প্রফেসর মাল্যবান দাশগুপ্ত : দ্য ম্যাজিশিয়ান
সোনালী গোস্বামী
আমি অত্যন্ত দুর্বল পাঠক, ততোধিক দুর্বল আলোচক। আমি এমন একজন মানুষ যে ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছবি তুলতে ভুলে যায় এই ভেবে যে অনুভূতির সুতো যেন ছিন্ন না হয়। নিজের অন্তরে, অনুভবে ধারণ করতে চাই দৃশ্য,শব্দ,গন্ধ। তেমনি কোনো ভালো লেখা পড়তে গিয়ে পড়ার পর তার যতটুকু ধারণ করি, আপন মনে জারণ করি, তার খুব নূন্যতম অংশই প্রকাশ করতে পারি। এ আমার যথার্থ অর্থেই অক্ষমতা স্বীকার করি। কিন্তু কিছু লেখা পড়ার পর নিজের জন্যই তার অনুভূতি লিখে রাখতে ইচ্ছে করে।
উপন্যাসটি পড়েছি আর ভেবেছি যাঁরা ভুমেন্দ্র গুহ কিংবা মাসুদ আহমেদ পড়েননি, যাঁরা 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি', পড়ার সুবাদে 'রূপসী বাংলা' পড়েছেন আর জীবনানন্দকে ভালবেসেছেন নিবিড়ভাবে; তাঁদের হাতে যদি এই বই দেওয়া হয় তাহলে কি হবে! ধরে নিই তাঁরা দৈবাৎ 'ধূসর পান্ডুলিপি' পড়েছেন আর বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন নৈরাশ্যের প্রকাশও এত সুন্দর হতে পারে জেনে। তাঁদের সামনে যখন মাল্যবানকে এনে দাঁড় করানো হবে, তাঁরা কি তাঁর 'বিপন্ন বিস্ময়' এ হতবাক ও স্থবির হয়ে যাবেন না!! তাঁরা কাকে আবিষ্কার করবেন মাল্যবানের জীবনানন্দ হয়ে ওঠা না জীবনানন্দের আড়ালে মাল্যবানের জীবন যন্ত্রণা, দ্বগ্ধতা!!
ম্যাজিশিয়ানের ম্যাজিকাল ট্রিকস বা ম্যাজিক বাক্সের মতোই যাঁর জীবন রহস্যময় তিনি জীবনানন্দ দাশের অলটার ইগো -- মাল্যবান দাশগুপ্ত। যাঁর সঙ্গে জীবনানন্দের অবাধ ও স্বচ্ছল স্থান বিনিময়। তথাকথিত চরিত্রধর্মী, আখ্যান নির্ভর উপন্যাস এটি নয়। প্লটহীনতার প্লটেই উপন্যাসটির স্বতন্ত্রতা। আত্মপ্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ক্ষতবিক্ষত এক মানুষ, জগত সংসার থেকে ক্রমশ গুটিয়ে যাওয়া, নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়া মাল্যবানের কথা বলে এই উপন্যাস। উপন্যাসটি যেন মাল্যবানের আত্ম-আবিষ্কারের, আত্ম-বিশ্লেষণের তথা আত্ম-অন্বেষণের কথামালা।
সারা উপন্যাস জুড়ে নৈরাশ্য, হতাশা, অপ্রাপ্তি, অপারগতা, অনাস্থারা নৃত্য করে গেছে ছন্দহীন বৈরাগীর মতো। সমাজের অনুসারী হয়ে কিছু করা এবং করতে না পারা এই দুয়ের সংঘাতে ক্ষতবিক্ষত মাল্যবান। নিজেকে সমাজের ছাঁচে প্রস্তুত করতে না পেরে তাঁর এও মনে হবে, "তার মধ্যে মানসিক ভারসাম্যের অভাব আছে।"
যে মাল্যবান নিজের লেখার প্রতি আস্থাশীল। তাঁর পাণ্ডুলিপি দিয়ে তিনি কী করবেন "তা সে পান্ডুলিপি গুলোই ঠিক করে দেবে" বলে দৃঢ় প্রত্যয়ী উচ্চারণ করতে পারেন যিনি, তিনিই আবার ব্লেডে করে কেটে নেন নিজের লেখার পাতা, ছিঁড়ে টুকরো করেন, পুড়িয়ে দেন অপছন্দ হলে। এতো খামখেয়াল নয়। নিজেকে সফল করবার তাগিদে নিজেকেই ভেঙেচুরে দেখার তীব্র, তিক্ত, কষাটে প্রচেষ্টা। মাল্যবান স্বপ্ন দেখেন কিন্তু স্বপ্নসন্ধানী নন। স্বপ্নের দেয়ালা তাঁকে দেউলিয়া করে বারবার।
