Sunday, 28 July 2024

প্রফেসর মাল্যবান দাশগুপ্ত : দ্য ম্যাজিশিয়ান : ই-কোরাস ১৮৮

 



প্রফেসর মাল্যবান দাশগুপ্ত : দ্য ম্যাজিশিয়ান

সোনালী গোস্বামী 

আমি অত্যন্ত দুর্বল পাঠক, ততোধিক দুর্বল আলোচক। আমি এমন একজন মানুষ যে ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছবি তুলতে ভুলে যায় এই ভেবে যে অনুভূতির সুতো যেন ছিন্ন না হয়। নিজের অন্তরে, অনুভবে ধারণ করতে চাই দৃশ্য,শব্দ,গন্ধ। তেমনি কোনো ভালো লেখা পড়তে গিয়ে পড়ার পর তার যতটুকু ধারণ করি, আপন মনে জারণ করি, তার খুব নূন্যতম অংশই প্রকাশ করতে পারি। এ আমার যথার্থ অর্থেই অক্ষমতা স্বীকার করি। কিন্তু কিছু লেখা পড়ার পর নিজের জন্যই তার অনুভূতি লিখে রাখতে ইচ্ছে করে।

 উপন্যাসটি পড়েছি আর ভেবেছি যাঁরা ভুমেন্দ্র গুহ কিংবা মাসুদ আহমেদ পড়েননি, যাঁরা 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি', পড়ার সুবাদে 'রূপসী বাংলা' পড়েছেন আর জীবনানন্দকে ভালবেসেছেন নিবিড়ভাবে; তাঁদের হাতে যদি এই বই দেওয়া হয় তাহলে কি হবে! ধরে নিই তাঁরা দৈবাৎ 'ধূসর পান্ডুলিপি' পড়েছেন আর বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন নৈরাশ্যের প্রকাশও এত সুন্দর হতে পারে জেনে। তাঁদের সামনে যখন মাল্যবানকে এনে দাঁড় করানো হবে, তাঁরা কি তাঁর 'বিপন্ন বিস্ময়' এ হতবাক ও স্থবির হয়ে যাবেন না!! তাঁরা কাকে আবিষ্কার করবেন মাল্যবানের জীবনানন্দ হয়ে ওঠা না জীবনানন্দের আড়ালে মাল্যবানের জীবন যন্ত্রণা, দ্বগ্ধতা!!

ম্যাজিশিয়ানের ম্যাজিকাল ট্রিকস বা ম্যাজিক বাক্সের মতোই যাঁর জীবন রহস্যময় তিনি জীবনানন্দ দাশের  অলটার ইগো -- মাল্যবান দাশগুপ্ত। যাঁর সঙ্গে জীবনানন্দের অবাধ ও স্বচ্ছল স্থান বিনিময়। তথাকথিত চরিত্রধর্মী, আখ্যান নির্ভর উপন্যাস এটি নয়। প্লটহীনতার প্লটেই উপন্যাসটির স্বতন্ত্রতা। আত্মপ্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ক্ষতবিক্ষত এক মানুষ, জগত সংসার থেকে ক্রমশ গুটিয়ে যাওয়া, নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়া মাল্যবানের কথা বলে এই উপন্যাস। উপন্যাসটি যেন মাল্যবানের আত্ম-আবিষ্কারের, আত্ম-বিশ্লেষণের তথা আত্ম-অন্বেষণের কথামালা।

সারা উপন্যাস জুড়ে নৈরাশ্য, হতাশা, অপ্রাপ্তি, অপারগতা, অনাস্থারা নৃত্য করে গেছে ছন্দহীন বৈরাগীর মতো। সমাজের অনুসারী হয়ে কিছু করা এবং করতে না পারা এই দুয়ের সংঘাতে ক্ষতবিক্ষত মাল্যবান। নিজেকে সমাজের ছাঁচে প্রস্তুত করতে না পেরে তাঁর এও মনে হবে, "তার মধ্যে মানসিক ভারসাম্যের অভাব আছে।"

যে মাল্যবান নিজের লেখার প্রতি আস্থাশীল। তাঁর পাণ্ডুলিপি দিয়ে তিনি কী করবেন "তা সে পান্ডুলিপি গুলোই ঠিক করে দেবে" বলে দৃঢ় প্রত্যয়ী উচ্চারণ করতে পারেন যিনি, তিনিই আবার ব্লেডে করে কেটে নেন নিজের লেখার পাতা, ছিঁড়ে টুকরো করেন, পুড়িয়ে দেন অপছন্দ হলে। এতো খামখেয়াল নয়। নিজেকে সফল করবার তাগিদে নিজেকেই ভেঙেচুরে দেখার তীব্র, তিক্ত, কষাটে প্রচেষ্টা। মাল্যবান স্বপ্ন দেখেন কিন্তু স্বপ্নসন্ধানী নন। স্বপ্নের দেয়ালা তাঁকে দেউলিয়া করে বারবার। 

তাঁর ব্যক্তি জীবনের ছায়া মাঝে মাঝে উপন্যাসের আকাশে ভাসমান মেঘের মতো ভেসে এসেছে। বাবা, মা লাবণ্য, মঞ্জু, শোভনা সেই ভাসমান মেঘপুঞ্জ। বারবার মাল্যবাণের ভাবনার আকাশে তারা ভিড় করে আসে। আরও চরিত্ররা এসেছে, আত্মীয়জন, বোর্ডিংয়ের মানুষজন ছাড়াও এসেছে হরেক মানুষজন। আসলে মাল্যবানের মানুষ - ছেঁচা ( সেচন করা অর্থে) চোখ, জীবন সেচে মানুষ কুড়িয়ে ফেরে যেন। তাই ধোপা- ধোপানীর জীবন, শিয়ালদার চোর, রাস্তার কুষ্ঠ বালক,বিধবা মহিলা, ভিখিরী, বাঁকা বুড়ো থেকে ডেকের নারী-পুরুষ  তাঁর দৃষ্টি থেকে বাদ পড়েনা কেউই। মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণে আগ্রহ নেই তাঁর, চরিত্ররা তাঁর ভাবনার  ফানুসে হাওয়া ভরে দেয়। নিত্য তাদের উড়ে চলা।

আসলে মাল্যবান লেখক হতে চেয়েছেন। যুগের পাতায় একেবারে স্বতন্ত্র ও বলিষ্ঠ কোনো লেখনীর আঙ্গিকের প্রতিষ্ঠাতা হয়ে থাকার বাসনা মাল্যবানের। যদিও "যাঁর ঝুলিতে আড়াই হাজার কবিতা, আগামীদিনে আরও পাঁচশো মতো কবিতা লিখবেন, যাঁর যা কিছু পরিচয় একজন কবি হিসেবেই, তিনি কিনা একজন নভেলিস্টের পরিচয়ে বাঁচতে চাইছেন।" এর জন্যই তাঁর অন্বেষণ, অপেক্ষা ও আক্ষেপ।

জগতের কাছে মাল্যবান অপদার্থ, আত্মীয়- পরিজন, ও পরিবারের কাছে সে অপদার্থ। চাকরীর চেষ্টা না করে দিন-গুজরান করা এক দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ। আসলে চাকরী মাল্যবান কখনও করতেই চাননি। তিনি মনে মনে চেয়েছেন কলমের মজদুরী করতে। "কেননা অক্ষর তাঁর কাছে প্রাণের স্পন্দন। অক্ষরচর্চা তাঁর কাছে অস্তিত্বের নামান্তর।" কিন্তু তাঁরও বোর্ডিং এর পরিবার দেখে মনে পড়ে লাবণ্য - মঞ্জুর কথা, তাদেরও এখানে এনে রাখতে ইচ্ছে করে, কিংবা বাংলো দেখে বাবাকে,লাবণ্যকে এমন একটা বাংলোতে এনে রাখতে সাধ হয়। পরক্ষণেই নিজের সামর্থ্যের কথা মনে করে নীরব হন। নিজেকে ব্যর্থ ভেবেছেন বারংবার। 

শোভনার প্রেম মাল্যবানের জীবনে সাধের যন্ত্রণা। যে নারীর ভালোবাসার আকর্ষণে মাল্যবানের হৃদয় পাখি ক্রমাগত ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়িয়েছে, কাতর হয়েছে কিন্তু ডানা গুটিয়ে বসতে পারেনি। এই নারীর প্রতি তাঁর অদম্য আকর্ষণ তাঁকে স্থিতু হতে দিল না, এমনকি সংসারেও না।  লাবণ্যকে তাঁর অসহ্য মনে হয়েছে। তাঁর মনে হয়েছে "বিবাহিত জীবন- হানিকর রকমের অভিশপ্ত।" লাবণ্যর কথা মনে পড়লে তাঁর মন তেতো হয়ে যায়। বিয়ের পর থেকেই লাবণ্যর মর্মপীড়া, বিহ্বলতা,পাগলামি, হীনবস্থা,অসুস্থতা, অসহ্য লেগেছে। লাবণ্যের আত্মহত্যার হুমকি, রাগে জল ভর্তি চোখ, ছেলেমানুষী, সেন্টিমেন্ট, তিক্ততা বাড়িয়ে দেয় ক্রমশ। তাই মাল্যবান পালিয়ে বেড়ায়। 'বেশিক্ষণ বাড়িতে থাকলে মাল্যবানের কেমন হাঁপ ধরে।' এই মাল্যবানের জন্য আমার মায়া হয়। 

স্ত্রী নয় কেবল, মেয়ে মঞ্জু, বাবা-মায়ের অবস্থান সব বিষয়েই তাঁর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি মনঃপীড়ার উদ্রেক ঘটায়। চাপা কষ্টে বুকের ভেতর দম আটকে আসে। মেয়ে মঞ্জু সম্পর্কে তাঁর মর্মান্তিক উচ্চারণ, "যদি মঞ্জু মরে যায়, কোনো কি ক্ষতি হবে? অর্থনৈতিক কোনো ক্ষতি হবে না বরং গ্লাক্স  দুধ ইত্যাদি কিনতে হবে না। আমাদের সময় ও শক্তির অপচয় বন্ধ হবে।" বিস্ময়ে হতবাক হই। অথচ যে মাল্যবানের কেতু নামক পথ কুকুরের প্রতি এত মায়া, যাকে সে দোকান থেকে গরম দুধ ও রুটি কিনে খেতে দেয় সেই মাল্যবান, পিতা মাল্যবান কন্যার মৃত্যু কল্পনা করেন!!! কি তীব্র আর্তক্রন্দন। কী নিদারুন হতাশা!! তার সুরটা যে কোন হৃদয়কে কাঁদায়। এই মাল্যবান কে আমি তীব্র অপছন্দ করি।

 রাগ হয় পরিবারের প্রতি তাঁর এহেন ঔদাসীন্য দেখে। এখানে এসে তাঁর চাকরির প্রতি নিশ্চেষ্ট, নিস্পৃহ মনোভাবকে আমার মাতৃহৃদয় তীব্র কষাঘাত করে। 

অথচ লাবণ্যের প্রতি তাঁর মায়া, লাবণ্যর জন্য  উৎকণ্ঠা ছবিও বারবার ভেসে ওঠে ফরহ্যান্স টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন দেখে লাবণ্যের পাইরিয়ার কথা মনে পড়া, লাবণ্য লজেন্স খেতে ভালোবাসে বলে লজেন্স কেনা, বিয়ে বাড়িতে লাবণ্যর কাছে যেতে না পারার জন্য তাঁর শূন্যতাবোধ ও ডাইরির পাতায় লিখে রাখা, লাবণ্যের গায়ের গন্ধ পাওয়ার জন্য তার ব্যবহৃত সাবানটা সুটকেসে ভ'রে নেওয়া, এমনকি লাবণ্যকে বায়োস্কোপ দেখতে যাবার ব্যবস্থা করে দেবার মধ্যেও লাবণ্যর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও মায়ার ছবি ফুটে ওঠে।

মাল্যবানের প্রেম, সংসার, সম্পর্ক, আকাঙ্ক্ষা, বাসনা সবকিছুরই প্রকাশ ঘটেছে এই উপন্যাসে। সমকালীন সামাজিক- রাজনৈতিক পরিমন্ডল সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারা, সমকালীন সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর অভিমত, সাহিত্য রচনা সম্পর্কে ভাবনা সবই প্রকাশ পেয়েছে টুকরো কথার আবর্তে। জীবন সম্পর্কে মাল্যবানের ধারণাও প্রকাশ করেছেন লেখক এরই মধ্যে সুচারু নিপুনতায়। সেই সুরটি ধরতে হবে।

ছোট্ট ছোট্ট বেশ কয়েকটি নামাঙ্কিত পরিচ্ছদে উপন্যাসটির বিন্যাস। লেখনীর ও কাহিনী বয়নের চুম্বক পাঠককে টেনে রাখে শেষ পর্যন্ত। মাননীয়া সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনকাড়া প্রচ্ছদ এবং ধানসিঁড়ি প্রকাশনের সুন্দর পৃষ্ঠা ও বাঁধাই পাঠককে বইটির প্রতি স্নেহদৃষ্টি ফেলতে বাধ্য করবে।

লেখককে সকৃতজ্ঞ অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। তাঁর লেখনী আমাদের পাঠের লিপ্সা নিবারণ করবে আরও এমন লেখায় এই আশা রাখি।


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Sunday, 21 July 2024

কাঁসাই পাড়ের যুদ্ধ : নিবিড় পাঠ // ই-কোরাস ১৮৭

 



কাঁসাই পাড়ের যুদ্ধ : নিবিড় পাঠ

ইতি মণ্ডল 

Child psychology বেশ জটিল। তাই শিশুদের নিয়ে কিছু লিখতে গেলে বেশ ভাবতে হয়। শিশুদের নিয়ে লেখাও বেশ কম। শ্রীজিৎ জানার "কাঁসাই পাড়ের যুদ্ধ" উপন্যাসটি আমার অনুভবে শিশুদের উপযোগী হয়েছে। 

         প্রথমেই বলতে হয় উপন্যাসটির আয়তন পরিমিত, তাই দীর্ঘসময় ব্যয় করতে হবে না। যা অনেক সময় বিরক্তির কারণ হয়। আবার ব্যস্ত জীবনে সময় সংকট হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতেই বাচ্চারা এখন সিলেবাসের বাইরের বই যেগুলি তার ক্যারিয়ারের কোন চমকপ্রদ নম্বর এনে দেবে না, তা পড়তে ভুলে গেছে।

            পুরো উপন্যাসটি ছোট ছোট সহজ সরল বাক্যে লেখা। কোথাও জটিল, যৌগিক বাক্য আমার চোখে পড়েনি। 

             ভাষা ব্যবহার একদম সাবলীল সরল কথ্য। সব থেকে আকর্ষণীয় উপন্যাসের শিশু চরিত্র গুলির মুখে অবিমিশ্র ভাষা। রুদ্রর মুখে---"সামার ভ্যাকেশন", বৃন্তিকার মুখে ----"নো !নো ইয়েস!" এগুলি ইংরেজি ভাষা। যা নবপ্রজন্মের মুখে আমরা শুনতে অভ্যস্ত। অর্কর মুখে--"লিউকোপ্লাস্ট সাঁটালাম"সাঁটালাম শব্দটি বেশ মজার। এরকম নানা ইং-বং মিশ্রিত শব্দ ব্যবহার উপন্যাসটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।। 

          বন্ধু দাদুর চরিত্রটির অবতারণা শিশু মনকে যথেষ্ট প্রভাবিতকরবে। ছোটবেলা থেকে আমরা দাদু ,দিদা ,ঠাকুমার মুখে গল্প শুনতে ভালোবাসি। একসময় আমরা গল্প দাদুর আসর খুব মন দিয়ে শুনতাম।

                  বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে লেখক নিজে নিজ অঞ্চলের প্রতি আসক্ত। তাই বারবার তাঁর লেখনিতে বিষয় হিসাবে নিজের মহকুমা, গ্রামের ঘটনা নির্বাচিত হয়। এটি ও তার ব্যতিক্রমী নয়। পুরো উপন্যাসটি একটি আঞ্চলিক স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত। দাসপুরের চেঁচুয়া হাটের স্বাধীনতা আন্দোলনের কাহিনী। যেখানে এখনো ১০ জন স্বদেশীর স্মৃতিচিহ্ন রক্ষিত আছে। এটি কাঁসাই পাড়ে অবস্থিত ।স্বদেশী আন্দোলন বর্ণনা করতে গিয়ে পারিপার্শ্বিক কিছু অঞ্চলের নাম, কাঁসাই নদীর নামকরণের ইতিহাস, দাসপুর থানার ইংরেজ  চাটুকারি অত্যাচারী ভোলা দারোগার বিশ্বাসঘাতকতা, বেশ কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংগ্রাম বর্ণিত হয়েছে। 

