Tuesday 20 June 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ২৪


 রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব- ২৪

নক্ষত্র পতন

মহাশ্বেতা দাস



      রবির বিয়ের পাঁচমাস যেতে না যেতেই ঠাকুর পরিবারের উপর দিয়ে তো বটেই রবীন্দ্র জীবনেও বয়ে গেল এক বড়সড় ঝড়। যে ঝড় অনেকখানি লণ্ডভণ্ড করলো কবি হৃদয় এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা। সাহিত্য সৃষ্টি, সমালোচনা, সঙ্গীতের জগৎ এসব তো বাইরের জগতে আচ্ছন্ন কিন্তু পারিবারিক সমস্যা, স্নেহ, অন্তরঙ্গতা, সখ্যতা… এসব তো মানুষ রবীন্দ্রনাথের একান্ত মানসলোকের কথা! সেখানে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই দুঃখ আছে, যন্ত্রণা আছে….আছে স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথা। 


    রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘ জীবনে মৃত্যু দেখেছেন অজস্র। স্বজন বিয়োগ বারেবারে ভারাক্রান্ত করেছে কবি হৃদয়। স্বল্পায়ু অনুজ বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু এবং মাতৃবিয়োগ (সারদা দেবীর মৃত্যু) সেভাবে অনুভব করতে পারেননি কারণ তখন কবির বয়স ছিল খুবই অল্প। তবে যে মৃত্যু কবিকে জীবনের প্রথম মৃত্যুর নিষ্ঠুরতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো ..... দীর্ণ বিদীর্ণ করলো কবিহৃদয়কে পরম বিচ্ছেদের বেদনায়!!- তা হলো তাঁর নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর অকাল প্রয়াণ। 

      

        কৈশোরের খেলার সাথী, যৌবনের লীলা সঙ্গিনী.... রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রধান অনুপ্রেরণা ও সমঝদার রবি জীবনের ধ্রুবতারা নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর এই মৃত্যু সম্পর্কে তিনি বলেছেন....


''আমার ২৪ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইয়াছিলো তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদ-শোকের সঙ্গেই মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাথিঁয়া চলিয়াছিল।"


       কবির মনের মণিকোঠায় চিরকালের জন্যে অধিষ্ঠিতা এই নারী  তাঁর হৃদয়কে অত্যন্ত গভীর ভাবে স্পর্শ করেছিল।

   ১২৯১ বঙ্গাব্দের ৮ বৈশাখ, ১৮৮৪ খিস্টাব্দের ১৯শে (মতান্তরে২১ শে) এপ্রিল কী এক গভীর অভিমানে স্নেহের দেবর রবি কে ছেড়ে প্রিয়তম স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কে ছেড়ে না ফেরার দেশে  পাড়ি দিলেন রবির অতি প্রিয় এবং শ্রদ্ধার পাত্রী নতুন বৌঠান কাদম্বরীদেবী। এই মৃত্যু কবি আমৃত্যু ভুলতে পারেন নি...


      ''তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।

         যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায়   

                 নব প্রেম জালে।

            যদি থাকি কাছাকাছি,

   দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি--

                   তবু মনে রেখো।" 


     কাদম্বরীদেবীর মৃত্যু রবীন্দ্র জীবন জিজ্ঞাসায় এক অনিবার্য কৌতূহল। রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষ থেকে রবীন্দ্র গবেষকদের মধ্যে এই মৃত্যুর কারণ নিয়ে একাধিক মত বিনিময় করতে দেখা যায়। ঠাকুর বাড়ির তরফ থেকে পারিবারিক সম্মানের কথা চিন্তা করে এই মৃত্যু রহস্যকে অনেকখানি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল চিঠিপত্র থেকে কাদম্বরীদেবীর লেখা সুইসাইড নোট পর্যন্ত। তাই সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয় নি আজও।তবু…. সুনয়না দেবী এবং ইন্দিরা দেবীর মতে আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। কাদম্বরীদেবী ছিলেন মানসিক অবসাদের রুগী। নিঃসন্তান জীবনে এই মানসিক অবসাদ মাথা চাড়া দেওয়ার সুযোগ পেত খুব। স্বর্ণময়ী দেবীর ছোট মেয়ে ঊর্মিলার দেখাশোনার ভার নিজেই নিয়েছিলেন কাদম্বরীদেবী। ঊর্মিলার সঙ্গ তাঁর নিঃসন্তান জীবনে কিছুটা হলেও প্রলেপ লাগাতে শুরু করেছিল। কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস!!! এক বছর যেতে না যেতেই তেতলার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়ে মারা যায় ঊর্মিলা। নিঃসন্তান বলে মহিলা মহলে নানা কটুকথা শুনতে তো হতই…. ঊর্মিলার মৃত্যু এই অবসাদে আরও ইন্ধন যোগালো…. নিজেকে অপরাধী মনে করতে লাগলেন তিনি। তাঁদের নিঃসন্তান পরিবারে রবির উপস্থিতিও অনেকখানি ভরিয়ে রাখতো। রবিও মাতৃ বিয়োগের পর থেকে আঁকড়ে ধরেছিলেন বয়সে কয়েক বছরের বড়ো নতুন বৌঠানকে। রবি পড়াশোনার জন্য দ্বিতীয়বার বিলেত যাওয়া মনস্থির করে রওনা দিলে কাদম্বরীদেবী সেই সময়ে একবার আত্মহননের চেষ্টা করে বিফল হয়েছিলেন…. রবি ফিরে এসেছিলেন….. বিলেত যাওয়া হয়ে ওঠেনি সে যাত্রায়। এছাড়া শোনা যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোব্বার পকেটে পাওয়া গেছিলো তখনকার এক বিখ্যাত অভিনেত্রীর চিঠি। অনেকে মনে করেন স্বামীর এই অবৈধ সম্পর্কই ছিল কাদম্বরীদেবীর মৃত্যুর আসল কারণ। ঠাকুর বাড়িতে প্রায়ই কাপড় বেচতে আসতো বিশু নামে এক কাপড়ওয়ালি। তাকে গোপনে টাকা দিয়ে আফিম আনিয়ে রেখেছিলেন তিনি। পরে ঐ আফিম খেয়েই আত্মহননের নেশায় মেতে ওঠেন। দুদিন ধরে ঠাকুর বাড়িতে দুজন ডাক্তার রেখে চিকিৎসা করানো হয় কাদম্বরীদেবীর। কিন্তু ডাক্তারদের অক্লান্ত পরিশ্রম, পারিবারিক বন্ধন, স্নেহশীল স্বামীর ভালবাসা , স্নেহের রবির আন্তরিক সখ্যতা.…. সবকিছুর মায়া কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত না ফেরার দেশে চলে গেলেন রবির নূতন বৌঠান। 


       "সে  চলে গেল, বলে গেল না-- 

      সে  কোথায় গেল ফিরে এল না।"


     তবে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখায় পাই রবীন্দ্রনাথের মন একজায়গায় ছিল অদ্ভুতভাবে নিরাসক্ত; কবির মতে - "ভুলিবার শক্তি প্রাণশক্তির একটা প্রধান অঙ্গ।" পুরাতন কে বিদায় দিয়ে কবি বারে বারে নূতন কে আহ্বান জানিয়েছেন। বিস্মৃতি ও অনাসক্তি কবিদের মহৎ গুণ; নইলে যে স্মৃতিভারে জর্জরিত হতে হয়…. নূতনের অভ্যুদয় হয় না! 

    

     "হেথা হতে যাও পুরাতন 

          হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে।" 

  

  কবির মতে আমরা আমাদের হারানো প্রিয়জনকে ফিরে পেতে পারি স্মৃতিভারে জর্জরিত হয়ে নয় বরং স্মৃতির আলো কে বিস্মৃতি তে রূপান্তরিত করে। আমাদের প্রিয়জন বেঁচে থাকে আমাদের প্রতিদিনের সৃষ্টিশীলতায়, নিত্য ভালোলাগায়…. ভালোবাসায়।

     

           "স্মরণের গ্রন্থি টুটে

                সে যে যায় ছুটে

            বিশ্বপথে বন্ধনবিহীন।" 

            ……………………… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


No comments:

Post a Comment

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...