Sunday, 27 October 2024

বহুতল - অর্থিতা মণ্ডল // ই-কোরাস ২০০



বহুতল

অর্থিতা মণ্ডল

নতুন কমপ্লেক্সে সাত তলা বিল্ডিংগুলোর মধ্যে পূবেরটা একটু বেশিই বড়ো,খোলামেলা।এটাই 'এ' ব্লক।একেবারে টপ ফ্লোরে মনোময়ের ফ্ল্যাট। ব্যালকনিতে বসলে পূবের শহরের  অনেকটা দেখা যায়। সাজানো গোছানো অভিজাত ফ্ল্যাটের বিছানায় শুয়ে মনোময়ের মনে হচ্ছে এত বিলাস বৈভব কদিনই বা ভোগ করতে পারল! দুটো কিডনিই নষ্ট। শরীরের বেশিরভাগ অর্গ্যান কাজ করছে না। আয়ু মেরেকেটে একমাস।শেষ কটা দিন বাড়িতেই থাকবেন । আয়া, নার্স , ওষুধের গন্ধে ঘরটা হাসপাতাল মনে হচ্ছে।  স্ত্রী নিরুপমা আজ বহুদিনের মধ্যেও এইঘরে আসে না।

মনোময় দেয়ালের দিকে তাকান।ছবিটার গায়ে ধুলো জমেছে।  মনোময় নিরুপমার বিয়ের ছবি।কুড়ি বছর আগে বিয়ের পরপর ছবিটা বাঁধিয়ে এনে দিয়েছিলেন নিরুপমার হাতে।

- বাঁদিকের দেয়ালটার মাঝ বরাবর টাঙানো যাক,ঘরে ঢুকলেই চোখে পড়বে।

নিরুপমা মাথা নাড়ে। মনময়ের মনে হয়েছিল তাঁর থেকে কুড়ি বছরের ছোটো বছর পঁচিশের নিরুপমা খুশি হয়েছে। নিরুপমা কি খুশি হয়েছিল! আসলে বিয়েটা কারুরই নিজের ইচ্ছায় হয়নি।

  কুড়ি বছর আগে অজ পারাগাঁয়ে বন্ধুর দূর সম্পর্কের আত্মীয় নিরুপমার বিয়েতে গেছিলেন। বর আসেনি, মেয়েটি লগ্ন ভ্রস্টা হবে ভেবে নিরুপমার বাড়ির সবাই বিপত্নীক মনোময় কে বিয়ে করতে অনুরোধ করেন।বাধ্য হয়ে বিয়েটা করে ফেলেন মনোময়। কুড়ি বছর আগে অজ পাড়াগাঁয়ে এই ধরনের  ব্যাপার তখনো ঘটতো। আজ মনে হয় ভুল করেছিলেন। নিরুপমা তাঁকে ভালোবাসতে পারেনি। তাঁর প্রথম স্ত্রী অনন্যার মতো হয়ে উঠতে পারেনি। মনোময় চাইলে এই সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন। তিনি নিরুপমাকে মুক্তি দিতে চাননি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কোথাও একটা প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে তীব্র হচ্ছিল। নিরুপমা এবং মনোময়ের দশ বছরের ছেলে সৌরাংশু দার্জিলিঙে বোর্ডিংয়ে থাকে।  

মনোময়ের ঘরে যেতেও ইচ্ছে করে না নিরুপমার। বিয়ের পর পর ভালোবাসার চেষ্টা করেছিল। নিরুপমার  বিয়েটা আর পাঁচজনের মতো হয়নি। সমস্ত স্বপ্ন ভেঙেচুরে যাওয়ার মুহূর্তে মনোময় তার জীবনে এসেছেন। মনোময় ওকে ভালবাসতে চেয়েছেন। তবুও দুজনের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে মনোময়ের মৃত স্ত্রী অনন্যা। বারবার দুজনের তুলনা উঠে এসেছে। মনোময় বোঝেননি নিরুপমা কখনোই অনন্যা হতে পারে না। একটা সময় অবসন্ন নিরুপমা নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল সমস্ত সাধ আহ্লাদ থেকে। সেই সময় হঠাৎই ওর জীবনে সপ্তক এল। ভালোবাসায়,আদরে নিরুপমা পরিপূর্ণ নারী হয়ে ওঠে। নিরুপমা এবং সপ্তকের সন্তান হল সৌরাংশু।মনোময় কি টের পেয়েছেন! হয়তো পেয়েছেন!

মনোময় নিরুপমা কেউই আইনি বিচ্ছেদ চায়নি।নিরুপমা কেনই বা চাইবে!সে টাকা সম্পত্তিকে সব সম্পর্কের উপরে স্থান দেয়। কেন দেবে না,ওই বয়স্ক লোকটার কাছ থেকে থেকে সম্পত্তি টাকার নিরাপত্তা ছাড়া আর পাওয়ার আছেটাই বা কী! মনোময় মৃত্যু শয্যায়।কটা দিনের অপেক্ষা।তারপর নিরুপমা সুখী।  ও হাসে। ক্রুর হাসির ভেতর থেকে আহ্লাদ ছড়িয়ে পড়ে।


দুই

 'এ' ব্লকের পাঁচ তলায়  নিজেদের  ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় হৈম। পশ্চিমমুখী ফ্ল্যাটে শেষ বেলার রোদ এসে পড়েছে। খুব শখ করে সাধ্যের বাইরে গিয়ে ফ্ল্যাটটা নিয়েছে ওরা। অভিরূপের স্যালারির বেশিরভাগটাই চলে যায় এই ফ্ল্যাটের ইএমআই দিতে।পনেরো বছরের ব্যাঙ্ক লোন নিয়েছে। হৈমর স্যালারি খুব একটা হাইফাই না।দুজনের ছোট্ট সংসার,চলে যায়। কিছুদিন ধরে হৈমর মন মেজাজ ভালো নেই।এখন যা অবস্থা আগামী পনেরো বছর বিদেশ ভ্রমণের স্বপ্নটাকে মুলতবি রাখতে হবে।অভিরূপ ওর কাঁধে এসে হাত রাখে।

- কী এত ভাবছ বলো তো?

- আমাদের সুইজারল্যান্ড যাওয়াটা পনেরো বছরের জন্যে পিছিয়ে গেল।বয়স বেড়ে যাবে।তখন আর কী মজা বলো।দেখো পাশের ফ্ল্যাটের রিমিরা গত মাসে ঘুরে এল।  তাছাড়া শুধু সুইজারল্যান্ড তো না, বিদেশের আরও অনেক জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে।

- আমিও সেটাই ভাবছি।এই মাত্র ফ্ল্যাট কিনলাম,এদিকে গাড়িটাও পুরোনো হয়ে গেছে।একটা বি এম ডাব্লিউ নেওয়ার ইচ্ছে। অসহ্য লাগছে। অন্য কোনো কাজ করা যায়।

- কী কাজের কথা ভাবছ? ব্যাবসা?

- সে চেষ্টা তো করছি।সময় লাগবে।ক্লাবের মৃন্ময়কে চেনো তো তুমি! প্রচুর জানাশোনা।

- তোমার বন্ধু মৃন্ময়, পর্ণ ভিডিও তৈরি করে না?

- হ্যাঁ, ও বলছিল আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিগত মুহূর্তকে ক্যামেরা বন্দী করি, এক একটা ভিডিও তে কয়েক লাখ টাকা পাওয়া যাবে। ভেবে দেখো,আমি তোমাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেব,তুমিও দেবে।এটা তো আমাদের দাম্পত্য জীবনে রোজকারই ব্যাপার।নতুন কিছু না।শুধু সেই মুহূর্তগুলো দেখবে বাইরের লোকেরা। পরিবর্তে টাকা।

হৈম এই প্রফেশনের কথা শুনে খুশি হয়। হবে নাই বা কেন! অন্য কোনো পুরুষ তো নয়, সে আর তার বর।

- কিন্ত অভিরূপ চেনা শোনা কেউ যদি এই ভিডিও দেখে, ছিঃ ছিককার পড়ে যাবে তো?

- ডার্লিং, যারা নীল ছবি দেখে তারা বলবে কী করে। এই সোসাইটিতে দেখাটাও তো লজ্জার।মনে মনে কে কী ভাবল, তাতে কী যায় আসে। মুখে তো কেউ কিছু বলতে পারবে না।

হৈম হেসে ফেলে। দু'তিন মাসের মধ্যে সুইজারল্যান্ড যেতে পারবে ভাবতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।ওইদিন রাতে অভিরূপকে নিজের ভেতর নিতে নিতে শ্রেষ্ঠ সুখী দম্পতির আবেশে বন্য হয়ে ওঠে।


তিন

গতকালই ওল্ড এজ হোম থেকে ফ্ল্যাটে ফিরেছেন শ্রীমতী।তিনতলার এই দক্ষিণমুখো ফ্ল্যাটটা বড়ো শখ করে কিনেছিলেন।দু বছর আগে অতনু মারা যান হার্ট অ্যাটাকে। তারপর থেকে একা একা এখানে থাকতে ভালো লাগে না। বছরের বেশিরভাগ সময়  ওল্ড এজ হোমে  থাকেন। মাঝে মাঝে এখানে আসেন। নিজের মতো করে থাকেন।ঘর গুছিয়ে রাখেন, হঠাৎই ছেলে বউ নাতনি যদি সুদূর বোস্টন থেকে চলে আসে।কতদিন ওদের দেখেননি। হোমে থাকার সময় প্রতিদিন মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখছেন। এনআরআই সন্তানরা বছরের পর বছর আসে না। পাশের রুমের অনিন্দিতা,আরেক রুমের নিবারণ বাবু, সুমিতা ছেলে মেয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে চলে গেলেন। শ্রীমতীর ভেতরে ভেতরে এই ভয়টাই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে অনেকদিন ধরে।দেখা হবে তো! আজ কতদিন পরে ব্যালকনিতে  দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্ত লাগছে।আগামীকাল ছেলে বউ নাতনি মিঠি  আসবে। অনেক রাতে ছেলে বুবুনের ফোন এল,

- মা জেগে আছো? জানোই তো এখানে এখন দিন । হাই টাফ কাজের মধ্যে এতক্ষণে টাইম পেলাম।

- হ্যাঁ বাবা জেগে আছি।তোরা আসবি। কতদিন পরে তোদের কাছে পাব।এখন কী আর ঘুম আসে।

- মা আই অ্যাম রিয়েলি সরি। এই ট্রিপে  যাওয়া হচ্ছে না। এন্ড অফ দি ইয়ার নিশ্চয়ই যাব। ডোন্ট মাইন্ড।

শ্রীমতীর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। বহুতল ফ্ল্যাটের ঝাঁ চকচকে ব্যালকনির ইজিচেয়ারে বসেও নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে। 


চার

‘এ’ ব্লকের চারপাশটা ভালো করে  দেখে নেয় সুভাষ।গতবছর লক ডাউনের সময় ফ্যাক্টরির চাকরিটা চলে যাওয়ার পরে এই ব্লকের দারোয়ানের চাকরিটা পেয়েছে  ও। না, সব ঠিক আছে।গ্যারেজের পাশে এক কামরার ঘরটায় ঢোকে। এখনো রাতের খাওয়া হয়নি। ও জানে সুতপাও না খেয়ে বসে আছে।

- এখন খাবে তো গো? সুতপা খাবার বাড়ে।

এক সঙ্গে খেতে বসে ওরা। 

- তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। সেলাইয়ের কাজ করে যে টাকাটা জমিয়েছি, তা দিয়ে হোম ডেলিভারির ব্যবসা করব?

- ব্যবসাটা ভালো সুতপা।কিন্ত আমি এখানে ব্যস্ত থাকি,বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছতে যাওয়া, এসব ঝামেলা সামলাবো কী করে।

- এই ব্লকের দোতলায় ওই শুভ্রাদিদি আছেন না,কলেজে পড়ান।উনি বলছিলেন এই আবাসনের সব ব্লকে অনেকেই খাবার নেবেন।

- এখানে তো হাই ফাই লোকেরা থাকেন ওঁরা কি এসব ভাত তরকারি খাবেন।

- হ্যাঁ গো। শুভ্রাদিদির কাছে শুনলাম, এখানের অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেন, মোচার ঘন্ট কতদিন খাননি, এঁচরের কালিয়া খাননি।

- সে তো ওরা রেস্টুরেন্টে খেতে পারেন।

-  দিদি বলছিলেন এখানের বেশিরভাগ ফ্যামিলিরিই  ছোটবেলা কেটেছে মধ্যবিত্ত বাড়িতে।বাঙালি খাবারের স্বাদ বাড়িতে বসে পেতে চান।কিন্ত বিজি লাইফ স্টাইলে সম্ভব না। একবার চেষ্টা করে দেখি না।

- আচ্ছা সুতপা চেষ্টা করে দেখা যাক।তুমি যখন বলছো।তাছাড়া তোমার হাতের রান্নার স্বাদ যে একবার খাবে ভুলতে পারবে না।আমি অন্য কথা ভাবছি। তোমার শরীরটা ভালো নেই।এই সময় এত চাপ নিতে পারবে!

- এই সময়ই তো চাপ নিতে হবে গো।যে আসছে তাকে ভালোভাবে মানুষ করব আমরা। তোমার একার উপর সব চাপটা দি কী করে বলো।

সুভাষ সুতপাকে কাছে টেনে নেয়। নটা ব্লক নিয়ে বিরাট জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বহুতল আবাসনের ফাঁক গলে একফালি চাঁদ এসে পড়েছে ওদের ঘরে। 


গল্পকার : অর্থিতা মণ্ডল 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Monday, 21 October 2024

হারিয়ে যাওয়া দিন - দুঃখানন্দ মণ্ডল // ই-কোরাস ১৯৯




আমার ছেলেবেলা; আমার হারিয়ে যাওয়া দিন

দুঃখানন্দ মণ্ডল  

স্মৃতিরা বারবার মনে করিয়ে দেয় মাটির সোঁদা গন্ধের কথা। আমি এখন একজন যুবক। এক নবজাতকের পিতা। পেরিয়ে এসেছি দিনকাল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তোমার প্রাঙ্গণ ভরে উঠছে নতুন ফুলের গন্ধে। যে প্রাঙ্গণ সর্বদা আহ্বান করে নতুনকে। এ যেন প্রকৃতির সাথে ভালোবাসার খেলা। এক অকৃত্রিম মেলবন্ধন। হাজার স্মৃতি, হাজার চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ হওয়ার হাতছানি। রয়ে যায় ছেলেবেলার দিনগুলির কথা, রয়ে যায় এক গভীর টান। যা দেখা যায় না, শুধু অনুভবে ছুঁয়ে থাকে মনপ্রাণ। 

"ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে,  

    ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।"

 ঠিক এমনিভাবেই শুরু হয় একটি শিশুর বড় হয়ে ওঠা। আমি কেন, আমার বন্ধুরা কেন, এমনকি আপনিও এমনিভাবেই বড় হয়েছেন বা পেরিয়ে এসেছেন শৈশব, কৈশোর, যৌবন। সবকিছুর ভিড়ে রয়ে গেছে হাজারও স্মৃতি, হাজারও ফেলে আসা দিনকাল। যে কথা লেখা হয়ে আছে মনে গহ্বরে। স্মৃতি উস্কে দিলেই ঠিক তখনি চোখের সামনে সেই ফেলে আসা দিনগুলি দৃশ্যমান হয়। হারিয়ে যায় মন। হারিয়ে এই বড়বেলা।    

      "ফেলে আসা কিছু স্মৃতি, কিছু প্রিয় মুখ

ভালোবাসার আবেশ জড়ানো কিছু চেনা সুখ।

       কিছু কিছু সম্ভাবনা, আর কিছু কল্পনা

বিস্মৃতির অতলে হারানো কিছু প্রিয় ঠিকানা।"

আমরা হারিয়ে ফেলি না। হারিয়ে যায় আমাদের মন থেকে। দিনের আলোর গভীরে রাতের তারাদের লুকিয়ে থাকার মতোই আমাদের নিত্য দিনের কাজের মাঝে স্মৃতি কথা চাপ পড়ে থাকে মাত্র, মুছে যায়না, হারিয়েও যায় না কখনও। তাই হঠাৎ পুরানো বন্ধুর সাথে দেখা হওয়া.... উস্কে দেয় আমাদের স্মৃতি কে। চোখের সামনে এক লহমায় ভীড় করে ফেলে আসা দিনের কথা। কোথা থেকে এক গভীর আন্তরিকতার জন্ম নেয়, জন্ম নেয় এক গভীর ভালোবাসা। আর তখনই শুরু হয় হাজার ব্যস্ততার মাঝে স্মৃতি থেকে উঠে আসা আলাপচারিতা। হারিয়ে যায় সে মন, ফেলে আসা দিনগুলির ভিড়ে!              

    "ওগো প্রবীণ, চলো এবার সকল কাজের শেষে

      নবীন হাসি মুখে নিয়ে চরম খেলার বেশে।"


এখন আর সেই তালগাছটা নেই! নেই বাবুইপাখির ঝুলন্ত বাসাটি! নেই মাটির স্কুল বাড়িটি! এমনকি খেলার মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে আসার পথটিও! নেই তালগাছটির পাশে চাপা জলের কলটি! নেই সারিবদ্ধ ভাবে লাগানো বিলাতিসাক। নেই মাটির স্কুল দালানটি! নেই টিফিনে রোদ পোহানোর উঁচু ঢিবিটি! জেঠুর মুখে শুনতাম স্কুলবাড়ির চারপাশে নীল চাষ হতো আর আমরা যে উঁচু ঢিবিতে রোদ পোহাতাম সেইগুলি নাকি নীল কুঠী ছিল। তবে এতসব জেনে আমাদের কাজ ছিল না। আমরা আমাদের মতোই থাকতাম। তখন আমাদের নিদিষ্ট পোশাক ছিল না। তাই বেশ সুন্দর লাগত বাগানে হরেকরকম ফুলের মতো। অন্যদিকে সিং পাড়া থেকে কোদাল নিয়ে এসে তৈরী করা হতো ক্রিকেট খেলার পিচ। উফফ কি ব্যস্ততা! কেউ আবার মাঠের শেষ প্রান্তে হাডুডু খেলার ঘর কাটতে ব্যস্ত, কেউ আবার হাই জ্যাম্প দেওয়ার জন্য বালির খোঁজ চালাতো। সময়টা ছিল এক ঘন্টার। তারই মাঝে হাট বারে আনা কাঠিভাজার চিকচিকিতে মুড়ি খাওয়া শেষ করা আর সেই চিকচিকিতে কল থেকে জল ভরে জল খাওয়া। কী এক ভালোবাসার টান। আসলে এ আমার সোনার গ্রাম, এ আমার ভালোবাসার ছেলেবেলা। ও হো সব কাজ শেষ করতে হবে সময় মতো "চল কোদাল চালাই"। কিংবা বর্ষাকাল পা ছিপছিপানি জল রাস্তাময়। দু-একটি ছাতা ছাড়া তারপর সবার মাথায় পরশ সারের বস্তার প্যেখা। খুব সাবধানে স্কুলে আসা, খুব সাবধানে বই খাতা নিয়ে যাওয়া। কী আশ্চর্য ভাবে তাকিয়ে থেকেছি বল গ্রাউন্ডের দিকে। ঘাসের ডোগার উপর দিয়ে বৃষ্টির জল বয়ে চলেছে। ঠাঁয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে নবজাত বাছুর ছানাটি তার মায়ের সাথে, উদাসী চোখে তাকিয়ে আছে বৃষ্টির দিকে। বুঝতে পারিনি ফুটো চাল দিয়ে সম্মুখে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে ক্লাস রুমে। জল পড়তে পড়তে মাটির মেঝে ভিজে যাচ্ছে। কবিতার লাইনের মতো এই বাস্তব এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠে-

      "এমন ঘরে জন্ম দিলি, কেন আমার মা! 

       সারাটা রাত জল পড়ছে; পাতা নড়ছে না।

অনেক শ্রাবণ পেরিয়ে গেল, উথালপাথাল ঝড়

গুড়িয়ে দিল বাঁশের বেড়া, উড়িয়ে নিল খড়।" 

কী এক গভীর মায়া জড়িয়ে আছে। যেন মায়ের কোলে শিশু সন্তান। কতবার এমন হয়েছে বইয়ের পাতা ভিজেছে বৃষ্টির জলে, কতবার হয়েছে বইখাতা সমেত পা পিছলে জলে পড়েছি, কতবার হয়েছে সারা রাস্তা ভিজতে ভিজতে ঘরে ফিরেছি। আর ভিজে যাওয়া বইখাতা মজে যাওয়া উনুনের পাশে শুকনো করতে দিয়েছে মা। বইয়ের ভাঁজে রয়ে যাওয়া পেনসিলের টুকরো জলের স্পর্শ পেয়ে চুনো হয়েছে। কষ্ট হয়েছে নিজেদের জন্য নয় বইখাতার জন্য। আসলে এই স্কুল আমার, এই স্কুল আমাদের, এই স্কুল আমার আর এক জননী। কোকিল বাবু পড়িয়ে চলেছেন উত্তরমেরু কথা। পাশের রুম থেকে কানে ভেসে আসছে প্রহ্লাদ বাবুর বীজগনিতের সূত্র। তখন বৃষ্টি অবিরাম ঝরে চলেছে। কে বা কারা নবজাত বাছুর আর তার মাকে নিয়ে গেছে গোয়াল ঘরে। আমাদের কৈশোর মনে ছুঁয়ে থাকত পাত্র স্যারের(নন্দ বাবু) ইংরেজি শেখানোর কৌশল। ছুঁয়ে থাকতো ইংরেজি গল্পের প্রতিটি লাইনের বাংলা মানে কালিবাবুর মুখ থেকে। কখনো শীত, কখনো গ্রীষ্ম, কখনো বা গরমকালে এই মানুষগুলির ভালোবাসাতে আমার মতো কত শত অবোধ ছাত্রছাত্রী বোধের মানদণ্ডকে স্পর্শ করেছে। 

