Wednesday 31 January 2024

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ১৪

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ১৪

মণিহার টকিজ – গোপীগঞ্জ, দাসপুর

শ্রীজিৎ জানা 


মশাই, শুধুমাত্র তাজমহলে পড়ে থাকলেই হবে! আগে বাড়ুন। সাধে কি কবিগুরু আক্ষেপ করেছেন– 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া'। দেখার ইচ্ছে হলে শাজাহান আরও খুঁজে পাবেন। আরে মশাই সে নাইবা মুঘল সম্রাট হোলো, মনে ও মেজাজে তিনিও রাজা, তিনি রাজা, তাঁর আশ্চর্য কর্মকান্ডের। তিনি ছিলেন বড় ব্যবসায়ী। তার উপর একবার কলকাতার ধাপার মাঠে  বাঁধাকপি চাষ করে সোরগোল ফেলে দেন। খেতাব পান 'ক্যাবেজ কিং’ নামে। প্রভূত অর্থ আসে তাঁর হাতে। সেই অর্থে তিনি জনগনের চলাচলের সুবিধার্থে সড়ক নির্মান করে দিলেন। রূপনারায়ণ নদের পাড়ের গোপীগঞ্জ থেকে সোনাখালি হয়ে দাসপুর ছুঁয়ে রসিগঞ্জ ডিঙিয়ে সোজা ঘাটাল অব্দি। আর সহধর্মিণীর নামে সেই সড়কের নামকরণ করলেন রাইমণি রোড। ভাবুন পত্নীপ্রেম কারে কয়। বুঝেছি, বিরক্তি বাড়ছে কারণ সিনেমাহলের কথা বলতে গিয়ে সড়কের গল্প ফেঁদেছি। চটে চট্টগ্রাম না হলে বলি, এবারের সিনেমাহলের অবস্থান দাসপুর -২ ব্লকের গোপীগঞ্জে। সেখানে যাওয়ার রাস্তাটা তাই আগেভাগে বাতলে দিলুম। তবে আজ গোপীগঞ্জ যেতে ঘাটাল-পাঁশকুড়া সড়কের সুলতাননগর মোড় থেকে সোজা পুবের সড়ক ধরে গেলেই হাজির হওয়া যাবে গোপীগঞ্জে। রূপনারায়ণের পশ্চিম পাড়ে গোপীগঞ্জ। নদ ডিঙোলে পুব পাড়ে হাওড়া আর হুগলী জেলা। গোপীগঞ্জ সেই অতীত কাল থেকেই ছিল জমজমাট একটি গঞ্জ। গঞ্জ সংলগ্ন আরও একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম হল আরিট। আরিটের প্রসিদ্ধি তার দুগ্ধজাত দ্রব্যের জন্য। আরিটে প্রচুর গোয়ালাদের বাস ছিল। গোপী তথা গোয়ালিনীরা দুগ্ধজাত পসরা নিয়ে ওই নদের পাড়ে ভীড় জমাত বলে নাম হয় গোপীগঞ্জ। ওখান থেকে ঘি, ছানা, মাখন, খোয়া জলপথে চলে যেত মহানগরে। সেই গঞ্জেই স্বাধীনোত্তর কালে বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে স্থাপন করেন 'গণেশ টকিজ' সিনেরমাহল। হাওড়া জেলার বাগনানা নিবাসী নবকুমার রায় গোপীগঞ্জে গড়ে তোলেন 'গণেশ টকিজ' সিনেরমাহল। দীর্ঘদিন চলার পর একসময় সেই টকিজ তিনি বিক্রি করে দিতে চাইলেন। সেইসময় রহমান ভাইদল ওই টকিজ কিনে নেন।


পাঁচ ভাই যৌথভাবে দেড় বিঘা জায়গা সহ 'গণেশ টকিজ' কিনে নিলেন। নতুন করে সাজালেন সিনেমাহলকে। নামও বদলে দিলেন। নতুন নাম রাখলেন 'মণিহার'। পাঁচ ভাইয়ের কনিষ্ঠ সেখ হাবিবুর সাহেবকে জিগ্যেস করলুম মণিহার নাসের কারণ কী? মানুষটি অতিসজ্জন। স্মিত হাসি ছড়িয়ে জানালেন, "এই নামটার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের পারিবারিক এক মহিলার নাম। সেইজন্য নামের কারণটি বিস্তারিত ভাবে বলা যাবে না"। তাঁর অমতের কারণকে শ্রদ্ধা জানালুম। কিন্তু অন্য সমস্ত বিষয়ে সযত্নে বললেন – "মোশান পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার ছিলাম আমি। কলকাতা যেতুাম মিটিংয়ে। যখনই কোন ছবি রিলিজ হত, তার সমস্ত খবরাখবর পেতুম। তখন আমাদের সিনেমাহলের রমরমা সময়। ওপারের দ্বীপ অঞ্চলের মানে হাওড়ার সিনেমা প্রেমীরাই ছিল মূলত আমাদের হলের দর্শক"। মণিহার সিনেমাহলের পথচলা শুরু ১৯৮৭ সালে। প্রথম ছবি "ঘর সংসার"। পুবে-পশ্চিমে লম্বা প্রেক্ষাগৃহে আসন সংখ্যা ছিল সাতশ। তিনটি স্টলে ভাগ করা আসনে ছিল ঠেস দেওয়া স্পঞ্জ লাগানো চেয়ার। কোন ব্যালকনি ছিল না। তবে পারিবারের আট-দশ জন লোক একসাথে বসে দেখার জন্য একট ব্যালকনির মতো জায়গা তাঁরা বানান। মণিহারে শো টাইম ছিল তিনটা ও ছ'টা। তবে ঈদের দিনে ১২ টার শো টাইম রাখা হত। প্রথম দিকে ফ্রন্ট স্টলে দর্শনী ছিল তিন টাকা,সেকেন্ড স্টলে পাঁচ টাকা আর ফার্স্ট ক্লাসের জন্য দশ টাকা ধার্য ছিল। দশ-বার জন স্টাফ মণিহারে কাজ করতেন। নিজস্ব প্রোজেক্টরের মাধ্যমে ছবি প্রদর্শিত হত। বাংলা ও হিন্দি উভয় ছবিরই কদর ছিল এই সিনেরমাহলে। তবে বাংলা ছবিতে দর্শক আসন উপচে পড়ত। বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না,লাঠি প্রভৃতি ছবি প্রায় দু'মাস করে চলে। 

মণিহার বন্ধ হয় ২০১৩ সাল নাগাদ। বন্ধের কারণ আশেপাশের অন্য সব সিনেরমাহল বন্ধের কারণের সঙ্গে মিলবে না। মূলত পারিবারিক কারণেই তাঁরা সিনেমাহল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন। হবিবুর সাহেবরা ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারভূক্ত। বড় ভাই সেখ্ খলিলুল রহমান একসময় তাঁদের নিজস্ব ধর্মমতকে আঁকড়ে ধরেন। বিনোদনের এই মাধ্যম থেকে পরিবারের অর্থ আয়কে তাঁরা অন্যায় মনে করলেন। স্বাভাবিকভাবে নিজেদের ধর্মকে শ্রদ্ধা জানিযে এবং দাদার আবেগকে সম্মান জানিয়ে সিনেমাহল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। আজকের জমজমাট গোপীগঞ্জ বাজারে ঢুকতেই রাস্তার বাম দিকে চোখে পড়বে মণিহারকে। একসময় এলাকার সিনেপ্রেমীদের সত্যিকারের কন্ঠহারের মতো ছিল মণিহার। কিন্তু আজ জীর্ণ চেহারা নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাকের মতো। সেখ হবিবুর সাহেব জানালেন কাঠামো ভেঙে একটা মার্কেট কমপ্লেক্স গড়ার চিন্তা ভাবনা করছেন তাঁরা।


তথ্যসূত্রঃ—

সেখ হাবিবুর রহমান – গোপীগঞ্জ, দাসপুর

                 ……………… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...