Monday 15 January 2024

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ১৩


 

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা - ১৩

ভারতী টকিজ– ঘাটাল 

শ্রীজিৎ জানা 


পুণ্যতোয়া শিলাবতীর দুই প্রান্তের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে কত গল্পকথা। কত জানা অজানা ইতিহাস। বিশেষত ঘাটাল শহরের অন্দরেই কতনা মিথ। সেই প্রথম নাকি এখানে ঘাঁটি গেড়েছিল ডাচেরা। তাদের অফিস আজকের মহকুমা কার্যালয়। পরে ইংরেজদের হাতে হস্তান্তরিত হয়। তাঁরা কার্যালয়ের উল্টোপারে গড়লেন নীলকুঠি। তখনো পোনটুন্ ব্রিজ গড়ে ওঠেনি। খেয়া পারাপারের মাধ্যমে যোগাযোগ চলত। এখানেই একটি মিথ শোনা যায়। নাকি সুড়ঙ্গ পথের মাধ্যমে নদীর পূর্ব পাড় থেকে পশ্চিম পাড়ে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করেছিলেন সাহেবরা। মিথের সপক্ষে যুক্তি হল, বর্তমান মহকুমা অফিসের  (১৫ নং ওয়ার্ড, ঘাটাল পৌরসভা) উত্তরদিকের একটি সুড়ঙ্গপথ। যার মুখটি আজ প্রায় আশি নব্বই বছর সিল করে রাখা হয়েছে। তারপর তো পোনটুন ব্রিজ হল। নীলকুঠি থেকে পশ্চিমপাড়ের নাম হল কুঠিবাজার (৪ নং ওয়ার্ড,ঘাটাল পৌরসভা)। সেই কুঠিবাজার স্বাধীনোত্তর কালেই সাহেবদের কাছ থেকে কিনে নেন কলকাতার মাড়োয়াড়ী ব্যবসায়ী রামজি দাস সুরেখা,শ্রীনিবাস সুরেখা ট্রাস্টি এস্টেটের নামে। তাঁরা কুঠিবাজার এলাকায় দোকানপাট বসাতে শুরু করেন। ইত্যবসরে কয়েকজন মানুষের প্রচেষ্টায় ঘাটালে তৈরী ঘাটাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড। মনে করা হয় সেই সালটা ছিল ১৯৪১। ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড সেই স্বাধীনতা উত্তরকালে স্থাপন করলের বিনোদনের এক পীঠস্থান 'ভারতী টকিজ'। কর্পোরেশন লিমিটেডের অন্যতম অংশীদার ছিলেন তৎকালীন নামকরা আইনজীবী ভবানীরঞ্জন পাঁজা। বিশেষ সূত্র মারফত জানা যায়, 'ভারতী টকিজ  নামটি 'ভবানীরঞ্জন পাঁজা মহাশয় কর্তৃক প্রদত্ত। স্বারস্বত সাধনার দেবী স্বরস্বতীর আরেক নাম ভারতীর নামে তিনি এই নামকরণ করেন।


প্রাক স্বাধীনতা কালে 'ভারতী টকিজ' এর পথচলা শুরু বলে বরিষ্ঠ মানুষজনের মত। তখন ভারতী টকিজ সংলগ্ন নীলকুঠির চিমনি বর্তমান ছিল। শুরুর দিকে সিনেমাহল ছিল নাকি  মাটির। পর্দার অংটি এবং মেঝে চুন সুরকি দিয়ে তৈরী হয়েছিল। তখন বন্যার সময় সিনেমাহলের মেঝেতে জল ঢুকে গেলে হল বন্ধ থাকত। কিছুদিন পরে কংক্রিটের দেয়াল তুলে পাকাপোক্ত ভাবে প্রক্ষাগৃহ চলতে থাকে। মাটির হলে পর্দার সামনে চটে বসার ব্যবস্থা ছিল। তারপর থাকত চেয়ার। অনেকেই জানাচ্ছেন একেবারে শুরুর দিবকে ভারতী টকিজে পুরুষ মহিলা আলাদা বসার আসন নির্দিষ্ট ছিল। ফ্রন্ট স্টলের টিকিট মূল্য ছিল ১৯ পয়সা,মিডিল স্টলের মূলবয ছিল ৭৫ পয়সা আর রেয়ার স্টলের টিকিট মূল্য ছিল ১ টাকা। শো টাইম ছিল ৩ টা এবং ৬ টা।  পরবর্তী নতুন করে সেজে ওঠা ভারতী টকিজের শো টাইম ১২টা,৩টা এবং ৬টা ছিল। তার সিট সংখ্যা ছিল ৫২৭, ব্যালকনি সহ। সেই সময় রমরমিয়ে চলতে থাকে সিনেমাহল। হিন্দি বাংলা ছবি তো ছিলই, সাথে ঘাটালের থিয়েট্রিকেল সোসাইটির মত বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া নিয়ে বিখ্যাত সব ইংরেজি ছবি দেখানো হত। 


এখনো পর্যন্ত আলোচনার কেন্দ্রেবিন্দুতে আছে কুঠিবাজারের ভারতী টকিজ। আজকের ভৌগলিক মানচিত্র মাফিক সঠিক অবস্থান বোঝাতে গেলে বলতে হবে, যেইখানে মতি সিনেমা রয়েছে, সেখানেই ছিল ভারতী টকিজ। মানে নিউ মার্কেট প্লেস, ঘাটাল পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ড। ওই ভারতী টকিজের প্রচার ব্যবস্থাও ছিল অভিনব। ঘাটাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের নিজস্ব একটি প্রেস ছিল,যার নাম ভারতী প্রেস। সেই প্রেসে নীল-সাদ এবং লাল-সাদা রঙে ছাপা হত সিনেমার পোস্টার। উপরে কোণায় লেখা থাকত,'চলিতেছে', 'সগৌরবে চলিতেছে', 'হৈ হৈ কান্ড, রৈ রৈ ব্যাপারে' প্রভূতি শব্দবন্ধ। তবে সবচেয়ে নজরকাড়া প্রচারের মুখ ছিলেন জগন্নাথ বাবু। তিনি পায়ে হেঁটে ঘাটাল বাজার এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রচার করতেন। বিশিষ্ট আইনজীবী দেবপ্রসাদ পাঠকব্যানার্জী জানালেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা,"আমাদের তখন কিশোর বয়স। জগন্নাথ বাবু মুখে রঙ মেখে বহুরুপী সেজে পাড়ায় আসতেন। হাতে থাকত চোঙা মাইক। বুকে পিঠে থাকত বাঁশের চাঁচেসাঁটানো সিনেমার পোস্টার। হরবোলার মতো বিভিন্ন আওয়াজ করে সকলকে আকৃষ্ট করতেন। এমনকি মুকাভিনয় করে দেখাতেন। তারপর চোঙা ফুঁকে ছবির প্রচার চালাতেন"। প্রসাদবাবুর মতে "এই প্রচারের টানেই ভারতীতে দর্শকের সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে যেত। আর আমাদের মতো ছোটদের কাছে হরবোলা জগন্নাথ বাবু ছিলেন সবচাইতে বেশি আকর্ষণের"।


কুঠিবাজারের ভারতী টকিজ পরে স্থানান্তরিত হয়। তা পিছনের কাহিনী বিস্তর। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ঘাটাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের সঙ্গে সুরেখা ট্রাস্টিবোডের জসির লিজ সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ বাধে। ঘটনা গড়ায় কোর্ট অব্দি। কেসে সুরেখা ট্রাস্টি বোর্ড জেতে। কোর্টের রায় মোতাবেক ট্রডিং কর্পোরেশন লিমিটেড তাদের ভারতী টকিজের কাঠামো ভেঙে দেন ১৯৭৩ সাল নাগাদ। আর পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে ঘাটালের কৃষ্ণনগর (৩ নং ওয়ার্ড, ঘাটাল পৌরসভা) অঞ্চলে নিজস্ব জায়গায় পুনরায় গড়ে তোলেন ভারতী টকিজ। শিলাবতীর পাশেই সুন্দর করে সাজিয়ে তোলেন তাঁরা। নবনির্মিত ভারতী টকিজের প্রথম ছবি ছিল 'চৈতন্য মহাপ্রভু'। তারাশঙ্কর পাল, বিজন গুঁই,ফণীন্দ্র পাল প্রমুখরা চিফ অপারেটর এবংয অ্যাসিস্ট্যান্ট অপারেটরের কাজ করতেন। তখন আর জগন্নাথ বাবু নেই। এই হলে প্রচারের একমাত্র মাধ্যম ছিল পোস্টার। রাধু রুইদাস পোস্টারিংয়ের কাজ করতেন। তবে মাঝেসাঝে মাইক প্রচারও হত। নতুন ভারতীর শো টাইম ছিল ১টা,৪টা এবং ৭টা। প্রেক্ষাগৃহের সিট সংখ্যা ছিল ৮০০,স্টাফ ছিল ৩২ জন। ভারতীর নাম দূরধূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর বাংলা ছবি প্রদর্শনের জন্য। এই সিনেমাহলের ব্লকবাস্টার হাউসফুল ছবিগুলি হল 'অন্যায় অবিচার',  'অনুসন্ধান' এবং 'বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না'। এই প্রত্যেকটি ছবি ছ'মাস করে চলেছিল।

ঘাটাল শহরের বিশিষ্ট কবি ও শিক্ষিকা মহাশ্বেতা দাস জানালেন ভারতী টকিজকে নিয়ে তাঁর সেদিনের স্মৃতি, "ভারতী সিনেমাহলে আমার প্রথম দেখা ছবি 'ভালবাসা ভালবাসা'। তবে ভারতীতে সিনেমা দেখার বাইরে আরেকটা বিষয় হল,যখন যতীশচন্দ্র স্মৃতি সদন (ঘাটাল টাউন হল) হয়নি তখন "বীণাপাণি কলাকেন্দ্র" সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক অনুষ্ঠান হত ভারতী প্রেক্ষাগৃহে। ছোট বয়েসে ওই পর্দা ঘেরা মঞ্চে, যেখানে সিনেমা দেখানো হয়,সেখানে আমরা নাচগান করছি,তার আনন্দই ছিল আলাদা"। পাশাপাশি ঘাটাল শহরের আরেকজন বিশিষ্ট শিক্ষিকা ইতি মণ্ডল জানালেন তাঁর স্মৃতির কথা, "একসময় ভারতীতে ছিল মহিলাদের জন্য স্পেশাল একটি গেট। আসলে সিনেমাহলের স্টাফ কার্ত্তিক দাস মারা গেলে তাঁর স্ত্রী গীতা দাস ওই গেটকিপারের কাজে যোগ দেন। এক পাড়ায় থাকতাম বলে ভাল সিনেমা এলে তার সৌজন্যে দিব্যি নির্ঝঞ্ঝাটে দেখা হয়ে যেত"। 

ভারতী সিনেমাহলের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট ব্যবসায়ী উত্তম মালাকার মহাশয়ের দেয় তথ্য থেকে জানা যায়,যখন সিনেমাহলে করমুক্ত ছবি আসত তখন দু'টাকা মূল্যের টিকিটের বিনিময়ে ছবি প্রদর্শিত হত। 'বিদ্যাসাগর', 'শহর থেকে দূরে' প্রভৃতি ট্যাক্স ফ্রি সিনেমা ভারতী টকিজে চালানো হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে দর্শক সংখ্যায় ভাটা পড়তে থাকে। আয়ের চেয়ে ব্যয় অধিক হতে থাকায় সিনেমাহল বন্ধের কথা ভাবতে বাধ্য হয় ঘাটাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের অংশীদাররা। অবশেষে ২০১৮ সালে ভারতী টকিজে ছবি প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রাচীর ঘেরা তালাবন্দী আজকের ভারতী টকিজ। ঘাড় উঁচিয়ে দেখতে হয় তার ভেতরের বর্তমান অবস্থা। কিন্তু দৃষ্টি উঁচু প্রাচীর টপকাতে পারে না।অগত্যা পাশের চা দোকানের আড্ডায় খোঁজ নিলে স্মৃতি হাতড়ে টুকরোটাকরা ছবির হদিশ দেয় অনেকেই। সেইটুকুই প্রাপ্তি।


তথ্যসূত্র :—

দেবপ্রসাদ পাঠকব্যানার্জী,  আইনজীবী, ঘাটাল

মহাশ্বেতা দাস, বিশিষ্ট শিক্ষিকা, ঘাটাল

ইতি মণ্ডল, বিশিষ্ট শিক্ষিকা, ঘাটাল

উত্তম মালাকার, বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী, ঘাটাল

                     …………………… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...