Wednesday 29 November 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৪৬

 



রবীন্দ্র পরম্পরা 

পর্ব - ৪৬ 

শেষ প্রশ্ন, তবু মেলে নি উত্তর

মহাশ্বেতা দাস 


     ২৫শে জুলাই ১৯৪১ সাল, রবীন্দ্রনাথ চিরতরে তাঁর প্রাণের শান্তিনিকেতন ছেড়ে  জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে চলে এলে  মহর্ষি ভবনের দোতলায় 'পাথরের ঘরে' কবির থাকার বন্দোবস্ত হল। 

   

      পরের দিন, অর্থাৎ ২৬শে জুলাই কবির কাছে এলেন প্রাণ প্রিয় ভাইপো 'অবন'। সেদিন কাকা- ভাইপো আলাপচারিতায় বোধয় স্মরণ করেছিলেন অতীত দিনের অনেক স্মৃতি…. 

              

        ঠাকুর বাড়ির দুই সন্তান, বয়সের ফারাক মোটে দশ বছর হলেও তাঁরা সম্পর্কে কাকা- ভাইপো। সম্পর্ক যাইহোক জীবন সমুদ্রে একাধিক দিক থেকে তাঁরা ছিলেন পরস্পর দোসর। 

          জীবনের শুরুতে একজনের হাতে কলম আর একজনের হাতে তুলি। কিন্তু যিনি সবসময় অনেক কিছুতেই মেলবন্ধন ঘটিয়ে এসেছেন সেই বিশ্বের বিস্ময় কবিগুরু এবারেও পারেন নি থেমে থাকতে! 'অবন' কে যে তাঁর চাই-ই-চাই। সুযোগ বুঝে ডেকে নিয়েছেন নিজের কাছে নিজের কাজে।

             

         ১৮৯২সাল , লিখলেন কাব্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা । লেখার সময়ই অবনীন্দ্রনাথের উপর নির্দেশ এলো ছবি দেওয়ার জন্যে । অবনীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন,- "....এই হল রবিকাকার সঙ্গে আমার প্রথম আর্ট নিয়ে যোগ । তারপর থেকে এতকাল রবিকাকার সঙ্গে বহুবার আর্টের ক্ষেত্রে যোগাযোগ হয়েছে, প্রেরণা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে । আজ মনে হচ্ছে আমি যা কিছু করতে পেরেছি তার মূলে ছিল তাঁরই প্রেরণা ।"

         

          এখানেই শেষ নয়! ছোটদের উপোযোগী লেখা চাই । কবি লক্ষ্য করেছেন অবন ভালো গল্প বলতে পারে। প্রিয় অবনকে বললেন- "তুমি লেখো না, যেমন করে তুমি মুখে মুখে গল্প কর তেমনি করেই লেখো ।"  তুলির আঁচড়ে দাগ টানার মতোই অবন এবার হাতে তুলে নিলেন কলম….. লিখলেন 'শকুন্তলা' । রবীন্দ্রনাথ লেখাটির প্রশংসা করলেন। এরপর প্রবল উৎসাহে অবনীন্দ্রনাথ পর পর লিখে ফেললেন ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী, বুড়ো আংলা ইত্যাদি।

     

      রবীন্দ্রনাথের রাখিবন্ধন উৎসব থেকে স্বদেশী আন্দোলন- সবেতেই অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন কবির অন্যতম সঙ্গী ও উদ্যোক্তা।

            



             অন্যদিকে ৭ই আগস্ট অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। ঠাকুরবাড়ির প্রথা অনুসারে জন্মাষ্টমীর দিনই জন্মদিন পালন করা হত। এই উপলক্ষে একবার রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেতেই ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় কলাভবনের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী মিলে পালিত হয়েছিল অবনীন্দ্র জয়ন্তী। 

         

           মনুষ্যজন্ম মানেই সুখ দুঃখে ভরা জীবন। আর এই জীবনে হাজারও প্রশ্ন থাকবে আজীবন ধরে এটা যেমন  স্বাভাবিক তেমনই সব প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যায় না বোধয় আজীবন ধরে, সে সাধারণ মানুষ হোক বা বিশ্বকবি! প্রশ্নের ধরণ আলাদা হলেও উত্তর মেলা বা না মেলার ক্ষেত্র টি বোধয় একই রকম। 


     শ্রাবণের আকাশ মানেই কখনও মেঘের ঘনঘটা আবার কখনও রৌদ্রজ্জ্বল দিন। কিন্তু ১৯৪১ সালের শ্রাবণের আকাশে মেঘের ঘনঘটার প্রাবল্য  ছিল বোধয় খুব বেশী। রবির আলো ক্ষীণ.... নিভু নিভু প্রায়। 

  

        জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে  "পাথরের ঘরে" কবি কাটিয়ে দিয়েছেন দু-দুটি দিন। "সময়ের হৃদয় হরণ" করা তো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়.... কিন্তু জীবন-প্রদীপের আলোও  শ্রাবণমেঘে ঢাকা সূর্যের মত ক্রমশঃ ক্ষীণ হচ্ছে।  তাই বলে আজীবন সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, ভ্রমণে- কর্মব্যস্ততায় যাঁর কলম থেমে থাকেনি ফুটিয়েছে শত শত ফুল....  কবির সে কলম আজও থেমে থাকল না! রোগশয্যায় শায়িত কবি তাই নিজের ভাবনা ছন্দে বেঁধে আমাদের উপহার দিয়ে চললেন একের পর এক কবিতা। নিজে আর কলম ধরতে পারেন না। তাই কবি মুখে মুখে বলে চলেন আর সেগুলি লিখে রাখেন কবির ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দ'র স্ত্রী,  রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ভাজন রাণী চন্দ। এভাবেই ১৯৪১সালের ২৭ শে জুলাই  ঠাকুরবাড়িতে বসে কবি  "প্রথম দিনের সূর্য"  কবিতাটি আমাদের উপহার দিলেন। 


     দূরদ্রষ্টা, মহামানব আজীবন ঈশ্বরে যাঁর অগাধ বিশ্বাস, উপনিষদের মন্ত্র যাঁর জীবনের মূল মন্ত্র তিনিও হয়তো নিজে …   

                 "কে তুমি?" 

  

       এই প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারেন নি!!! 


        কে তুমি? - এই একটি প্রশ্নের মধ্যেই রয়েগেছে অনেক বড় একটি জীবন জিজ্ঞাসা! কবি আসলে কাকে  প্রশ্ন করছেন? ….. ঈশ্বর? না সূর্যকে প্রশ্ন করছেন? না কি প্রশ্ন করছেন নিজেকেই নিজে ? যা ধরা দিচ্ছে কখনো ঈশ্বরের হিসেবে.. কখনো মহাকাল.. আবার কখনো বা আমাদের আত্মা হয়ে  দাঁড়াচ্ছে সম্মুখে। আর আমরা তখন যেন নিজেকেই প্রশ্ন করছি- কে আমি?


    প্রসঙ্গত মনে পড়ে  সক্রেটিসের সেই বিখ্যাত উক্তি- "নিজেকে জানো" । নিজেকে জানার চেষ্টা মানব জাতির ইতিহাসে অনেক পুরানো। মনীষীরা বারবার বলেছেন- নিজেকে জানো.. নিজেকে খোঁজো.. নিজের মধ্যেই তুমি স্রষ্টাকে খুঁজে পাবে..

কিন্তু আমরা সারাজীবন ধরে কতটুকু বা নিজেকে জানতে পারি??

     

       কবিও পারেন নি। আর তাই…..

     

            রয়ে গেল "শেষ প্রশ্ন"!

            পেল না উত্তর.....! 


                  ………………….. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...