Thursday 30 November 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ১০

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ১০

মল্লিকা - বকুলতলা, দাসপুর -১ ব্লক

শ্রীজিৎ জানা


কুলতলা জায়গার নাম হয়েছে বকুল গাছ থেকে। সরকারি নথিতে বকুলতলা মৌজা কোত্থাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আসলে ওই স্থানটি মামুদপুর ( জে এল নং-৬১)  গ্রামের অন্তর্ভুক্ত। তবে যেই সুবিশাল মনোরম বকুল গাছের নামে বকুলতলার নাম,সেই গাছটি আজকে আর নেই। অনেকের স্মৃতিপটে অথবা অনেকের অ্যালবামে থেকে যেতে পারে সেই ঘন সবুজ পাতায় সাজানো সুদৃশ্য বকুল গাছের ছবি। কিন্তু গাছ নিয়ে এত কথা বলছি কেন! এমন তো অনেক জায়গার নাম গাছের নামেই চেনে সকলে। তেঁতুল গাছ থেকে তেঁতুলতলা,বেল গাছ থেকে বেলতলা এরকম ঢের আছে মশাই। তা অবিশ্যি আছে কিন্তু এই বকুলতলা  এমন একটা ঠিকানা যেখানে একসময় গমগম করত লোকসমাগমে। অগুন্তি সিনেপ্রেমীদের ভিড়ে ভিড়াক্কা বকুলতলা চত্বর। ছুটন্ত বাস হঠাৎ থমকে যেত এখানে। আর স্রোতের মতো মানুষ দৌড় লাগাত ঘাটাল- পাঁশকুড়ো সড়কের পুব দিকে সিনেমাহলের দিকে। আজ সেইসব সোনালী দিন শুধুই স্মৃতি।


আজকের বকুলতলা জমজমাট বাসস্টপ। তেমাথার মোড়। কিন্তু ষাটের দশকে এই স্থান ছিল জঙ্গলাকীর্ণ।  তখনো ঘাটাল - পাঁশকুড়া পিচের সড়ক হয়নি। আনুমানিক ১৯৬৭ সালের শেষ দিকে পিচ সড়ক হয়। যদিও খুকুড়দহতে তখনো খেয়া চলত। অর্থাৎ যাকে বলে কাটা সার্ভিস। এদিকে ঘাটাল থেকে বাস খুকুড়দহ অব্দি যেত। সেখানে খেয়া পেরিয়ে ওইপার থেকে পুনরায় বাস ধরতে হত। আর এদিকে মেদিনীপুর থেকে নাড়াজোল  বাস চলাচল করলেও,তা বকুলতলা অব্দি চালু ছিল না। ঠিক এই সময়ে মামুদপুর মৌজায় কানাই প্যোড়া সহ আরো অন্য ক'জন অংশীদারদের কাছ থেকে সড়ক সংলগ্ন ছিয়ানব্বই শতা জায়গা কিনলেন তৎকালীন ঘাটাল নিবাসী সুধীর পাল। উদ্দেশ্য ছিল পেট্রোল পাম্প করবেন। কিন্তু তাঁর প্রথম থেকেই সিনেমাহল ব্যাবসার প্রতি মারাত্ম ঝোঁক ছিল। সেই ঝোঁক বশত ওই স্থানে গড়লেন 'জনতা' নামের সিনেমাহল। 'জনতা' সিনেমাহলের যাত্রা শুরু আনুমানিক সত্তরের শেষের দিক ধরা যেতে পারে। কিন্তু জনতা হলের যাত্রাপথ খুব বেশি এগোয়নি। মাত্র বার বছরের তার যাত্রাকাল। এর মধ্যে জনতা প্রেক্ষাগৃহের কাঠামোর অনেক ভাঙন গড়নের পর্ব চলে।পরে জায়গা সহ প্রেক্ষাগৃহ হস্তান্তর হয়। আশির দশকে পাল পরিবারের কাছ থেকে প্রায় নয় - দশ লাখ টাকায় জায়গা সমেত সিনেমাহল কিনে নেন আশুতোষ মাইতি, বাড়ি কামালডিহি,হরেকৃষ্ণপুর,দাসপুর। দিল্লী প্রবাসী বিশিষ্ট স্বর্ণ ব্যবসায়ী আশুতোষ মাইতি এন্ড ব্রাদার্স নতুন করে শুরু করলেন সিনেমাহল। পূর্বের 'জনতা' সিনেমাহলের নাম বদলে রাখলেন 'মল্লিকা'। আশুতোষ বাবুর একমাত্র মেয়ের নামে নাম হল 'মল্লিকা' সিনেমাহল।


সালটা ১৯৮৭, শুভ মহরত হল মল্লিকা সিনেমাহলের।  প্রথম ছবি 'বেহুলা লখীন্দর'। এরই মাঝে নাড়াজোল - দাসপুর সড়ক যোগাযোগ চালু হয়ে গেছে। মল্লিকায় উপচে পড়া সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের ভীড়। নতুন নতুন হিট বাংলা ও হিন্দি সিনেমার টানে ছুটে আসছে দর্শক। তার উপরে বেশ পরিপাটি সিনেমাহল বলা-ই যেত মল্লিকা প্রক্ষাগৃহকে। দর্শক আসনও নেহাত কম ছিল না। ফ্রন্ট স্টলে ১০৬টি, মিডিল স্টলে ২৩৬টি,রেয়ার স্টলে ২৬৭টি এবং ব্যালকনির ২২৪ টি সিট মিলে মোট আসন ছিল ৮৩৩ টি। শুরুতে ফ্রন্টে  এক টাকা নব্বই পয়সা,মিডিলে দু'টাকা পঞ্চাশ পয়সা,রেয়ারে তিন টাকা পঞ্চাশ পয়সা টিকিটের মূল্য ছিল। ব্যালকনির টিকিট মূল্য ছিল চার টাকা পঞ্চাশ পয়সা। স্পঞ্জের গদি বসানো ফোল্ডিং চেয়ারে বসে দুর্দান্ত সাউন্ড সিস্টেমে আর বড় পর্দায় দর্শক উচ্ছ্বসিত হত মল্লিকা সিনেমা হলে ছবি দেখে।  মল্লিকা সিনেমাহলে জাপানী কোম্পানির  সাউন্ড সিস্টেম বসিয়ে ছিলেন মাইতি ব্রাদার্স। তৎকালীন সময়ে যার অর্থ মূল্য ছিল প্রায় পঞ্চান্ন হাজার টাকা।  একের পর এক সিনেমা কয়েক সপ্তাহ ব্যাপী হাউসফুল হয়েছে এই মল্লিকায়। প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি অভিনীত 'প্রতিবাদ' ছবি চলে ১৫ সপ্তাহ,যা মল্লিকা সিনেমাহলের ক্ষেত্রে ছিল রেকর্ড সৃষ্টিকারী।  একইভাবে 'যুদ্ধ' ছবি চলে ১০ সপ্তাহ,'সঙ্গী' ১৩ সপ্তাহ,'লাল পান বিবি' ১০ সপ্তাহ, শ্বশুর বাড়ি জিন্দাবাদ ৮ সপ্তাহ এবং 'সজনি গো সজনি' বই চলে ৭ সপ্তাহ। বাংলা ছবির পীঠস্থান বলা যেতে পারে মল্লিক্ সিনেমাহলকে। হলের দীর্ঘদিনের ম্যানেজার আলোক মন্ডলের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে সেদিনের মল্লিকা সিনেমাহলের কথা-" সজনি গো সজনি সিনেমা চলাকালীন মল্লিকায় আসেন ওই সিনেমার নায়ক সঞ্জীব দাসগুপ্ত এবং শিশু অভিনেতা মাস্টার রিন্টু। এমনকি পরিচালক তরুণ মজুমদার মহাশয়ও আসেন সাথে। সেদিস হলের সামনে মাথা গোনা যাবে না এমন ভীড়"। 


মল্লিকা সিনেমাহলের চিফ অপারেটর ছিলেন রণজিৎ রণ ( বরদা,ঘাটাল)।  রাজা কোম্পানীর প্রোজেকশান মেশিন সিনেমাহল মালিক শুরুতেই কেনেন। প্রথম দিকে স্টাফ ছিলেন ছাব্বিশ জন,শেষে কমতে কমতে ঊনিশ জনে নামে। ছবি আসত ধর্মতলার তিন নম্বর স্যাকলাথ প্লেস থেকে। ব্রোকার ছিলেন থড়ার নিবাসী নিমাই পাঁজা। প্রথম দিকে ২/ ৫ / ৮ টার শো চলত মল্লিকায়। কিন্তু নাইট শোতে লস হওয়ার দরুণ মালিক পক্ষ ভাবনা চিন্তা করে শো-টাইম ১২ / ৩ / ৬ টা করে দেন। ছবিরশুরু এবং  মাঝে বিরতি পর্বে চলত বিজ্ঞাপন। রসিকগঞ্জের মুস্তাফা ধূপ,তারা ব্যাটারি,ঘাটালের বিখ্যাত নাগের মিঠা পান নামক পানস্টলের বিজ্ঞাপন দেখানো হত মাসিক তিনশ ( ফ্লিম) ও পঞ্চাশ টাকার ( স্লাইড) বিনিময়ে।

 ওদিকে ঘাটাল এদিকে খুকুড়দহ সহ পশ্চিমে নাড়াজোল অব্দি পোস্টারিংয়ের মাধ্যমে ছবির প্রচার করতেন পাঁজ জন স্টাফ। ন্যূনতম টিকিট মূল্যে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের দেখানো হত শিক্ষামূলক সিনেমা। প্রতিবেদক নিজেও এই হলে ছাত্রাবস্থায় দেখেছে 'সবুজ দ্বীপের রাজা' সিনেমা। বিভিন্ন মিটিং ও সভার কাজেও শো - টাইমের পূর্বে মল্লিকা সিনেমাহলকে কখনো ভাড়ায়,কখনো বিনা মূল্যে ভাড়ায় দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন ম্যানেজার আলোকবাবু। সেইসাথে জানালেন আরও একটি ঘটনা। সুরিন্দর ফ্লিমসের সুরিন্দর সিং, নিসপাল সিং ( বর্তমানে যিনি অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিকের স্বামী) প্রায়শই আসতেন চন্দ্রকোনার ভগবন্তপুর গুরুদ্বারে। আর যাত্রাপথে অবশ্যই কিছুটা সময় কাটাতেন এই মল্লিকা সিনেমাহলে। তাঁদের প্রোডাকশন হাউসের সঙ্গে ছিল মাইতি ব্রাদার্সের বিশেষত আলোক বাবুর খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সুরিন্দর ফ্লিমস্ প্রোডাকশনের সমস্ত ছবিই চলেছে মল্লিকা সিনেমাহলে।



কিন্তু সময়ের সাথে কোথায় হারিয়ে গেছে মল্লিকা সিনেমাহলের সেইসব উজ্জ্বল দিন। অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে প্রক্ষাগৃহ চললেও শুধু এলাকার নয়,বহু দূর-দূরান্তের সিনেমা পাগল বাঙালিদের প্রিয় ঠিকানা ছিল মল্লিকা। স্কুল কলেজের ক্লাস বাঙ্ক করে ম্যাটিনি শোতে কোনার সিটে বসে কত যুগল তাদের সোনালী মুহুর্ত যাপন করেছে মল্লিক্য়। আলোক বাবু আক্ষেপ করে জানান, " টিভি,ভিডিও,মিনি পর্দার রমরমা  সিনেমাহলের ক্ষতি করেছে,কিন্তু এইসবের সাথে মল্ৰিকার ক্ষতি করেছে স্টাফেদের ইউনিয়নবাজি"। মাঝে বেশ কিছুদিন মল্লিকা সিনেমাহল লিজে দিয়ে চালান মালিক পক্ষ। অবশেশে ২০০৮ সালের জুন- জুলাই মাস নাগাদ মল্লিকা সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যায়। তবে আজও দাঁড়িয়ে আছে তার কাঠামো। ভেতরে আজও পর্দা চেয়ার মেশিন সবই রয়েছে।  কিছু বিক্রি করেননি মালিকপক্ষ। তবে কান পাতলে শোনা যাবে হয়তো বোবা কান্না।


তথ্যসূত্র 

১.শ্রী আলোক মন্ডল, রাধাকান্তপুর।

২. শ্রী মোহন বেরা, দাসপুর।

৩.শ্রী বিদ্যুৎবিকাশ শাসমল,দাসপুর।

                     …………………. 



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪




No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...