Saturday 25 February 2023

আমাদের বাংলা ভাষা // ই-কোরাস ৯৮

 



"এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি -খেউড়ের পৌষমাস"

শ্রীজিৎ জানা


---আজ দিনটা চাঁড়ে চলে গেল। মটকা পুরো গরম। মেজাজ খিঁচে আছে। শালা যত্ত ক্যাচাল আমার কিসমতে। ধান্দার লাইনে অল টাইম চোখ কান খোলা রাখা জরুরী। একটু গা হেলান দিয়েছো কি পুরো পোঙা মেরে হাওয়া। 

-----মাল পটানো বাঁ হাতের খেল। ঝারিটারি মারা আমার পোষায় না। ডাইরেক্ট হিট করি। মাল বেশি ঘ্যাম দেখালে আমিও গেম বাজিয়ে দেব। মালের মালাইকারি রেসিপি এক চুটকিতে ভাইরাল করে দেব। তখন কেস পুরো  কিচাইন।

 ----তুমি আবার বেশি সতীপনার জ্ঞান কপচিও না। খালি রং নিচ্ছো? বাওয়ালি?  চাটু তেতে গেলে একদম ঝেড়ে দেবো। তোমার তো মাঝে মাঝেই চেগে ওঠে। ফুল্লি বাইচুং ভুটিয়া কেস। তুমি কে হে সুধীর ভাই? পোঁদ মারাচ্ছো? এমন পাছায় লাথাবো না হাগুমুতু সব সেঁটে যাবে। বসে বসে পেছনে কাঠি করা জন্মের মত চুলকে যাবে। খুব যে দেখি পুলকি! যতই কেরতানি মারো আমার কিছু করতে পারবে না। ছিঁড়ে বোঝা করবে তুমি।

----ঝাক্কাস রোদ! ঝিংকু মামনিরা দলবেঁধে বেরিয়েছে বেড়ু বেড়ু করতে। বাঙালি ঘরে বসে ল্যাদ খেতে ভালবাসে।  চলো সোন্টাই,  জানু, সুইটি, হানি বেবিদের সঙ্গে কিছুক্ষণ চ্যাট করি। ফ্লাইং কিস, সেক্সি ইমোজি চালাচালি হোক। হেব্বি লাগছে তোকে। হ্যালো গাইস। কুল ডাউন।বিকেলে পার্টি আছে। ফুল মস্তি হবে।

-----তোর আবার কি হলো? এমন ক্ষেপচুরিয়াস মেজাজ কেন? চিল বেবি! কাজের মাসিরা ওরকম কানের কাছে হাজারটা ভ্যানতারা শোনায়। তুমি আবার বেশি গাঁড়পিঁয়াজি মারতে এসোনা।বেশি ধানাইপানাই করলে কেলানি খেয়ে যাবে। উষ্টুমধুষ্টুম ঝেড়ে দেবো।

----মাইথাই দেখেই তো দিন একটা কাবার। কাজকম্মের গাঁড় মেনে গ্যাছে। শ্লা মাদার-ফাকার সোসাইটি! কেউ কিস্যু করেনা কারুর জন্য। সব বানচোতরা স্বার্থপর। একটাই উশুল ছিনিয়ে নিতে হবে। কুত্তাগিরি না করলে চলবে না।

কথাগুলো শুনে সুশীলবাবুর কানে পোঁ বাজাতে থাকে। হাপরের গরম আঁচ বেরোয়। গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে হাজির হারবার্টদা। নবারুণ ভটচায্যির পাড়ার লোক।নম্র ভদ্র ভাষাপ্রেমী সুশীলবাবু তার  মতামত জানতে চাইলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

---ভায়া, এসব  কথার কি ছিরিছাঁদ  বলো দেখি.?  মাথা তো ঠিক রাখা যায় না। বাংলা ভাষার এমন দৈন্যদশা! শুনে মুডটা খারাপ হয়ে গেল।

 হারবার্টদা তো অভ্যাসবশত ধোঁয়াধার ব্যাটিং করে চলল, -----আমাদের আবার মুড! খানকির ছেলেদের জানবি মুডফুড নিয়ে কোন চুদুরবুদুর নেই। আচে শুধু মজা!

 এসব কি বলছে হারবার্ট! সুশীল বাবুর মুখখানা 'হলদে গোলাপ' হবার জোগাড়। অকুস্থলে স্বপ্নময়  চক্কোতি মশাই হাজির হলেন। প্রসঙ্গ একটু অন্য দিকে মোড় নিল। সুশীল বাবুকে তিনি শোনালেন তাুর  দশম শ্রেণীর এক ছাত্রের গুপ্ত রোগের বর্ণনা ---"এখন আমি আমার এক গোপন সমস্যার কথা বলি। রাত্রে প্রায়ই আমার পেনিসের দ্বার দিয়া শরীরের সারমসলা নির্গত হইয়া যায়। কিছুতেই চেক করিতে পারিনা।... আগে হস্তমোচন করিতাম। ওই কু অভ্যাস ছাড়িয়ে দিয়েছি। এখন রাত্রে শুইবার আগে রাবারের গাডার দিয়া প্যানিস আটকাইয়া রাখি।, তা সত্ত্বেও ঐ পদার্থ নির্গত হইয়া যায়"

 সুশীল বাবুর এবার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। লেধুস মাছের মত মুখ করে চক্কোতি মশাইকে শুধালেন,

----এমন করে খুল্লামখুল্লা আপনি বলে যেতে পারলেন? মুখে বাধলো না? লজ্জা শরম নেই?

 হারবার্টদা  তো ছোডনে বালা বান্দা নয়। সুশীল বাবুর উপর খঁচে ওঠে।

----  বেশ করবে বলবে। যে যুগের যেমন ভাষা সেভাবেই বলবে। মান্যগণ্যদের ঘুষ খেতে লজ্জা নেই, জালজোচ্চুরি করতে লজ্জা নেই, খালি দুটো খিস্তি  দিলেই জগত রসাতলে! কি যুক্তি মাইরি! কেন বঙ্কিম বাবু যখন হরিদাসী বোষ্টমীকে গালিগালাজ করেন, তখন আপনার কানে কি কর্ণমল ঠাসা ছিল মহাশয়? 

-" প্রমদা বলিলে, মাগীর বুকের কাছটা যেন যাত্রার সুখীদের মতো। দেখে ঘৃণা করে। ললিতা বলিল, তা দেখিতে যেমন হউক মাগী গায় ভালো।"

 হারবার্টদা থামছে না কিছুতেই।

---'মাগী' শব্দটাতে কি আপনার আপত্তি আছে? তাহলে দু কলি মধুকবি শোনাই-- "কুলটা যে নারী--বেশ্যা গর্ভে তার কি হে জনমিলা আসি/ হৃষীকেশ?" বেশ্যা শব্দের জন্য মধুকবিকে কী একহাত নিতে চাইবেন?

সামান্য ধাতস্থ হয়ে সুশীলবাবু মুখ খুললেন।

-- তাহলে ভাষার শ্লীল অশ্লীল বলে কোন বালাই নেই?

----ভাষার শ্লীল -অশ্লীল বলে কিস্যু নেই। সুনীল গাঙ্গুলী মশাই কবেই তা বলে গেছেন। প্রকাশ ভঙ্গি ওই দোষে দুষ্ট হতে পারে। বন্ধুকে 'বোকাচোদা'  বল্লে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয় শুনি? ধর্ষকের মুখে কী লেখক আস্থা চ্যানেলের অমৃতবাণী বসাবে।

-----কিন্তু ভাষা তো ভাববাহী। পশুত্বের ভাব, মনুষ্যত্বের ভাব, দেবত্বের ভাব, সকল ভাবের পৃথক পৃথক ভাষা থাকাই তো শ্রেয়। প্রকাশভঙ্গির লালিত্য এবং সম্ভ্রম না থাকলে ভাষার সৌন্দর্য কোথায়? ইচ্ছাকৃত উদোম খিস্তিখেউড় আউড়ে সাহিত্য শিল্প জগত সভায় কোন উচ্চাসন লাভ করে? তা কি শাশ্বত কালের মর্যাদা পায়? ব্যক্তির সাময়িক গায়ের ঝাল মেটে কিন্তু মনের আরাম কিংবা প্রশান্তি আদৌ কি মেলে? যৌনতার শেষে গ্রাস করে চরম বিষাদ। রগরগে যৌনগন্ধী  সংলাপ শুধুমাত্র অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ ঘটায়, মানসিক প্রশান্তির হদিস দেয় না।

----আপনাদের মতো জ্যাঠামার্কা লোকেদের জন্যই বাংলা ভাষার এমন দুর্গতি। সময়ের সাথে ভাষাকে খাপ খাইয়ে নিতে দিন। তাছাড়া যে সমাজে প্রতি সেকেন্ডে নারীর শ্লীলতাহানী ঘটছে,সেখানে ভাষার শ্লীল অশ্লীলতা নিয়ে এত হাইপার কেন বাপু!

একদিকে সুশীল বাবু অন্যদিকে হারবার্টদা। বিতর্ক থামানো যাচ্ছে না।

---জীবনকে যখন প্রকাশ করা হবে তখন জীবনের সমস্ত ভাবকে ভাষার অনুসঙ্গে প্রকাশ করাই একমাত্র লক্ষ্য হবে লেখকের। সেক্ষেত্রে শ্লীল- অশ্লীলতার কোন বাছ-বিচার রাখা মানেই জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে প্রতারণা করা। কোন ব্যক্তিকে যখন অপমানিত করতেই চাইছি তখন 'শুয়োরবাচ্চা' না বলে 'বরাহনন্দন' বল্লে কোন বাহাদুরি দেখানো হয় শুনি?

সুশীলবাবু মেনে নিতে পারেন না। তার কাছে বাংলা ভাষা ক্রমশ অশ্লীলতায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। ইচ্ছাকৃত এবং অপ্রয়োজনীয় ভাবে। যৌনগন্ধী,  সন্ত্রাসমূলক,  ঊস্কানি ও শাসানিমূলক  শব্দ প্রয়োগ করা হচ্ছে দৈনন্দিন কথাবার্তার মধ্যে। বাংলা ভাষা তার লালিত্য হারাচ্ছে ক্রমশ। সমাজের একাংশের মুখে ভাষা ক্রমশ দূষিত হচ্ছে। রাজনীতি নেতাদের ঔদ্ধত্য ভাষাকে সংক্রমিত করছে প্রতিনিয়ত। তাদের নিজস্ব আসুরিক প্রবৃত্তির ছাঁচে ভাষাকে বসিয়ে সমাজের উপর প্রভুত্ব কায়েম করতে চাইছে।  ভাষা হয়ে উঠছে নেতাদের ক্ষমতা প্রকাশের বাহন। অহংকারের ও পেশী প্রদর্শনের হাতিয়ার। সেক্ষেত্রে বর্তমান বহুল প্রচলিত 'খেলা হবে' শব্দবন্ধ নিছক আনন্দ বিনোদন ভরা ক্রীড়ামূলক অর্থকে তুলে ধরছে না।  উচ্চারণেরর স্বরক্ষেপে এবং প্রয়োগের বিচারে বিশেষত বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে 'খেলা' শব্দটি যেন বিভীষিকাময় রূপ নিয়ে প্রতিভাত হচ্ছে সমাজে। তখন খেলা অর্থ  জীবন নিয়ে খেলা, রক্ত নিয়ে খেলা, ধ্বংসের খেলা, লুটতরাজের খেলার  দ্যোতক হয়ে উঠছে। ঢাকের বাদ্দি 'চড়ামচড়াম'  উৎসবমুখর পরিবেশের কথা বলে না। পরিবর্তে হুকুম না মানায় শাসকের উত্তম মাধ্যমের শাসানকে স্মরণ করিয়ে দেয়। একইভাবে 'নকুলদানা', 'গুড়বাতাসা', 'শিককাবাব' প্রভৃতি বহু ব্যবহৃত শব্দগুলো বর্তমানে সমাজের এক ধরনের শাশনের কোড ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। 

ঝাড়গ্রাম - পুরুল্যা-বাুঁকুড়ার জঙ্গলমহল এলাকা থেকে লোকগান রূপে যে গান আমাদানি করা হচ্ছে আসলে তা কোনভাবেই  উক্ত অঞ্চলের শিকড়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়।থ সিনেমা, সিরিয়ালে বিশেষত ওয়েব সিরিজের ডায়লগে  প্রতিনিয়ত এমন ধরনের শব্দ ঢুকিয়ে দেওয়া  হচ্ছে যা কোনোভাবেই  শ্রুতিসুখকর নয়।  অশ্রাব্য বললেও অত্যুক্তি হবে না। শব্দ অথবা ভাষা যা কানের ভেতর দিয়ে মর্মে আঘাত হানে আর প্রাণকে আকুল করে তোলে। বাংলা ভাষার ভেতর থেকে সেই প্রাণ আকুল করা সুরতরঙ্গ, ব্যঞ্জনা, পদলালিত্য   ক্রমশ অপসৃয়মান।

আবরণ ভাষার অর্থসৌন্দর্যকে, অর্থগৌরবকে সর্বক্ষেত্রে ঢেকে দেয় না। অনেক ক্ষেত্রেই আড়াল ভাষার নান্দনিক গুণকে দ্বিগুণ করে দেয়। ভাষার প্রসাদগুণ বৃদ্ধি করে। শ্রুতি মধুর করে তোলে। ভাষার ভিতর দিয়ে ভাবের অতলে পৌঁছে দুদন্ড শান্তি খোঁজে পাঠক। সাময়িক গা গরম করতে চাওয়া এবং করাতে চাওয়া এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা। বাংলা ভাষা সেই অসুস্থতায় আক্রান্ত হচ্ছে। তবে বাংলা ভাষার ব্যাধি প্রতিরোধ ক্ষমতা তার জন্মলগ্ন থেকেই বিদ্যমান।  সেই আশা সেই দৃঢ়তা থেকেই বাংলা ভাষার দীর্ঘ সুস্থতা কামনা করা যেতেই পারে।

হারবার্টদা অদৃশ্য হয়ে যায়। সুশীল বাবু সোজা হয়ে দাঁড়ান। চোখে মুখে তার প্রত্যয়ের চিহ্ন স্পষ্ট। ভাষা ভাবের আধার। শব্দ ব্রহ্ম। যে ভাব,যে শব্দ সমাজের জন্য,প্রজন্মের জন্য হিতকারী নয় তার আয়ু স্বল্প। মধুক্ষরা বাংলা ভাষা তার অতুল সৌন্দর্য নিয়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল। দু'চারটে কটু শব্দ তার বিশাল শব্দভাণ্ডারে জোর করে ঢুকবে ঠিকই কিন্তু কালের বিচারে তারা যেমন সম্মানের  যোগ্য তার বেশি কখনোই পাবে না। সুশীল বাবুর মুখে উচ্চারিত হয় কবিতার পঙক্তি --" হে আমার আঁখিতারা তুমি উন্মীলিত সর্বক্ষণ জাগরণে/ তোমাকে উপড়ে নিলে বলো আর কী থাকে আমার?/......বর্ণমালা আমার দুখিনী বর্ণমালা।"


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - অভিষেক নন্দী

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614

No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...