ভাষার জন্য দেশ
তাহমিনা শিল্পী
ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা সাধারণত ১৯৫২ সালের ৮ ফাল্গুন বা ২১ ফেব্রুয়ারিকেই বুঝি। এই সময়ে ভাষার জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল তার ইতিহাস সকলেরই জানা। কিন্তু এই ভাষা আন্দোলন থেকেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের মোহনায়। এটি অনেকেরই জানা বা বোঝার বাইরে। তাই আমি আজ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে বিশদভাবে আলোচনায় না রেখে,বরং ভাষা আন্দোলনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কের সূত্রে আলোকপাত করবো।
ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। আমাদের দেশ স্বাধীন হবার নেপথ্যে যার রয়েছে বিশাল ভূমিকা ও প্রভাব। সেইসূত্রে বলা যায়,ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার প্রথম পর্ব।
তৎকালীন পাকিস্তানের মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬% বাংলাভাষী।তাই স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের রাষ্টভাষা হবার কথা ছিল বাংলা। তথাপি অন্যায়ভাবে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষনা করে, পাকিস্তানি শাসকবর্গের চাপিয়ে দেয়া অন্যায়ের প্রতিবাদে যদি ভাষা আন্দোলন না হত,যদি না বাংলা ভাষায় কথা বলার জোড় দাবী উঠতো। তাহলে আপামর জনতার মনে বাংলা ভাষার প্রতি গভীর মমতা তৈরি হত না। তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হত না এবং ভাষা আন্দোলনও মারাত্মক আকার ধারণ করত না।
প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্টভাষা একমাত্র উর্দু হলে,বাঙালা ভাষাভাষীরা যে কত পিছিয়ে যেত,বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালনা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ থেকে বাদ পড়ে যেত,সেই ষড়যন্ত্র বুঝতে ভুল করেনি বাংলার দামাল ছেলেরাও সাধারণ জনগন। তাই ভাষা শহীদদের আত্মবলিদানের বিনিময়ে ভাষার দাবী পূরণ হবার পরও বাঙালি থেমে থাকেনি। বরং ভাষা আন্দোলনের সুত্র ধরেই,স্বায়ত্তশাসনের দাবি ক্রমাগত প্রখরতর হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সুকৌশলে ভাষা আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করে প্রায়ই পার্লামেন্টে সংসদের কার্যপ্রণালী বাংলায় বলতে দাবী জানান।এক সময় ধীরেন দত্ত-ও পার্লামেন্টে এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ছিলেন। এইসবের প্রেক্ষিতে একে একে হয় ৬দফা,১১ দফা ও অসহযোগ আন্দোলন। সবশেষে হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ।
২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে নিজ বাসভবন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষাণ দেন। সেই থেকে আমরা স্বাধীন। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু বললেন বাংলার মাটি থেকে চির তরে পাকিস্তানের শেষ সৈন্যকে খতম করা না পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে। ৯ মাস যুদ্ধ চলল। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে ও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই দিন আমাদের মহান বিজয় দিবস। বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি লাভ করে।
৫২-র ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনের এক অবিস্মরনীয় ঘটনা।এক গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস।যার একপ্রান্তে ভাষা আন্দোলন আর অন্যপ্রান্তে মুক্তিযুদ্ধ।তাই ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বাংলাদেশের মানুষের জীবনে অপরিসীম। একুশের শহীদেরা বুকের রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যেটি সেটি হলো-ভাষা শহীদদের রক্ত এ দেশের উর্বর মাটিতে বপন করেছিল স্বাধীনতার বীজ। যে কারণে বায়ান্ন ও একাত্তর একসূত্রে গাঁথা।
উল্লেখ্য, একুশে ফেব্রুয়ারি এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক দিবসে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। ফলে এখন পৃথিবীজুড়ে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। পৃথিবী জুড়েই বাংলাদেশের পরিচিতি।
অধিকার আদায়ের আন্দোলন বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই হয়েছে।কিন্তু ভাষার জন্য এইরকম আন্দোলন। ভাষার জন্য দলমত নির্বিশেষে জাতিগত চেতনা জাগ্রত হওয়া। নিজের ভাষার জন্য বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি,পরিচিতি এবং সর্বোপরি মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হওয়ার ইতিহাস বিরল। তাই এক কথায় বলা যায়,ভাষার জন্যই আমাদের প্রানপ্রিয় এই বাংলাদেশ।
.............................
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
ছবি - তাহমিনা শিল্পী
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment