Sunday 30 October 2022

মহাশ্বেতা দাস এর গল্প // ই-কোরাস ৮০

 



অরিত্র' র দীপাবলি

মহাশ্বেতা দাস 

      

দিদি এই নে পাঁচ রকমের শাক এনেছি.... কলমী, শুস্নি, উলেখাড়া, সজনে আর নটে শাক। ওবেলা লাউমাচা থেকে লাউ শাক কেটে নেব আর ওপাড়ার টুনি দিদি আলুশাক দেবে বলেছে, তাহলে আর কত রকম বাকি রইল? কুঁড়ে ঘরের দাওয়ায় বসে মহিম পড়া মুখস্থ করছে, শিউলি উঠোনে পিটুলি গোলার আলপনা দিতে দিতে ছোট ভাই মহিমের ভুল শুধরে দিচ্ছে, এমন সময় বড়ভাই যতীন কথাগুলো বলতে বলতে উঠোনে এসে দাঁড়ালো। এমন সময় মা বেরিয়ে আসে; আমি দুপুর বেলা বাকি গুলো জোগাড় করে নেবো। বেলা হলো মুড়ি খাবি নে?


দীপাবলির সময় চোদ্দশাক খাওয়ায় কথা মহিম দিদির মুখে বহুবার শুনেছে। তবু এই কথা গুলো শুনতে শুনতে তার মন চলে গেল ভাদ্রমাসের তাল নবমী তিথির দিনে। তাল নবমী তিথিতে সরকার বাড়িতে বড়ো ধুম। গ্রামের অনেকেরই নিমন্ত্রণ থাকে। নানারকম উপাদেয় খাবারে ভরে যায় পাত। অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা মহিমের বড়ো সাধ জাগে এমন নেমন্তন খাওয়ার।


বিমলেন্দু সরকার ছিলেন বিরাট ব্যবসায়ী। বছর তিনেক হল তিনি ইহ জগতের মায়া ত্যাগ করেছেন। তাঁর সুযোগ্য দুই ছেলে শ্যামলেন্দু ও অমলেন্দু সরকার। শ্যামলেন্দু অধ্যাপনা করেন, ব্যবসায়িক দিকে তেমন আগ্রহ নেই। তাঁর স্ত্রী বিমলা সরল মানুষ, সংসারের জটিলতা তাঁকে বদলাতে পারে নি। মেয়ে রিমাও মায়ের মতোই নরম মনের আর মিশুকে প্রকৃতির। অন্যদিকে অমলেন্দু পুরোপুরি বৈষয়িক প্রকৃতির মানুষ, পিতৃদেবের ব্যবসার বেশিরভাগটাই দেখাশোনা করেন তিনি। স্ত্রী রমিতা। পূজা অর্চনা নিয়ে মেতে থাকতে ভালোবাসেন। বাকি রইল অমলেন্দুর দশ বছরের ছেলে অরিত্র। যেন খাপ খোলা তলোয়ার। বুদ্ধিতে, ব্যবহারে গ্রামের ছোট বড়ো সবারই প্রিয় পাত্র। অরিত্র লক্ষ্মী পূজা উপলক্ষে কয়েকদিন আগে গেছে একমাত্র পিসিমা প্রতিমা' র বাড়ি। দীপাবলি তে পিসিমা কে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার কথা তার। কালী পূজা উপলক্ষে চারিদিকে সাজো সাজো রব, বিশেষ করে সরকার বাড়িতে। চন্দননগর থেকে কারিগর এসেছে এতবড় বাড়ির ছাদ, দালান, সামনের বাগান, রাস্তা সাজিয়ে তুলতে হবে আলোর চমকপ্রদ রোশনাইতে। সরকার গিন্নির প্রতিষ্ঠা করা কালী পূজা। খুব জাঁকজমকে পালন হয়।


গ্রামে সরকার বাড়ি থেকে পশ্চিমে কয়েকটা বাড়ি পরেই গোপাল দত্তর কুঁড়ে ঘর। দিনমজুর গোপাল দত্তর স্ত্রী রূপালী, দুই ছেলে; যতীন ও মহিম এবং মেয়ে শিউলি কে নিয়ে অভাবের সংসার। গোপাল দত্তর মত গ্রামে আরও অনেক পরিবারই আছে যাদের ভালোমন্দ দূরে থাক দু'বেলা পেট ভরে সকলের খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়। হাতে হাতে মায়ের কাজ এগিয়ে দেওয়া, দুই ভাইকে সামলানোর মত গুরু দায়িত্ব পালন করতে করতে চোদ্দ বছরেই শিউলির মধ্যে একটা অভিজ্ঞতার ছাপ পড়েছে। তাই খিদে পেলেও কাউকে টের পেতে দেয় না! কিছুটা দিদিকে দেখে আর কিছুটা অভাবের তাড়নায় যতীনের মুখেও একটা বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব। খালি মহিমটাই এখনও অতটা বুঝদার হয়নি, খিদে পেলে তাই দিদির কাছে বায়না ধরে আর কাউকে নেমন্তন্ন বাড়ি যেতে শুনলেই তার মনে হয় তাকে কেন নেমতন্ন করা হয় নি! মুখ ভার হয়ে যায়!

 

ভাদ্র মাসে তাল নবমী তিথিতে সরকার বাড়িতে অনেকের নিমন্ত্রণ থাকলেও যতীন আর মহিমের কেন যে নেমন্তন্ন ছিল না সে প্রশ্নের উত্তর আজও তাদের অজানা! তিনদিন ধরে ভোরে উঠে তাল কুড়িয়ে সরকার বাড়িতে জেঠিমার কাছে পৌঁছে দিয়েছিল তারা। নেমন্তন্ন পাওয়ার আশায় দাদাকে সরকার জেঠিমার কাছে একটি পয়সাও নিতে দেয়নি মহিম। যতীন বারণ করেছিল, দেখিস ভাই আমাদের নেমন্তন্ন করবে না। তার চেয়ে পয়সা পেলে দু'জনে ঝালশুটি কিনে খেতাম। তবু বিকেল পর্যন্ত আশায় ছিল মহিম, ছুতো করে কয়েকবার সরকার বাড়ির কাছে ঘুরঘুর ও করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গাছের গুঁড়িতে বসে চোখের সামনে দিয়ে তার সম বয়সী অনেককেই বাপ কাকার হাত ধরে সরকার বাড়ির দিকে যেতে দেখলো।  রিমা দিদি আর অরিত্রও তো নেই....  কী একটা কাজে কলকাতা গেছে... কয়েকদিন পরে গ্রামে ফিরবে।


দীপাবলিতে তাই সরকার বাড়ির নিমন্ত্রণের আশা ছেড়েই দিয়েছে মহিম আর যতীন। সবসময় আগলে রাখা শিউলির চোখ দুই ভাইয়ের ব্যথা এড়াতে পারে নি। তাই দীপাবলির কয়েকদিন আগে থেকেই নিজে হাতে মাটির প্রদীপ তৈরী করে মুড়ি ভাজার উনুনে পুড়িয়ে ছেঁড়া কাপড় দিয়ে সলতে পাকিয়ে রেখেছে সে। হাট থেকে নকুল দানাও এনে রেখেছে তাদের মতো করে দীপাবলি উৎসব করবে, দুই ভাইয়ের হাসি মুখ দেখবে এই আশায়।


সকালবেলা সরকার বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। গাড়ী থেকে নেমেই অরিত্র এক দৌড়ে চলে গেল বাগানের পাশে দেবদারু গাছটার কাছে। দেখা পেয়ে গেল মহিমের - কী রে মহিম! আজ বিকেলে মাঠে খেলতে আসবি তো? অনেকদিন খেলা হয় নি! না রে.... আজ অনেক কাজ। দিদির সাথে হাটে যাব। মহিম উত্তর দিল। পিসি প্রতিমা ততক্ষণে অন্দরে প্রবেশ করেছে। অরু টা এমন জিদ ধরলো যে না এসে পারলাম না! ভালোই করেছ দিদি। এতদিন পরে এসেছো যখন একদম ভাইফোঁটা দিয়ে তবে বাড়ি ফিরবে। বিমলা আর রমিতার সাথে এভাবেই আলাপচারিতা এগিয়ে চললো।


বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এল। চারিদিকে শাঁখ বাজিয়ে তুলসী তলায় সাঁঝবাতি দেওয়া শুরু হয়ে গেল। বিজলি বাতির আলোর জোয়ারে ভাসতে লাগলো সরকার বাড়ি, কুন্ডু বাড়ি আর চক্রবর্ত্তীদের উঠোন। গ্রামে অন্যান্য বাড়ি গুলিও যে যার মতো মোমবাতি আর মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে আহ্বান জানাল দীপাবলিকে। শুধু প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতো পড়ে রইলো গোপাল দত্তর মত কয়েকটি কুঁড়ে ঘর। শিউলি মাটির প্রদীপ তৈরী করে কাপড়ের সলতে পাকিয়ে ছিল ঠিকই কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রদীপের আলোয় দুই ভাইয়ের হাসি মুখ দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি, কারণ প্রদীপ প্রজ্বলনের পর্যাপ্ত তেল জোগাড় করতে পারেনি সে!

 

সরকার বাড়িটা আজ আলোয় আলোয় ভরে উঠেছে শুধু মুখ ভার করে চিলে কোঠার ছাদের এক কোণে চুপ করে বসে আছে অরিত্র। মহিম কেন যে তার সাথে খেলতে চাইল না! সেই থেকে মনটা ভালো নেই তার। 

ভাই কোথায় গেলি! পিসিমার দেওয়া নতুন জামাটা পরবি না? বলতে বলতে রিমা উঠে এল। পিছন থেকে অরিত্র' র মা ছুটে এলেন, দেখ না মা রিমা! এক্ষুনি ঠাকুর মশাই এসে পড়বেন অথচ সিদে সাজাতে গিয়ে দেখি ঝুড়িতে শাক রয়েছে এগারো রকমের! কী হবে!

আমি দেখছি কাকিমা, রিমা বলতে না বলতেই অরিত্র বলে উঠলো; দিদি একবার শিউলি দিদিদের বাড়ি গিয়ে দেখলে হয় না! প্রস্তাবটা মনে ধরল রমিতার। তাই না হয় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে শিউলিদের বাড়ি যা রিমা। সব শুনে শিউলি আর মা রূপালী ঝুড়ি ভর্তি করে দিল সারাদিন ধরে জোগাড় করা অনেক রকম শাক। অরিত্র এগিয়ে এল... যতীন দাদা মহিম তোমরা শিউলি দিদিকে সাথে নিয়ে আজ আমাদের বাড়িতে চলো। আজ তোমাদের সবার নিমন্ত্রণ, পুজোর পরে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হয়েছে। আমরা সবাই মিলে একসাথে খাবো আজ। রিমা শিউলির হাত ধরে… তোর হাতে গড়া মাটির প্রদীপ গুলো নিয়ে আয়। আমি বোতলে করে তেল এনেছি এখন সবাই মিলে সেগুলো দিয়ে এই বাড়ির তুলসী তলা সাজাবো... বড়ো অন্ধকার হয়ে আছে। 


কিছুক্ষণের মধ্যেই গোপাল দত্তর কুঁড়ে ঘর প্রদীপের আলোয় স্বপ্নের মতো মনে হল। আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো মহিমের মায়ের চোখ দিয়ে। অরিত্র আজ ভীষণ খুশী। দীপাবলির আলো আজ শুধু বাইরে নয় আলোকিত করেছে ওদের মনের অন্দর। পাঁচজনে একসাথে পা বাড়ালো সরকার বাড়ির দিকে। দূর থেকে গান ভেসে এলো.... 

    " আরো আলো আরো আলো

         এই নয়নে প্রভু ঢালো, 

          সুরে সুরে বাঁশি পুরে 

তুমি আরো আরো আরো দাও তান।" 

…………………….....


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - কোরাস

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614




No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...