তাঁর ব্যক্তি জীবনের ছায়া মাঝে মাঝে উপন্যাসের আকাশে ভাসমান মেঘের মতো ভেসে এসেছে। বাবা, মা লাবণ্য, মঞ্জু, শোভনা সেই ভাসমান মেঘপুঞ্জ। বারবার মাল্যবাণের ভাবনার আকাশে তারা ভিড় করে আসে। আরও চরিত্ররা এসেছে, আত্মীয়জন, বোর্ডিংয়ের মানুষজন ছাড়াও এসেছে হরেক মানুষজন। আসলে মাল্যবানের মানুষ - ছেঁচা ( সেচন করা অর্থে) চোখ, জীবন সেচে মানুষ কুড়িয়ে ফেরে যেন। তাই ধোপা- ধোপানীর জীবন, শিয়ালদার চোর, রাস্তার কুষ্ঠ বালক,বিধবা মহিলা, ভিখিরী, বাঁকা বুড়ো থেকে ডেকের নারী-পুরুষ তাঁর দৃষ্টি থেকে বাদ পড়েনা কেউই। মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণে আগ্রহ নেই তাঁর, চরিত্ররা তাঁর ভাবনার ফানুসে হাওয়া ভরে দেয়। নিত্য তাদের উড়ে চলা।
আসলে মাল্যবান লেখক হতে চেয়েছেন। যুগের পাতায় একেবারে স্বতন্ত্র ও বলিষ্ঠ কোনো লেখনীর আঙ্গিকের প্রতিষ্ঠাতা হয়ে থাকার বাসনা মাল্যবানের। যদিও "যাঁর ঝুলিতে আড়াই হাজার কবিতা, আগামীদিনে আরও পাঁচশো মতো কবিতা লিখবেন, যাঁর যা কিছু পরিচয় একজন কবি হিসেবেই, তিনি কিনা একজন নভেলিস্টের পরিচয়ে বাঁচতে চাইছেন।" এর জন্যই তাঁর অন্বেষণ, অপেক্ষা ও আক্ষেপ।
জগতের কাছে মাল্যবান অপদার্থ, আত্মীয়- পরিজন, ও পরিবারের কাছে সে অপদার্থ। চাকরীর চেষ্টা না করে দিন-গুজরান করা এক দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ। আসলে চাকরী মাল্যবান কখনও করতেই চাননি। তিনি মনে মনে চেয়েছেন কলমের মজদুরী করতে। "কেননা অক্ষর তাঁর কাছে প্রাণের স্পন্দন। অক্ষরচর্চা তাঁর কাছে অস্তিত্বের নামান্তর।" কিন্তু তাঁরও বোর্ডিং এর পরিবার দেখে মনে পড়ে লাবণ্য - মঞ্জুর কথা, তাদেরও এখানে এনে রাখতে ইচ্ছে করে, কিংবা বাংলো দেখে বাবাকে,লাবণ্যকে এমন একটা বাংলোতে এনে রাখতে সাধ হয়। পরক্ষণেই নিজের সামর্থ্যের কথা মনে করে নীরব হন। নিজেকে ব্যর্থ ভেবেছেন বারংবার।
শোভনার প্রেম মাল্যবানের জীবনে সাধের যন্ত্রণা। যে নারীর ভালোবাসার আকর্ষণে মাল্যবানের হৃদয় পাখি ক্রমাগত ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়িয়েছে, কাতর হয়েছে কিন্তু ডানা গুটিয়ে বসতে পারেনি। এই নারীর প্রতি তাঁর অদম্য আকর্ষণ তাঁকে স্থিতু হতে দিল না, এমনকি সংসারেও না। লাবণ্যকে তাঁর অসহ্য মনে হয়েছে। তাঁর মনে হয়েছে "বিবাহিত জীবন- হানিকর রকমের অভিশপ্ত।" লাবণ্যর কথা মনে পড়লে তাঁর মন তেতো হয়ে যায়। বিয়ের পর থেকেই লাবণ্যর মর্মপীড়া, বিহ্বলতা,পাগলামি, হীনবস্থা,অসুস্থতা, অসহ্য লেগেছে। লাবণ্যের আত্মহত্যার হুমকি, রাগে জল ভর্তি চোখ, ছেলেমানুষী, সেন্টিমেন্ট, তিক্ততা বাড়িয়ে দেয় ক্রমশ। তাই মাল্যবান পালিয়ে বেড়ায়। 'বেশিক্ষণ বাড়িতে থাকলে মাল্যবানের কেমন হাঁপ ধরে।' এই মাল্যবানের জন্য আমার মায়া হয়।
স্ত্রী নয় কেবল, মেয়ে মঞ্জু, বাবা-মায়ের অবস্থান সব বিষয়েই তাঁর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি মনঃপীড়ার উদ্রেক ঘটায়। চাপা কষ্টে বুকের ভেতর দম আটকে আসে। মেয়ে মঞ্জু সম্পর্কে তাঁর মর্মান্তিক উচ্চারণ, "যদি মঞ্জু মরে যায়, কোনো কি ক্ষতি হবে? অর্থনৈতিক কোনো ক্ষতি হবে না বরং গ্লাক্স দুধ ইত্যাদি কিনতে হবে না। আমাদের সময় ও শক্তির অপচয় বন্ধ হবে।" বিস্ময়ে হতবাক হই। অথচ যে মাল্যবানের কেতু নামক পথ কুকুরের প্রতি এত মায়া, যাকে সে দোকান থেকে গরম দুধ ও রুটি কিনে খেতে দেয় সেই মাল্যবান, পিতা মাল্যবান কন্যার মৃত্যু কল্পনা করেন!!! কি তীব্র আর্তক্রন্দন। কী নিদারুন হতাশা!! তার সুরটা যে কোন হৃদয়কে কাঁদায়। এই মাল্যবান কে আমি তীব্র অপছন্দ করি।
রাগ হয় পরিবারের প্রতি তাঁর এহেন ঔদাসীন্য দেখে। এখানে এসে তাঁর চাকরির প্রতি নিশ্চেষ্ট, নিস্পৃহ মনোভাবকে আমার মাতৃহৃদয় তীব্র কষাঘাত করে।
অথচ লাবণ্যের প্রতি তাঁর মায়া, লাবণ্যর জন্য উৎকণ্ঠা ছবিও বারবার ভেসে ওঠে ফরহ্যান্স টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন দেখে লাবণ্যের পাইরিয়ার কথা মনে পড়া, লাবণ্য লজেন্স খেতে ভালোবাসে বলে লজেন্স কেনা, বিয়ে বাড়িতে লাবণ্যর কাছে যেতে না পারার জন্য তাঁর শূন্যতাবোধ ও ডাইরির পাতায় লিখে রাখা, লাবণ্যের গায়ের গন্ধ পাওয়ার জন্য তার ব্যবহৃত সাবানটা সুটকেসে ভ'রে নেওয়া, এমনকি লাবণ্যকে বায়োস্কোপ দেখতে যাবার ব্যবস্থা করে দেবার মধ্যেও লাবণ্যর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও মায়ার ছবি ফুটে ওঠে।
মাল্যবানের প্রেম, সংসার, সম্পর্ক, আকাঙ্ক্ষা, বাসনা সবকিছুরই প্রকাশ ঘটেছে এই উপন্যাসে। সমকালীন সামাজিক- রাজনৈতিক পরিমন্ডল সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারা, সমকালীন সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর অভিমত, সাহিত্য রচনা সম্পর্কে ভাবনা সবই প্রকাশ পেয়েছে টুকরো কথার আবর্তে। জীবন সম্পর্কে মাল্যবানের ধারণাও প্রকাশ করেছেন লেখক এরই মধ্যে সুচারু নিপুনতায়। সেই সুরটি ধরতে হবে।
ছোট্ট ছোট্ট বেশ কয়েকটি নামাঙ্কিত পরিচ্ছদে উপন্যাসটির বিন্যাস। লেখনীর ও কাহিনী বয়নের চুম্বক পাঠককে টেনে রাখে শেষ পর্যন্ত। মাননীয়া সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনকাড়া প্রচ্ছদ এবং ধানসিঁড়ি প্রকাশনের সুন্দর পৃষ্ঠা ও বাঁধাই পাঠককে বইটির প্রতি স্নেহদৃষ্টি ফেলতে বাধ্য করবে।
লেখককে সকৃতজ্ঞ অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। তাঁর লেখনী আমাদের পাঠের লিপ্সা নিবারণ করবে আরও এমন লেখায় এই আশা রাখি।
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment