকনাথ', 'অনুসন্ধান', 'অন্যায় আবিচার', 'প্রতিকার','শোলে','কুলি' প্রভৃতি সিনেমা। 'বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না' সিনেমা হাউসফুল চলেছে বেশ কয়েক সপ্তাহ।



সিনেমাহলের কথা উঠতেই লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষক দেবাশিস ভট্টাচার্য জানালেন তার ছোটবেলাকার স্মৃতি–" বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ছুটির দিনে বাবার হাত ধরে আমার প্রথম ওই হলে সিনেমা দেখতে যাওয়া। আবার বয়স তখন আট। সেটা ছিল দারুণ অনুভূতি। পরে যখন ক্লাস টেনে পড়ি(১৯৮২) তখন হলে দেখানো হচ্ছিল সত্যজিৎ রায়ের  'অশনি সংকেত' ছবি। স্কুল থেকে দেখানো হবে। বলা হল, যে বেশি টিকিট বিক্রি করতে পারবে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। সর্বোচ্চ একশটা টিকিট বেচে পুরস্কৃত হয়েছিলাম সেবার। এর পর স্কুল থেকেই দেখতে গিয়েছি,'পথের পাঁচালি','বাঞ্ছারামের বাগান','ছুট','চিরন্তন' এর মতো সিনেমা"। বিরতির মাঝে হলের ভিতর ফেরি হত লজেন্স,ছোলা-বাদাম। ছোটবেলায় খুব বায়না করতাম হলের ভিতর ওগুলো কিনে খাওয়ার জন্য।"


প্রায় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে গ্রামগঞ্জে বিনোদনের নতুন এক ধারার প্রচলন হয়। টিভি ও মিনি পর্দার ভিডিওহল গড়ে ওঠে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর ভিতরে। ভিডিও হলের টিকিটের মূল্য ছিল বেশ হাতের নাগালের মধ্যে।তার উপর ওইসব হলে বিভিন্ন ভৌতিক ও 'এ' মার্কা ছবি দেখিয়ে এক শ্রেনীর দর্শকদের ভিডিওহলমুখী করা হত। স্বভাবিক কারণে সিনেমাহলের ভিড় ক্রমশ কমতে থাকে। আইভিলতা টকিজের পাশেই এবং কয়েক মাইল দূরে ঝলকা মৌজায় গড়ে ওঠে এরকম ভিডিওহল। ক্রমশ আইভিলতার ভিড়ে ভাটা পড়তে থাকে। ছবির খরচ,সাত- আট জন স্টাফের বেতন,প্রচার,হলের মেইন্টেনেন্স খরচ প্রভৃতি আয়ের চেয়ে বেশি হতে থাকে। ফলে লসে রান করতে থাকে সিনেমাহল। অবশেষে ২০০০ সাল নাগাদ আইভি লতা টকিজ  বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ সিনেমা হলের কাঠামো দীর্ঘদিন টিকে থাকলেও বিগত ২০১১-১২ সাল নাগাদ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। আজ শুধুমাত্র এলাকার মানুষের স্মৃতিতে বেঁচে আছে 'আইভি লতা টকিজ'।


কৃতজ্ঞতা :–

অজিত সিংহ ( মগরা)

দেবাশিস ভট্টাচার্য ( নাড়াজোল)

শ্যামলী সিংহ  ( মেদিনীপুর) 

সৌভিক সিংহ ( মেদিনীপুর)

           ……………………… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...