Tuesday 13 June 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ২৩

 



রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ২৩

রবি-পরিণয়

মহাশ্বেতা দাস


   "ধরাতলে দীনতম ঘরে 

 যদি জন্মে প্রেয়সী আমার, নদীতীরে

কোন এক গ্রামপ্রান্তে প্রচ্ছন্ন কুটিরে

  অশ্বত্থ ছায়ায়, সে বালিকাবক্ষে তার

  রাখিবে সঞ্চয় করি সুধার ভান্ডার

    আমারি লাগিয়া সযতনে।" 


   ছোট দেবর টি দেখতে দেখতে বাইশ বছরের হয়ে গেছে… এবার তো তাঁকে সংসারী করে দেওয়া বৌঠানদের একরকম দায়িত্ব ও কর্তব্য! জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, কাদম্বিনী দেবীর চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো এমনই সব ভাবনা। তাছাড়া জ্যোতিদাদা আর নূতন বৌঠানের ছত্রছায়ায় থাকলে রবি কোন দিনই দায়িত্ববান হবেন না, জমিদারির দায়ভার ও দেওয়া যাবে না! তাই তাঁকে সংসারী করে দেওয়া কর্তব্য…. এমন ভাবনা মহর্ষির মনেও উঁকি দিয়েছিল। আর তাই, রবির জন্যে শুরু হয়ে গেল পাত্রীর খোঁজ।  

   

    এ বিশ্ব-সংসারে রবির মতো প্রতিভাবান পাত্রের জন্য সুযোগ্য পাত্রীর অভাব অলভ্য না হলেও পিরালি ব্রাহ্মণ সমাজে এমন সুশিক্ষিত গুণসম্পন্না পাত্রী যথেষ্টই দুর্লভ ছিলো। শেষ পর্যন্ত জ্ঞানদানন্দিনী দেবী জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তার কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর মেয়ে ফুলি ওরফে ভবতারিণী কে রবির জন্য পছন্দ করে শ্বশুরমশায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কে একথা জানান। মহর্ষির সম্মতি এবং রবীন্দ্রনাথের মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী দেবীর ঘটকালিতে বিয়ের জন্য ওখানেই মনস্থির করা গেল।  

    

     দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মের প্রাণপুরুষ হলেও এক্ষেত্রে খুলনা জেলার হিন্দু বিবাহ রীতি অনুযায়ীই বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বললেন। সেসব ঠিকই ছিল..… কিন্তু রবির ইচ্ছে কন্যাহ্বানে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। অর্থাৎ পাত্র শ্বশুরালয়ে যাবে না বিয়ের জন্যে…. উল্টে পাত্রীকে আহ্বান করে নিয়ে আসা হবে এখানে। ঠাকুর পরিবারের ছোট ছেলের বিয়ে বলে কথা…. তার উপর লেখালেখিতে সে এখন  যথেষ্ট যশস্বী। দেবেন্দ্রনাথ তাই পাত্রীর বাড়ীর আত্মীয় স্বজনদের সবাইকে কলকাতায় এনে রাখলেন একটি ভাড়া বাড়িতে। গায়ে হলুদ, আইবুড়োভাত এসব অনুষ্ঠানের সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরোয়া এবং ইন্দিরাদেবীর লেখনীতে। আইবুড়োভাতের দিন রবীন্দ্রনাথ এমন জমকালো রঙের শাল জড়িয়েছিলেন ইন্দিরা দেবীর কথায়- "একে রবিকা তায় এই সাজ! সে শুধু আমরাই দেখে নিয়েছি।" অবনীন্দ্রনাথের কথা অনুযায়ী সেদিন তাঁর রবিকা কে লাগছিল 'দিল্লির বাদশা'! 


   এসবের পর একদিন অর্থাৎ ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১২৯০ ( ৯ই ডিসেম্বর, ১৮৮৩) জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে রবীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালেন অন্দরমহলে বিয়ের পিঁড়িতে। ঠাকুর বাড়ির রীতি অনুযায়ী একখানা বেনারসি শাল বংশ পরম্পরায় যেটা বর সজ্জার অন্যতম উপকরণ হতো ….  রবীন্দ্রনাথ ও সেদিন সেই শাল গায়ে জড়িয়ে বর সজ্জা সম্পন্ন করেছিলেন। 

    

     যদিও এই বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ থেকে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর মতো ঠাকুর পরিবারের অনেক সদস্য এবং রবির প্রিয়জনেরা। টুকরো টুকরো অনেক কারণের মধ্যে যে ঘটনাটি ভীষন ভাবে উল্লেখ্য… ঐ দিন শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়ো বোন সৌদামিনী দেবীর স্বামী সারদা প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় মারা যান। মহর্ষি যাকে পুত্রতুল্য স্নেহ করতেন… এই ঘটনা মহর্ষির মনে দারুণ রেখাপাত করে। 

     

      কেবলমাত্র পিরালিত্ব ছাড়া দুই পরিবারের মধ্যে কোন মিল তো ছিলই না আর রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভাবান, সুদর্শন, সুপুরুষের কাছে পাত্রী হিসেবে অতি সাধারণ ভবতারিণী তো বলার  অপেক্ষা রাখেই না! যাইহোক…. এভাবেই অত্যন্ত সাদামাটা ভবতারিণী একদিন ঠাকুর পরিবারের বধূ হয়ে এলেন। কিন্তু "ভবতারিণী" নামটি তো এখানে, ঠাকুর পরিবারে অচল! যেমন করে কাদম্বিনী দেবী হয়েছিলেন কাদম্বরী দেবী…. ভবতারিণীর ও নাম পাল্টে রাখা হলো মৃণালিনী। রবি ই তাঁর প্রিয় নাম নলিনী'র প্রতিশব্দ রূপে নাম রাখলেন মৃণালিনী। 

     

    কিন্তু শুধু নাম পরিবর্তন করলেই তো হলো না…. শিক্ষা, সংস্কৃতি সব দিক থেকেই তাঁকে ঠাকুরবাড়ির উপযুক্ত করে তুলতে হবে। রবি অগ্রজ হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী নীপময়ী দেবী দায়িত্ব নিলেন রবিপত্নীর স্বাস্থ্য ও শিক্ষার। এভাবে ঠাকুর বাড়ির তত্ত্বাবধানে এবং রবি-স্নেহে ধীরে ধীরে 'ভবতারিণী' হয়ে উঠলেন 'মৃণালিনী'। 

     

    যদিও স্বল্পায়ু ছিলেন মৃণালিনী দেবী। জগৎ খ্যাত প্রতিভাবান, ধনবান, রূপবান স্বামীর স্নেহডোর বেশীদিন তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি এই মর্ত্যলোকে! রবির স্নেহের আদরের  "ভাই ছুটি" র ছুটি হয়ে গেছিলো বড্ড তাড়াতাড়ি! …. তবু রবীন্দ্রনাথের নানান কর্মপ্রচেষ্টায় তিনি ছিলেন সহচরী, সহযোগী। রবীন্দ্রনাথের প্রাণাধিক প্রিয় শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠায় কবি সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবীর অবদান ছিল অপরিসীম।

                  …………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


No comments:

Post a Comment

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...