রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ৪৫
শেষ কথা কে বলবে
মহাশ্বেতা দাস
"সাঙ্গ হয়ে এল পালা
নাট্যশেষের দীপের মালা
নিভে নিভে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে;
রঙিন ছবির দৃশ্যরেখা
ঝাপসা চোখে যায় না দেখা,
আলোর চেয়ে ধোঁয়া উঠছে জমে।"
প্রদীপে যে আর তেল নেই….. ফুরিয়ে আসছে একটু একটু করে। চিকিৎসা, সেবা… কোন কিছুর ত্রুটি নেই। তবু দেহ আর চলছে না। চিকিৎসকরা পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন কবির অস্ত্রপ্রচারের। অস্ত্রপ্রচার হবে কলকাতায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। দিনক্ষণ স্থির করা হলো ২৫শে জুলাই কবিকে নিয়ে যাওয়া হবে কলকাতায়।
দূরদর্শী মহামানবের বুঝতে বাকী রইলো না-
'সময় হয়ে এল এবার,
স্টেজের বাঁধন খুলে দেবার।'
শান্তিনিকেতনের সাথে কবির বাঁধন কী আজকের! শৈশব, যৌবন, প্রৌঢ় ও বার্ধক্য…. কবির জীবনের সমস্ত অবস্থার স্মৃতি জড়িয়ে আছে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে। দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে গাঁথা হয়েছে যে স্মৃতির মালা- তার বাঁধন খুলতে গেলে তো বাজবেই!!
১৯৪১ সালের ২৫শে জুলাই (৯ই শ্রাবণ) ভোরবেলায় কবি পোশাক পরে তৈরী হয়ে বসে আছেন উদয়ন গৃহের পূব জানালার ধারে। যেন শেষবারের মতো তাঁর প্রাণপ্রিয় শান্তিনিকেতনের রূপ- রস- গন্ধ কে প্রাণ ভরে গ্রহণ করছেন । আশ্রমের ছেলেমেয়ের দল দেখা করতে এসে জানালার ধারে গিয়ে গাইল-
"এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার"।
কবির মন ক্রমশ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। শরীর তো অনেকদিনই খারাপ। আজ তার সাথে পাল্লা দিয়ে খারাপ কবির মন। চোখের জল আড়াল করতে কবির চোখে আজ কালো চশমা। তবু কোপাইয়ে বান এলে তা কী আর কারো বারণ মানে! সবকিছু ঠেলে শুষ্ক গাল বেয়ে নেমে এল মুক্তোদানার মতো অশ্রুধারা। আশ্রমের ছেলেমেয়েরা এবার গাইল-
"আমাদের শান্তিনিকেতন,
সে যে সব হতে আপন।"
যাওয়ার আগে মোটরগাড়িতে চেপে শান্তিনিকেতন আশ্রমের সবার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ। গাড়িতে করেই গোটা আশ্রম ঘোরানো হলো কবিকে। আশ্রমের চিকিৎসক শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে ডেকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন….. 'শচী, আমার আশ্রম রইল, আশ্রমবাসীরাও রইলেন। তুমি দেখে রেখো।'
স্ট্রেচারে করে কবিকে গাড়িতে তোলা হলো। উপাসনা গৃহ, ছাতিম তলা, আম্রকুঞ্জ পেরিয়ে গাড়ি গড়িয়ে চলল স্টেশনের দিকে। তাদের অতি প্রিয় মানুষটিকে চোখের জলে শেষ বিদায় জানাতে রাস্তার দুপাশে ভীড় করে দাঁড়িয়ে রইলো বোলপুরের বাসিন্দারা। স্টেশনে এসে অতি সাবধানে কবিকে তুলে দেওয়া হল রেলের নির্দিষ্ট কক্ষে। ১৮৭৩ সালে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ১১ বছর ৯ মাস বয়সে ছিল কবির জীবনের প্রথম রেল যাত্রা, হাওড়া থেকে বোলপুর। … আর জীবনের শেষ রেল যাত্রা ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই, বোলপুর থেকে হাওড়া। আশ্চর্যজনক ভাবে কবির দীর্ঘ জীবনের প্রথম ও শেষ রেলযাত্রা একই পথে! এ যেন, কবির জীবনের যাত্রা-পথ এভাবেই এক সুরে বেঁধে দিল রেলের বন্ধনহীন গ্রন্থি! গাড়ী বোলপুর স্টেশন ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল হাওড়ার দিকে--
"তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ,
তাই তব জীবনের রথ
পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার
বারম্বার।"
বেলা ৩টা ১৫ মিনিটে রবীন্দ্রনাথ এলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। কবির কলকাতা আসার খবরটা সাধারণ মানুষের কাছে গোপন রাখায় স্টেশনে কিংবা বাড়িতে বিশেষ ভিড় ছিল না। পুরোনো বাড়ির দোতলায় ‘পাথরের ঘর’-এ স্ট্রেচারে করে কবিকে নিয়ে যাওয়া হলো।
…………………….
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment