নগরবাউল
অংশুমান কর
গত শতাব্দীর নয়ের দশকের শেষের দিক। পুরুলিয়া থেকে ট্রেনে করে একটি অনুষ্ঠানের পরে একসঙ্গে ফিরছি আমি আর অরুণ চক্রবর্তী। আসানসোল থেকে ওই ট্রেনে উঠল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিভাগের আমার কিছু সহপাঠিনী। বসল আমাদের ঠিক উলটোদিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অরুণদা ওদের সঙ্গে নানারকম ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে শুরু করলেন। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। বারবার আশঙ্কা হচ্ছে, না জানি আমার বন্ধুনিরা কী মনে করবে অরুণদার এই ব্যবহারে। কিন্তু, ওরা কিছু মনে তো করলই না, বরং কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম ওরা বেশ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে প্রাণোচ্ছল অরুণদাকে। অরুণদা ওদের দিতে শুরু করেছেন চকলেট। এমনই ছিল এই নগরবাউলের স্বভাব। চকলেটের মোড়কে নিষ্পাপ বন্ধুত্ব বিলি করে বেড়িয়েছেন সারা জীবন। লিখেছেন এমন কিছু কবিতা যা বাংলা কাব্যজগতে রয়ে যাবে নিজেদের গুণেই। কোনো কিছুকেই ভয় করতে দেখিনি অরুণদাকে। এমনকি নেশাকেও ভয় করতেন না। কী অনায়াসে লিখেছিলেন, "নেশা আমার চাকরবাকর"! আমার নানা লেখায় মাঝে মাঝেই অরুণদার কবিতার বেশ কিছু পঙ্ক্তি ব্যবহার করেছি। খবরকাগজে প্রকাশিত সেই সমস্ত লেখা পড়লেই অরুণদা ঠিক ফোন করতেন। শেষ কয়েক বছরে মাত্র এক-দুবারই দেখা হয়েছিল। কিন্তু ফোনে কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার। অরুণদা ছিলেন, এটাই ছিল আমাদের এক বড়ো ভরসা। ভালো লাগত এটা ভেবে যে, কবিতার রাজনীতির ক্লেদের বাইরে একজন নাগরিক বাউল বাংলা কবিতায় বেঁচে রয়েছেন এখনও। তিনি আর নেই। এই শূন্যতা পূর্ণ হওয়া কঠিন।
হেসে অরুণদা আবার এক চুমুক
আশিস মিশ্র
'পদ্যে অনেক কান্না ঝরায়, কান্না কি খুব সোজা',
' মদ্যপ ' শব্দটির বদলে ' পদ্যপ ' বললে তো দোষমুক্ত হওয়াই যায়। একগাল হেসে অরুণদা আবার এক চুমুক দিলেন। রাত কত হল, খেয়ালই নেই। সেবার ফারাক্কায় কবিসম্মেলনে গিয়ে সুনীল করণদার ফ্ল্যাটে দু'টি রাত কীভাবে যে কেটে গেল। আমি, অরুণদা, প্রদীপ আচার্য, গৌতমদা, সুনীলদা...। সে-সময় অরুণদার একটি ফটোগ্রাফ ( নটরাজ মূর্তির আঙ্গিকে) তুলেছিলাম। ছবিটি আর পাচ্ছি না। গান, কবিতা, আড্ডার ফাঁকে তাঁরই লেখা আওড়ে যাই এখনও-- আমি কোনো ঝঞ্ঝাটে নেই / নেশা আমার চাকর বাকর...
কিংবা --
স্তন নিংড়ে যতই ঢালো দুধ গঙ্গাজল / শিবলিঙ্গ কাত হয় না...
বাংলা কবিতার এমন গৃহী বাউল কবির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটি যুগের অবসান হয়ে গেল। লক্ষ মানুষের ভিড়ে যাঁর স্বরূপ চিনতে কারুরই অসুবিধে হত না। সে জয়দেব কেঁদুলি মেলা হোক, শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা হোক। আর পকেট থেকে কোনো কবিকে চকোলেট বের করে দিতে দেখবো না!
অরুণদা বলতেন, বুড়ো ১০ টি কবিতাই লিখবো। ৯ টি লিখেছি। ১ টি বাকি।
সত্যিই তো -- একজন কবির ১০ টি কবিতাই পৃথিবী কাঁপিয়ে দিতে পারে। অরুণদার ক্ষেত্রে তার কিছুটা তো হয়েছে গানের ভেতর দিয়ে।
হলদিয়া, দাঁতন, ঔরাঙ্গাবাদ, রাণাঘাট, ঝাড়গ্রাম, মেচেদা, মালদা -- তাঁর সঙ্গে রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতা আমার আছে। কত কথা লিখবো?
ট্রেন ছুটছে --দীপ মুখোপাধ্যায় আমাকে গেটের কাছে টেনে নিয়ে গেল। একটা জলের বোতল আমাকে ধরিয়ে বলল, টেনে দাও। সামনের স্টেশন চুঁচুড়া --বুড়ো উঠবে। একটু পরে দরজা দিয়ে সত্যি সত্যি
' অউম ' পত্রিকার সম্পাদক উঠে পড়লেন। বাইরে ঘন অন্ধকার --হাওয়া -- দৌড় -- দৌড় --অরুণদাও আর একটি বোতল টেনে দিলেন।
আমি বললাম -- নেশা যখন বাঘ হয়ে যায় / বাঘের গলায় ঘুঙুর বাঁধি / নেশা যখন সাপ হয়ে যায় / শ্যামের বাঁশি বাজায় রাধে...অরুণদা হেসে বললেন -- কী সাঙ্ঘাতিক!
হাতে দিলেন একটি লজেন্স
সুকান্ত সিংহ
তারিখটা মনে আছে। ২৭জুলাই ২০১৯। হিন্দমোটর স্টেশনে নেমেছি, দেখি ১নং প্ল্যাটফর্মে তিনি। অরুণকুমার চক্রবর্তী। আগে ছবি দেখেছি অনেকবার। সামনাসামনি এই এথম। আর ওই শেষবার। এগিয়ে গিয়ে বললুম, যা সাধারণত কাউকে বলি না, আপনার একটা ছবি তুলব? হাসি মুখ। তারপর ছবি তোলা। হাতে দিলেন একটি লজেন্স। আগেও শুনেছি লজেন্স তাঁর কাছে সব সময় থাকে। আমার এক আত্মীয়ের স্কুলে এসেছিলেন একবার। তিনি তো বহুদিন তাঁর দেওয়া লজেন্সটি রেখে দিয়েছিলেন।
'লাল পাহাড়ির দেশে যা' লেখার পিছনের গল্প কোথাও পড়েছিলুম। এই হেমন্তের দিনে তিনি হয়তো সেই দেশেই এখন লজেন্স দিতে দিতে হেঁটে চলেছেন!
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment