বহুস্বরের ওপার হতে
আশিস মিশ্র
'এত কবি কেন' বলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে যে বহুস্বরের ঝড় সামলাতে হয়েছিল, সে-কথা অনেকেই জানেন। যেহেতু তিনি শক্তি, তাই সেই সময়ে তাঁর বা তাঁর সমসাময়িক খ্যাতিমান কবিদের কোনো কথার যে ভ্যালু থাকত, সে -বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর এখন আমার মতো কোনো লেখক যদি বলেন 'এত কবিতা কেন' এই কথা নিয়ে তেমন কোনো ঝড় বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই নেই। বরং এ-কান দিয়ে শুনে ও-কান দিয়ে বের করে দেওয়া যায়।
মাঝে মাঝে সত্যিই মনে হয়, এত কবিতার কী প্রয়োজন? এতো কবিতার পোস্ট দিয়েও কী লাভ? এটাও মনে হয়, একটি কবিতা লিখে শেষ করবার পর তার আপাদমস্তকে কোনো বদল দরকার কিনা, সে-বিষয়ে ভাববার অবকাশই নেই! কখনো কখনো একটি কবিতা একবার লিখে শেষ করার পর মনে হয়, লেখাটি বেশ হয়েছে। অতএব এর কোনো পংক্তির বা শব্দের বদল দরকার নেই। একে অনায়াসে কোনো পত্রিকায় পাঠানো যেতে পারে। এমনকী সেই কবিতা প্রকাশের পর তার ফটোকপি পোস্ট দেওয়া যেতে পারে।
এটাও মাঝে মাঝে লক্ষ্য করেছি যে, যেমন করে সাজিয়ে একটি কবিতা লিখে পাঠালাম, দেখা গেল ছাপার পর তার আপাদমস্তক আর একরকম হয়ে গেছে। এতে সম্পাদকের ওপর রাগ হয় ঠিকই, পরক্ষণে আর সেই পত্রিকায় কোনো কবিতা দিতে ইচ্ছে করে না।
আবার এটাও দেখা গেছে অনেক কবি টাইপ করে যে কবিতাটি পাঠান, তিনি টাইপটিও ঠিক মতো করতে জানেন না। একটি কবিতার টেকস্টকে কেমন করে সাজিয়ে টাইপ করতে হয়, তাও অনেকে এখনও রপ্ত করতে পারেননি। ফলে কবিতার লে-আউটেও গন্ডগোল দেখা দেয়। যাইহোক, কী কথা বলতে গিয়ে কোন কথা বললাম।
ওই যে কবিতা বিষয়ে কোনো কথা বললে, তা শুনবে কে? শুনলেও তার প্রত্যু্ত্তরে অনেক ট্যারা-বাঁকা কথা শুনতে হবে। কিন্তু না বলে তো থাকা যায় না। ভাবতে ভাবতে একটি বই খুলে বসলাম। বইটি শ্রদ্ধেয় চিন্ময় গুহ-র লেখা 'আয়না ভাঙতে ভাঙতে'। ২৩ জন বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন। প্রতিটি পৃষ্ঠাই আমাদের মস্তিষ্ক ও চেতনাকে আলোড়িত করে। তখন মনে হয়, কতটুকুই আর জানি! কার কাছে বসে জানবো এখন! চারপাশে শূন্য চরাচর! বই ছাড়া যেন কোনো বন্ধু নেই!
শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের একটি অংশ এখানে তুলে আনলাম মাত্র। " চিন্ময় গুহ প্রশ্ন করছেন : রবীন্দ্রনাথের যেমন ভিন্ন ভিন্ন পাঠ রয়েছে, এলিয়টের পাঠান্তরের কথাও আমরা জানি, মার্কেস তো একটি কাহিনি ন-বার লিখেছেন। আপনার কবিতাটি ছাপা হওয়ার আগে নিশ্চয়ই এমন হয়েছে। কিন্তু প্রকাশিত হওয়ার পর বদলানোর কথা কি কখনও মনে হয়েছে আপনার?
উ: ছাপা হয়ে যাওয়ার আগে শব্দবদল -- এমনকী বিন্যাসবদল --সে তো অনেক সময়ই হয়েছে। তবে যে সব নাম আপনি বললেন তাঁদের মতো ততখানি নয়।ততটা ধৈর্যও নেই আমার। বদলের পরিমাণ অল্পই। রবীন্দ্রনাথ যে 'রক্তকরবী' দশবার লিখেছিলেন সে-তথ্যে ততটা বিস্ময় লাগে না, কিন্তু 'মুক্তির উপায়' -এর মতো একটা অকিঞ্চিৎকর নাটককে সাতাত্তর বছর বয়সে ছ-বার পালটাচ্ছেন কেউ, এটা মনে পড়লে স্তব্ধ হতে হয়।
ছাপা হয়ে যাওয়ার পর পাল্টানোর অভ্যেস -- প্রবন্ধে অল্পস্বল্প থাকলেও -- কবিতায় প্রায় নেই বললেই চলে। পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবার পর সেটা পাঠকেরই নিজস্ব হয়ে যায়, সেখানে হাত দেওয়া মনে হয় অনধিকার -চর্চা। অল্প বয়সেই কবে এটা মনে হয়েছিল জানেন? সুধীন্দ্রনাথের কবিতার দুটো লাইন খুব আওড়াতাম আমরা : ' একটি কথার দ্বিধাথরোথরো চূড়ে / ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী '। কবিতাটির নতুন সংস্করণে দেখি সুধীন্দ্রনাথ তাকে করে দিয়েছেন : ' একটি কথার দ্বিধাথরোথরো চূড়ে / বাসা বেঁধেছিল সাতটি অমরাবতী। ' কী আঘাত যে পেয়েছিলাম আমরা বন্ধুরা! সেই সঙ্গে মনে হয়েছিল, কী করে এ উনি করতে পারেন? এ তো এখন আমাদেরই লাইন, ওঁর আজ এটা পালটাবার কী অধিকার? "
এর পরও উত্তর কিছুটা রয়েছে। শঙ্খ ঘোষ নিজের কবিতারও বদল করেছিলেন।
কিন্তু ওই যে একটি কথা, তেমন কবিতা এখন কটাই বা লেখা হচ্ছে, যে কবির দুটি / চারটি লাইন বন্ধুরা মুখে মুখে আওড়াবো? বহুস্তরে দাঁড়িয়ে যখন বহুস্বরের ঝড়ে ভেসে যাচ্ছি, তখন ওপার থেকে চিরস্মরণীয় সেই সব কবির কবিতার লাইন ভেসে আসছে কানে। প্লেটো যতই বলুন কবিদের নিয়ে -' গড সেন্ট
ম্যাডনেস ' -- কবিদের এই ঐশ্বরিক খ্যাপামি না থাকলে ভালো কবিতা লেখা অসম্ভব।
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment