অরন্ধন দিবস
মহাশ্বেতা দাস
আজ অনেক দিন পর আবার ইচ্ছে করলো কিছু লিখতে। মানে না লিখে আর উপায় রইলো না যে!! আজ বার বার যে কথা গুলো মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে…..
আমরা মানে আমাদের প্রজন্মের সবাই জন্মগ্রহণ করেছি স্বাধীন ভারতবর্ষে। তাই পরাধীনতার গ্লানি পরাধীন ভারতের কষ্ট আমরা ভোগ করিনি। ইতিহাসে পড়েছি সেসব দিনের কথা। কত রক্ত কত ঘাম কত চোখের জলের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল সেদিনের স্বাধীনতা। পড়েছি আমাদেরই দেশের কিছু সুবিধাবাদী, ভোগবিলাসি বিশ্বাসঘাতকের কথা… পড়েছি বঙ্গভঙ্গের সেই কালোদিন আর তা প্রতিরোধের, প্রতিবাদের কারণে সারা দেশে *অরন্ধন দিবস* পালনের কথা। সেদিনের দেশবাসী আন্দোলনে পথে নেমেছিল প্রাণের টানে সমস্ত রাজনৈতিক দলাদলির, সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে।
তারপর একটু একটু করে সেসব দিনের কথা ভুলে গেলাম আমরা। পাপ জমতে জমতে, ভোগবিলাস আর সুবিধাবাদে গা ভাসাতে ভাসাতে আমাদের নৌকো আজ যে চড়ায় এসে আটকে গেছে….. সেখানে শুধুই বালি!!! অল্প উত্তপ্ত হতে হতে ফিরে আসার পথ তৈরি করতে না পারলে শুকিয়ে মরতে হবে। সেকথা প্রাণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল রক্ত দিয়ে লিখে গেছে আমাদের মেয়ে অভয়া। আর তার সেই দেখানো পথে প্রাণপণ লড়াই করে আমাদের রাজ্যকে কলুষ মুক্ত দুর্নীতি মুক্ত করতে চাইছে আমাদেরই ছেলেমেয়ের দল যারা নিজেদের প্রাণ বাজি রেখে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে অনশন মঞ্চে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, ওদের জন্যে মঙ্গল কামনা করা ছাড়া আমাদের আর কী বা ক্ষমতা আছে!!!
তবে একটা কথা আজ মানতেই হচ্ছে…. কিছুদিন আগে স্বপ্ননীলের মৃত্যুর পর দুদিনের মোমবাতি মিছিল করে যেভাবে সবকিছু ধামাচাপা পড়ে গেছিল এবারে আর তেমনটি সম্ভব নয়। শাসকের দমনপীড়ননীতি যত বাড়ছে তার থেকেও বহুগুণ চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়েচলেছে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আজ রাজনৈতিক দলাদলির ঊর্ধ্বে উঠে পাশে দাঁড়িয়েছে ওদের। দ্রোহের আগুনে ঝলসে যাচ্ছে পুঞ্জীভূত পাপের কালো হাত। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে হয় রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্র ভাবনা । রবীন্দ্রনাথ যদিও ছিলেন ঋষি কবি । ঋষি রা তো রাষ্ট্র , রাজনীতি নিয়ে খুব বেশী ভাবনা চিন্তা করেন না ! তবু তাঁর গান ও কবিতায় রাষ্ট্রদর্শন অপ্রকাশিত থাকেনি । তিনি জানিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রের শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত । কেমন হাওয়া দরকার নাগরিকের কার্যবিধি ও প্রশাসকের ক্ষমতার প্রকৃত স্বরূপ । খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থে শিশু উপযোগী ছড়া 'রাজব্যবস্থা ' কবিতায় লিখেছেন -
মহারাজা ভয়ে থাকে
পুলিসের থানাতে ,
আইন বানায় যত পারে না তা মানাতে ।
চর ফিরে তাকে তাকে,
সাধু যদি ছাড়া থাকে,
খোঁজ পেলে নৃপতি রে
হয় তাহা জানাতে -
রক্ষা করিতে তারে
রাখে জেলখানা তে ॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্যাণ রাষ্ট্র সম্পকির্ত ধারণা আমরা পেয়ে যাই এই গান টি তে -
আমরা সবাই রাজা। আমাদের এই রাজার রাজত্বে,
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?
১৯০৫সালের ১৬ই অক্টোবর। লর্ড কার্জনের "বঙ্গভঙ্গ" প্রস্তাব অনুসারে "Divide and Rule" নীতির কার্যকরি অভিযানের শুরু। ধর্মপ্রাণ ভারতবাসীর ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে জাতীয়তাবোধকে বিচ্ছিন্ন করার ধারালো অস্ত্র হিসেবে ঔপনিবশিক ব্রিটিশ সরকার ব্যবহার করছেন ভারতবাসীর ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসকে! তৎকালীন ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহকে লর্ডকার্জন এজন্য প্রচুর উৎকোচও প্রদান করলেন। যার প্রায়শ্চিত্ত করতে হল আমাদের পরবর্তী কয়েক দশক ধরে।
ঔপনিবেশিক কূটনীতির এই বিয়োগান্তক পরিণতি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম কিংবা পৌত্তলিকতাকে কোনদিন নিজের জীবনে স্থান দেননি তিনি। যদিও তিনটি ধারায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল (স্বদেশী আন্দোলন, চরমপন্থী বৈপ্লবিক আন্দোলন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্ব ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্যে সংস্কৃতিক আন্দোলন) । তবু অন্যান্য গুলিকে তিনি "রাজশক্তির কাছে ভিক্ষাবৃত্তি" বলে মনে করেছিলেন…..
"আমাদের নিজের দিকে যদি সম্পূর্ন ফিরিয়া দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশ মাত্র কারণ দেখি না।"
হিন্দু-মুসলমান মিলনের সৌরভেই সুরভিত হোক বাংলার মানুষের বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের জীবন ঐতিহ্য… এই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনা। তাই সেদিন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সম্প্রীতির রাখিকেই হাতিয়ার করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্যে সংস্কৃতিক ঐক্যবন্ধনের ডাক দিয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর "রবিকা'র" সেই লড়াই কে "ঘরোয়া" তে ব্যক্ত করেছেন। সেদিন সকাল বেলা পায়ে হেঁটে গঙ্গার জগন্নাথ ঘাটে পৌঁছে গেলেন সবাই। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ছাদ থেকে রাস্তার দু-পাশে লোকে লোকারণ্য। মেয়েরা শাঁখ বাজাচ্ছে, ফুল ছড়াচ্ছে... মনিব চাকর সবাই একসাথে স্নান করে একে অপরের হাতে রাখি বাঁধলেন। *সারা বাংলা সেদিন পালন করল অরন্ধন দিবস।* হাঁটতে হাঁটতে পাথুরে ঘাটার বীরুমল্লিকের আস্তাবলে সহিসদের হাতে রাখি বাঁধলেন তাঁরা, সহিসরা তো অবাক!! তারপর চিৎপুরের মসজিদে গিয়ে মৌলবীদের হাতে ও রাখি বাঁধা হল। এভাবে সেদিন রাস্তায় যাদেরই দেখা পাওয়া গেছে.... ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কে পরানো হল রাখি আর গাওয়া হয়েছিল সেই গান -
"বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার বায়ু বাংলার ফল
পূণ্য হউক পূণ্য হউক
পূণ্য হউক হে ভগবান।"
সেদিনগুলি তো আমাদের চোখে দেখা নয়! বইয়ে পড়া। তাই আজ যেন এই ছেলেমেয়েগুলোর শিরদাঁড়ার জোর দেখে সেসব দিনের স্বাদ পাচ্ছি। সমস্ত মানুষ আজ এদের সাথে আছে। আগামীকাল সেজন্যেই পালিত হবে দেশ জুড়ে *অরন্ধন দিবস।*
আমি সপরিবারে পালন করবো। এভাবেই থাকবো অনিকেত, কিঞ্জল, স্নিগ্ধা, দেবাশীষ…. দের পাশে। আপনারাও থাকছেন নিশ্চয়।
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment