প্রহর গোনে বীজ বাসনা
বনশ্রী রায়দাস
যে ঋতু নিয়ে কবির ভাবনার শেষ নেই যে ঋতুর অপেক্ষায় প্রহর গোনে বীজ বাসনা । উচাটন মন ঘিরে নৃত্য করে সহস্র ময়ূর, আকাশের আলেখ্যপাঠ করে সাতরঙা রামধনু।মৃদুমন্দ স্বর খোঁজে মেঘ মল্লার, যে ঋতুর জন্য অনন্তকাল অপেক্ষারত বিরহকাতর যক্ষ ও যক্ষপ্রিয়া। কুটজকুসুমের মালা গেঁথে মেঘদূতের মাধ্যমে ব্যাথাতুর হৃদয়ের সংবাদ পাঠায় । তার প্রিয়ার কাছে । সেই ভাব বিহ্বল গুরু গুরু গম্ভীরা আজও বিপুল ঝড় তোলে নম্র জানালায়। ভেসে ওঠে মেঘের চঞ্চল দেহপুষ্প , ঈশান কোণে দানা বেঁধে চকিতে হয়ে উঠে উন্মত্ত প্রেমিক, আদরে সোহাগে ভরিয়ে দেবে নম্র ধরাতল। ফ্রক-বালিকার আঁচলই আশ্রয় কি ক্ষতি করতে পারে তার ঘন ঘন বিজুরী ছটা তীব্র আলোর রোশনাই। কবির কথায় ----
"শ্রাবণ গগনে ঘোর ঘনঘটা
ঘনঘন দামিনী রে"
এসে গেল দ্রিম দ্রিম ঝমঝম। হুটোপাটি গৃহস্থের উঠোনে । ত্রস্ত মা জেঠিমা শুকোতে দেওয়া শীতল পাটির ধান গম মশলাপাতি বাঁচাতে অস্থির।
ঠাকুরমা রাখালকে বলেন শিগগির গরু গুলোর বাঁধন খুলে দিতে। বারান্দা-দোলনায় ফ্রক-বালিকা কামিনী সংকেতে হৃদি-ফুল ফুটে উঠল নয়ন তারায়। মাঠঘাট কাণায় কাণায় পূর্ণ মনের হরষে সে ছড়া কাটে --
"টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে নদে এলো বান
শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যে দান '।
বর্ষার নতুন জল মেখে খেলায় মত্ত হয় দামাল ছেলেরা। নদী বাঁক বদল করে , কেতকী কদমের স্বরগ্রামে আসন পাতে লজ্জাবতী স্পর্শ । আকাশ কোণে কম্পিত চাঁদ ধোয়া জলে যৌবনের আঘ্রাণ।
কবি লিখলেন ----
"ওগো নির্জনে বকুল শাখায়
দোলায় কে আজি দুলিছে
দোদুল দুলিছে "
নীড়ে না ফিরে ডালে বসে বৃষ্টি মাখে কপোত কপোতি, বেশ কিছু সময় অঝোর ঝরে যেন সমাহিত শান্ত। ধুয়ে মুছে সাফ করে সবুজ প্রকৃতি। উৎফুল্ল কবি গেয়ে উঠলেন "বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল", আবার কখনও বিষাদ মথিত কবি ছুটে যান হারানো প্রিয়ার সন্ধানে বিগ্রহ শূন্য হৃদয় ----
"এ ভরা বাদর মোহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর "।
বর্ষা আমার কাছে ধরা দেয় সমস্ত অপ্রাপ্তির অবসান হিসেবে । মেঘের বজ্রবিশান যেমন ধুইয়ে দেয় বর্ষাপাঠ তেমনি হৃদয়ের গুমোট যন্ত্রণা ধুয়ে মুছে সাফ করে । শীতল প্রাণ জুড়িয়ে গান বাজে বেতারে --- 'বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি এ কোন অপরূপ সৃষ্টি'। বর্ষার সেই মাতাল করা রিমঝিম ভরিয়ে দেয় পিয়াসী অঙ্গন। আমার কলমে তখন সম্পূর্ণ এক শ্রাবণ দিনের কাব্য----
"মেঘের টুকরো থেকে দু পঙক্তি
বেজে উঠল পাহাড়ের দ্রিম দ্রিম,
নদীর হাঁসলি বাঁকে অঝোর,
বাউল উড়ে গেল ধৈবতে।
বীজ বোনা অসম্পূর্ণ রেখে
কৃষক ফিরেছে নাকছাবি ঘরে,
নৌকো ঘাটে বেঁধে নুলিয়া ফিরল
আগুন পোহাবে বলে"।
এইভাবেই প্রতিটি তৃষীত হৃদয়কে যেমন পূর্ণ করে বর্ষা তেমনই তার অবারিত বারি, শস্য শ্যামল করে দাহজর্জর প্রকৃতিকে। হাসি ফোটে কৃষকের ঘরে বর্ষণসিক্ত নরম মাটি কর্ষণ, বীজ বপন তারপর সারা বছরের খাদ্যের সংস্থান। কেয়া ফুলের মাতাল সুগন্ধ খাজুরাহো ছুঁয়ে গেলে ----
"মন মোরো মেঘের সঙ্গী
উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে"।
…………………
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ ভাবনা - রাজকুমার মুখার্জী
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment