পুজো আসছে
সুকান্ত সিংহ
যেদিন স্কুলে পুজোর ছুটি পড়বে, কোনো স্যার কুড়ি পাতা হাতের লেখা, কেউ চারটা অনুশীলনীর অঙ্ক করতে দিচ্ছেন ছুটিতে, আর আমাদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা। নতুন জামাকাপড়ের থেকেও পুজোর ছুটি যেন আরো বেশি আনন্দের ছিল। গতকাল যার সাথে ঝগড়া হয়েছে গুলি খেলা নিয়ে, ছুটির দিনে সে ঝগড়ার সমাধান না করেই তার সাথে ভাব হয়ে গেল। পরশু যে কলমের নিব ঘষে দিয়েছিল, পেয়ারার ভাগ দেয়নি, আমাকে ফেলে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়েছিল, আজ সে বা তারা পাশে বসতেই রাগ ভেসে গেল। এমনকী রাশভারী বড় মাস্টার পর্যন্ত টিফিনে ছুটি মঞ্জুর করে দিলেন!
দুর্গাপুজোর সাথে একটা শব্দ সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে থাকে, সেটা হল 'আসছে'। পুজো আসছে। মহালয়ার ভোরের রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আগে থেকেই গাঁঘরের মাটিতে, বাতাসে, মেঘে, ভোরের শিশিরে, নদীর পাড়ে টের পাওয়া যেত পুজো আসছে। সে টের পাওয়া এত স্বাভাবিক ছিল যে, চোখের থেকে তাকে এড়িয়ে গেলেও মনের থেকে এড়িয়ে যাওয়া যেত না। মাঠেঘাটে সবখানেই যেন ফুটে থাকত এই কথাটি, পুজো আসছে। অনেক পরে, সম্ভবত বিজ্ঞাপনের ভাষায় পুজো আসছে হল মা আসছেন। তারপর সেটাই একধরনের জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল। কিন্ত পুজো আসছে কথাটির মধ্যে যে অনাবিল আনন্দের স্রোত বয়ে যায়, সেটির কাছে অন্য কোনো কথাই ঠিকঠাক মানানসই হত না।
পুজো কি শুধু প্রকৃতিতেই আসত? তা নয়। পুজো আসত জামাকাপড়ের দোকানে, জুতোর দোকানে, দর্জির দোকানে, খবরের কাগজ দিতে আসা মানুষটির ব্যাগের পুজোবার্ষিকীতে। ঘরদোর পরিস্কার শুরু হত ঠিক এই সময়েই। বিশেষ করে রান্নাঘরের সমস্ত পুরাতন ডিবে কৌটো, চ্যাঙারি, কুলো, ধামা, নারকেল কুরুনি, এসব সাবানজল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকোতে দিলেই মন বলল পুজো আসছে। বিছানা বালিশের ওয়াড় সব একসাথে খারকাচা হলেই মনে হত পুজো আসছে। খাটের তলায় রাখা নারকেল নাড়িয়ে দেখার ভেতরে ছিল পুজো আসছে। খইয়ের জন্য ভালো ধান, তিল আর গুড় খোঁজ করার মধ্যে ছিল -- পুজো আসছে।
পুজো আসার সাথে চিঠি আসত। যারা দূরের তাদের যেমন মনে করিয়ে দেওয়া হত পুজোর দিনক্ষণ, তারাও চিঠি লিখে পাঠাত কে কবে নাগাদ আসতে পারবে, কে এবার খোকার সামনে বড় পরিক্ষা বলে আসতে পারছে না, এইসব। সেসব চিঠি এ-হাত ও-হাত ঘুরে বেড়াত। তারপর কর্তার টিনের তোরঙে ঠাঁই পেত। তখনকার দিনে চিঠি পড়েই ফেলে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না। বেশ কিছুদিন পরে কোনো কারণে নজরে পড়লে পুরাতন চিঠি আবার একবার পড়ে গুরুত্ব বুঝে তবেই ফেলে দেওয়া হত। সেসব যেন চিঠিমাত্র নয়, যেন চিঠি লেখার মানুষটি স্বয়ং চিঠি হয়েই আছে! তবে সেকালে এই ফেলে দেওয়ার রেওয়াজ কম ছিল বলেই তো কত জনের কত চিঠি আজো পড়তে পাই, সে রবীন্দ্রনাথ হোন বিবেকানন্দ। কারো রেখে দেওয়ার অভ্যাসেই তো রয়ে গেছে সেসব অমূল্য জিনিস। কারো কারো ঘরে পুজোর খরচ বাবদ মানিঅর্ডার আসত। নীচে এক দু লাইন হয়তো লেখা, ছুটি নাই বলিয়া যাইতে পারিব না। ছেলে হয়তো কাজ করে কলিয়ারিতে, বা দূরের কোনো সেরেস্তায়। না আসার সংবাদে মন খারাপ হলেও মানিঅর্ডার যেদিন আসত, সেদিন পিয়নকে নাড়ু জল খাওনোর রেওয়াজ ছিল। কখনো কখনো বকশিস বাবদ কিছু দেওয়া হত।
আনাগোনা বাড়ত আলতা- সিঁদুর- আলতাপাটি- ঘষা পাথর নিয়ে নাপিত বৌয়ের। সেযুগে তারাই চলমান বিউটি পার্লার। মহিলামহলে তাঁদের অনায়াস যাতায়াত। আসত কাঠের বাক্সে ছোট ছোট সেন্টের শিশি নিয়ে একজন। কাপড়ের গাঁটরি কাঁধে ফেলে আসত ফেরিওয়ালা। ঝাঁকায় করে এলুমিনিয়মের নতুন বাসন, কুমোর পাড়ার থেকে খোলাখাবরি আসত ফেরি করতে। পাড়ার কোনো একটা জায়গায় তারা নামাত ঝাঁকা। সেখানেই গোল করে ঘিরে দেখত সবাই।
কার ঘরে কতটা খইচূড়, তিলের নাড়ু পাঠাতে হবে, এসব কথা যেদিন থেকে গৃহস্থঘরে শুরু হত, সেদিন থেকেই বোঝা যেত, হ্যাঁ পুজো আসছে। সত্যি বলতে এর পরে পুজোরও আর না এসে উপায় ছিল না যে!
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
পুজো আসছে, অবশ্যই কয়েক দশক আগে, যে ছন্দ ও আবেগ ছিল, যা প্রকাশিত হতো ছোট ছোট প্রস্তুতিতে, মুন্সিয়ানা নিয়ে প্রকাশ করেছেন কবি, প্রাবন্ধিক সুকান্ত।
ReplyDeleteভালো লেখা পাঠের সময় যে প্রীতিবোধ
সঞ্চারিত হয় পাঠকের অন্তরে, একটুও
তাল কাটেনি সেই তরঙ্গের। অনুভবে উঠে
এলো নির্বাক সেই সব স্মৃতি যা এই সময়ে
রূপকথা হয়ে গেছে।
সুকান্ত সেই কাজটি করলেন ওর অনবদ্য
অধিকারে। (পড়ুন ভাষার অধিকার)।
শুধু ধন্যবাদ ও প্রীতি নয়, প্রত্যাশা থাকলো
এমন ঋজু গদ্যের স্বাদ পাওয়ার।
দুঃখানন্দ ও সৃজিত কে সেই ভালোবাসা ও
সম্মান যা ওরা নিজেদের অধিকার
অর্জন করেছে।
এক কথায় , ইচ্ছে করে ডুবে থাকি এম্নি লেখায়
ReplyDeleteলেখার স্পর্শে
. . . . . . . . আজীবন 👌