রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ৮
হিমালয় যাত্রা
মহাশ্বেতা দাস
" খোকা যে ছিল বাঁধন -বাধা -হারা
যেখানে জাগে নূতন চাঁদ,
ঘুমায় শুকতারা।"
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের চোখে কনিষ্ঠ পুত্রের নক্ষত্রদ্যুতি ধরা পড়েছিল অক্লেশেই। রবীন্দ্রনাথ বহুবার বলেছিলেন উপনিষদ তাঁর আজন্ম সখা। তাঁর সমগ্র জীবন এবং বিপুল সৃষ্টির ধারায় উপনিষদেরই আলোকছটা। ব্রাহ্মোপাসনা এবং উপনিষদের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন কবি বাবার কাছেই। এমনকি জীবনভর কবির অগণিত মৃত্যুশোক সহনের অতুলনীয় শক্তিও পিতা দেবেন্দ্রনাথেরই তেজের অংশ।
শান্তিনিকেতনের সেই দিনগুলিতে খোয়াই থেকে জামার আঁচলে করে পাথর বয়ে এনে যে পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন সেদিনের কিশোরটি - পিতা দেবেন্দ্রনাথ সেখানে চৌকি নিয়ে উপাসনায় বসতেন। পুবদিকের প্রান্তরে তখন সূর্যোদয় হত। খোয়াইয়ের মাটি ক্ষয় হয়ে যেখানে গভীর গর্ত সৃষ্টি হয়েছিল... সেখানে মাটি চুঁইয়ে জল জমা হত। এই জলে ছোট ছোট মাছেদের খেলা, কখনও বা গর্ত ছাপিয়ে ঝিরঝির জলস্রোত কিশোর রবিকে এক অনিন্দ্য আনন্দের জগতে পৌঁছে দিত। একদিন বাবাকে গিয়ে বললেন....
"ভারি সুন্দর জলের ধারা দেখিয়া আসিয়াছি, সেখান হইতে আমাদের স্নানের জল অনিলে বেশ হয়।"
মহর্ষি উৎসাহ সহকারে সেখান থেকে জল আনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
"সে বিচারে আমার কী বা হয়
খোকা বলেই ভালোবাসি
ভালো বলেই নয়।"
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি তন্ময়তার পাশাপাশি যে বৈষয়িক বুদ্ধির পরিচয় আমরা পাই সেই জমিদারি তদারকি শিক্ষার হাতে খড়ি ও গড়ে উঠেছিল পিতা দেবেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে। শান্তিনিকেতনের এই দিনগুলিতে দুই-চার আনা পয়সা দিয়ে ছেলেকে বলতেন হিসাব রাখতে হবে। তাঁর দামি সোনার ঘড়িটা দম দেওয়ার ভার দিয়ে দায়িত্ব বোধের শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। যদিও কিশোর রবির প্রবলবেগে যত্নের দরুণ কিছুদিনের মধ্যেই ঘড়িটা মেরামতের জন্য কলকাতা পাঠাতে হয়েছিল! পয়সা জমা খরচের হিসেব মেলানোর সময় কিছুই মিলত না। কিন্তু সেজন্য কোনদিন তিরস্কার করা বা নিরুৎসাহিত করেন নি। একদিন হিসেব দিতে গিয়ে তো তহবিল বেড়ে গেল! উৎসাহ দিয়ে বললেন --
"তোমাকেই দেখিতেছি আমার ক্যাশিয়ার রাখিতে হইবে, তোমার হাতে আমার টাকা বাড়িয়া উঠে।"
বোলপুরে কয়েকদিন থাকার পরে যথাক্রমে সাহেবগঞ্জ, দানাপুর, এলাহাবাদ, কানপুর প্রভৃতি স্থানে মাঝে মধ্যে কয়েকদিন বিশ্রামের জন্য... এরপর অমৃতসরের উদ্যেশ্যে যাত্রা।
রেলগাড়ি ছুটে চলেছে.... মাঝে মধ্যে নির্দিষ্ট স্টেশনে গাড়ি থামলে যাত্রী ওঠা নামা ইত্যাদি রোজকার চেনা ছবি... এমনই একটি স্টেশনে গাড়ি থামলো। রবির বয়স তখন বারো বছর হয়নি বলে তার জন্য হাফ টিকিট কাটা হয়েছিল। টিকিট পরীক্ষক এসে টিকিট দেখলেন। রবির মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন সন্দেহ হল! কিছুক্ষণ পরে স্টেশন মাস্টার এসে রবিকে দেখিয়ে মহর্ষি কে বললেন - "ইহার জন্য পুরা ভাড়া দিতে হইবে।" আত্মসম্মান সচেতন মহর্ষির কোনখানে বাজলো তা সেদিনের এগারো বছরের কিশোর রবির চোখ এড়িয়ে যেতে পারেনি। তাই জীবনস্মৃতি গ্রন্থে তিনি এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন --
"আমার পিতার দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। তিনি বাক্স হইতে তখনই নোট বাহির করিয়া দিলেন। ভাড়ার টাকা বাদ দিয়া অবশিষ্ট টাকা যখন তাহারা ফিরাইয়া দিতে আসিল তিনি সে টাকা লইয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন, তাহা প্ল্যাটফর্মের পাথরের মেঝের উপর ছড়াইয়া পড়িয়া ঝনঝন করিয়া বাজিয়া উঠিল।"
স্টেশন মাস্টার অপ্রস্তুত এবং সংকুচিত হয়ে চলে গেলেন। আসলে টাকা বাঁচানোর জন্য মিথ্যা কথা বলা... এই সন্দেহের ক্ষুদ্রতায় মহর্ষির মত মানুষের মাথা হেঁট হয়েছিল।
অমৃতসরের শিখ মন্দিরে পিতৃদেবের সাথে গিয়ে শিখ উপাসকদের সাথে সাধন- ভজনে স্বল্প বিস্তর যোগদান... মিছরির খন্ড ও হালুয়ার প্রসাদ - সব মিলিয়ে কিশোরের মনে এক স্বপ্নের দেশ রচিত হয়েছিল... যার স্মৃতি থেকে গিয়েছিল বহুদিন।
অমৃতসরে যেখানে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল.... সন্ধ্যাবেলায় গাছের ছায়ার ভিতর দিয়ে চাঁদের জোৎস্নার আলো বারান্দার উপর এসে পড়ত। মহর্ষি সেই বারান্দায় বসে ব্রহ্মসঙ্গীত শোনাবার জন্য ছেলেকে ডেকে পাঠাতেন। এমনই এক সন্ধ্যায় যখন বাড়ির সামনের বাগান, বারান্দা চাঁদের জোৎস্নার স্রোতে ভেসে যাচ্ছে, মহর্ষি কোলের উপর দুহাত জোড় করে একান্ত ধ্যান মগ্নের মত বসে আছেন.... রবি কিশোর কণ্ঠে বেহাগের সুরে গাইছেন...
" তুমি বিনা কে প্রভু সংকট নিবারে,
কে সহায় ভব অন্ধকারে।"
…………………………
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - অভিষেক নন্দী
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment