Tuesday 28 February 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৯

 



রবীন্দ্র পরম্পরা 

পর্ব - ৯

হিমালয় যাত্রা

মহাশ্বেতা দাস



     " মনেরে আজ কহ যে

     ভালো মন্দ যাহাই আসুক

       সত্যেরে লও সহজে।" 


   সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের জীবন চাকর বাকরদের শাসন- পীড়নে কিভাবে কাটত সে ইতিহাস আমাদের জানা। স্কুল জীবনে সহপাঠীদের নির্যাতন, শিক্ষক মহাশয়ের কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ সব মিলিয়ে স্কুল যাওয়ার অনীহার কথা....  আগের পর্ব গুলিতে আলোচনা করেছি। হিমালয় যাত্রায় পিতার সান্নিধ্য লাভ নিয়েও আগের দুটি পর্বে কিছু কথা লিখেছি। তবে এই পর্বে আলোচনা করব পিতা দেবেন্দ্রনাথ কিভাবে জীবনে সত্য কে গ্রহণ করার শিক্ষা দিয়েছিলেন। 


      পিতা দেবেন্দ্রনাথের চোখে কনিষ্ঠ পুত্রের নক্ষত্রদ্যুতি ধরা পড়েছিল বলেই প্রতিভা সম্পন্ন বালকটিকে তিনি সংসারিক অবজ্ঞা আর চাকর বাকরদের অনাদরের হাত থেকে তুলে এনেছিলেন। ছোট্ট রবির মধ্যে গুটিয়ে থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করে হিমালয় যাত্রায় তাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন.... নিয়ে গিয়েছিলেন প্রকৃতির মাঝে। বিশ্বজোড়া পাঠশালার অকৃপণ দানে শুশ্রূষা করেছিলেন কিশোর মনের। এই সময় তাই পিতার সঙ্গ ও স্নেহ তাঁর আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা উন্মোচনে যেন মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। 


    ছেলেকে পড়াবেন বলে নিজে পছন্দ করে বেশ কিছু বই এনেছিলেন। কিন্তু সেখানেও ফ্রাঙ্কলিনের বইটির প্রতিবাদ না করে থেমে থাকতে পারেন নি। ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হলেই তা মেনে নিতে হবে অথবা বিখ্যাত কেউ লিখলেই তা প্রতিবাদ যোগ্য হবে না .... এই ধরনের সংস্কার থেকে ছেলের মন কে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। 


       বক্রোটায় একটি পাহাড়ের চূড়ায় বাংলোতে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। এখানে ছেলেকে গ্রহ ও নক্ষত্রের রহস্যময় বিশাল জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন। 


     জীবনস্মৃতি গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - " যাহা কর্তব্য তাহা আমরা অন্তরের সহিত করিব, এজন্য তিনি অপেক্ষা করিতেন। সত্য কে এবং শোভন কে আমরা বাহিরের দিক হইতে লইব, ইহাতে তাহার মন তৃপ্তি পাইত না; তিনি জানিতেন সত্য কে ভালোবাসিতে না পারিলে সত্য কে গ্রহণ করাই হয় না।" 


      জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাই ছেলের স্বাতন্ত্র্যে বাধা দিতে চাইতেন না। তাঁর রুচি বা মতের বিরুদ্ধে কোন কাজ করলেও কোনদিন শাসন করে তা নিবারণের চেষ্টা করেন নি। 


      বক্রোটায় এক একদিন দুপুর বেলায় কিশোর রবি একা লাঠি হাতে এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে বেড়াতে যেতেন। মহর্ষি এ বিষয়ে কোনদিন কোন কষ্ট বা বিপদের আশঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন নি। মহর্ষি ছেলের সামনে জীবনের আদর্শ তুলে ধরেছিলেন কিন্তু কখনও শাসনের দন্ড উদ্যত করেন নি। তাই যেমন করে বক্রোটায় পাহাড়ে অথবা শান্তিনিকেতনের মাঠে বাটে একলা ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তেমনি সত্যের পথেও চিরদিন নিজ গম্যস্থান খুঁজে নেওয়ার ও স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। 


       পিতা পুত্রের চিন্তা প্রবাহ যে সব সময় এক পথে হেঁটেছে - এমনটা ও নয়। সেক্ষেত্রেও পিতা দেবেন্দ্রনাথ ছেলেকে নিজস্ব মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। শব্দার্থ নিয়ে ছেলে তর্ক করতে ছাড়তেন না। কলকাতার বাড়ি থেকে চিঠি এলে মহর্ষি ছেলে কে পড়তে দিতেন.... এভাবে যেমন চিঠি লেখার কৌশল রপ্ত করতে শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠিক তেমনই মেজদাদার চিঠির কয়েকটি বাক্য নিয়ে তর্ক শুরু হলে মহর্ষি ছেলে কে একবারের জন্যও ধমক দিয়ে নিরস্ত করেন নি বরং ধৈর্য্যের সঙ্গে সমস্ত প্রতিবাদ সহ্য করে ছেলেকে বিষয় টি বুঝিয়ে দিয়েছেন। মহর্ষি ছেলের সাথে কৌতুকের গল্প ও করতেন যা ছোট রবিকে আনন্দ দান করতো। এই ভাবে প্রথম থেকেই বালকের চিন্তাশক্তির গোড়ায় জল ঢেলেছেন তিনি। পরবর্তী ক্ষেত্রে তাই " বিশ্ব পরিচয়" গ্রন্থে আমরা দেখি মহর্ষি কে তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে স্মরণ করেছিলেন। 


      এইসব স্বাধীনতার পাশাপাশি শৃঙ্খলার দিকটিতে ও অতন্দ্র প্রহরীর মতো মনোযোগ দিতে ছাড়েন নি পিতা দেবেন্দ্রনাথ। রাতের অন্ধকার দূর হতে না হতেই ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে সংস্কৃত পড়ানো, তারপর তাকে পাশে নিয়ে উপনিষদের মন্ত্র পাঠ করা, ছেলেকে সঙ্গে করে পাহাড়ি পথে প্রাতঃভ্রমণ এবং বেড়িয়ে ফিরে ইংরেজি পড়ানো। এখানেই শেষ নয় - বেলা দশটা নাগাদ বরফ ঠান্ডা জলে স্নানের হাত থেকেও রেহাই ছিলো না। 

    

     এভাবে পিতার সান্নিধ্যে বেশ কয়েক মাস কাটানো.... যা পরবর্তী জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তারপর একদিন মহর্ষি তাঁর অনুচর কিশোরী চাটুজ্যের সাথে ছেলেকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন। 

                   ……………… 



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - অভিষেক নন্দী

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614


No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...