Tuesday 25 July 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ২৯

 


রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ২৯

মর্ত্যপ্রেমে

মহাশ্বেতা দাস


     "পুণ্য সঞ্চয় করলেই স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে এই কথাই চলতি কথা; কিন্তু আমি বলছি যে, আমি স্বর্গ থেকেই পুণ্যের জোরে মর্তে নেমে এসেছি। আমি যখন গন্ডীবদ্ধ প্রকাশের মধ্যে পরিস্ফুট হলাম তখনই আমার সকল অপূর্ণতা সত্ত্বেও মর্তের মধ্যে স্বর্গ ধন্য হল।"       


      রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন আন্তরিকতার সাথে মানুষের কাছে, মাটির কাছে, প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে সুখ দুঃখে ভরা মানব জীবনের রস আস্বাদন করতে চেয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই গণ্ডিবদ্ধ জীবন সাধারণ মানুষের কাছে না যেতে পারার কষ্ট তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল। তাই পরিণত বয়সে যেদিন থেকে জমিদারি দেখাশোনার জন্য মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার অনুমতি মিলল…. সেদিন থেকে কবির মননে, লেখনীতে যেন নব দিগন্ত উন্মোচিত হলো। জমিদারি দেখাশোনার কাজে নিয়মিত বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়…. পল্লী গ্রামের সুখ দুঃখ, হাসি কান্না বিজড়িত অনেক সমস্যার সাথেই পরিচয় ঘটে, বিভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়। ঠাকুর বাড়ির ছোট ছেলেটির এসব ভালোই লাগে। উচ্চবিত্তের ঘেরাটোপে মোড়া দমবন্ধ করা বদ্ধ জীবনের চেয়ে এই জীবন বেশ ভালো। মাঝে মাঝেই নদীতে নৌকা বিহারে বেরিয়ে পড়া.… এমনি করেই বেশ দিন কাটছিল। নৌকায় ঘুরতে ঘুরতেই একদিন চলে এলেন রাজশাহী তে। এখানে এসে দেখা পেলেন সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার মৈত্র'র সাথে। আর পেলেন রবীন্দ্র সাহিত্যের একান্ত সমঝদার, সৌন্দর্যের উপাসক অন্তরঙ্গ বাল্যবন্ধু লোকেন পালিত কে। লোকেন পালিত তখন রাজশাহীতে জেলা-জজ।


         ব্রিটিশ সরকারের প্রভাবে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার তখন একপ্রকার ভগ্ন দশা। ঔপনিবেশিক সরকার তাদের ব্যবসায়িক বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলছে একের পর এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। লক্ষ্য একটাই বছর বছর আগত ভারতীয় শিশুদের তোতাপাখির মতো কিছু বুলি শিখিয়ে মাছি মারা কেরানী গড়ে তোলা আর সমস্ত উচ্চ পদ গুলিতে থাকবে ব্রিটিশরা। স্কুল গুলির বাইরের চাকচিক্যে মোহিত হয়ে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ মাতৃভাষা শিক্ষা ছেড়ে চাকরি পাওয়ার আশায় সেদিকেই তখন মনোনিবেশ করছে, যেটা আমাদের দেশ ও সমাজ কোন কিছুর জন্যেই স্বাস্থ্যকর নয়। বিষয়টি কবিকে ভাবিয়ে তুলেছে। বাল্যবন্ধু এবং অক্ষয় কুমারের অনুরোধে তাই লিখে ফেললেন "শিক্ষার হেরফের" প্রবন্ধ। রাজশাহী এসোসিয়েশনে (১৮৯২) প্রবন্ধটি পাঠও করলেন। 

    

      সমাজ সচেতন যে মানুষটির সহজাত প্রবৃত্তি শিক্ষাদান, তিনি যে এ বিষয়ে লেখনী ধারণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। তিনি অনুভব করেছিলেন যে আমাদের দেশে শিক্ষার সঙ্গে ভাষা ও জীবনের সামঞ্জস্য সাধিত হয় নি, রচিত হয়নি তাই যোগাযোগের রাস্তাও। তিনি মনে করেছিলেন এই হেরফেরটি মুছে যাওয়া দরকার। এ যেন জলের মধ্যে থেকেও মাছেদের তেষ্টা মিটছে না! জল আছে মাছেদের তেষ্টাও আছে তবু পান করার উপায় নেই! অর্থ রোজগারের চিন্তা এতটাই বেড়ে উঠেছে যে তারা নিজেদেরকে উচ্চতর ভাবের আদর্শে অধিষ্ঠিত রাখে না। স্বাভাবিক ভাবেই পার্থক্য রয়ে যায় বিদ্যা ও ব্যবহারের মধ্যে অথচ প্রয়োজনটাই হলো শিক্ষার সঙ্গে জীবনের সামঞ্জস্য বিধান। রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন এই গুরু দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষা। এর আগে শিক্ষা বিষয়ে এমন সুচিন্তিত লেখনী ধারণ আর কেউ করেন নি। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ মোহন বসু কবিকে এই প্রবন্ধে তাঁর সুচিন্তিত, বলিষ্ঠ ও যুক্তিপূর্ণ কথনের জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লেখেন। 


    এরপর নাটোরের রাজা জগদিন্দ্রনাথের আতিথ্য গ্রহণ ইত্যাদিতে বেশ কিছুদিন  সমারোহে কাটলেও পার্থিব রোগ জ্বালা থেকে তো রেহাই নেই! দাঁতের ব্যথায় কাবু হলেন!!  ফিরে এলেন শিলাইদহে। এ তো গেল শারীরিক কষ্ট। কিন্তু কবির মন!! বহু দিন হলো কাব্যলক্ষীর দেখা মেলেনি। কবি-মন কি সুখে থাকতে পারেন? একটি পত্রে তিনিই তো একবার লিখেছিলেন- "বাস্তবিক এ জীবনে কবিতাই আমার সর্বপ্রথম প্রেয়সী - তার সঙ্গে বেশীদিন বিচ্ছেদ আমার সয় না।"  সত্যিই তো আশৈশব যিনি স্বভাব কবি তিনি কতদিন আর কবিতা থেকে দূরে থাকবেন!! লিখলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা "মানস সুন্দরী"। প্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কে কেবলমাত্র হৃদয়াবেগের মুগ্ধতা নয় বরং তার থেকেও বেশী প্রকৃতি ও মানুষকে পূর্ণসত্ত্বায় প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি এই কবিতায়। সত্য ও সুন্দরের পূজারী তিনি। কবির এই সৌন্দর্য্য চেতনার সাথে যুক্ত হয়েছে মানব মনন। আর তাই কবিতার পরতে পরতে ব্যক্ত হয়েছে মানুষের মনোজগতের কথা। 


     "মানস সুন্দরী" কবিতায় কবির বিশ্বপ্রেমের আলোকে ধ্বনিত হয়েছে মর্ত-প্রীতির সুর। ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো অনুভূতি গুলিকে এক জায়গায় জড়ো করে মানস লোকে একটি নারীমূর্তি প্রত্যক্ষ করলেন তিনি। তাই "মানস সুন্দরী" হলো বিশ্বের সমস্ত প্রিয়ার প্রতীক। প্রকৃতি ও মানুষ এখানে এক সূত্রে গ্রথিত হয়েছে। পদ্মাতীরের গ্রামের ছবি, সূর্যাস্তের ছবি, বালিকা বধূর ঘরে ফেরার ছবি, জীর্ণ কুটিরে সাঁঝবাতির আলো জ্বালার ছবি ফুটে উঠেছে কবিতায়। সুখ দুঃখ, বিরহ প্রেম, আনন্দ বেদনায় বিশ্ব এখানে পরিপূর্ণ রূপে প্রকাশিত। কবির মর্তপ্রেম এবং মানুষের প্রতি গভীর সমবেদনা ও ভালোবাসা কবিতাটিকে চরম উৎকর্ষতা দান করেছে। 


    " মানসী রূপিণী ওগো বাসনাবাসিনী,

      আলোকবসনা ওগো নীরবভাষিনী, 

     পরজন্মে তুমি কি গো মূর্তিমতী হয়ে

      জন্মিবে মানবগৃহে নারীরূপ লয়ে

      অনিন্দ্যসুন্দরী?"  

                    ……………………


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...