স্কুলের একটি নিয়ম ছিল। সেই নিয়মের সাথে প্রতিটি ক্লাস যুক্ত ছিল। আমিও বাদ ছিলাম না। মাটির দালান পেরিয়ে সরু ছোট উঠোন। না আমার বাড়ির নয়! আমাদের স্কুল বাড়ির উঠোনের কথা বলছি। যেমন মনে হতো কোনো একটি গ্রাম্য পরিবারের উঠোন। যা জুড়ে আছে বাড়ির সদস্যদের কিচিরমিচির শব্দ দিয়ে। তেমনি ছিল গভীর টান আঁকড়ে রাখার। প্রার্থনার লাইনে সারিবদ্ধ ভাবে আমরা। সামনের নারিকেল গাছের ডালে বসে ডেকে চলেছে একটি কোকিল কুহু কুহু ডাক। স্কুল বাড়ির শেষপ্রান্তের তালগাছ আর মাঝ বরাবর থাকা তালগাছের ছায়া পড়েছে আমাদের প্রার্থনার লাইনের উপর। তারাও আমাদের ছায়া দেয়। পূব আকাশে সূর্য ধীরগতিতে মধ্য আকাশের দিকে এগিয়ে আসছে। দুর থেকে মনে হয় এই ছায়াপথ যেন সীমান্তরেখায় দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিক দল। সবার বিষ্টু দা ঢঙ ঢঙ করে সকাল ১০.৪৫ মিনিটের ঘন্টা বাজিয়ে দিতেন। শুরু হতো। সমবেত প্রার্থনার সুর মুখরিত করতো কালিতলার বাতাস। কতবার ছাত্রদল পেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছে দ্রুত গতিতে আসা পাত্র বাবুকে। দেখেছে সুর মেলাতে-

"জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে।।"

এরপর লাইন ভেঙে সবাই খেলার মাঠে। না খেলতে নয়। পাত্র বাবুর শেখানো আদর্শকে পালন করার তাগিদে। সবাই মিলে শুরু করতো খেলার মাঠ পরিষ্কারের কাজ। মনে পড়ে যায় সহজপাঠের কথা;

"আজ মঙ্গলবার। পাড়ার জঙ্গল সাফ করবার দিন। সব ছেলেরা দঙ্গল বেঁধে যাবে। রঙ্গলাল-বাবুও এখনি আসবেন। আর আসবেন তাঁর দাদা বঙ্গ-বাবু। সিঙ্গি, তুমি দৌড়ে যাও তো। অঙ্গনদাদাকে ধরো, মোটর-গাড়িতে তাঁদের আনবেন। সঙ্গে নিতে হবে কুড়ুল, কোদাল, ঝাঁটা, ঝুড়ি।" হয়তো বা সেই আদর্শে উনি আমাদেরকে আদর্শিক করে তুলতে চেয়েছিলেন। 

গতদিনের পড়ে থাকা টুকরো কাগজ থেকে শুরু করে যাবতীয় সমস্ত কিছু। একসময় সবাই হাতমুখ ধুয়ে ক্লাস রুমে। ক্লাস রুম  থেকে দেখা যেত মাঠের সবুজ ঘাসের হাসি। আর কানে ভেসে আসতো প্রতিটি শ্রেণীকক্ষ থেকে উপস্থিত, প্রেজেন্ট স্যার, ইয়েস স্যার।         

কথায় আছে; সময় সব থেকে বড় বন্ধু। তাই সময়ের হাতেই সব টা সঁপে দিতে হয়। সময়ই কথা বলবে; কে কার সাথে কতটা পথ চলবে। ক্লাস রুমের পাশে আলোচনা হচ্ছে বিদ্যালয়ের অফিস ঘরটি পাকার হবে। পাকা শুনে বেশ আনন্দ হচ্ছিল। আবার মনে মনে কষ্ট হচ্ছিল এই যে; মাটির বাড়িটি তাহলে কি ভেঙে দেওয়া হবে! মাটির সোঁদা গন্ধ আর কি পাবো না। টপটপ করে বৃষ্টি কি আর ক্লাস রুমে পড়বে না! ছেলেবেলার মন কেমন যেন উত্তাল হয়ে উঠছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই ডি সি এম গাড়িতে এল ইট। সারিবদ্ধভাবে সাজানো হলো পোড়া মাটির ইট। কিন্তু মাটির গন্ধ নেই! নিয়ে আসা হলো সিমেন্ট আর বালি। 

   "আমি যে রোজ সকাল হ’লে

                     যাই শহরের দিকে চ’লে

             তমিজ মিঞার গোরুর গাড়ি চ’ড়ে;

সকাল থেকে সারা দুপুর

ইঁট সাজিয়ে ইঁটের উপর

        খেয়াল মত দেয়াল তুলে গড়ে।"

যেন মনে হতো মাটির সাথে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ মাটির বুক চিরে গাঁথা হতে লাগল পাকা বাড়ি। আমাদের স্কুলের অফিস ঘর। সেই প্রথম বেঞ্চের মধ্যে ধুলোর সাথে সিমেন্টের মিশ্রণ দেখলাম। অনুভব করলাম আর এক নতুন গন্ধ। যে গন্ধের মধ্যে প্রকৃতির কোনো টান নেই! আমার স্কুল বাড়ির ক্রমবিবর্তন শুরু হয়েছিল সেই দিন থেকে। সেই প্রথমবার শিক্ষক মহাশয়ের কাছ থেকে শিখেছিলাম কেমন করে Wastege জিনিস দিয়ে সুন্দর কিছু তৈরী করা যায়। আসলে মানুষের ইচ্ছে শক্তি মানুষকে প্রেরণা দেয়। আমরা সরস্বতী পূজার আগের রাত্রিতে পুরাতন অফিস ঘরের সিলিং এ লাগানো ছেঁড়া সাদা কাপড়কে খুলে তাতে নিজেদের মতো করে পাহাড় তৈরী করেছিলাম। হয়তো বা সেটিই ছিল আমাদের শেষ প্যান্ডেল তৈরী সরস্বতী পূজোতে-

      "তোমার হল শুরু আমার হল সারা, 

               তোমায় আমায় মিলে

                   এমনি বহে ধারা।"

 তবে একথা অকপটে বলতে পারি এখনো পূজার দিন নিয়ম করে বিদ্যালয়ে যাই। আর স্মৃতি উস্কে দেয় সেই ছাত্রবেলার কথা; ভোরে উঠে বাসী রুটির সাথে খেজুর গুড় আর ঠাণ্ডা দুধ এবং সব শেষে এক মুঠো মু্ড়ি। খাওয়ার পর কত গল্পগুজব ঠাকুরমার সাথে। আসলে সেই সময় প্রতিটি পরিবার ছিল একান্নবর্তী। সব বাচ্চারা এক সাথে। এখন আর একান্নবর্তী পরিবার নেই। নেই ভোরে উঠে পেট ভর্তি করার তাড়া। এখন আর নেই ফুল তুলে নিয়ে যাওয়ার পালা। গ্রামের মধ্যেও প্রবেশ করে গেছে শহরের কৃত্রিম ছায়া।                                               

              "দিন আসে দিন যায়,

  সময় চলে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

               মন পাখি ছুটে যায়,

               স্মৃতি পটে বারবার দূরে বহু দূরে।

               ঝরে পড়া মুহূর্তরা উদ্বেল হয়,

               একি পিছুটান নাকি বেঁচে থাকা!

               মুঠোয় বাঁধা হয় মায়ার প্রশ্রয়, 

  মুহূর্তের কাছে মুহূর্তের ঋণী থাকা!"

শিক্ষার্থীদের কাছে তার শিক্ষক বা শিক্ষিকা পিতামাতার সমান আবার বন্ধুর মতোও। মনের কথা যেমন বলা যায় তেমন জ্ঞান অর্জনের কথাও গল্পের ছলে বুঝিয়ে দেন। সেদিন গল্পের ছলে, সদ্য স্কুলে আসা মল্লিকা ম্যাডাম প্রশ্ন করেছিলেন; তোমরা কতক্ষণ ঘুমাও? বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে উত্তর দিয়েছিল। কেউ বলেছিল খাওয়ার পর, কেউ বলছিল বাবা ফেরার পর, কেউ বলেছিল লম্ফের তেল শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত, কেউ বলেছিল চোখে ঘুম আসার আগে পর্যন্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা আমাদের মতো করে বলছিলাম। কিন্তু সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অঙ্কটা। উনি শুরু করেছিলেন আমাদের বেঁচে থাকার সময়সীমা দিয়ে। যদি ষাট বছর আমরা বাঁচি আর প্রতিদিন আট নয় ঘন্টা ঘুমোই তাহলে একসপ্তাহে কত সময় ঘুমালাম, একমাসে কত সময় ঘুমালাম, এক বছরে কত সময় এবং ষাট বছরে কত সময়। সেদিন বুঝিনি অঙ্কের সূত্র। এখন বুঝি কেন একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা এতো আপন হয়ে থাকেন শিক্ষার্থীদের কাছে! এখন অনুভব করতে পারি কেন উচ্চ কণ্ঠে প্রতিটি লাইন পড়তে বলতেন নগেন বাবু। কখন যে আমাদেরকে খুব কাছে করে নিয়েছিলেন ভূপাল বাবু তার টের পাইনি। আসলে আমরা উষ্ণতা খুঁজতাম। যে উষ্ণতায় আগামী দিনের স্বপ্ন পূরণ করার অঙ্গীকার থাকত। এখন বুঝি জীবনের স্বর্ণালী দিন মানেই ছাত্রজীবন। 

"আমরা রচি ভালোবাসার

   আশার ভবিষ্যৎ

মোদের স্বর্গ-পথের আভাস দেখায়

   আকাশ-ছায়াপথ!

  মোদের চোখে বিশ্ববাসীর

   স্বপ্ন দেখা হোক সফল।

   আমরা ছাত্রদল।।"

আজ সেই মাটির স্কুল বাড়ি নেই! নেই তালগাছ! নেই নারিকেল গাছ! নেই স্কুল বাড়ির পিছনের বড় আম গাছটি! শোনা যায় না কোকিলের ডাক সারা দুপুর ধরে! নেই রং-বেরঙের জামা ছাত্রছাত্রীদের পোশাক হিসেবে! কিন্তু সবকিছুর ভিড়েই লুকিয়ে আছে সবকিছু। সুসজ্জিত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে পাকার স্কুল বাড়ি। ছায়া দিয়েছে ছাত্রছাত্রীদের তুলতুলে হাতে লাগানো গাছের পাতারা। প্রার্থনার লাইনে নীল সাদা পোশাক চিনিয়ে দিচ্ছে আমরা ছাত্রদল-

"ঊষার দুয়ারে হানি' আঘাত

আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,

আমরা টুটাব তিমির রাত,

বাধার বিন্ধ্যাচল।"

এমনিভাবেই প্রাক্তন-প্রাক্তনীদের স্মৃতি রয়ে যাবে মনের গহ্বরে। আর এই স্মৃতি তখনই উস্কে দেয়; যখন কাটিয়ে আসা নিজের ছাত্রবেলার সময়টি বর্তমান ছাত্রদল তাদের মতো করে তৈরী করছে। কি আশ্চর্য ভাবেই স্মৃতি আর বর্তমান এক হয়ে যায়। সেই ক্লাস রুম। সেই ছাত্র-ছাত্রী, সেই শিক্ষক-শিক্ষিকা। 

        "পথে চলা এই দেখাশোনা

              ছিল যাহা ক্ষণচর

         চেতনার প্রত্যন্ত প্রদেশে

      চিত্তে আজ তাই জেগে ওঠে।"

চোখের সামনে ভেসে উঠছে; পড়া বলা, ব্ল্যাকবোর্ডে চক ভেঙে ফেলা, হাতের লেখা সই করানো, দশে দশ পাওয়ার ওয়াল দেওয়া কিংবা অঙ্কের সূত্র শিখতে শিখতে চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়া। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়েছে দিনকাল। তবে পরিবর্তন হয়নি এসব। পরিবর্তন হয়নি তোর জন্য গোপনে খাতার পাতায় চিঠি লেখাতে…  

           " রঙিন ছবির দৃশ্যরেখা

            ঝাপসা চোখে যায় না দেখা, 

        আলোর চেয়ে ধোঁয়া উঠছে জমে।" 

               …………………….. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

                    


                         




      

Sunday, 13 October 2024

আপনাকেই বলছি - মিঠু চন্দ্র // ই-কোরাস ১৯৮ঘ

 



আপনাকেই বলছি

মিঠু চন্দ্র 


হ্যাঁ আপনাকেই বলছি,

আপনাকে, আপনি শিল্পী, হতে পারেন লেখক/লেখিকা কিংবা বাচিক শিল্পী কিংবা নৃত্যশিল্পী কিংবা অভিনেতা/অভিনেত্রী.....আপনাদের কাছে একটা প্রশ্ন করি, ধরুন এই পুজো উপলক্ষ্যে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এ সঞ্চালনা করছেন, কিংবা নৃত্য পরিবেশন করছেন, অথবা গান গাইছেন আবার হয়তো নাটকে অভিনয় করছেন স্টেজে দাঁড়িয়ে, আপনার সঞ্চালনার মাঝে, নৃত্যের মাঝে, গানের মাঝে, নাটকের টানটান সংলাপ বলতে যাচ্ছেন ঠিক সেই সময় একদল লোক হুড়মুড় করে হাতে প্ল্যাকার্ড ইত্যাদি নিয়ে "জাস্টিস ফর আরজিকর", "উই ওয়ান্ট জাস্টিস".....ব্যাস মনোগ্রাহী দর্শক তখন উসখুস করতে লাগলো, বিরক্ত হয়ে আসন ছেড়ে উঠে পড়লো, আপনারও কাজ‌ পন্ড হল, সবমিলিয়ে এক চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হল, ঐ সময়ে দাঁড়িয়ে আপনার, আপনাদের কীরকম অনুভূতি হবে? খুব জানতে ইচ্ছে করে। 

বিগত দুই মাস ধরে আপনি ক্ষোভে ফুঁসছেন, আপনার মনের মধ্যে হাজার ব্যস্ততার ভিড়েও একটা অশান্তি কাজ করছে, আপনি প্রতি মুহূর্তে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে চলেছেন একটা মেয়ের জন্য, "তিলোত্তমা" যাকে খুব নিষ্ঠুরতার সঙ্গে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরেও এরকম আরও কয়েকটি ব-র্ব-র ঘটনা। আপনিও সুবিচার দাবী করেন কিন্তু ঐ বিশৃঙ্খলার সময় আপনি ভাববেন সবকিছুর জন্য নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম থাকা দরকার, তাই না? 

পুজো প্যান্ডেল ধর্মীয় পরিবেশ, আনন্দের পরিবেশ, বিনোদনের পরিবেশ ঠিক যেমন আপনার ঐ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আনন্দের ও বিনোদনের পরিবেশ, সেখানে একগাদা লোক জড়ো করে "জাস্টিস ফর আরজিকর", "উই ওয়ান্ট জাস্টিস" স্লোগান তোলা "অপকর্ম" ছাড়া আর কিছুই নয়। 

প্রতিবাদ করাটা যেমন সাংবিধানিক অধিকার তেমনি পুজো প্যান্ডেলে দর্শনার্থীদের ভিড় করা, ঠাকুর দেখা, ব্লগ করা, রিলস বানানো, ছবি তোলা এগুলো তাদের সাংবিধানিক অধিকার। হঠাৎ করে সেখানে প্রতিবাদের নামে কিছু লোকজন নিয়ে ঢুকে পড়লে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তার দায় কে নেবে? তাছাড়া ধর্মীয় ভাবাবেগ এ আঘাত হয়েছে এরকম ধরে নিয়ে ধর্মান্ধ লোকজনের সাথে যদি প্রতিবাদীদের সংঘর্ষ বাঁধে তার দায় কে নেবে? তাই সবদিক বিচার বিবেচনা করেই কোর্টের সিদ্ধান্ত পুজো প্যান্ডেল এর ২০০ মিটারের মধ্যে প্রতিবাদ মিছিল, স্লোগান চলবে না।  

পুজো প্যান্ডেল আর দর্শনার্থীদের ভিড় লাইন বাদ দিয়ে বাকি পৃথিবী তো রইলোই প্রতিবাদের জন্য। আমি কোর্টের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছি। আপনি/আপনারা?


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Saturday, 12 October 2024

প্রতিবাদী উৎসব - মহাশ্বেতা দাস // ই-কোরাস ১৯৮গ

 



অরন্ধন দিবস

মহাশ্বেতা দাস


   আজ অনেক দিন পর আবার ইচ্ছে করলো কিছু লিখতে। মানে না লিখে আর উপায় রইলো না যে!! আজ বার বার যে কথা গুলো মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে….. 

    আমরা মানে আমাদের প্রজন্মের সবাই জন্মগ্রহণ করেছি স্বাধীন ভারতবর্ষে। তাই পরাধীনতার গ্লানি পরাধীন ভারতের কষ্ট আমরা ভোগ করিনি। ইতিহাসে পড়েছি সেসব দিনের কথা। কত রক্ত কত ঘাম কত চোখের জলের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল সেদিনের স্বাধীনতা। পড়েছি আমাদেরই দেশের কিছু সুবিধাবাদী, ভোগবিলাসি বিশ্বাসঘাতকের কথা… পড়েছি বঙ্গভঙ্গের সেই কালোদিন আর তা প্রতিরোধের, প্রতিবাদের কারণে সারা দেশে *অরন্ধন দিবস* পালনের কথা। সেদিনের দেশবাসী আন্দোলনে পথে নেমেছিল প্রাণের টানে সমস্ত রাজনৈতিক দলাদলির, সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে। 

    তারপর একটু একটু করে সেসব দিনের কথা ভুলে গেলাম আমরা। পাপ জমতে জমতে, ভোগবিলাস আর সুবিধাবাদে গা ভাসাতে ভাসাতে আমাদের নৌকো আজ যে চড়ায় এসে আটকে গেছে….. সেখানে শুধুই বালি!!! অল্প উত্তপ্ত হতে হতে ফিরে আসার পথ তৈরি করতে না পারলে শুকিয়ে মরতে হবে। সেকথা প্রাণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল রক্ত দিয়ে লিখে গেছে আমাদের মেয়ে অভয়া। আর তার সেই দেখানো পথে প্রাণপণ লড়াই করে আমাদের রাজ্যকে কলুষ মুক্ত দুর্নীতি মুক্ত করতে চাইছে আমাদেরই ছেলেমেয়ের দল যারা নিজেদের প্রাণ বাজি রেখে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে অনশন মঞ্চে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, ওদের জন্যে মঙ্গল কামনা করা ছাড়া আমাদের আর কী বা ক্ষমতা আছে!!! 

    তবে একটা কথা আজ মানতেই হচ্ছে…. কিছুদিন আগে স্বপ্ননীলের মৃত্যুর পর দুদিনের মোমবাতি মিছিল করে যেভাবে সবকিছু ধামাচাপা পড়ে গেছিল এবারে আর তেমনটি সম্ভব নয়। শাসকের দমনপীড়ননীতি যত বাড়ছে তার থেকেও বহুগুণ চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়েচলেছে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আজ রাজনৈতিক দলাদলির ঊর্ধ্বে উঠে পাশে দাঁড়িয়েছে ওদের। দ্রোহের আগুনে ঝলসে যাচ্ছে পুঞ্জীভূত পাপের কালো হাত। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে হয় রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্র ভাবনা । রবীন্দ্রনাথ যদিও  ছিলেন ঋষি কবি । ঋষি রা তো রাষ্ট্র , রাজনীতি নিয়ে খুব বেশী ভাবনা চিন্তা করেন না ! তবু  তাঁর গান ও কবিতায় রাষ্ট্রদর্শন অপ্রকাশিত থাকেনি । তিনি জানিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রের শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত । কেমন হাওয়া দরকার নাগরিকের কার্যবিধি ও প্রশাসকের ক্ষমতার প্রকৃত স্বরূপ । খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থে শিশু উপযোগী ছড়া 'রাজব্যবস্থা ' কবিতায় লিখেছেন - 

    মহারাজা ভয়ে থাকে    

    পুলিসের থানাতে , 

 আইন বানায় যত পারে না তা মানাতে । 

  চর ফিরে তাকে তাকে, 

 সাধু যদি ছাড়া থাকে, 

খোঁজ পেলে নৃপতি রে 

   হয় তাহা জানাতে - 

  রক্ষা করিতে তারে 

  রাখে জেলখানা তে ॥ 

        রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্যাণ রাষ্ট্র সম্পকির্ত ধারণা আমরা পেয়ে যাই এই গান টি তে - 

    আমরা  সবাই রাজা।  আমাদের এই রাজার রাজত্বে, 

 নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে? 

    ১৯০৫সালের ১৬ই অক্টোবর। লর্ড কার্জনের "বঙ্গভঙ্গ" প্রস্তাব অনুসারে "Divide and Rule" নীতির কার্যকরি অভিযানের শুরু। ধর্মপ্রাণ ভারতবাসীর ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে জাতীয়তাবোধকে বিচ্ছিন্ন করার ধারালো অস্ত্র হিসেবে ঔপনিবশিক ব্রিটিশ সরকার ব্যবহার করছেন ভারতবাসীর  ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসকে! তৎকালীন ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহকে লর্ডকার্জন এজন্য প্রচুর উৎকোচও প্রদান করলেন। যার প্রায়শ্চিত্ত করতে হল আমাদের পরবর্তী কয়েক দশক ধরে।

        ঔপনিবেশিক কূটনীতির এই বিয়োগান্তক পরিণতি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম কিংবা পৌত্তলিকতাকে কোনদিন নিজের জীবনে স্থান দেননি তিনি। যদিও তিনটি ধারায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল (স্বদেশী আন্দোলন, চরমপন্থী বৈপ্লবিক আন্দোলন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্ব ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্যে সংস্কৃতিক আন্দোলন) । তবু অন্যান্য গুলিকে তিনি "রাজশক্তির কাছে ভিক্ষাবৃত্তি" বলে মনে করেছিলেন….. 

    "আমাদের নিজের দিকে যদি সম্পূর্ন ফিরিয়া দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশ মাত্র কারণ দেখি না।" 

    হিন্দু-মুসলমান মিলনের সৌরভেই সুরভিত হোক বাংলার মানুষের বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের জীবন ঐতিহ্য… এই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনা। তাই সেদিন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সম্প্রীতির রাখিকেই হাতিয়ার করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্যে সংস্কৃতিক ঐক্যবন্ধনের ডাক দিয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

         অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর "রবিকা'র" সেই লড়াই কে "ঘরোয়া" তে ব্যক্ত করেছেন। সেদিন সকাল বেলা পায়ে হেঁটে গঙ্গার জগন্নাথ ঘাটে পৌঁছে গেলেন সবাই। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ছাদ থেকে রাস্তার দু-পাশে লোকে লোকারণ্য। মেয়েরা শাঁখ বাজাচ্ছে, ফুল ছড়াচ্ছে... মনিব চাকর সবাই একসাথে স্নান করে একে অপরের হাতে রাখি বাঁধলেন। *সারা বাংলা সেদিন পালন করল  অরন্ধন দিবস।* হাঁটতে হাঁটতে পাথুরে ঘাটার বীরুমল্লিকের আস্তাবলে সহিসদের হাতে রাখি বাঁধলেন তাঁরা, সহিসরা তো অবাক!! তারপর চিৎপুরের মসজিদে গিয়ে মৌলবীদের হাতে ও রাখি বাঁধা হল। এভাবে সেদিন রাস্তায় যাদেরই দেখা পাওয়া গেছে.... ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কে পরানো হল রাখি আর গাওয়া হয়েছিল সেই গান - 

  "বাংলার মাটি বাংলার জল 

    বাংলার বায়ু বাংলার ফল 

     পূণ্য হউক পূণ্য হউক 

    পূণ্য হউক হে ভগবান।" 

   সেদিনগুলি তো আমাদের চোখে দেখা নয়! বইয়ে পড়া। তাই আজ যেন এই ছেলেমেয়েগুলোর শিরদাঁড়ার জোর দেখে সেসব দিনের স্বাদ পাচ্ছি। সমস্ত মানুষ আজ এদের সাথে আছে। আগামীকাল সেজন্যেই পালিত হবে দেশ জুড়ে *অরন্ধন দিবস।* 

       আমি সপরিবারে পালন করবো। এভাবেই থাকবো অনিকেত, কিঞ্জল, স্নিগ্ধা, দেবাশীষ…. দের পাশে। আপনারাও থাকছেন নিশ্চয়।  


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Thursday, 10 October 2024

শ্রীচরণেষু মা // তৃষ্ণা বসাক // ই-কোরাস ১৯৮ খ

 



অনশনরত জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে খোলা চিঠি

তৃষ্ণা বসাক


“শ্রীচরণেষু মা,

মাগো আমার, তুমি কাঁদবে না। আমি কষ্ট পাবো তাহলে।…আমার মা-কে যদি কেউ আমার চোখের সামনে অত্যাচার করে, কেটে টুকরো টুকরো করতে চায় এবং আমি যদি পাগলের মতো না লাফিয়ে, বিচার করতে বসি, যে এতে আদৌ সুরাহা হবে কি না, আইন এর মান্যতা দেয় কিনা, এ নিয়ে খবরের কাগজে তীব্র প্রবন্ধ লেখা যায় কি না – তবে আমি হয়তো অনেকের কাছে ধীর মস্তিষ্ক ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেবো ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে তোমার মাতৃহৃদয়টা কি ছিঃ ছিঃ করে জ্বলে উঠবে না মা? তোমার অন্তরাত্মা কি বলবে না মা – যে ছোটোবেলায় বুকের দুধের সাথে বিষ মিশিয়ে কেনো এই ক্লেদের পিন্ডটাকে মেরে ফেলিনি?…

…তোমার কোলের ছেলে কচি কিন্তু চিরকাল তোমারই থাকবে।…আজ একটা আদর্শের জন্য প্রাণ বিসর্জন করছি। তাতে আনন্দ আমার মনের কানায় কানায় ভরে উঠেছে। ফাঁসির কাঠটা আমার কাছে ইংরেজদের রসিকতা বলে মনে হচ্ছে।

আমার এই অন্তরের কথা তোমারই অন্তরের প্রতিধ্বনি।

আমি চিরদিনই জানি যে, আমি বাঙালী তথা ভারতবাসী, আর তুমি আমার বাংলা তথা ভারতবর্ষ – একই পদার্থ। একথা আমাকে শিখিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল। যুগ যুগ ধরে তুমি যে অপমান, লাঞ্ছনা ও নির্যাতন সহ্য করে এসেছো, মাটিতে মুখ থুবড়ে বোবা গরুর মতো মার খেয়েছো, তারই বিরুদ্ধে তোমার মনে যে বিদ্রোহ অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বয়ে যাচ্ছিল, সেই পুঞ্জীভূত বিদ্রোহ–ই আমি। বিপ্লব জিনিসটা শুধু আমাদের নয়, মানবজাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যুগে যুগে এটার প্রয়োজন হয়েছে। যাদের প্রতিটি রক্তবিন্দু দাসত্বের কলঙ্কে কলঙ্কিত হয়ে গেছে, তাদের কথা ভাবি না।…কিন্তু যারা মধ্যপন্থী, আপস মীমাংসায় এখনো বিশ্বাসবান, তাদের জন্য দুঃখ হয়…।”

1933 সালের 12  জানুয়ারি মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসির কদিন আগে মাকে লুকিয়ে লেখা শহিদ প্রদ্যোত ভট্টাচার্যর চিঠি।

একজন লেখক নয়, একজন মা হিসেবে অনশনরত জুনিয়র ডাক্তারদের  বলছি - তোমরা অনশন প্রত্যাহার করো। লড়াইয়ের অন্য পন্থা আছে। 

বেঁচে থাকো, বেঁচে থেকে লড়াই করো। মনে রেখো, সুজাতার পায়েস খাবার পরেই বুদ্ধদেব নিজের অভীষ্ঠ লাভ করেছিলেন।

এই বাংলার সব মায়েদের ভীষণ ভয় করছে।  আর একটিও প্রাণ যেন অসংবেদনার বলি না হয়।

সুস্থ থাকো, লড়াইয়ে থাকো।


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪



Wednesday, 9 October 2024

পুজো আসছে - সুকান্ত সিংহ // ই-কোরাস ১৯৮ ক


পুজো আসছে

সুকান্ত সিংহ 


যেদিন স্কুলে পুজোর ছুটি পড়বে, কোনো স্যার কুড়ি পাতা হাতের লেখা, কেউ চারটা অনুশীলনীর অঙ্ক করতে দিচ্ছেন ছুটিতে, আর আমাদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা। নতুন জামাকাপড়ের থেকেও পুজোর ছুটি যেন আরো বেশি আনন্দের ছিল। গতকাল যার সাথে ঝগড়া হয়েছে গুলি খেলা নিয়ে, ছুটির দিনে সে ঝগড়ার সমাধান না করেই তার সাথে ভাব হয়ে গেল। পরশু যে কলমের নিব ঘষে দিয়েছিল, পেয়ারার ভাগ দেয়নি, আমাকে ফেলে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়েছিল, আজ সে বা তারা পাশে বসতেই রাগ ভেসে গেল। এমনকী রাশভারী বড় মাস্টার পর্যন্ত টিফিনে ছুটি মঞ্জুর করে দিলেন!

দুর্গাপুজোর সাথে একটা শব্দ সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে থাকে, সেটা হল 'আসছে'। পুজো আসছে। মহালয়ার ভোরের রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আগে থেকেই গাঁঘরের মাটিতে, বাতাসে, মেঘে, ভোরের শিশিরে, নদীর পাড়ে টের পাওয়া যেত পুজো আসছে। সে টের পাওয়া এত স্বাভাবিক ছিল যে, চোখের থেকে  তাকে এড়িয়ে গেলেও মনের থেকে এড়িয়ে যাওয়া যেত না। মাঠেঘাটে সবখানেই যেন ফুটে থাকত এই কথাটি, পুজো আসছে। অনেক পরে, সম্ভবত বিজ্ঞাপনের ভাষায় পুজো আসছে হল মা আসছেন। তারপর সেটাই একধরনের জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল। কিন্ত পুজো আসছে কথাটির মধ্যে যে অনাবিল আনন্দের স্রোত বয়ে যায়, সেটির কাছে অন্য কোনো কথাই ঠিকঠাক মানানসই হত না।

পুজো কি শুধু প্রকৃতিতেই আসত? তা নয়। পুজো আসত জামাকাপড়ের দোকানে, জুতোর দোকানে, দর্জির দোকানে, খবরের কাগজ দিতে আসা মানুষটির ব্যাগের পুজোবার্ষিকীতে। ঘরদোর পরিস্কার শুরু হত ঠিক এই সময়েই। বিশেষ করে রান্নাঘরের সমস্ত পুরাতন ডিবে কৌটো, চ্যাঙারি, কুলো, ধামা, নারকেল কুরুনি, এসব সাবানজল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকোতে দিলেই মন বলল পুজো আসছে। বিছানা বালিশের ওয়াড় সব একসাথে খারকাচা হলেই মনে হত পুজো আসছে। খাটের তলায় রাখা নারকেল নাড়িয়ে দেখার ভেতরে ছিল পুজো আসছে। খইয়ের জন্য ভালো ধান, তিল আর গুড় খোঁজ করার মধ্যে ছিল -- পুজো আসছে।

পুজো আসার সাথে চিঠি আসত। যারা দূরের তাদের যেমন মনে করিয়ে দেওয়া হত পুজোর দিনক্ষণ, তারাও চিঠি লিখে পাঠাত কে কবে নাগাদ আসতে পারবে, কে এবার খোকার সামনে বড় পরিক্ষা বলে আসতে পারছে না, এইসব। সেসব চিঠি এ-হাত ও-হাত ঘুরে বেড়াত। তারপর কর্তার টিনের তোরঙে ঠাঁই পেত। তখনকার দিনে  চিঠি পড়েই ফেলে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না। বেশ কিছুদিন পরে কোনো কারণে নজরে পড়লে পুরাতন চিঠি আবার একবার পড়ে গুরুত্ব বুঝে তবেই ফেলে দেওয়া হত। সেসব যেন চিঠিমাত্র নয়, যেন চিঠি লেখার মানুষটি স্বয়ং চিঠি হয়েই আছে! তবে সেকালে এই ফেলে দেওয়ার রেওয়াজ কম ছিল বলেই তো কত জনের কত চিঠি আজো পড়তে পাই, সে রবীন্দ্রনাথ হোন বিবেকানন্দ। কারো রেখে দেওয়ার অভ্যাসেই তো রয়ে গেছে সেসব অমূল্য জিনিস। কারো কারো ঘরে পুজোর খরচ বাবদ মানিঅর্ডার আসত। নীচে এক দু লাইন হয়তো লেখা, ছুটি নাই বলিয়া যাইতে পারিব না। ছেলে হয়তো কাজ করে  কলিয়ারিতে, বা দূরের কোনো সেরেস্তায়। না আসার সংবাদে মন খারাপ হলেও মানিঅর্ডার যেদিন আসত, সেদিন পিয়নকে নাড়ু জল খাওনোর রেওয়াজ ছিল। কখনো কখনো বকশিস বাবদ কিছু দেওয়া হত। 

আনাগোনা বাড়ত আলতা- সিঁদুর- আলতাপাটি- ঘষা পাথর নিয়ে নাপিত বৌয়ের। সেযুগে তারাই চলমান বিউটি পার্লার। মহিলামহলে তাঁদের অনায়াস যাতায়াত। আসত কাঠের বাক্সে ছোট ছোট সেন্টের শিশি নিয়ে একজন। কাপড়ের গাঁটরি কাঁধে ফেলে আসত ফেরিওয়ালা। ঝাঁকায় করে এলুমিনিয়মের নতুন বাসন, কুমোর পাড়ার থেকে খোলাখাবরি আসত ফেরি করতে। পাড়ার কোনো একটা জায়গায় তারা নামাত ঝাঁকা। সেখানেই গোল করে ঘিরে দেখত সবাই। 

কার ঘরে কতটা খইচূড়, তিলের নাড়ু পাঠাতে হবে, এসব কথা যেদিন থেকে গৃহস্থঘরে শুরু হত, সেদিন থেকেই বোঝা যেত, হ্যাঁ পুজো আসছে। সত্যি বলতে এর পরে পুজোরও আর না এসে উপায় ছিল না যে!


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...