            কাহিনী বিন্যাস তথ্য ভারে কোথাও ভারাক্রান্ত হয়নি। মাঝে মাঝে বিরতি উপন্যাসটিকে তথ্যভার থেকে মুক্ত করেছে। কাহিনীর মাঝে একটি নৌকাডুবির অলৌকিক ঘটনা প্রচলিত মিথ বলা যেতে পারে শিশু মনের গল্প শোনার তেষ্টাকে জাগিয়ে তুলেছে। সামান্য মোড় পরিবর্তন। তবে সাব-প্লট গুলি কখনোই কেন্দ্রীয় প্লটকে ছাপিয়ে যায়নি বা অপ্রাসঙ্গিক হয়নি। 

         সুন্দর রূপকধর্মী বাক্যের ব্যবহার---"কিহে দাদু, এরা কারা? ভীমরুল নাকি বোলতা? এতগুলো হুল ফোটালে বুড়োটা যে অক্কা পাবে।"উত্তরে---"আমরা ভীমরুল বোলতা কোনটাই নই আমরা প্রজাপতি ।আজ চেটেপুটে সব মধু নিয়ে যাব।"

         আঞ্চলিক ইতিহাসের সাথে লেখক সুনিপুনভাবে  জাতীয় ইতিহাসের সেতুবন্ধন করেছেন। গান্ধীজীর "লবণ সত্যাগ্রহ" আন্দোলন অর্থাৎ "ডান্ডি" অভিযান।

         কাহিনীর মধ্যে আবেগঘন মুহুর্তের পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন লেখক সঙ্গীতের চরণ দিয়ে—"ভয় কি মরনে /রাখিতে সন্তানে,/ মাতঙ্গী মেতেছে আজ/ সমর রঙ্গে।"আবেগ ঘন মাতৃত্বের ঘটনা --স্বদেশীদের  তৃষ্ণা মেটানোর জন্য মায়েদের স্তন পান করানো। আবারো একবার প্রমাণ হল নারী শক্তি কোন কালেই পিছিয়ে ছিল না। তাঁদের বুদ্ধিমত্তা, মমত্ববোধের কাছে সব চক্রান্ত ব্যর্থ হতে পারে। এই বিরল অথচ সত্য তথ্য গুলি লেখক সংগ্রহ করে তাঁর কলমের লেখনিতে জীবন্ত করে তুলেছেন। আরেকটি চরিত্র মন কেড়েছে বিহারী লছমন সিং ।ভিন রাজ্যের হয়েও এখানকার স্বদেশীদের পাশে থেকে লড়াই করেছে।

     সর্বোপরি বলা যেতে পারে শ্রীজিতের "কাঁসাই পাড়ের যুদ্ধ" শিশু উপন্যাসটি  বেশ সুখপাঠ্য আর লেখক অতীব বুদ্ধিমত্তা ,ধৈর্য, শ্রম ও নিপুণতার সাথে উপন্যাসটির মধ্য দিয়ে শিশুদের কে নিজের আঞ্চলিক ইতিহাস জানান দিয়েছেন।যা পড়ে শিশু ঋদ্ধ  হবে ও শিশুমনে স্বদেশ প্রীতি সঞ্চারিত হবে ।

        শ্রীজিৎ কে ধন্যবাদ এরকম একটি শিশু উপন্যাস বাংলা শিশু সাহিত্যকে উপহার দেওয়ার জন্য ।যা শিশু সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করবে ও নব প্রজন্মের পাথেয় হবে।।

কাঁসাই পাড়ের যুদ্ধ, প্রকাশক- সায়ন্তনী, মূল্য -১০০/


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Sunday, 14 July 2024

বহুস্বরের ওপার হতে - আশিস মিশ্র // ই-কোরাস ১৮৬

 





