Sunday, 27 October 2024

বহুতল - অর্থিতা মণ্ডল // ই-কোরাস ২০০



বহুতল

অর্থিতা মণ্ডল

নতুন কমপ্লেক্সে সাত তলা বিল্ডিংগুলোর মধ্যে পূবেরটা একটু বেশিই বড়ো,খোলামেলা।এটাই 'এ' ব্লক।একেবারে টপ ফ্লোরে মনোময়ের ফ্ল্যাট। ব্যালকনিতে বসলে পূবের শহরের  অনেকটা দেখা যায়। সাজানো গোছানো অভিজাত ফ্ল্যাটের বিছানায় শুয়ে মনোময়ের মনে হচ্ছে এত বিলাস বৈভব কদিনই বা ভোগ করতে পারল! দুটো কিডনিই নষ্ট। শরীরের বেশিরভাগ অর্গ্যান কাজ করছে না। আয়ু মেরেকেটে একমাস।শেষ কটা দিন বাড়িতেই থাকবেন । আয়া, নার্স , ওষুধের গন্ধে ঘরটা হাসপাতাল মনে হচ্ছে।  স্ত্রী নিরুপমা আজ বহুদিনের মধ্যেও এইঘরে আসে না।

মনোময় দেয়ালের দিকে তাকান।ছবিটার গায়ে ধুলো জমেছে।  মনোময় নিরুপমার বিয়ের ছবি।কুড়ি বছর আগে বিয়ের পরপর ছবিটা বাঁধিয়ে এনে দিয়েছিলেন নিরুপমার হাতে।

- বাঁদিকের দেয়ালটার মাঝ বরাবর টাঙানো যাক,ঘরে ঢুকলেই চোখে পড়বে।

নিরুপমা মাথা নাড়ে। মনময়ের মনে হয়েছিল তাঁর থেকে কুড়ি বছরের ছোটো বছর পঁচিশের নিরুপমা খুশি হয়েছে। নিরুপমা কি খুশি হয়েছিল! আসলে বিয়েটা কারুরই নিজের ইচ্ছায় হয়নি।

  কুড়ি বছর আগে অজ পারাগাঁয়ে বন্ধুর দূর সম্পর্কের আত্মীয় নিরুপমার বিয়েতে গেছিলেন। বর আসেনি, মেয়েটি লগ্ন ভ্রস্টা হবে ভেবে নিরুপমার বাড়ির সবাই বিপত্নীক মনোময় কে বিয়ে করতে অনুরোধ করেন।বাধ্য হয়ে বিয়েটা করে ফেলেন মনোময়। কুড়ি বছর আগে অজ পাড়াগাঁয়ে এই ধরনের  ব্যাপার তখনো ঘটতো। আজ মনে হয় ভুল করেছিলেন। নিরুপমা তাঁকে ভালোবাসতে পারেনি। তাঁর প্রথম স্ত্রী অনন্যার মতো হয়ে উঠতে পারেনি। মনোময় চাইলে এই সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন। তিনি নিরুপমাকে মুক্তি দিতে চাননি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কোথাও একটা প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে তীব্র হচ্ছিল। নিরুপমা এবং মনোময়ের দশ বছরের ছেলে সৌরাংশু দার্জিলিঙে বোর্ডিংয়ে থাকে।  

মনোময়ের ঘরে যেতেও ইচ্ছে করে না নিরুপমার। বিয়ের পর পর ভালোবাসার চেষ্টা করেছিল। নিরুপমার  বিয়েটা আর পাঁচজনের মতো হয়নি। সমস্ত স্বপ্ন ভেঙেচুরে যাওয়ার মুহূর্তে মনোময় তার জীবনে এসেছেন। মনোময় ওকে ভালবাসতে চেয়েছেন। তবুও দুজনের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে মনোময়ের মৃত স্ত্রী অনন্যা। বারবার দুজনের তুলনা উঠে এসেছে। মনোময় বোঝেননি নিরুপমা কখনোই অনন্যা হতে পারে না। একটা সময় অবসন্ন নিরুপমা নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল সমস্ত সাধ আহ্লাদ থেকে। সেই সময় হঠাৎই ওর জীবনে সপ্তক এল। ভালোবাসায়,আদরে নিরুপমা পরিপূর্ণ নারী হয়ে ওঠে। নিরুপমা এবং সপ্তকের সন্তান হল সৌরাংশু।মনোময় কি টের পেয়েছেন! হয়তো পেয়েছেন!

মনোময় নিরুপমা কেউই আইনি বিচ্ছেদ চায়নি।নিরুপমা কেনই বা চাইবে!সে টাকা সম্পত্তিকে সব সম্পর্কের উপরে স্থান দেয়। কেন দেবে না,ওই বয়স্ক লোকটার কাছ থেকে থেকে সম্পত্তি টাকার নিরাপত্তা ছাড়া আর পাওয়ার আছেটাই বা কী! মনোময় মৃত্যু শয্যায়।কটা দিনের অপেক্ষা।তারপর নিরুপমা সুখী।  ও হাসে। ক্রুর হাসির ভেতর থেকে আহ্লাদ ছড়িয়ে পড়ে।


দুই

 'এ' ব্লকের পাঁচ তলায়  নিজেদের  ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় হৈম। পশ্চিমমুখী ফ্ল্যাটে শেষ বেলার রোদ এসে পড়েছে। খুব শখ করে সাধ্যের বাইরে গিয়ে ফ্ল্যাটটা নিয়েছে ওরা। অভিরূপের স্যালারির বেশিরভাগটাই চলে যায় এই ফ্ল্যাটের ইএমআই দিতে।পনেরো বছরের ব্যাঙ্ক লোন নিয়েছে। হৈমর স্যালারি খুব একটা হাইফাই না।দুজনের ছোট্ট সংসার,চলে যায়। কিছুদিন ধরে হৈমর মন মেজাজ ভালো নেই।এখন যা অবস্থা আগামী পনেরো বছর বিদেশ ভ্রমণের স্বপ্নটাকে মুলতবি রাখতে হবে।অভিরূপ ওর কাঁধে এসে হাত রাখে।

- কী এত ভাবছ বলো তো?

- আমাদের সুইজারল্যান্ড যাওয়াটা পনেরো বছরের জন্যে পিছিয়ে গেল।বয়স বেড়ে যাবে।তখন আর কী মজা বলো।দেখো পাশের ফ্ল্যাটের রিমিরা গত মাসে ঘুরে এল।  তাছাড়া শুধু সুইজারল্যান্ড তো না, বিদেশের আরও অনেক জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে।

- আমিও সেটাই ভাবছি।এই মাত্র ফ্ল্যাট কিনলাম,এদিকে গাড়িটাও পুরোনো হয়ে গেছে।একটা বি এম ডাব্লিউ নেওয়ার ইচ্ছে। অসহ্য লাগছে। অন্য কোনো কাজ করা যায়।

- কী কাজের কথা ভাবছ? ব্যাবসা?

- সে চেষ্টা তো করছি।সময় লাগবে।ক্লাবের মৃন্ময়কে চেনো তো তুমি! প্রচুর জানাশোনা।

- তোমার বন্ধু মৃন্ময়, পর্ণ ভিডিও তৈরি করে না?

- হ্যাঁ, ও বলছিল আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিগত মুহূর্তকে ক্যামেরা বন্দী করি, এক একটা ভিডিও তে কয়েক লাখ টাকা পাওয়া যাবে। ভেবে দেখো,আমি তোমাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেব,তুমিও দেবে।এটা তো আমাদের দাম্পত্য জীবনে রোজকারই ব্যাপার।নতুন কিছু না।শুধু সেই মুহূর্তগুলো দেখবে বাইরের লোকেরা। পরিবর্তে টাকা।

হৈম এই প্রফেশনের কথা শুনে খুশি হয়। হবে নাই বা কেন! অন্য কোনো পুরুষ তো নয়, সে আর তার বর।

- কিন্ত অভিরূপ চেনা শোনা কেউ যদি এই ভিডিও দেখে, ছিঃ ছিককার পড়ে যাবে তো?

- ডার্লিং, যারা নীল ছবি দেখে তারা বলবে কী করে। এই সোসাইটিতে দেখাটাও তো লজ্জার।মনে মনে কে কী ভাবল, তাতে কী যায় আসে। মুখে তো কেউ কিছু বলতে পারবে না।

হৈম হেসে ফেলে। দু'তিন মাসের মধ্যে সুইজারল্যান্ড যেতে পারবে ভাবতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।ওইদিন রাতে অভিরূপকে নিজের ভেতর নিতে নিতে শ্রেষ্ঠ সুখী দম্পতির আবেশে বন্য হয়ে ওঠে।


তিন

গতকালই ওল্ড এজ হোম থেকে ফ্ল্যাটে ফিরেছেন শ্রীমতী।তিনতলার এই দক্ষিণমুখো ফ্ল্যাটটা বড়ো শখ করে কিনেছিলেন।দু বছর আগে অতনু মারা যান হার্ট অ্যাটাকে। তারপর থেকে একা একা এখানে থাকতে ভালো লাগে না। বছরের বেশিরভাগ সময়  ওল্ড এজ হোমে  থাকেন। মাঝে মাঝে এখানে আসেন। নিজের মতো করে থাকেন।ঘর গুছিয়ে রাখেন, হঠাৎই ছেলে বউ নাতনি যদি সুদূর বোস্টন থেকে চলে আসে।কতদিন ওদের দেখেননি। হোমে থাকার সময় প্রতিদিন মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখছেন। এনআরআই সন্তানরা বছরের পর বছর আসে না। পাশের রুমের অনিন্দিতা,আরেক রুমের নিবারণ বাবু, সুমিতা ছেলে মেয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে চলে গেলেন। শ্রীমতীর ভেতরে ভেতরে এই ভয়টাই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে অনেকদিন ধরে।দেখা হবে তো! আজ কতদিন পরে ব্যালকনিতে  দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্ত লাগছে।আগামীকাল ছেলে বউ নাতনি মিঠি  আসবে। অনেক রাতে ছেলে বুবুনের ফোন এল,

- মা জেগে আছো? জানোই তো এখানে এখন দিন । হাই টাফ কাজের মধ্যে এতক্ষণে টাইম পেলাম।

- হ্যাঁ বাবা জেগে আছি।তোরা আসবি। কতদিন পরে তোদের কাছে পাব।এখন কী আর ঘুম আসে।

- মা আই অ্যাম রিয়েলি সরি। এই ট্রিপে  যাওয়া হচ্ছে না। এন্ড অফ দি ইয়ার নিশ্চয়ই যাব। ডোন্ট মাইন্ড।

শ্রীমতীর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। বহুতল ফ্ল্যাটের ঝাঁ চকচকে ব্যালকনির ইজিচেয়ারে বসেও নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে। 


চার

‘এ’ ব্লকের চারপাশটা ভালো করে  দেখে নেয় সুভাষ।গতবছর লক ডাউনের সময় ফ্যাক্টরির চাকরিটা চলে যাওয়ার পরে এই ব্লকের দারোয়ানের চাকরিটা পেয়েছে  ও। না, সব ঠিক আছে।গ্যারেজের পাশে এক কামরার ঘরটায় ঢোকে। এখনো রাতের খাওয়া হয়নি। ও জানে সুতপাও না খেয়ে বসে আছে।

- এখন খাবে তো গো? সুতপা খাবার বাড়ে।

এক সঙ্গে খেতে বসে ওরা। 

- তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। সেলাইয়ের কাজ করে যে টাকাটা জমিয়েছি, তা দিয়ে হোম ডেলিভারির ব্যবসা করব?

- ব্যবসাটা ভালো সুতপা।কিন্ত আমি এখানে ব্যস্ত থাকি,বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছতে যাওয়া, এসব ঝামেলা সামলাবো কী করে।

- এই ব্লকের দোতলায় ওই শুভ্রাদিদি আছেন না,কলেজে পড়ান।উনি বলছিলেন এই আবাসনের সব ব্লকে অনেকেই খাবার নেবেন।

- এখানে তো হাই ফাই লোকেরা থাকেন ওঁরা কি এসব ভাত তরকারি খাবেন।

- হ্যাঁ গো। শুভ্রাদিদির কাছে শুনলাম, এখানের অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেন, মোচার ঘন্ট কতদিন খাননি, এঁচরের কালিয়া খাননি।

- সে তো ওরা রেস্টুরেন্টে খেতে পারেন।

-  দিদি বলছিলেন এখানের বেশিরভাগ ফ্যামিলিরিই  ছোটবেলা কেটেছে মধ্যবিত্ত বাড়িতে।বাঙালি খাবারের স্বাদ বাড়িতে বসে পেতে চান।কিন্ত বিজি লাইফ স্টাইলে সম্ভব না। একবার চেষ্টা করে দেখি না।

- আচ্ছা সুতপা চেষ্টা করে দেখা যাক।তুমি যখন বলছো।তাছাড়া তোমার হাতের রান্নার স্বাদ যে একবার খাবে ভুলতে পারবে না।আমি অন্য কথা ভাবছি। তোমার শরীরটা ভালো নেই।এই সময় এত চাপ নিতে পারবে!

- এই সময়ই তো চাপ নিতে হবে গো।যে আসছে তাকে ভালোভাবে মানুষ করব আমরা। তোমার একার উপর সব চাপটা দি কী করে বলো।

সুভাষ সুতপাকে কাছে টেনে নেয়। নটা ব্লক নিয়ে বিরাট জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বহুতল আবাসনের ফাঁক গলে একফালি চাঁদ এসে পড়েছে ওদের ঘরে। 


গল্পকার : অর্থিতা মণ্ডল 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...