বহুস্বরের ওপার হতে

আশিস মিশ্র 


'এত কবি কেন' বলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে যে বহুস্বরের ঝড় সামলাতে হয়েছিল, সে-কথা অনেকেই জানেন। যেহেতু তিনি শক্তি, তাই সেই সময়ে তাঁর বা তাঁর সমসাময়িক খ্যাতিমান কবিদের কোনো কথার যে ভ্যালু থাকত, সে -বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর এখন আমার মতো কোনো লেখক যদি বলেন 'এত কবিতা কেন' এই কথা নিয়ে তেমন কোনো ঝড় বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই নেই। বরং এ-কান দিয়ে শুনে ও-কান দিয়ে বের করে দেওয়া যায়। 

মাঝে মাঝে সত্যিই মনে হয়, এত কবিতার কী প্রয়োজন? এতো কবিতার পোস্ট দিয়েও কী লাভ? এটাও মনে হয়, একটি কবিতা লিখে শেষ করবার পর তার আপাদমস্তকে কোনো বদল দরকার কিনা, সে-বিষয়ে ভাববার অবকাশই নেই! কখনো কখনো একটি কবিতা একবার লিখে শেষ করার পর মনে হয়, লেখাটি বেশ হয়েছে। অতএব এর কোনো পংক্তির বা শব্দের বদল দরকার নেই। একে অনায়াসে কোনো পত্রিকায় পাঠানো যেতে পারে। এমনকী সেই কবিতা প্রকাশের পর তার ফটোকপি পোস্ট দেওয়া যেতে পারে। 

এটাও মাঝে মাঝে লক্ষ্য করেছি যে, যেমন করে সাজিয়ে একটি কবিতা লিখে পাঠালাম, দেখা গেল ছাপার পর তার আপাদমস্তক  আর একরকম হয়ে গেছে। এতে সম্পাদকের ওপর রাগ হয় ঠিকই, পরক্ষণে আর সেই পত্রিকায় কোনো কবিতা দিতে ইচ্ছে করে না। 

আবার এটাও দেখা গেছে অনেক কবি টাইপ করে যে কবিতাটি পাঠান, তিনি টাইপটিও ঠিক মতো করতে জানেন না। একটি কবিতার টেকস্টকে কেমন করে সাজিয়ে টাইপ করতে হয়, তাও অনেকে এখনও রপ্ত করতে পারেননি। ফলে কবিতার লে-আউটেও গন্ডগোল দেখা দেয়। যাইহোক, কী কথা বলতে গিয়ে কোন কথা বললাম। 

ওই যে কবিতা বিষয়ে কোনো কথা বললে, তা শুনবে কে? শুনলেও তার প্রত্যু্ত্তরে অনেক ট্যারা-বাঁকা কথা শুনতে হবে। কিন্তু না বলে তো থাকা যায় না। ভাবতে ভাবতে একটি বই খুলে বসলাম। বইটি শ্রদ্ধেয় চিন্ময় গুহ-র লেখা 'আয়না ভাঙতে ভাঙতে'। ২৩ জন বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন। প্রতিটি পৃষ্ঠাই আমাদের মস্তিষ্ক ও চেতনাকে আলোড়িত করে। তখন মনে হয়, কতটুকুই আর জানি! কার কাছে বসে জানবো এখন! চারপাশে শূন্য চরাচর! বই ছাড়া যেন কোনো বন্ধু নেই! 


শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের একটি অংশ এখানে তুলে আনলাম মাত্র। "  চিন্ময় গুহ প্রশ্ন করছেন : রবীন্দ্রনাথের যেমন ভিন্ন ভিন্ন পাঠ রয়েছে, এলিয়টের পাঠান্তরের কথাও আমরা জানি, মার্কেস তো একটি কাহিনি ন-বার লিখেছেন। আপনার কবিতাটি ছাপা হওয়ার আগে নিশ্চয়ই এমন হয়েছে। কিন্তু প্রকাশিত হওয়ার পর বদলানোর কথা কি কখনও মনে হয়েছে আপনার? 


উ:  ছাপা হয়ে যাওয়ার আগে শব্দবদল -- এমনকী বিন্যাসবদল --সে তো অনেক সময়ই হয়েছে। তবে যে সব নাম আপনি বললেন তাঁদের মতো ততখানি নয়।ততটা ধৈর্যও নেই আমার। বদলের পরিমাণ অল্পই। রবীন্দ্রনাথ যে 'রক্তকরবী'  দশবার লিখেছিলেন সে-তথ্যে ততটা বিস্ময় লাগে না, কিন্তু 'মুক্তির উপায়' -এর মতো একটা অকিঞ্চিৎকর নাটককে সাতাত্তর বছর বয়সে ছ-বার পালটাচ্ছেন কেউ, এটা মনে পড়লে স্তব্ধ হতে হয়। 

ছাপা হয়ে যাওয়ার পর পাল্টানোর অভ্যেস -- প্রবন্ধে অল্পস্বল্প থাকলেও -- কবিতায় প্রায় নেই বললেই চলে। পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবার পর সেটা পাঠকেরই নিজস্ব হয়ে যায়, সেখানে হাত দেওয়া মনে হয় অনধিকার -চর্চা। অল্প বয়সেই কবে এটা মনে হয়েছিল জানেন? সুধীন্দ্রনাথের কবিতার দুটো লাইন খুব আওড়াতাম আমরা : ' একটি কথার দ্বিধাথরোথরো চূড়ে / ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী '। কবিতাটির নতুন সংস্করণে দেখি সুধীন্দ্রনাথ তাকে করে দিয়েছেন : ' একটি কথার দ্বিধাথরোথরো চূড়ে / বাসা বেঁধেছিল সাতটি অমরাবতী। ' কী আঘাত যে পেয়েছিলাম আমরা বন্ধুরা! সেই সঙ্গে মনে হয়েছিল, কী করে এ উনি করতে পারেন?  এ তো এখন আমাদেরই লাইন, ওঁর আজ এটা পালটাবার কী অধিকার?  " 

এর পরও উত্তর কিছুটা রয়েছে। শঙ্খ ঘোষ নিজের কবিতারও  বদল করেছিলেন। 

কিন্তু ওই যে একটি কথা, তেমন কবিতা এখন কটাই বা লেখা হচ্ছে, যে কবির দুটি / চারটি লাইন বন্ধুরা মুখে মুখে আওড়াবো? বহুস্তরে দাঁড়িয়ে যখন বহুস্বরের ঝড়ে ভেসে যাচ্ছি, তখন ওপার থেকে চিরস্মরণীয় সেই সব কবির কবিতার লাইন ভেসে আসছে কানে। প্লেটো যতই বলুন কবিদের নিয়ে -' গড সেন্ট 

ম্যাডনেস ' -- কবিদের এই ঐশ্বরিক খ্যাপামি না থাকলে ভালো কবিতা লেখা অসম্ভব।


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Sunday, 7 July 2024

পাঠ প্রতিক্রিয়া : কাঁসাই পাড়ের যুদ্ধ // ই-কোরাস ১৮৫

 



পাঠ প্রতিক্রিয়া : কাঁসাই পাড়ের যুদ্ধ 

মহাশ্বেতা দাস

    একই বাড়িতে দুইবোনের নাম অনুপমা আর নিরুপমা হলে যেমন তাদের ভালবেসে ডাকা হয় অনু আর নিরু বলে! তেমনই আমাদের ঘাটাল মহকুমায় শিলাবতী আর কংসাবতী…. বহমান এই দুই নদী যেন আমাদেরই ঘরের মেয়ে, হেসে খেলে ঘুরে বেড়ায় আমাদেরই চারপাশে! আর তাই আবাল্য সখ্যতায় এদেরও ডাকা হয় শিলাই আর কাঁসাই আদুরে নামে। নিত্য যাপনে মিশে থাকা এদের ঘিরে অনেক স্মৃতি অনেক ভাললাগা অনেক মুহূর্তের ঋণ! তাই এদের নিয়ে সাহিত্য লেখা হলে সেই বইটি যে একটু বেশিই ভাললাগার বই হবে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। হ্যাঁ ঠিকই টের পেয়েছেন। আমি শ্রীজিৎ জানার শিশু ও কিশোরদের জন্য লেখা “কাঁসাই পাড়ের যুদ্ধ “ উপন্যাসটির কথা বলছি। 

         শ্রীজিৎ এর লেখা “অন্তরে বাহিরে সহজপাঠ”, “বিষাদ গীতিকা” এবং বেশকিছু ছোটগল্প পড়েছি। সায়ন্তনী পত্রিকায় নিয়মিত ছোটদের জন্য গল্প লিখতে দেখেছি, পড়ে মজা পেয়েছি। তবে ছোটদের জন্য ওঁর লেখা উপন্যাস এই প্রথম। অন্তরে বাহিরে সহজপাঠ এর মতো গুরুগম্ভীর গবেষণাধর্মী লেখার পর ছোটদের জন্য ছোটদের হয়ে ছোটদের মতো করে লেখার এই যে যাত্রাপথ, লেখককে পৌঁছে দিয়েছে বাংলা শিশুসাহিত্যের অন্যতম স্থানে। গল্পকথক উমাপতি বাবু…. রুদ্র, বৃন্তিকা, রিনিয়া আর অর্কর যিনি বন্ধুদাদু! এই চরিত্রটির মাধ্যমে সহজ সরল ভাষায় লেখক বলে গেলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কংসাবতী নদীর পাড়ে ঘটে যাওয়া এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা যা কিনা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতার এক কোণে চেঁচুয়া বিদ্রোহ নামে কয়েক পঙক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েগেল এত বছর ধরে। অবিভক্ত মেদিনীপুর যে ছিল স্বদেশী আন্দোলনের আঁতুড় ঘর….. ক্ষুদিরাম , প্রদ্যোৎ , মৃগেন প্রমুখ বিপ্লবী যে শুধু এই জেলার নয় ঘাটাল মহকুমার দাসপুরের ভূমিপুত্র…. এঁদের আত্মত্যাগ, ভোলা দারোগার মত কিছু ব্রিটিশের পা-চাটা বিশ্বাস ঘাতকের কথা বড়দের জানা থাকলেও শিশু কিশোরদের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। তাই ওদের উপযোগী এই উপন্যাসটি বাংলা শিশু সাহিত্যের ভান্ডারে অন্যতম সম্পদ হয়ে রইল। 

     বৃন্তিকা, রুদ্র, অর্ক আর রিনিয়ার খুনসুটি, শিশুসুলভ দুষ্টুমি… রুদ্রর মা সুতপার অভিভাবকত্ব সবটা নিয়ে বেশ টুকটুক করে এগিয়ে চলেছিল গল্প। সর্বোচ্চ উত্তেজনা অনুভূত হয় সপ্তম পর্বে এসে। মেনকা দেবী ও ব্রজবালা দেবী বুকের স্তন্য দিয়ে যেদিন প্রাণ বাঁচালেন ভোলা দারোগার অত্যাচারে বন্দী আন্দোলনকারীদের আর ওঁদের এই কাজে শিব মন্দিরের আটচালা কাপড় দিয়ে ঘিরে সাহায্য করলেন গ্রামের অন্যান্য মহিলারা! স্বামী বিবেকানন্দ চিরকাল মাতৃশক্তি জাগ্রত করার কথা বলেছেন। মায়েরা জেগে উঠলে বিশ্বের যেকোন অশুভ শক্তি যে পিছু হটতে বাধ্য থাকে..  সেদিন একথাই টের পেয়েছিল ইংরেজ সরকার। আমাদের মা-মাসি থেকে পাড়ার অশিক্ষিত সাধারণ মেয়েদের অবদান ও কোন অংশে যে কমছিল না…. কে মনে রাখে!!!  শ্রীজিৎ তাঁর উপন্যাসে সেসব অভিজ্ঞতার কথাই তুলে ধরেছেন। সাবলীল ভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের এইসব টুকরো অথচ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরার যে দায়বদ্ধতা পালন করেছেন লেখক তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। 

     তিতাস পন্ডার তৈরী প্রচ্ছদ, কণিকা পাঁজার অলংকরণ, অনুপম মুখোপাধ্যায়ের লেখা প্রস্তাবনা এবং…. অপূর্ব দাস, সৌমিত্র হড়, তিতাস পন্ডা এবং কণিকা পাঁজা এর  সামগ্রিক কাজ, সবটা মিলিয়ে সায়ন্তনী প্রকাশনার প্রযত্নে “কাঁসাই পাড়ের যুদ্ধ”  বইটি শিশু কিশোরদের জন্যে আকর্ষণীয় এক উপহার। 

মূল্য - ১০০/-


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...